বুয়েট ও কুয়েটে ভর্তির সুযোগ পেয়েও অর্থাভাবে ভর্তি ও পড়ালেখা অনিশ্চিত শান্ত বিশ্বাসের
Published: 10th, March 2025 GMT
দরিদ্র পরিবারের সন্তান শান্ত বিশ্বাস। বাবা বাড়িতে শিঙাড়া তৈরি করে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বিক্রি করেন। মা বাড়িতে সুতা কেটে যে টাকা আয় করেন, তা দিয়েই কোনোমতে চলে তাঁদের সংসার। অভাবের সংসারে কষ্ট করে পড়ালেখা করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এবং খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন শান্ত। কিন্তু অর্থাভাবে তাঁর ভর্তি ও পড়ালেখা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
শান্ত বিশ্বাস সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলার গোপালপুর গ্রামের কল্পনা বিশ্বাস ও জয়কৃষ্ণ বিশ্বাস দম্পতির ছেলে। দুই ভাইবোনের মধ্যে শান্ত বড়। ছোট বোন তৃষ্ণা বিশ্বাস স্থানীয় চৌবাড়ী ইসলামিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
ভর্তি পরীক্ষায় বুয়েটের মেধাতালিকায় ৮৩৫তম ও কুয়েটে ২২৭তম স্থান অধিকার করেছেন শান্ত। তাঁর ফলাফলে স্বজনদের পাশাপাশি আশপাশের মহল্লার সবাই খুশি। শান্তর মা কল্পনা বিশ্বাস বলেন, ছোটবেলা থেকে শান্ত পড়াশোনায় অনেক মনোযোগী। তাঁদের অভাবের সংসারে সামান্য আয়ের কারণে ছেলের পড়ালেখায় তেমন সহায়তা করতে পারেননি। ছেলের নিজের পরিশ্রম দিয়ে এই সফলতা এসেছে।
কল্পনা বিশ্বাস বলেন, পিএসসি থেকে সব পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন শান্ত। অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছেন। এক স্বজনের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করে ভর্তি পরীক্ষার জন্য ঢাকার একটি কোচিংয়ে ভর্তি করিয়েছিলেন, কিন্তু টাকার কারণে ক্লাস করা হয়নি। পরে মুঠোফোনে অনলাইনে পড়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা স্বামী-স্ত্রী পড়ালেখা জানি না। বুয়েটে পড়তে ছেলের কেমন খরচ হবে, সেটাও জানি না। ঢাকা শহরে আমাদের কোনো আত্মীয়স্বজনও নেই। সেখানে নাকি অনেক খরচ। আবার ভর্তিতেও খরচ হবে। সেই অর্থের জোগান আমাদের নেই। তাই বাধ্য হয়েই সাহায্যের প্রার্থনা করছি।’
শান্ত বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘কলেজের প্রথম বর্ষে ভর্তির পর একটানা ১০ মাস সকালে না খেয়ে একবারে দুপুরে খেয়েছি। কলেজে শহরের বন্ধুদের সঙ্গে পড়ার সময় মনে মনে বলতাম, এই কষ্টগুলোই আমাকে শক্তিশালী করছে। সব কষ্টকে শক্তি বানিয়ে বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা দেব। বুয়েটে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়ার সুযোগ পেয়ে আমার বড় একটি স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আমি একজন কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে আমার মা–বাবার পাশে দাঁড়াতে চাই। আমার প্রতিবেশী ও দেশের মানুষকে সাহায্য করতে চাই।’
শান্তর বাবা জয়কৃষ্ণ বিশ্বাস বলেন, ‘ছেলের এই সফলতায় আনন্দ করব না দুঃখ করব, বুঝে উঠতে পারছি না। জীবনে কখনো কারও কাছে সাহায্যের হাত বাড়াইনি। বুয়েটে পড়ালেখা ও ঢাকায় থাকা-খাওয়ার যে খরচ, তাতে ছেলেকে বুয়েটে পড়ানো আমার মতো দরিদ্র মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। যদি কোনো সহৃদয়বান ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়, তাহলে চিরকৃতজ্ঞ থাকব।’
সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও শান্তর চেষ্টা ও একাগ্রতা এই সফলতা এনে দিয়েছে। একটু সহায়তা পেলে তাঁর মাধ্যমে দেশ ও জাতি সুফল পাবে—এমনটিই তাঁর বিশ্বাস।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: পর ক ষ
এছাড়াও পড়ুন:
নতুন রাজনৈতিক দলের কাছে তরুণদের প্রত্যাশা
২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান নিঃসন্দেহে একটি নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার জন্ম দিয়েছে, যেমনটা হয়েছিল ১৯৭১ ও ১৯৯০-এ। দেশের রাজনৈতিক পরিসরে যত বড় আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে, প্রতিটিই প্রায় অভিন্ন প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। এর সারকথা হচ্ছে, বৃহত্তর রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোতে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসা, যা অনেক ক্ষেত্রেই নিষ্পেষণ ও নিপীড়নমূলক, গোষ্ঠীতন্ত্রকে প্রশ্রয় দেয় এবং দুর্নীতিগ্রস্ত। ২০২৪-এর নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতাও এসব পশ্চাৎপদতা ও পুরোনো ধারণা থেকে সমাজ কাঠামোকে বের করে নিয়ে আসার দাবি জানাচ্ছে।
ছাত্রদের নেতৃত্বে ইতোমধ্যে নতুন রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ প্রত্যাশা করে এই দল এবং গণঅভ্যুত্থানের অগ্রগামী ছাত্রনেতারা তাদের দক্ষতা ও প্রজ্ঞা প্রয়োগের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ গড়ার সুযোগ সবার সামনে উন্মোচন করবে। তাদের সফলতা বৈষম্যমুক্ত এক বাংলাদেশের সূচনা করবে। আবার তাদের ব্যর্থতা ছাত্র ও যুবদের নিজেদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করার পাশাপাশি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকেও এক অনিশ্চিত পথে ধাবিত করতে পারে। ছাত্রদের বর্তমান নেতৃত্ব বলছে, ‘এখনই সময় দেশ গড়ার’, যা বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ আলাপ। এতে অনেক ‘যদি’ ও ‘কিন্তু’ আছে। ছাত্র ও যুবনেতৃত্বে নতুন বাংলাদেশ গড়তে হলে নতুন নেতৃত্বকে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। তাদের অনেক কিছু যেমন ছাড়তে হবে এবং একই সঙ্গে বেশ কিছু নতুন নীতি, দক্ষতা ও প্রজ্ঞার সমন্বয় ঘটাতে হবে।
গত সাত মাসে দেশে বেশ কিছু ইতিবাচক পরিবর্তনের ধারা শুরু হলেও প্রত্যাশিত রাজনৈতিক পরিবর্তন অনেকাংশেই সম্ভব হয়নি। আরও কিছু বিষয়ে জনগণের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে অনেকেই বলেন, শুধু পাত্রপাত্রীর পরিবর্তন হয়েছে। সাবেক রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় যারা নিপীড়কের ভূমিকায় ছিল, তারা ও তাদের সমর্থক গোষ্ঠীর অনেকেই নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। অনেকেই নতুন এক কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থা উদ্ভব হয়েছে বলে মনে করছেন। এই কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ভিন্নমত ও ভিন্ন সংস্কৃতির চর্চা অবদমিত হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কেউ কেউ বলছেন, এই সময় নারী ও সংখ্যালঘুদের প্রতি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বৈষম্য দৃশ্যমান হয়েছে। বলা হচ্ছে, মব সৃষ্টির মাধ্যমে রাজনৈতিক কর্তৃত্ববাদ তৈরির চেষ্টা চলছে।
এই প্রেক্ষাপটে যুব ও ছাত্রদের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক শক্তিকে আইনের শাসন, মানবাধিকার, ন্যায্যতা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের মতো বিষয়গুলোর ওপর যে কোনো আঘাত প্রতিরোধ করতে হবে। একই সঙ্গে এসব বিষয়ে নতুন সংলাপ ও বয়ান তৈরিতে তাদের উদ্যোগ নিতে হবে। এই ছাত্রদের সরকার ও বর্তমান ক্ষমতা কাঠামো থেকে প্রচ্ছন্নভাবে দূরেও থাকতে হবে, যাতে সরকারের ব্যর্থতা তাদের কলুষিত করতে না পারে। নিজেদের গণমানুষের পক্ষের শক্তি হিসেবে অবস্থান দৃঢ় করার জন্য সরকারকে নৈতিক জায়গা থেকে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের মধ্যে রাখতে হবে। তা না হলে না চাইলেও সরকারের ব্যর্থতা ছাত্র ও যুবদের এই রাজনৈতিক শক্তিকে গ্রাস করতে পারে।
ছাত্র-যুবদের রাজনৈতিক শক্তিকে সফল হওয়ার জন্য গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার দরকার আছে। মনে রাখতে হবে, ছাত্র-যুবার এই রাজনৈতিক প্রচেষ্টা যদি সফল না হয়, তার জন্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ভূমিকা যতটা দায়ী হবে, তার থেকে অনেক বেশি দায়ী হবে তাদের নিজেদের কাঙ্ক্ষিত প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে না পারা, অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করা। ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া যে কোনো রাজনৈতিক শক্তির প্রজ্ঞার পরিচয়। এটিও মনে রাখতে হবে দায়িত্ব গ্রহণের পর কারও বয়স ও অনভিজ্ঞতা আর মুখ্য বিবেচ্য বিষয় থাকে না। মানুষ দেখতে চায় তাদের ওপর যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যে বিশ্বাস স্থাপন করা হয়েছে, সেই বিশ্বাসের প্রতিফলন আছে কিনা। প্রতিফলন থাকলে জনতা তাদের মাথায় তুলে রাখবে আর আর না থাকলে ঐতিহাসিক ব্যর্থতার সত্য তাদেরও মেনে নিতে হবে। সেটিই ঐতিহাসিক পরাজয়।
গণআন্দোলনে ছাত্র ও যুবদের ব্যাপক অংশগ্রহণ প্রমাণ করে তাদের বৃহত্তর অংশ নতুন রাজনৈতিক শক্তির সফলতাই চায়। এই সফলতার মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের সুযোগ তৈরি হতে পারে; যে বাংলাদেশ সবার, বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর না। আবার এই রাজনৈতিক শক্তির ব্যর্থতা তাদের মধ্যে নতুন করে হতাশার জন্ম দিতে পারে। তারা বাংলাদেশকে নিয়ে আবারও আশাহত হতে পারে, যা আমাদের কারও কাছে কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়।
নাজমুল আহসান: উন্নয়নকর্মী