খাদ্য নিরাপত্তায় সর্বজনীন রেশনের বিকল্প নেই
Published: 10th, March 2025 GMT
ছাত্রজীবনে আমাদের এক বন্ধুর একটি ছড়ার সঙ্গে পরিচিত ছিলাম। ‘উর্বরা ক্ষেত খাদ্য নাই– খাদ্য দিয়ে পেট ভরাবে, শাসকদের সাধ্য নাই’। এ প্রেক্ষিতে ফিরে দেখার সুযোগ আছে যে দেশে খাদ্য সংকট কোথায়? এটি কি খাদ্য উৎপাদনে, আমদানিতে, সংরক্ষণে, নাকি বিনিময়ে, বণ্টনে? এই লেখায় প্রথমত আমরা সেটিই খুঁজে দেখার চেষ্টা করব। খাদ্য সংকট কত গভীর ও খাদ্য নিরাপত্তা কত দরকার, তা বোঝা যায় যখন মধ্যবিত্তরা পর্যন্ত টিসিবির ট্রাক সেলের লাইনে দাঁড়িয়ে চাল-ডাল জোগাড়ের চেষ্টা করে। কিন্তু কর্মজীবী মানুষ কাজ করবে, নাকি টিসিবির ট্রাকের অপেক্ষায় লাইনে দাঁড়িয়ে রোজকার মজুরি থেকে বঞ্চিত হবে? এ প্রশ্ন থাকায় অনেকে ট্রাকের পেছনে লাইনে আসতে পারে না। যদি সবাই আসতে পারত, তবে চিত্র ভয়াবহ হতো।
খাদ্যনীতি হলো খাদ্যশস্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, গুদামজাতকরণ, পরিবহন, বিতরণ ও বিপণনের কাজে সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপ। এর উদ্দেশ্য হলো, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, কৃষকদের অধিক খাদ্য ফলনে উৎসাহ দেওয়া, ফসল তোলার সময় কৃষকদের কাছ থেকে ভর্তুকি মূল্যে বা উৎসাহজনক দামে খাদ্যশস্য কেনা। দেশে উৎপাদিত শস্যের সুষ্ঠু সরবরাহ এবং বিতরণ ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ। নিম্ন আয়ের ব্যক্তির কাছে খাদ্যপ্রাপ্তি সহজ করা। শস্যের উৎপাদন খরচ এবং জনগণের ক্রয়ক্ষমতার সঙ্গে সংগতি রেখে খাদ্যমূল্য স্থির রাখা। উৎপাদিত কিংবা অন্য কোনো উৎস থেকে সংগৃহীত খাদ্যের যথাযথ সংরক্ষণ। দুর্যোগকালীন অবস্থা মোকাবিলার জন্য ‘খাদ্য মজুত’ ব্যবস্থা অথবা দুঃসময়ে ব্যবহৃত শস্যভান্ডার গড়ে তোলা। খাদ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ। খাদ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিকে শক্তিশালী করে ক্রমান্বয়ে খাদ্যে ভর্তুকি কমিয়ে আনা ইত্যাদি।
খাদ্য নীতিমালার বাস্তবায়নে নিম্ন আয়ের ব্যক্তির কাছে খাদ্য পৌঁছাতেই রেশন কার্ড প্রয়োজন। সর্বজনীন রেশন ব্যবস্থা চালু করলে গরিব ও মধ্যবিত্তদের খাদ্যের প্রাপ্তি নিশ্চিত হবে। আমরা যদি আমাদের খাদ্যপ্রাপ্তির নিশ্চয়তার ইতিহাসের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব ’৪৭ থেকে ’৯৩ পর্যন্ত উপমহাদেশের প্রথম যে রেশনিং ব্যবস্থা চালু হয়েছিল ‘বিধিবদ্ধ রেশনিং’ নামে, তার পটভূমি ছিল ’৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ। এরপর গ্রাম এলাকায় চালু হয়েছিল ‘সংশোধিত রেশনিং’। আবার ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষে আমরা আরও ব্যাপক মৃত্যুযজ্ঞ থেকে রেহাই পেয়েছিলাম ‘বিধিবদ্ধ রেশনিং’ ছাড়াও কাজের বিনিময়ে খাদ্য– কাবিখা, ভালনারেবল গ্রুপ ডেভেলপমেন্ট ভিজিডি একযোগে চালু ছিল বলে। ’৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে আরও অনেক বেশি লোক মারা যেত যদি তাদের রেশন কার্ড না থাকত। বর্তমানেও সরকার জরুরি ভিত্তিতে সর্বজনীন রেশন কর্মসূচি চালু করতে পারলে আসন্ন খাদ্য সংকট থেকে মানুষকে বাঁচানো সম্ভব হবে।
এই দেশ স্বাধীন করার যুদ্ধ করেছিল যে গরিব মানুষ, তারা সামাজিক নিরাপত্তা বিশেষত খাদ্যনিরাপত্তা কেন পাবে না? একের পর এক ১৪ প্রকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু ও বন্ধ করা হয়েছে এ দেশে শুধু দুর্নীতির কথা বলে। প্রথমত, এটি দুর্ভাগ্যের যে একটি স্বাধীন দেশে বিশ্বব্যাংক এবং ইউএস এইডের ‘দুর্নীতির জন্য রেশনিং বন্ধের’ ভুল পরামর্শ কেন বাস্তবায়িত করতে হবে? দ্বিতীয়ত, দুর্নীতি দমন করা তো সরকারেরই দায়িত্ব। মাথাব্যথা হলে নিরাময়ের ব্যবস্থা নিন, মাথা কেটে ফেলবেন কেন? কিন্তু সরকার মাথা কেটেই রেশন বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। দুর্নীতি বন্ধ না করে রেশন বন্ধ করে দিয়েছিল। হঠাৎ এমন সিদ্ধান্তের পর খাদ্যগুদামের শস্য রিলিজ করে গুদাম খালি করার প্রশ্ন এসেছিল, কৃষকদের থেকে বোরো মৌসুমের ক্রয়কৃত ধান রাখার জায়গার জন্য। এই গুদাম খালি করার প্রয়োজন থেকে নানা খাদ্যভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালুর প্রশ্ন এসেছিল! তাই সব মিলিয়ে ১৪ প্রকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু ও বন্ধ করা হলো বটে, কিন্তু নাগরিকরা শেষ বিচারে সামাজিক নিরাপত্তা পেল না। এতগুলো উদ্যোগের পরও আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে না। অথচ পাশের দেশ ভারত তাদের রেশন বন্ধ না করে আধার কার্ডে যুক্ত করে ‘দুয়ারে রেশন’ ইত্যাদি স্লোগানে কিছু সুফল সৃষ্টি তথা সামাজিক নিরাপত্তা কিছুটা করতে পেরেছে। কারণ তারা মাথাব্যথায় মাথা না কেটে উল্টো রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার দাঁড় করাতে আইনগত বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করেছে। আইনি অধিকারে রূপান্তর করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে তারা পুরো প্রক্রিয়া ডিজিটাইজেশন করেছে।
আমাদের চিত্রে বোঝা যায় কৃষকের উৎপাদনে সমস্যা নয়, সরকারের বণ্টন নীতিতেই সমস্যা। তাই আমরা মনে করি, দরিদ্রের খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষকের মূল্য সহায়তা এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ– তিনটিই সম্ভব সর্বজনীন রেশন চালুর মাধ্যমে। তাই দ্রব্যমূল্যের যে সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে, তাও মোকাবিলা করা সম্ভব এই সর্বজনীন রেশন প্রক্রিয়াতেই।
জহিরুল ইসলাম: সভাপতি, বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব যবস থ আম দ র উৎপ দ সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
৮৮২ কোটি টাকার সড়ক মৃত্যুফাঁদ
বছর চারেক আগে ৮৮২ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০৬ কিলোমিটার দিনাজপুর-গোবিন্দগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়ক নির্মাণ করে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ। দুই বছর না যেতেই বিভিন্ন স্থানে উঁচু-নিচু ঢেউ, গর্ত ও খানাখন্দ তৈরি হয়। দিনাজপুর জেলা সদর থেকে ফুলবাড়ী, বিরামপুর ও ঘোড়াঘাট হয়ে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ মহাসড়কের প্রায় ৬৬ কিলোমিটারে এই দশা। এতে ঝুঁকি নিয়ে চলছে গাড়ি। প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা।
সরেজমিন দেখা গেছে, ফুলবাড়ী ঢাকা মোড় থেকে দক্ষিণে আম্রবাটি মাদ্রাসা মোড়, লক্ষ্মীপুর বাজার থেকে জয়নগর বাজার, চণ্ডিপুর বাজার থেকে দুর্গাপুর ঢিবি, বিরামপুর পৌর শহরের ঢাকা মোড়, মির্জাপুরের ব্র্যাক চিলিং সেন্টার থেকে ঘোড়াঘাট রেলঘুমটি পর্যন্ত কোথাও কোথাও সড়ক উঁচু-নিচু হয়ে আছে। পিচঢালাই উঠে খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে অনেক জায়গায়।
মহাসড়কটিতে নিয়মিত যাতায়াতকারী ব্যাংক কর্মকর্তা শামিম হোসেন ও ট্রাকচালক হৃদয় খান বলেন, সড়কের অনেক স্থান দেবে আলপথের মতো হয়ে গেছে। এ কারণে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হয়। নিচু স্থানে চাকা পড়লে নালা থেকে যানবাহন সাইড দেওয়া-নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে।
একই অবস্থা ফুলবাড়ী ঢাকা মোড় থেকে পশ্চিম দিকে রাঙামাটি হয়ে বারাইহাটের কিছু অংশ এবং আমবাড়ী যাওয়ার আগে দিনাজপুর পর্যন্ত। মহাসড়কের এসব স্থান দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স, পণ্যবাহী পরিবহন, ইজিবাইক, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহনের চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। সন্ধ্যার পর মহাসড়কের এসব এলাকা দিয়ে চলাচল আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, যত্রতত্র উঁচু হয়ে থাকায় এসব অংশ দিয়ে চলাচল করতে গিয়ে মোটরসাইকেল উল্টে দুর্ঘটনা ঘটে।
কোতোয়ালিসহ ফুলবাড়ী, বিরামপুর ও ঘোড়াঘাট থানার সূত্রে জানা গেছে, গত এক বছরে এই মহাসড়কে ১১৮টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ৬৭ জন নিহত হয়েছেন। তার মধ্যে ঘটনাস্থলে মারা গেছেন ৪৫ জন। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত শুধু ফুলবাড়ীতে ২২টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ১৪ জন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছে শতাধিক। এ ছাড়া গত জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছয়টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে পাঁচজন নিহত হয়েছে।
দিনাজপুর সড়ক ও জনপথ কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে গোবিন্দগঞ্জ থেকে দিনাজপুর ১০৬ কিলোমিটার ৪২ ফুট প্রশস্তকরণে ৮৮২ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। রাস্তাটি ৯টি গুচ্ছের মাধ্যমে আট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ২০১৮ সালের ১ জুলাই থেকে নির্মাণকাজ শুরু করে সংস্কারসহ প্রশস্তকরণ কাজ ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে শেষ করে। প্রশস্ত ও সংস্কারের কাজ শেষ করার দুই বছরের মাথায় আবারও রাস্তাটি দেবে গিয়ে খানাখন্দ তৈরি হয়েছে।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বলেছে, সড়ক নির্মাণের কাজ শেষ হওয়ার পরবর্তী তিন বছর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের জন্য ওই সড়কের সংস্কার করে দেওয়ার চুক্তি থাকে। এর মধ্যে মহাসড়কে যেখানে সমস্যা হয়েছিল, তারা সেসব জায়গা সংস্কার করেছেন। এখন চুক্তির সময় ২০২৪ সাল পার হয়েছে। তাই তাদের আর কাজ করার সুযোগ নেই।
তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ বিদুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি ফুলবাড়ী শাখার আহ্বায়ক সৈয়দ সাইফুল ইসলাম জুয়েল বলেন, ২০১৭-১৮ সালে সেই সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রী ও চেয়ারম্যানরা ঠিকাদারের কাছে কমিশন বাণিজ্য করেছেন। সড়কের শতকরা ৬০ ভাগ টাকা লুটপাট করে তাদের পকেট ভরেছেন। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজশ করে নিম্নমানের উপকরণ দ্বারা সংস্কার ও প্রশস্তকরণ করে বরাদ্দের অধিকাংশ
টাকা লুটপাট করায় এখন রাস্তাটি চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
এ বিষয়ে দিনাজপুর সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান বলেন, অনেক সময় ওভারলোড গাড়ি চলাচলের কারণে যেসব জায়গা উঁচু-নিচু হয়েছে, তা আমরা কেটে ফেলব। সড়কে ৮টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পৃথকভাবে কাজ করেছে। অনেকেরই চুক্তি শেষে হয়েছে এবং কিছু জায়গায় চুক্তির সময় আছে। সরেজমিন দেখে ঠিকাদারের মাধ্যমে সেই জায়গাগুলো সংস্কার করা হবে।