ট্রফি হাতে নিয়ে সাংবাদিকদের পেছনে রেখে ব্যাকড্রপের দিকে মুখ করে দাঁড়ালেন রোহিত শর্মা। সংবাদ সম্মেলন কক্ষের সবাই তৎক্ষণাৎ বুঝে গেল কী হতে চলেছে।

চ্যাম্পিয়ন রোহিত সবাইকে নিয়ে সেলফি তুললেন। এরপর ট্রফি হাতে নিজেই পোজ দিলেন ডায়াসে দাঁড়িয়ে, ফোন–ক্যামেরা এবার ভারতীয় দলের মিডিয়া ম্যানেজারের হাতে। পেছনে সংবাদ সম্মেলনে থাকা সাংবাদিকেরা। ওই দিক থেকে ছবি তোলা শেষ হলে পরে সাংবাদিকেরাও পাল্টা সেলফি তুললেন রোহিতকে পেছনে রেখে।

রোহিত শর্মার সংবাদ সম্মেলনে বরাবরই বাড়তি কিছু থাকে, তবে শর্ত হলো ভারতকে জিততে হবে। কাল তো দুবাইয়ে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির চ্যাম্পিয়ন হয়েই তিনি এলেন সংবাদ সম্মেলনে।

প্রায় ২৩ মিনিটের প্রশ্নোত্তর পর্ব যতটা সম্ভব মিঠে হলো। মিঠে মানে কোনো কড়া প্রশ্ন নেই, কোনো বাঁকা উত্তর নেই। কারণ রোহিতের হাতে করে নিয়ে আসা ওই ট্রফিটা। রোহিতের ভাষায় যেটাতে অধিকার গোটা ভারতের। যেটা তিনি উৎসর্গও করেছেন ভারতবাসীকে। এমন রাতে অধিনায়কেরা কলমের ডগায় তলোয়ার নিয়ে ঘোরা সাংবাদিকদেরও অনেক কাছে চলে আসেন। রোহিত তো আসেন বারবারই।

২০২৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল কলম্বোতে। শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে এশিয়া কাপ জিতে রোহিত শর্মা এসেছিলেন সংবাদ সম্মেলনে। বাইরে পটকা–বাজির আওয়াজ থামছেই না। ধুম–ধাম শব্দে সংবাদ সম্মেলনে কথা শুরু করেও ভারত অধিনায়ককে চুপ হয়ে যেতে হয়েছিল। একটু থেমে রোহিত পরে মজা করে বলেছেন, ‘আরে এখন ফোটাচ্ছ কেন, আমরা বিশ্বকাপ জেতার পর আতশবাজি ফোটাও!’

এক মাস পরই ভারতে হয়েছিল ওয়ানডে বিশ্বকাপ। রোহিতের দল অবশ্য সেটা জিততে পারেনি। তবে গত বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এবং কাল দুবাইয়ে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি—পরপর দুটি আইসিসি ইভেন্টের শিরোপা উঠেছে রোহিতেরই হাতে। এমন রাতে তিনি দিলখোলা হয়ে উঠবেন, সেটাই স্বাভাবিক। যেকোনো প্রশ্নেই স্বভাবসুলব ধীরস্থির বাচনভঙ্গিতে বিস্তারিত উত্তর, সঙ্গে কখনো মিশিয়ে দিয়েছেন রসিকতা। মিডিয়া ম্যানেজার ২২–২৩ মিনিটের মাথায় সংবাদ সম্মেলনের ইতি টানলেও রোহিতকে দেখে মনে হচ্ছিল কথা বলায় তাঁর ক্লান্তি ছিল না।

সংবাদ সম্মেলন শেষ করার পরও যেমন তিনি দুই লাইন বাড়তি বলে গেলেন, ভারতকে চ্যাম্পিয়ন করার রাতে যে প্রসঙ্গ টানতে সম্ভবত অস্বস্তি হচ্ছিল সাংবাদিকদেরও। একবার শুধু একজন একটু ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে রোহিতের ভবিষ্যত পরিকল্পনা জানতে চেয়েছিলেন।

রোহিতও সরাসরি প্রসঙ্গে না গিয়ে ঘুরিয়ে পেঁচিয়েই শেষে বলেছেন, ‘কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নেই। যেভাবে চলছে চলবে।’ কিন্তু সংবাদ সম্মেলন শেষে চেয়ার ছেড়ে ওঠার আগে তিনি নিজ থেকেই আবার পাড়লেন প্রসঙ্গটা। মুচকি হেসে বললেন, ‘একটা বিষয় আমি পরিস্কার করতে চাই। আমি কোথাও যাচ্ছি না। এই সংস্করণ থেকে আমি অবসর নিচ্ছি না।’ সবাই হো হো করে হেসে উঠল, হাততালির শব্দও শোনা গেল বোধহয় একটু।

ফাইনালের আগের দিন যে বিষয়টা নিয়ে মহাগুঞ্জনে কেটেছিল, সেটাকে রীতিমতো রসিকতা বানিয়ে সবার কৌতুহল মিটিয়ে চলে গেলেন রোহিত। যাওয়ার আগে ওই ছবি আর সেলফি তোলার পর্ব, তারও আগে মূল সংবাদ সম্মেলন।

ভারতের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পেছনে যেখানে দলীয় প্রচেষ্টার কথাই বারবার বলেছেন রোহিত। দলের এক থেকে এগারো—বাদ দেননি কাউকেই। আর এটা শুধু গতকালের শিরোপা জয়েরই নয়, ভারতের ধারাবাহিক সাফল্যেরই সূত্র। রোহিতের ভাষায়, ‘যখন সবাই মিলে খেলবেন এবং একসঙ্গে দলের অনেকে অবদান রাখবে, আপনি ধারাবাহিকভাবে অনেক সাফল্য পাবেন। এই টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচ থেকে শেষ ম্যাচ পর্যন্ত সেটাই হয়েছে।’

সর্বশেষ তিনটি আইসিসি টুর্নামেন্টে রোহিতের ভারত হেরেছে কেবল ২০২৩ বিশ্বকাপ ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে। নইলে ওই বিশ্বকাপ, পরের বছর টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এবং এবারের চ্যাম্পিয়নস ট্রফি মিলিয়ে ২৪ ম্যাচের ২৩টিতেই জিতেছে ভারত।

রোহিতের কাছে এটা অনেক বড় অর্জন, ‘দুটি আইসিসি টুর্নামেন্ট পরপর জেতাই একটা বড় অর্জন এবং সেগুলো অপরাজিত থেকে জেতাটা তো সোনায় সোহাগা। আমার জানা মতে খুব কম দলই পরপর দুটি বড় টুর্নামেন্ট অপরাজিত থেকে জিতেছে।’ এর জন্য রোহিত ভারতের দর্শকদেরও কৃতিত্ব দিয়েছেন। পাঁচটি ম্যাচই দুবাইয়ে খেলা ভারত প্রবাসী ভারতীয়দের বিপুল সমর্থন পেয়ে রীতিমতো হোম কন্ডিশনের সুবিধাই ভোগ করেছে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে। কথাটা স্বীকার করেছেন রোহিতও।

অধিনায়ক রোহিত ভারতের এই সাফল্যে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিয়েছেন। কালও তাঁর ৭৬ রানের ইনিংসই জয়ের পথ দেখাতে শুরু করে ভারতকে। যদিও রোহিতের কথা, এটা বাড়তি কিছু নয়। আগের ম্যাচগুলোতে যা যা করে আসতে চেয়েছেন বা করেছেন, ফাইনালের ৭৬ রানের ইনিংসও সেরকমই কিছু, ‘পাওয়ার প্লেতে রান করাটা গুরুত্বপূর্ণ আমি জানি। এক–দুটি নয়, পাঁচটি ম্যাচেই দেখেছি ১০ ওভারের পর ফিল্ডিং ছড়িয়ে পড়লে এবং স্পিনাররা এলে রান করা কঠিন হয়ে যায়। কারণ এখানে উইকেট এমনিতেই একটু মন্থর।’

রোহিতের কাছে ৩০–৪০ রানের ইনিংসও অনেক গুরুত্বপূর্ণ যদি তা দলকে জেতাতে সাহায্য করে, ‘২০১৯ বিশ্বকাপেও আমি অনেক অবদান রেখেছিলাম, কিন্তু আমরা বিশ্বকাপ জিতিনি। ওটাতে তাই আনন্দও পাইনি। আপনি যদি ৩০–৪০ রানও করেন আর দল জিতে, তাতেই বরং অনেক বেশি সন্তুষ্টি ও আনন্দ আসে।’

রোহিত নিজেই অবশ্য একবার বলেছেন, আইসিসি বিশ্বকাপ মানে ওয়ানডে বিশ্বকাপ; যেটা এখনো তাঁর জেতা হয়নি। টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ও চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জিতেছেন। তবে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিটা যেহেতু ওয়ানডে টুর্নামেন্টই, তাতে ওয়ানডে বিশ্বকাপ জিততে না পারার অতৃপ্তি কি কিছু কমল তাঁর? সেটা জানতে গিয়েই ভারতের এক সাংবাদিকের প্রশ্ন, ‘আপনি কি বলবেন যে দুটোই সমান, নাকি এখনো বলবেন ওয়ানডে বিশ্বকাপই বড়?’

প্রশ্ন শুনে রোহিত শুরুতে একটু যেন খেই হারালেন। তবে মুহুর্তেই সামলে নিয়ে যেটা বললেন, মনে হতেই পারে আসলে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিও বিশ্বকাপের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তার আগে ওয়ানডে বিশ্বকাপ নিয়ে তাঁর আগের বলা কথার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ভারত অধিনায়ক ফিরে গেলেন ছোট বেলায়, ‘দেখুন সামনে যে আইসিসি ট্রফিই আসবে, সেটা জিততে চেষ্টা করতে হবে। ওয়ানডে বিশ্বকাপ হলো ওয়ানডে বিশ্বকাপ। ছোট বেলা থেকে ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ দেখেই তো বড় হয়েছি। তখন টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ছিল না, আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ বা চ্যাম্পিয়নস ট্রফিও হতো না। সে জন্যই বলছি, এটা আমাদের কাছে ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ জেতার মতো।’

এরপরই পাশে রাখা ট্রফিটা দেখিয়ে আবার রসিকতা, ‘আরে ভাই, এটার মধ্যেও কোনো কমতি নেই…।’ শ্রোতাকূলে আবার হাসি। ওদিকে রোহিত বলে যান, ‘ট্রফি তো ট্রফিই। যে কোনো ফাইনাল জেতাই গৌরবের। শুধু আমি নই, পুরো দল, আমাদের পুরো জাতিই আজ খুশি কারণ, কোনো টুর্নামেন্টের ফাইনাল জেতা অনেক বড় অর্জন।’
সেরকম বড় অর্জনের পর রোহিত যখন চনমনে বড় মন নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন, সেখানে থাকাটাও তাঁর ব্যাটিং দেখার মতোই চরম বিনোদনমূলক এক ব্যাপার।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: বল ছ ন ফ ইন ল আইস স ভ রতক

এছাড়াও পড়ুন:

মাঠে ফিরেই নির্বাচকদের দিকে নাসিরের আঙুল

লাল সবুজের জার্সিতে নাসির হোসেন সবশেষ খেলেছেন ২০১৮ সালে। ক্যারিয়ার জুড়ে নানান বিতর্কের সঙ্গে টি-টেনে অসদচারণের জন্য আইসিসির নিষেধাজ্ঞা ইঙ্গিত দিয়েছিল তাঁর ক্যারিয়ারের ইতির। না, তা হয়নি।

নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ঢাকা লিগ দিয়ে নাসিরের প্রত্যাবর্তন ঘটে। সোমবার (৭ এপ্রিল) হোম অব ক্রিকেটে গাজী গ্রুপ-রূপগঞ্জ টাইগার্স ম্যাচ ছাপিয়ে ম্যাচটি হয়ে যায় নাসিরময়। পারফরম্যান্সে আলো ছাড়াতে পারেননি, তবে ফিরতে পেরেই নাসির ছিলেন উৎফুল্ল।

আরো পড়ুন:

শান্তদের জিম্বাবুয়ে সিরিজের ক্যাম্পে ছাড়তে চায় না ক্লাবগুলো

ওয়াসিম-ইমরান পারলে তাসকিন কেন পারবে না, সুজনের প্রশ্ন

সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে নাসির কেবল নানা প্রশ্নের উত্তর দেননি, সংবাদমাধ্যমের কাজ কেমন হওয়া উচিত সেটিও বলেছেন অবলীলায়। নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে বলতে গিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন মিনহাজুল আবেদীন নান্নুর তৎকালীন নির্বাচক প্যানেলকে।

নাসির বলেন, “আমার মনে হয়, আপনি যখন নির্বাচক প্যানেলে থাকবেন... যদি বাইরের দেশে দেখেন, দুই বছর পরপর নির্বাচক প্যানেল বদলায়। ধরেন আমি নির্বাচক হিসেবে আছি। আমার চোখে কিন্তু সবাইকে সমান ভালো লাগবে না। এটাই স্বাভাবিক।”

“দুই বছর পরপর বদলালে, আমার চোখে যাকে ভালো লাগত না, অন্য কারও চোখে তাকে ভালো লাগতেও পারে। আপনি যদি এখন ৯-১০ বছর ধরে একই জায়গায় থাকেন, যাকে ভালো লাগবে না, তার তো ক্যারিয়ারই শেষ হয়ে গেল প্রায়। আমি মনে করি, আমার ক্ষেত্রে এই জিনিসটা হয়েছে। আমি যদি ৫টা সুযোগ পাই, বাকিদেরও ৫টা সুযোগই পাওয়া উচিত। এমন না হয় যেন, ওরা ২০টা সুযোগ পেল, আমি ৫টা সুযোগ পেলাম। আমার মনে হয়, আমার ক্ষেত্রে এই জিনিসটাই হয়েছে।”- আরো যোগ করেন নাসির। 

নিষিদ্ধ হওয়ার আগে ২০২৩ সালের বিপিএলে দুর্দান্ত খেলেছিলেন নাসির। ঢাকার জার্সিতে ১২ ম্যাচে নাসির ৩৬৬ রান করেছিলেন। ৪৫.৭৫ গড়ে ১২০ স্ট্রাইকরেটে ছন্দময় ব্যাটিং করেছেন পুরো আসর জুড়েই। ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি বোলিংয়েও সমান সাফল্য পেয়েছিলেন। ১২ ম্যাচে ১৬ উইকেট নিয়ে টুর্নামেন্টে দলের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি ছিলেন তিনি।

এরপরেও পরবর্তীতে ইংল্যান্ড সিরিজে জায়গা হয়নি। কয়েক মাস পরেই আসে নিষেধাজ্ঞা। বাংলাদেশের হয়ে ১৯টি টেস্ট, ৬৫টি ওয়ানডে ও ৩১টি টেস্ট খেলেছেন নাসির। এখনো স্বপ্ন দেখেন জাতীয় দলের।

“আমার মনে হয় যারা ক্রিকেট খেলে, জাতীয় দলে খেলার জন্যই খেলে। আমিও স্বপ্ন দেখি। এটা বিশ্বাস করি, এখনও সুযোগ আছে। যদি পারফর্ম করতে পারি অবশ্যই জাতীয় দলে খেলতে পারব। আপনি পারফর্ম করলে সেটার মূল্যায়ন যদি ক্রিকেট বোর্ড করে, তাহলে আপনি পারফর্ম করতে পারবেন।”

এই প্রসঙ্গ আসতেই যেন নির্বাচক-বোর্ডকে এক প্রকার বার্তা দিয়ে রাখেন নাসির, “যদি দেখেন, যেবার আমি বিপিএল ভালো খেললাম, এরপর কিন্তু 'এ' দল বা টাইগার্স বা প্রস্তুতি ম্যাচ- কোথাও আমাকে ডাকেনি। তো আপনি যদি পারফর্ম করার পর এসব জায়গায় না ডাকে, তাহলে জাতীয় দলে কীভাবে খেলবেন? অবশ্যই স্বপ্ন দেখি জাতীয় দলে খেলার। এটা বিশ্বাস করি, পারফর্ম করলে অবশ্যই সুযোগ আসবে।”

নির্বাচকরা কি তাকে পছন্দ করতেন না? নাসিরের স্পষ্ট উত্তর, “হইতে পারে। আমার কাছে তা-ই (পছন্দ হয়নি দেখে সুযোগ পাইনি) মনে হয়।”

ঢাকা/রিয়াদ/নাভিদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পরপর দুবার ভিক্ষা চাওয়ায় ভিক্ষুকের কান কেটে দিলেন যুবক, পরে আটক
  • মাঠে ফিরেই নির্বাচকদের দিকে নাসিরের আঙুল