ইফতার অনুষ্ঠানে দাওয়াত করা হয়েছে ৬০০ জনকে। তাঁদের খাওয়ানো হবে আলুর ঘাঁটি দিয়ে সাদা ভাত। অবশ্য সাড়ে চার মণ আলুর সঙ্গে মেশানো হবে ৫২ কেজি মাছ। তাই সকাল ছয়টা থেকে শুরু হয়েছে আলু সেদ্ধ করা ও মাছ কাটার ব্যস্ততা। গ্রামের ১১০ বছর বয়সী খন্দকার সাইফুদ্দিন বসে দেখছেন সেদ্ধ আলু ভাঙার কাজ। তিনিই বললেন, ‘ইফতার অনুষ্ঠানে আলুঘাঁটি আর সাদা ভাত দেওয়া আমাদের চৌদ্দ পুরুষের চল। মাংস–বিরিয়ানি দিলেও মানুষ এতটা খুশি হয় না।’
রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার বাড়ীগ্রামে ৬ মার্চ হয়ে গেল এমন ঐতিহ্যের একটি ইফতার অনুষ্ঠান।
গ্রামের শরিফুল ইসলাম এই অনুষ্ঠানের আয়োজক। তিনি একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন। প্রতিবছরই ইফতার অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এতে নিজের আত্মীয়স্বজন ও এলাকাবাসীকে দাওয়াত করেন। জানা গেল, ইফতারিতে খেজুর, শরবত, সালাদ দেওয়া হবে কিন্তু আলুঘাঁটি আর সাদা ভাত না দিলে এগুলো কিছুই না। শরিফুল বললেন, ‘৬০০ মানুষকে দাওয়াত করা হয়েছে, দেখবেন তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ চলে আসবে। আলুঘাঁটির ইফতারের কথা শুনলেই এলাকার মানুষ চলে আসেন। সেই আন্দাজে বেশি করে রান্না করা হয়।’
ইফতার শেষে তাঁর কথার সত্যতা মিলল। ছোট-বড় মিলে এসেছিলেন ১ হাজার ১০০ রোজাদার।
কথা বলে জানা গেল, বাগমারা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে আলুর ঘাঁটি দিয়ে সাদা ভাতের ইফতারের ঐতিহ্য শত বছরের পুরোনো। মূলত এলাকার অবস্থাপন্ন ব্যক্তিরাই এর আয়োজন করে থাকেন।
শরিফুলের বাড়ির রেওয়াজ অনুযায়ী, প্রতিবছর ভোরে পুকুরে মাছ ধরা হয়। এবার পুকুরে বড় মাছ না থাকায় রাজশাহী শহর থেকে ৫২ কেজি মাছ কিনে আনেন শরিফুল। ইফতার সফল করতে ভোর থেকে প্রায় ৭০ জন মানুষ কাজে লেগে পড়েন। বাবুর্চি থেকে শুরু করে তাঁদের কেউই এ জন্য পারিশ্রমিক নেন না। মনের আনন্দে তাঁরা ইফতারের এই আয়োজনকে উৎসবে পরিণত করেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কামরুজ্জামানের পৈতৃক বাড়ি সেখানে। বললেন, এই অঞ্চলের মানুষের পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য আলু আর মাছের ঘাঁটি দিয়ে ইফতার করা। এলাকার অবস্থাসম্পন্ন মানুষ রোজার মধ্যে ইফতার অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। আলু-মাছের ঘাঁটি দিয়ে ভাত দেওয়া হয়। সঙ্গে একটু তেঁতুলের টক থাকে। তাই দিয়েই তাঁরা তৃপ্তি করে খান। তিনি একবার খাসির মাংস দিয়ে বিরিয়ানি করে বিপাকে পড়েছিলেন বলে জানালেন।
রাজশাহী শহরের ৪০ কিলোমিটার উত্তরে নিভৃত একটি পল্লির নাম বাড়ীগ্রাম। সকালে শরিফুল ইসলামের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, মেয়েরা বাড়ির ভেতরে মাছ কাটাকুটি করছেন। আর একদল যুবক সাড়ে চার মণ আলু সেদ্ধ করে খোসা ছাড়াচ্ছিলেন। সকালে একটি চুলায় সাড়ে ৯ কেজি তেঁতুলের টক রান্না শুরু হয়েছে। বাবুর্চি আবদুল বারী মণ্ডল বললেন, ‘আলুঘাঁটির সঙ্গে এই টক নিলে রোজাদারদের মুখে রুচি আসে।’
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আলু প্রস্তুতের কাজ শেষ হলো। চারটি চুলায় তুলে দেওয়া হলো আলু ও মাছ। চুলায় জ্বালানি ঠেলার আলাদা লোক, চারটি চুলার দায়িত্বে চারজন। তাঁরা অনবরত খুন্তি দিয়ে নাড়তে থাকেন। বেলা একটার সময় লবণ ঠিক হয়েছে কি না, তা চাখার দায়িত্ব পালন করলেন একজন।
বেলা ১টা ৫ মিনিটে বাবুর্চি আবদুল বারী মন্ডল ঘোষণা দিলেন মোজাম্মেলের হাঁড়ি নামবে। সঙ্গে সঙ্গে দড়ি–লাঠি নিয়ে ছুটলেন দুজন। হাঁড়ির গলায় দড়ি পেঁচিয়ে তার ভেতরে লাঠি ভরে চুলা থেকে নামালেন। বেলা ১টা ১০ মিনিটে ইমরানের হাঁড়ি নামল। এর পরপরই নামল আনোয়ার ও মিনারের হাঁড়ি। এরপর চুলায় চাপানো হলো ভাত। একইভাবে চলল রান্না।
এদিকে কামরুজ্জামানের আমবাগানে সকালেই পানি ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে ধুলা না ওড়ে। বিকেলে তাতে চট বিছিয়ে দেওয়া হলো। ইফতারের কিছু আগে দলে দলে রোজাদারেরা আসতে লাগলেন। দেখার মতো বিষয় ছিল, একেকজনের পাতে যতটা ভাত, ততটা আলুর ঘাঁটি।
খাওয়া চলছে, এরই মধ্যে চারদিক থেকে ‘খাটা, খাটা, খাটা’ বলে একটা রব উঠল। তখন দেখা গেল, একদল লোক তেঁতুলের টক নিয়ে দৌড়াচ্ছেন। বোঝা গেল, তেঁতুলের টকই সেখানে ‘খাটা’ নামে পরিচিত।
ইফতারের আগে দোয়া পরিচালনা করলেন মাওলানা আবদুস সোবহান। পরে খেতে খেতে বললেন, ‘বাগমারার ঐতিহ্যবাহী এই আলুঘাঁটি-সাদা ভাত আলহামদুলিল্লাহ আমরা তৃপ্তিসহকারে খেলাম।’
বাংলাদেশ ডিপ্লোমা মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের রাজশাহী জেলা শাখার সভাপতি হালিমুজ্জামানের পৈতৃক নিবাস ওই গ্রামে। তিনিও ছিলেন ইফতার অনুষ্ঠানে। খেতে খেতে বললেন, ‘আমি অনেক মানুষকে আমাদের এই অনুষ্ঠানে নিয়ে এসেছি। যে একবার বাগমারার এই আলুঘাঁটি খেয়েছে, সে বলে কবে আবার হবে এই অনুষ্ঠান।’ তিনি বললেন, ‘আমাদের বাপ-দাদার এই ঐতিহ্য বংশপরম্পরায় ধরে রাখতে চাই। ১৫ মার্চ এই গ্রামে আমি আলুঘাঁটি-সাদা ভাত দিয়ে ইফতারির আয়োজন করব। দেড় হাজার মানুষকে দাওয়াত করেছি।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ত ল র টক ইফত র র ব গম র বলল ন
এছাড়াও পড়ুন:
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের ঘরের চাবি তুলে দিলেন প্রধান উপদেষ্টা
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বিশেষ আবাসন প্রকল্পে নির্মিত ঘরের চাবি তুলে দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
বুধবার (৩০ এপ্রিল) সকাল সাড়ে ১০টায় প্রধান উপদেষ্টা তেজগাঁওয়ের কার্যালয় থেকে ভার্চুয়াল মাধ্যমে অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
এ সময় চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লা জেলা থেকে উপকারভোগীদের হাতে চাবি হস্তান্তর করা হয়।
প্রতিটি জেলা থেকে একজন করে উপকারভোগী তাদের অনুভূতি প্রকাশ করেন। তারা প্রধান উপদেষ্টার প্রতি ধন্যবাদ জানান।
উজানের তীব্র ঢল আর অতি ভারি বৃষ্টির কারণে গত বছরের ২০ অগাস্ট থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। পরে দ্রুতই তা ছড়িয়ে যায় ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজারে।
ওই সময় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানায়, বন্যায় ১১ জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৫০ লাখ ২৪,২০২ জন। এসব জেলায় মারা যান ৭১ জন। এর মধ্যে ২৮ জনই ছিলেন ফেনীতে।
মৃতদের মধ্যে পুরুষ ছিলেন ৪৫ জন। এছাড়া, ১৯ শিশু এবং ৭ জন নারী মারা যান।
জেলাভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী, ফেনীতে মারা যান সবচেয়ে বেশি ২৮ জন। এরপর কুমিল্লায় ১৯, চট্টগ্রামে ৬, নোয়াখালীতে ১১ জন, কক্সবাজারে ৩ এবং খাগড়াছড়ি, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, লক্ষ্মীপুর এবং ও মৌলভীবাজারে ১ জন করে মারা যান। দুর্গত এলাকায় ৩,৬১২টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়।
৩৬ দিনের গণ-আন্দোলন আর সহিংতায় সরকার পতনের ধাক্কা সামলে দেশকে স্থিতিশীলতার দিকে নিতে মাত্র কজ শুরু করেছিল অন্তর্বর্তী সরকার। ঠিক তখনই এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসে।
দুই সপ্তাহের মাথায় আসা এই দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকার দ্রুতই তৎপরতা দেখিয়েছিলো।
দেশের ১১ জেলায় বন্যা ছড়িয়ে পড়লে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গণত্রাণ সংগ্রহ কর্মসূচি শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, যার কেন্দ্র হয়ে ওঠে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র-টিএসসি।
ঢাকা/হাসান/ইভা