এটি এখন স্পষ্ট, রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মরিয়া হয়ে প্রতিরোধ লড়াই চালাতে থাকা ইউক্রেনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন বিশ্বাসঘাতকতা করবে। বোঝা যাচ্ছে, ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়ে ট্রাম্প হয় ভুল তথ্যের শিকার, নয়তো তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে আমেরিকান জনগণকে যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল সম্পর্কে বিভ্রান্ত করার চক্রান্তে জড়িত।

ট্রাম্পের মিথ্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে—তিনি দাবি করছেন, এ যুদ্ধের জন্য ইউক্রেনও সমান দায়ী। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির হাতে যুদ্ধ শেষ করার মতো কোনো ‘তাস’ নেই এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য না পেলে ইউক্রেন নিজেকে রক্ষা করতে পারত না।

কিন্তু সারা বিশ্ব জানে, এ যুদ্ধে ইউক্রেনকে সমানভাবে দায়ী করা যায় না। কারণ, রাশিয়া বিনা উসকানিতে ইউক্রেনের ওপর হামলা চালিয়েছে। আমাদের সবার মনে আছে, যুদ্ধের প্রথম কয়েক সপ্তাহে ইউক্রেনের সেনারা যখন ১ হাজার ৮০০ মাইল দীর্ঘ ফ্রন্টলাইনে বীরত্বের সঙ্গে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, তখনো পশ্চিমা দেশগুলোর গোলাবারুদ, সাঁজোয়া যান ও বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা তাদের কাছে পৌঁছায়নি।

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ওভাল অফিসের ঘটনাটি স্পষ্টভাবে দেখিয়েছে, ট্রাম্প ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির প্রতি শত্রুতামূলক মনোভাব পোষণ করেন এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রতি তাঁর গভীর পক্ষপাতিত্ব রয়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো, এর পেছনে কি শুধু এই একটি মাত্র কারণই কাজ করেছে যে ট্রাম্প স্বার্থপর ও উচ্চাভিলাষী একনায়কদের পছন্দ করে থাকেন; নাকি তার আসল কারণ হলো পুতিনের কাছে ট্রাম্পের দুর্বলতার কোনো গোপন তথ্য আছে, যা পুতিন ফাঁস করে দিলে ট্রাম্পের জন্য বিপজ্জনক অবস্থা তৈরি করতে পারে?

যাহোক, ট্রাম্প আইনের শাসনের মূল ধারণাটিকেই প্রত্যাখ্যান করে বসেছেন। কারণ, তিনি আইনের গুরুত্বকে রাজনৈতিক স্বার্থের অধীন করে ফেলেছেন। ট্রাম্পের মতে, আইন যতক্ষণ প্রেসিডেন্টের স্বার্থ রক্ষা করবে, ততক্ষণ আইন মানতে হবে। আর যখন আইন প্রেসিডেন্টের কাজে বাধা সৃষ্টি করবে, তখন তা মানার কোনো দরকার নেই। তাঁর দৃষ্টিতে, বিভিন্ন দেশের মধ্যে যে আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো (এমনকি তাঁর নিজের স্বাক্ষর করা চুক্তিগুলোও) যখন ইচ্ছা তখন ভঙ্গ করা যেতে পারে।

১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে স্বাক্ষরিত বুদাপেস্ট স্মারক অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও রাশিয়া একত্রে ইউক্রেনের ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এর বিনিময়ে ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার ত্যাগ করতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে রাশিয়া যখন ইউক্রেনে হামলা চালিয়ে ক্রিমিয়াকে বেআইনিভাবে দখল করে, তখন তারা এই চুক্তি ভঙ্গ করে। আর এখন সেই চুক্তির দুই পক্ষ—যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য—ইউক্রেনের সঙ্গে যা করছে, তা বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কিছু নয়।

ইউরোপকে বুঝতে হবে, ইউক্রেন শুধু নিজের জন্য নয়, তারা পুরো ইউরোপের নিরাপত্তার জন্য লড়াই করছে। এ অবস্থায় ইউরোপ আইনি জটিলতার আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারে না। এখনই সময় রাশিয়ার সম্পদ ব্যবহার করে ইউক্রেনকে সহায়তা করার।

ট্রাম্পের আমেরিকার প্রতিশ্রুতি না মানা লজ্জাজনক। ইউক্রেন তাদের দায়িত্ব পালন করেছে এবং তারা আশা করেছিল, যুক্তরাষ্ট্রও তাদের পূর্বপ্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ করবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কথা রাখল না, বিশ্বাসঘাতকতা করল। কিন্তু এই বিশ্বাসঘাতকতা শুধু ইউক্রেনের জন্যই বিপদ ডেকে আনছে না, বরং এর গভীর প্রভাব ইউরোপের নিরাপত্তার ওপরও পড়বে।

বহু দশক ধরে ন্যাটোর চুক্তির ৫ নম্বর অনুচ্ছেদের ওপর ইউরোপের নিরাপত্তা নির্ভর করেছে। ওই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ন্যাটোর কোনো সদস্যরাষ্ট্র আক্রান্ত হলে সেটিকে পুরো জোটের ওপর হামলা হিসেবে দেখতে হবে। কিন্তু এখন স্পষ্ট, ট্রাম্প মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র ততক্ষণই ইউরোপকে রক্ষা করবে, যতক্ষণ ইউরোপ ট্রাম্পের ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলে সহায়ক হবে।

আন্তর্জাতিক আইন ও চুক্তির বাধ্যবাধকতার কোনো মূল্য ট্রাম্পের কাছে নেই; ঠিক যেমন পুতিনের কাছেও তার কোনো মূল্য নেই।

ইউরোপের দেশগুলো এখন এই কঠিন বাস্তবতাকে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। এখন তাদের সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তোলা এবং ২০২২ সালে জব্দ করা রাশিয়ার ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ইউরোপের হাতে থাকা ২২০ বিলিয়ন ডলার কীভাবে ব্যবহার করা হবে, তা নির্ধারণ করা।

২০২৪ সালের জুনে জি-৭ দেশগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, এই সম্পদের সুদ থেকে ৫০ বিলিয়ন ডলার ইউক্রেনকে সহায়তা হিসেবে দেওয়া হবে। এরপর ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ইউরোপীয় কমিশন প্রথম দফায় তিন বিলিয়ন ডলার ছাড় করেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যদি ইউক্রেনকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া বন্ধ করে দেয়, তাহলে এই আংশিক ব্যবস্থা আর কাজ করবে না। সে ক্ষেত্রে ইউরোপকে আরও এগিয়ে যেতে হবে এবং তার নিয়ন্ত্রণে থাকা রাশিয়ার সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে।

আমরা এর আগে বলেছিলাম, রাশিয়ার জব্দ করা এই সম্পদ ইউক্রেনের পুনর্গঠনের জন্য ব্যবহার করা উচিত। কারণ, রুশ আগ্রাসনের কারণে যে ক্ষতি হয়েছে, তা ২২০ বিলিয়ন ডলারের অনেক বেশি। কিন্তু এখন এই অর্থ আরও জরুরি হয়ে উঠেছে।

যে দেশ এখনো হামলার শিকার এবং আংশিক দখলের মধ্যে আছে, সেটির পুনর্গঠনে কাজ শুরু করা সম্ভব নয়। ন্যায়বোধ ও সাধারণ যুক্তি বলে, এই সম্পদ ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করা উচিত। ইউরোপ আইনগতভাবে যা করার দরকার তা করতে পারে। তবে মূল বিষয় হলো এই অর্থ ইউক্রেনকে দ্রুত দিতে হবে, যাতে তারা সামরিক সরঞ্জাম কিনতে পারে এবং রাশিয়ার ধ্বংস করা অবকাঠামো মেরামত করতে পারে।

এখানে দায়বদ্ধতা নিয়ে কোনো প্রশ্নই ওঠে না। যখন রাশিয়া নিজেই আইনের শাসন ধ্বংস করছে এবং নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা পশ্চিমা দেশগুলোর সম্পদ বাজেয়াপ্ত করছে, তখন তারা আন্তর্জাতিক আইনের দোহাই দিতে পারে না। এ ছাড়া এই তহবিল ইউক্রেনকে দেওয়া ইউরোপের নিজের স্বার্থের মধ্যেই পড়ে। ইউক্রেন তাদের প্রতিরক্ষা খাতে যে অর্থ ব্যয় করবে, তা ইউরোপের সামরিক সক্ষমতা বাড়াবে এবং ইউরোপের দুর্বল হয়ে পড়া অর্থনীতিকেও চাঙা করবে।

সময় নষ্ট করার সুযোগ নেই। এই অর্থকে ভবিষ্যতের আন্তর্জাতিক দাবিসংক্রান্ত কমিশনের জন্য জামানত হিসেবে রাখার যে প্রস্তাব এসেছে, তা শুধু অহেতুক বিলম্ব ঘটাবে।

ইউরোপকে বুঝতে হবে, স্বৈরাচারী শক্তিগুলো আরও শক্তিশালী হচ্ছে, আর ইউরোপই এখন এর বিরুদ্ধে প্রধান প্রতিরোধক। ইউরোপীয় মূল্যবোধ, নাগরিক স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ভবিষ্যৎ—এসব কিছু এখন তাদের এ সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ সম্প্রতি বলেছেন, ইউরোপের আবার ঝুঁকি নেওয়ার সাহস, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও ক্ষমতার স্বাদের অন্বেষণ করা উচিত।

যদি মাখোঁ এবং অন্য ইউরোপীয় নেতারা ওভাল অফিসের অপমানজনক ঘটনার পর সত্যিই ইউক্রেনকে সমর্থন করতে চান, তাহলে এখনই তাঁদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অর্থাৎ এখনই তাঁদের রাশিয়ার জব্দ করা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে।

ইউরোপকে বুঝতে হবে, ইউক্রেন শুধু নিজের জন্য নয়, তারা পুরো ইউরোপের নিরাপত্তার জন্য লড়াই করছে। এ অবস্থায় ইউরোপ আইনি জটিলতার আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারে না। এখনই সময় রাশিয়ার সম্পদ ব্যবহার করে ইউক্রেনকে সহায়তা করার।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

জোসেফ ই.

স্টিগলিটজ নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ও কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং অ্যান্ড্রু কোসেনকো মারিস্ট কলেজের স্কুল অব ম্যানেজমেন্টের অর্থনীতির সহকারী অধ্যাপক।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইউক র ন র প ব যবহ র কর র জন য প আইন আইন র র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

ফের আইপিএল থেকে সরে গেলেন ব্রুক, হতে পারেন নিষিদ্ধ

২০২৫ আইপিএল শুরুর আগে বড় ধাক্কা খেল দিল্লি ক্যাপিটালস। টুর্নামেন্ট শুরুর মাত্র ১২ দিন আগে হ্যারি ব্রুক সরে দাঁড়িয়েছেন আসর থেকে। দ্বিতীয় মৌসুমে টানা আইপিএল না খেলার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় এবার দু’বছরের নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে পারেন ইংলিশ এই ব্যাটার।

আইপিএলের নিয়ম অনুযায়ী, নিলামে দল পাওয়ার পর কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়া খেলতে অস্বীকৃতি জানালে খেলোয়াড়কে দুই বছরের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হতে পারে। ফলে ব্রুকের এবারের সিদ্ধান্ত নিয়ে ইতোমধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে।

২০২৪ আইপিএলে দিল্লি ক্যাপিটালসের হয়ে খেলার কথা ছিল ব্রুকের। নিলামে তাকে ৬ কোটি ২৫ লাখ রুপিতে দলে নেয় ফ্র্যাঞ্চাইজিটি। এর আগের মৌসুমেও পারিবারিক কারণে আইপিএল থেকে নাম প্রত্যাহার করেছিলেন ব্রুক। এবারের সরে দাঁড়ানোর পেছনে জাতীয় দলের প্রস্তুতির কারণ দেখিয়েছেন ২৬ বছর বয়সী ব্যাটার। সম্প্রতি ইংল্যান্ডের চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ব্যর্থতার পর ওয়ানডে নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন জস বাটলার। ধারণা করা হচ্ছে, নতুন অধিনায়ক হিসেবে ব্রুকের ওপরই ভরসা রাখতে পারে ইংল্যান্ড বোর্ড।

এক্স ও ইনস্টাগ্রামে নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে ব্রুক লিখেছেন, ‘আইপিএল না খেলার সিদ্ধান্ত সহজ ছিল না। আমি দিল্লি ক্যাপিটালস ও ভক্তদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। তবে দেশের হয়ে খেলা আমার অগ্রাধিকার।’

ব্রুক মনে করছেন, জাতীয় দলের ব্যস্ত সূচির জন্য এই সময়টায় বিশ্রাম জরুরি। আইপিএলের পরিচালনা পর্ষদ তার সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করে আগামী দিনগুলোতে নিষেধাজ্ঞা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাতে পারে।

প্রসঙ্গত, ২০২৩ মৌসুমে সানরাইজার্স হায়দরাবাদের হয়ে আইপিএলে অভিষেক হয় ব্রুকের। সেবার ১১ ম্যাচে করেছিলেন ১৯০ রান, যার মধ্যে ছিল একটি সেঞ্চুরি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ