সেকেন্ড রিপাবলিক, একটা বাক্যবিলাস ছাড়া আর কিছু নয়
Published: 10th, March 2025 GMT
ছাত্রদের নেতৃত্বে যে নতুন রাজনৈতিক দলের সূচনা হয়েছে, ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’, এটাকে আমরা স্বাগত জানাই। আমরা আশা করি, একটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে তাদের ভূমিকা থাকবে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুন যে জাতীয় সংসদ গঠিত হবে, সেই সংসদে সবারই প্রত্যাশা অনুযায়ী বর্তমান অগণতান্ত্রিক সংবিধানের গণতান্ত্রিক সংস্কার হবে, সংশোধনী হবে। সেটাতে তারাও ভূমিকা রাখবে, আমরাও রাখব, সে প্রত্যাশা আমাদের আছে।
তবে ছাত্রদের নেতৃত্বে গঠিত নতুন দলটি প্রাথমিক লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে, একটি নতুন রিপাবলিক (প্রজাতন্ত্র), সেকেন্ড রিপাবলিক তারা চায়। সেটা প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদের মাধ্যমে তারা একটি নতুন সংবিধান রচনা করতে চায়। আমরা মনে করি, এ কথাগুলো পরস্পরবিরোধী। কারণ, আমাদের একটি সংবিধান আছে। আমরা নতুন করে একটি রাষ্ট্র হিসেবে এখন আত্মপ্রকাশ করিনি।
১৯৭১ সালে আমরা এ রাষ্ট্র পেয়েছি। যেখানে রাষ্ট্র নতুনভাবে স্বাধীন হয় এবং সংবিধান রচিত থাকে না, সেখানে সংবিধান নতুনভাবে রচনা করার জন্য গণপরিষদের প্রয়োজন হয়। এখানে আমাদের একটি রাষ্ট্র আছে, যা স্বাধীন-সার্বভৌম। এখন সেই রাষ্ট্র পুরোপুরি গণতান্ত্রিক কি না, সেটা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে।
আমাদের এ রাষ্ট্রের প্রথম রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা হয়েছে সংবিধান রচনার মধ্য দিয়ে। সেটা ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের পরে, আমাদের বিজয় অর্জনের পরে যে গণপরিষদ ঘোষণা করা হয়েছিল আগের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে। সেই গণপরিষদের মাধ্যমে একটি সংবিধান গৃহীত হওয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের রিপাবলিক (প্রজাতন্ত্র) রচনা হয়ে যায়।
রিপাবলিকের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা হবে এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আবার নির্বাচনের মাধ্যমে পরিবর্তন হবেন। সেই রাষ্ট্রের হেড অব স্টেট থাকবে। সেটা নমিনেটেড (মনোনীত) হোক বা ইলেকটেড (নির্বাচিত) হেড অব দ্য স্টেট হোক। সে চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য এ রাষ্ট্রের আছে। অর্থাৎ আমরা একটা রিপাবলিকের মধ্যেই আছি।
এই রিপাবলিকের মধ্যে অনেক সময় অনেক রকমের সিস্টেম পরিবর্তন হয়েছে। যেমন একদলীয় শাসনব্যবস্থার মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব এই রিপাবলিকের চরিত্র পরিবর্তন করেছিলেন। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সাহেবের সময় পঞ্চম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য পুনঃস্থাপন করা হয়। তখন বিচার বিভাগের ওপর যে হস্তক্ষেপ বাকশালের মধ্য দিয়ে হয়েছিল, সেটাকে আবার সংশোধিত করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল স্থাপন করা হয় সংবিধানের ৯৬ ধারায়, যেটা এখনো বহাল।
.
কিন্তু প্রতিবারই যদি আমরা এই সংবিধান সংশোধনগুলোয় একটা রিপাবলিকের ক্রমিক নম্বর দিই, সেটা অসুবিধা। কারণ, এতে রিপাবলিকের পরিবর্তন হয় না। রিপাবলিকের যে চরিত্র, যে বৈশিষ্ট্য, তার মধ্যে কিছু সংস্কার, কিছু সংশোধনী আসে। কিন্তু আমরা একটি রাষ্ট্রে আছি এবং সেই রাষ্ট্র স্বাধীন-সার্বভৌম। তাকে পুরোপুরি গণতান্ত্রিক ধারায় নিয়ে আসার জন্য আমরা রিপাবলিকের চলনের মধ্যে, ধরনের মধ্যে, পরিচালনার মধ্যে বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন করি জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী।
জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী এটা করতে গেলে যেমন বিভিন্ন আইন লাগে, সংবিধানেও সে রকম পরিবর্তন আনতে হয়, আনব। কিন্তু সেটার জন্য গণপরিষদের প্রয়োজন নেই; যেহেতু আমরা নতুন রাষ্ট্র নই, একটা প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র। দ্বিতীয় রিপাবলিক বলতে তারা (ছাত্রনেতৃত্ব) যেটা বোঝাচ্ছে, তারা সেটা না বুঝে হয়তো নামকরণ করছে। আমাদের এই রিপাবলিকের পরিচালনার জন্য বিভিন্ন রকমের সাংবিধানিক ও আইনি সংশোধনী যেগুলো প্রয়োজন, সেটা আমরা আনব।
আরেকটি হচ্ছে নতুন সংবিধান, আসলে সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে যে সংবিধান আমরা হাতে পাব সামনে। সেটাও অনেকটা ব্যাপক সংস্কারযুক্ত, সংশোধনীযুক্ত সংবিধান আমরা পাব। যেটাকে আমরা বলব একটা বৃহত্তর কনসাশনেসের (সচেতনতা) মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক সংস্কার হবে আমাদের সংবিধানের। সেটা আমাদের প্রতিশ্রুতি ছিল, আমাদের ৩১ দফায়ও ছিল, বর্তমানে সংস্কার কমিশনগুলোর গঠনের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার সে উদ্যোগ নিয়েছে। আমরাসহ সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলো সেখানে প্রস্তাব দিয়েছি। এ ব্যাপারে এখনো আলাপ-আলোচনা চলছে। সেই সংবিধানকে আমরা নতুন সংবিধান বলতে পারি।
এখন যদি আমরা সংশোধিত সংবিধানকে নতুন সংবিধান নামে অভিহিত করতে চাই, তাতে আমাদের আপত্তি নেই, সেটা বলা যায়। কিন্তু এখন সেই নতুন সংবিধানের জন্য যদি আমরা এটাকে দ্বিতীয় রিপাবলিক হিসেবে ঘোষণা করতে চাই, সেটা একটা বাক্যবিলাস ছাড়া আর কিছু হবে না।
এখনো আমরা যদি আবেগপ্রবণ হয়ে বাক্যবিলাসের মধ্যে থাকি, সেটা জাতির জন্য সুসংবাদ নয়। আমি আশা করব, আমাদের নতুন বন্ধুরা, যাঁরা পরিবর্তনের জন্য রাজনীতিতে এসেছেন—সমাজের পরিবর্তনের জন্য এবং একটি বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের জন্য, একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন্য—তাঁদের আমরা অনুরোধ করব, আমরা যেন সম্মিলিতভাবে ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্যকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে এ জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাই। ঐক্যের মধ্যে যেন কোনোভাবে ফাটল সৃষ্টি হতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখি।
● সালাহ উদ্দিন আহমদ স্থায়ী কমিটির সদস্য, বিএনপি
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গণত ন ত র ক র প বল ক র ন র জন য আম দ র এ
এছাড়াও পড়ুন:
গণপরিষদ নির্বাচন নিয়ে নতুন ধারণা দিলেন এনসিপির নেতা সামান্তা
গণপরিষদ নির্বাচন ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন একসঙ্গে হতে পারে—সম্প্রতি সদ্য আত্মপ্রকাশ করা রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) এমন প্রস্তাব রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা তৈরি করেছে। এই আলোচনার মধ্যে গত শনিবার দুপুরে বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘আমাদের কথা পরিষ্কার, এ বিষয়ে কোনো জাতীয় ঐক্য হয়তো হবে না।’ তবে সালাহ উদ্দিন আহমদের এই কথাকে এ ব্যাপারে দলটির শেষ কথা বলে মনে করছে না এনসিপি।
আরও পড়ুনকথা পরিষ্কার, এখানে কোনো জাতীয় ঐক্য হবে না : সালাহ উদ্দিন০৮ মার্চ ২০২৫নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের বিষয়ে এখনো অটল অবস্থানে আছে এনসিপি। অবশ্য তরুণদের নতুন এই দলটির নেতারা এখন বলছেন, একসঙ্গে গণপরিষদ ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ধারণাটি তাঁরা বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছেন। এনসিপি এখন নতুন একটি চিন্তা সামনে আনতে চাইছে। তারা বলছে, গণপরিষদ নির্বাচনে যাঁরা জিতে আসবেন, সংবিধান প্রণয়নের পর গণপরিষদ আইনসভায় রূপান্তরিত হয়ে যাবে। গণপরিষদের সদস্যরা আইনসভা তথা সংসদের সদস্য হয়ে যাবেন। এমনটা হলে স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদি কোনো ধরনের সমস্যা হবে না।
আরও পড়ুনগণপরিষদ ও সংসদ নির্বাচন একসঙ্গে চায় জাতীয় নাগরিক পার্টি০৪ মার্চ ২০২৫২৮ ফেব্রুয়ারি আত্মপ্রকাশ করে এনসিপি। নেতাদের ৪ মার্চ জাতীয় স্মৃতিসৌধ ও ঢাকার রায়েরবাজারে জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদদের কবর জিয়ারতের মধ্য দিয়ে দলটির আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। সেদিন রায়েরবাজারে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছিলেন, ‘গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রকৃত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণে সহায়তা করবে। গণপরিষদ নির্বাচন ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন একসঙ্গে হতে পারে। এর মাধ্যমেই নতুন কাঠামো ও নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে।’ এরপর ৬ মার্চ রয়টার্সে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে নাহিদ বলেন, গণপরিষদ নির্বাচন ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন একসঙ্গে হতে পারে। তিনি মনে করেন, গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রকৃত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণে সহায়তা করবে।
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সম্প্রতি গণপরিষদ নির্বাচন ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন একসঙ্গে করার কথা বলেছিলেন