গাইবান্ধা পৌরসভার উপসহকারী প্রকৌশলী (সিভিল) শফিউল ইসলামের ‘টাকা’ চাওয়ার একটি অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এক ঠিকাদারের কাছে একটি প্রকল্পের কাজের জন্য তিনি ৬ পার্সেন্ট টাকা দাবি করেন। 

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া অডিওটি ১০ মিনিট ১৬ সেকেন্ডের। ওই অডিওতে প্রকৌশলীকে একটি প্রকল্পের রাস্তা কার্পেটিংয়ের কাজের জন্য টাকা চাইতে শোনা যায়। কাজের বরাদ্দ অনুসারে প্রকৌশলী ছয় শতাংশ টাকা দাবি করেন।

টাকা কম দিতে চাইলে ওই ব্যক্তিকে প্রকৌশলী বলেন, একটি টাকাও কম দেওয়া যাবে না। টাকা কম দিলে বিল পার করা যাবে না। 

আরো পড়ুন:

৮ পর্যটককে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগ, নারীসহ গ্রেপ্তার ৪

ঝিনাইদহে সাড়ে ৪ বছর বয়সী শিশুকে ‘ধর্ষণ’, থানায় মামলা 

অডিওতে ঘুষ লেনদেন সংক্রান্ত বিভিন্ন কথা বলতে শোনা যায়। অডিওটি গোপনে ধারণ করেন ফিরোজ কবির নামে ভুক্তভোগী। 

এদিকে, গত ১৫ জানুয়ারি ওই প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাকে অডিওসহ অভিযোগ দেন ফিরোজ কবির। অভিযোগের অনুলিপি গাইবান্ধা জেলা প্রশাসককেও দেন তিনি। এরই প্রেক্ষিতে গত ৫ ফেব্রুয়ারি সরেজমিনে তদন্ত করেন গাইবান্ধার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আল মামুন। যদিও তদন্তের একমাসেও প্রতিবেদন জমা দেননি তিনি। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আল মামুন বলেন, “বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকায় তদন্ত কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। শিগগিরি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। তদন্তাধীন বিষয়ে এখনি কিছু বলা যাবে না।” 

উপদেষ্টা বরাবর দেওয়া অভিযোগে বলা হয়েছে, প্রকৌশলী শফিউল ইসলাম প্রায় ১৩ বছর ধরে গাইবান্ধা পৌরসভা কার্যালয়ে চাকরি করছেন। র্দীঘদিন থেকে অনিয়ম করলেও ভয়ে তার বিরুদ্ধে কেউ ব্যবস্থা নিতে পারেননি। ওই প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে ঘুষ বাণিজ্য ছাড়াও দুর্ব্যবহার, অনিয়ম-দুর্নীতির আরো অভিযোগ রয়েছে। প্রকল্পের বরাদ্দ টাকার শতকরা ৬ ভাগ ঘুষ দিয়ে ফাইল ছাড় করতে হয়। 

আবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, যোগদানের পর থেকে তিনি (শফিউল ইসলাম) পৌরসভার নকশা অনুমোদনের দায়িত্ব পালন করেন। বাড়ি নির্মাণে নকশা অনুমোদনের জন্য তিনি চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নিতেন। টাকা না দিলে সেবাগ্রহীতাদের নানাভাবে হয়রানি করতেন। এভাবে অবৈধভাবে টাকা আয় করে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। জেলা ও ঢাকা শহরে জমিসহ বাড়ি কিনেছেন। 

অডিও ফাঁস এবং অভিযোগ কতটুকু সত্য জানতে চাইলে ঠিকাদার ফিরোজ কবির দাবি করেন, “আমি নিজেও ওই প্রকৌশলীকে মোটা অঙের টাকা দিয়ে বিল তুলতে বাধ্য হয়েছি। কেউ প্রতিবাদ করলে, তার কাজে নানাভাবে হয়রানি করতেন। এমনকি একটি সড়কের কাজ দুই থেকে তিনবার করে নিতেন। তার কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।” 

এ বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত প্রকৌশলী শফিউল ইসলামের মোবাইলে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। 

সোমবার (১০ মার্চ) সন্ধ্যায় গাইবান্ধা পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী রেজাউল ইসলাম বলেন, “পৌর প্রশাসক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সাধারণ) হেদায়েতুল ইসলাম অভিযুক্ত প্রকৌশলী শফিউল ইসলামকে শোকজ (কারণ দর্শানোর নোটিশ) করেছেন। এ ব্যাপারে তিন দিনের মধ্যে জবাব চাওয়া হয়েছে।” 

এদিকে, ওই ঘটনার প্রতিবাদে গাইবান্ধা প্ল্যানার্স এন্ড ডিজাইনার্স প্রকৌশলী কল্যাণ সংস্থা মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে। আজ দুপুরে শহরের গানাসাস মার্কেটের সামনে এই কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। এরপর পৌর প্রশাসক ও জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলীপি দেন তারা।

ঢাকা/মাসুম/মাসুদ

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর অভ য গ ল ইসল ম র জন য তদন ত রকল প প রসভ

এছাড়াও পড়ুন:

ধর্ষণ প্রতিরোধে কাঠামোগত যে পরিবর্তন জরুরি

ধর্ষণ নিঃসন্দেহে ব্যক্তিগত অপরাধ। তবে এটি সামাজিক ও কাঠামোগত সমস্যাও বটে, যা সমাজের বিদ্যমান ক্ষমতার ভারসাম্য, লিঙ্গগত বৈষম্য এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রতিফলন। বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পেছনে আইনের শৈথিল্য, বিচারহীনতা, পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও সামাজিক নীরবতার মতো নানা কারণ কাজ করছে। ধর্ষণের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত সচেতনতা ও আইনগত প্রতিকার প্রয়োজন হলেও শুধু এসব পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। কাঠামোগত পরিবর্তন ব্যতীত ধর্ষণ প্রতিরোধ সম্ভব নয়। কারণ এটি শুধু অপরাধীদের বিচার ও শাস্তির বিষয় নয়; বরং সমাজে নারীর অবস্থান, অর্থনৈতিক ক্ষমতা, শিক্ষা ব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির সঙ্গেও গভীরভাবে যুক্ত।

বাংলাদেশে ধর্ষণ-সংক্রান্ত মামলার বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘ ও জটিল। ফলে ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন। কথায় আছে– ‘জাস্টিস ডিলেইড জাস্টিস ডিনাইড’। এ ছাড়াও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপরাধীদের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব থাকার কারণে তারা শাস্তি এড়াতে সক্ষম হয়। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি অপরাধীদের উৎসাহিত করে এবং সমাজে একটি বার্তা পাঠায়– ধর্ষণ করেও পার পাওয়া সম্ভব। তাই ধর্ষণের বিচার প্রক্রিয়া আরও দ্রুত ও কার্যকর করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন; পুলিশ ও বিচার বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং ভুক্তভোগীদের জন্য নিরাপদ আইনি সহায়তা নিশ্চিত করা জরুরি।
নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন ও স্বনির্ভরতা ধর্ষণ প্রতিরোধের একটি কার্যকর উপায় হতে পারে। বাংলাদেশে নারীদের একটি বড় অংশ এখনও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নয়। ফলে তারা পরিবারের ওপর নির্ভরশীল এবং অনেক সময় নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হয়েও তা প্রকাশ করতে পারে না। কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি, সমান মজুরি এবং কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করলে নারীরা অধিক আত্মনির্ভরশীল হবেন এবং লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শক্তি পাবেন। 

গণমাধ্যম ও বিনোদন জগতে নারীদের উপস্থাপনা ধর্ষণের সংস্কৃতির বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অনেক ক্ষেত্রে চলচ্চিত্র, নাটক ও বিজ্ঞাপনে নারীদের ‘বস্তু’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, যা নারীর জন্য মর্যাদাহানিকর। যেহেতু মানুষের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় গণমাধ্যম বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তাই সব ধরনের গণমাধ্যমে নারীদের ইতিবাচক ও মর্যাদাসম্পন্নভাবে উপস্থাপন এবং ধর্ষণের বিরুদ্ধে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো ধর্ষণ প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে।
প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা ও ডিজিটাল অপরাধ প্রতিরোধের বিষয়ও ধর্ষণের কাঠামোগত সমাধানে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। বাংলাদেশে নারীরা অনলাইন হয়রানির শিকার হচ্ছেন, যা অনেক সময় সাইবার ব্ল্যাকমেইল ও ধর্ষণের মতো অপরাধের সূত্রপাত করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীদের ব্যক্তিগত তথ্য ও ছবি অনৈতিকভাবে ব্যবহার করে ব্ল্যাকমেইল করা হচ্ছে, যা তাদের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে। এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে সাইবার আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর কার্যকর মনিটরিং নিশ্চিত করা প্রয়োজন। 

সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকাও ধর্ষণ প্রতিরোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে মসজিদ, মন্দির ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সমাজে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বিনির্মাণে বিশাল প্রভাব ফেলে। যদি এসব প্রতিষ্ঠান নারীর মর্যাদা, লিঙ্গ সমতা ও ধর্ষণবিরোধী বার্তা প্রচার করতে সক্রিয় ভূমিকা নেয়, তবে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে কিছু বিতর্কিত ধর্মীয় নেতা নারীদের পোশাক বা আচরণ নিয়ে কট্টর মনোভাব পোষণ করেন, যা ধর্ষণের জন্য নারীকেই দায়ী করার প্রবণতা তৈরি করে। এই মনোভাব পরিবর্তন করতে হলে ধর্মীয় নেতাদের সচেতন করা ও ইতিবাচক বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া জরুরি।

ধর্ষণ প্রতিরোধে কমিউনিটি পর্যায়ের উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ধর্ষণের ঘটনা অনেক সময় ধামাচাপা দেওয়া হয় বা সালিশের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয়, যা অপরাধীদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। কমিউনিটি ওয়াচ গ্রুপ, নারীদের স্ব-সহায়ক দল ও স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এতে নারীরা সাহসী হয়ে অপরাধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারবেন এবং সমাজেও ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। পুরুষদের সচেতনতা ও সম্পৃক্ততা ছাড়া ধর্ষণ প্রতিরোধ সম্ভব নয়। পুরুষদের মধ্যে যদি ছোটবেলা থেকেই নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার শিক্ষা দেওয়া এবং তাদের বোঝানো হয়– নারীর সম্মতি ছাড়া কোনো সম্পর্ক গ্রহণযোগ্য নয়, তাহলে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে। ‘মাচো সংস্কৃতি’ বা পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যবাদকে চ্যালেঞ্জ এবং পুরুষদের এ বিষয়ে শিক্ষিত করা ধর্ষণ প্রতিরোধের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হতে পারে।
ধর্ষণ প্রতিরোধে কাঠামোগত পরিবর্তন সময়সাপেক্ষ, তবে এটি ছাড়া কোনো দীর্ঘমেয়াদি সমাধান সম্ভব নয়। বাংলাদেশে ধর্ষণ প্রতিরোধে শুধু আইনি ব্যবস্থা বা শাস্তির বিধান যথেষ্ট নয়। বরং সামাজিক মানসিকতা, শিক্ষা ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক নীতি, গণমাধ্যমের ভূমিকা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার সমন্বিত পরিবর্তন প্রয়োজন। নারীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সমাজ গড়ে তুলতে হলে শুধু ধর্ষকদের শাস্তি দিলেই হবে না, বরং ধর্ষণের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার পথগুলোও চিরতরে বন্ধ করতে হবে। এটাই ধর্ষণ প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর ও স্থায়ী উপায়।

মো. ইমরান আহম্মেদ, পিপিএম: অতিরিক্ত পুলিশ সুপার,
বাংলাদেশ পুলিশ, বর্তমানে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি
অব ওয়ারউইকে পিএইচডি গবেষক 
emranahmmed1991@gmail.com

সম্পর্কিত নিবন্ধ