এ বছর ১২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত জার্মান ওয়াচের ‘ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স-২০২৫’ অনুসারে প্রতিবছর দুর্যোগে বাংলাদেশে গড়ে ৬৩ লক্ষাধিক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত এবং ৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় (সমকাল, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫)। সৌভাগ্যবশত ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কিছু অগ্নিকাণ্ড ছাড়া এ বছর উল্লেখযোগ্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়নি। 

অবশ্য এপ্রিল-মে মাসে আসছে কালবৈশাখী ও ঘূর্ণিঝড় মৌসুম। জুন থেকে শুরু হবে বন্যা মৌসুম। আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুসারে ২০২৫ সালও ২০২৪ সালের মতো উষ্ণতম বছর হবে। এ ছাড়া প্রতিবছর বজ্রপাতে অনেক প্রাণহানি ঘটে। নীরব দুর্যোগ নদীভাঙনে প্রতিবছর অনেক মানুষের সম্পদহানি ও বাস্তচ্যুতি কঠিন বাস্তবতা। এমন প্রেক্ষাপটেই আজ পালিত হচ্ছে জাতীয় দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবস। দুর্যোগের ক্ষতিকর প্রভাব ও তা প্রশমনে জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ১৯৯৮ সাল থেকে পালিত দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য- ‘দুর্যোগের পূর্বাভাস প্রস্তুতি, বাঁচায় প্রাণ ক্ষয়ক্ষতি’। 

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে আটটি আন্তর্জাতিক সংস্থার যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত ‘বিশ্ব ঝুঁকি প্রতিবেদন’-এ বলা হয়, দুর্যোগ-ঝুঁকিপ্রবণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান নবম।
২০২৪ সালে বাংলাদেশের ৪৬ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত। দেশজুড়ে শৈত্যপ্রবাহ, তাপদাহ, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ছাড়াও প্রতি মাসে গড়ে দুই হাজার অগ্নিকাণ্ডজনিত দুর্যোগ সংঘটিত হয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা জানিয়েছে, বাংলাদেশে ২০২৪ সালে পাঁচ দফা বন্যায় দুই লাখ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। উপরন্তু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাতের কারণে দুর্যোগের সংখ্যা, ধরন, মৌসুম ও ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপকতা কীভাবে বাড়ছে, আমি নিজেও পেশাগত কাজে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট অঞ্চল ঘুরে জেনেছি।

ওদিকে, ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেও বাংলাদেশ ভূমিকম্পজনিত দুর্যোগের জন্যও বিপদাপন্ন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সংঘটিত ঘন ঘন ছোট ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প এ আশঙ্কাকে ঘনীভূত করছে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশে ৫৪টি ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। ঢাকাসহ সারাদেশে বিল্ডিং কোডসহ নিয়ম না মানায় শক্তিশালী ভূমিকম্পে ভবন ধ্বংস ছাড়াও জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হবে, তা নিশ্চিত। সচেতনতা বৃদ্ধি, ভবন-স্থাপনা নির্মাণে আইন ও নিয়ম প্রতিপালন এবং প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের মাধ্যমেই ভূমিকম্পজনিত দুর্যোগের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব। 
দুর্যোগে শিশুদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব আমাদের বিবেচনায় না থাকলেও ইউনিসেফ এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ২০২৪ সালে জলবায়ু প্রতিঘাতজনিত কারণে বাংলাদেশের ৩ কোটির বেশি শিশুর শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। দুর্যোগের কারণে বিভিন্ন সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত ছাড়াও শিশুর মনোযোগ ও মানসিক সমস্যা হয়। দুর্যোগে অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ৬ লাখ শিশু শিক্ষা থেকে ঝরে পড়েছে।

দুর্যোগ প্রস্তুতিতে বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও সক্ষমতা স্বীকার্য হলেও সরকারের দুর্যোগবিষয়ক স্থায়ী আদেশাবলি বা এসওডি অনুসারে জাতীয় থেকে ইউনিয়ন, ওয়ার্ড পর্যায়ে কাঠামো বা কমিটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে সক্রিয় নয়। তবে সরকার ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ১৯৭২ সাল থেকে যৌথভাবে পরিচালিত ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) উপকূলজুড়ে ৮১ সহস্রাধিক স্বেচ্ছাসেবক ঘূর্ণিঝড়ের সংকেত প্রচারসহ মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় সফল। এ ছাড়া ফায়ার সার্ভিস, রেড ক্রিসেন্ট, স্কাউটসহ অনেক সংস্থারই স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক রয়েছেন, যারা দুর্যোগ মোকাবিলায় অংশগ্রহণ করেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুর্যোগের পূর্বাভাস এবং বিপদাপন্ন মানুষ ও তাদের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি বিশ্লেষণ করে দুর্যোগের আগেই তাদের কাছে সহযোগিতা পৌঁছানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

এত উদ্যোগ ও সফলতা সত্ত্বেও দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছাতে হলে সতর্ক সংকেত ব্যবস্থাকে আরও আধুনিকায়ন ও নির্ভুল এবং বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য সহজবোধ্য ও সহজপ্রাপ্য করতে হবে। জাতিসংঘ বলছে, বিশ্বে এখনও অর্ধেক জনগোষ্ঠীর কাছে দুর্যোগের পূর্ব সংকেত পৌঁছে না। তাই ২০২২ সাল থেকে জাতিসংঘ ‘সবার জন্য পূর্ব সংকেত’ ক্যাম্পেইনের সূচনা করেছে, যা বাস্তবায়নে বাংলাদেশেও সমন্বিতভাবে কাজ করছে। প্রসঙ্গত, আকস্মিক বন্যা পূর্বাভাস প্রদানে সতর্ক সংকেত উদ্ভাবন ও তা প্রচারে কার্যকর পদক্ষেপ দরকার, যাতে ২০২২ সালের হাওর অথবা ২০২৪ সালে ফেনী ফ্ল্যাশ-ফ্লাডের মতো দুর্যোগ ও জনদুর্ভোগের পুনরাবৃত্তি না ঘটে। 

২০২৪ সালের বন্যায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলোর অবস্থা পর্যালোচনা এবং বন্যা মৌসুম শুরুর আগেই মেরামত প্রয়োজন। এ ছাড়া অনেক দেশের অনুকরণে দুর্যোগের ক্ষতি পুনরুদ্ধারে কৃষি বীমার কথা ভাবতে হবে। 
আজকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দুর্যোগবিষয়ক ডিগ্রি বা কোর্স অন্তর্ভুক্ত করা হলেও স্কুল-কলেজের পাঠ্যসূচিতে দুর্যোগ বিষয়ে অধিক বিষয়বস্তুর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন, যা শিক্ষার্থীদের দুর্যোগ-সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়তে ভূমিকা রাখবে।

আমাদের জাতীয় বাজেটে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য বরাদ্দ নগণ্য। বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচিকে অনেক ক্ষেত্রে দুর্যোগ মোকাবিলায় ‘সরকারের অবদান’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বিশ্বের অনেক দেশ দুর্যোগ প্রস্তুতি খাতে বিশেষ বাজেট বরাদ্দ রাখে। জাতিসংঘ বলছে, দুর্যোগের আগে ১ ডলার বিনিয়োগ করলে দুর্যোগের পরে ১০ ডলার সমপরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস সম্ভব। আসন্ন জাতীয় বাজেটে দুর্যোগ-পরবর্তী ত্রাণসহ দুর্যোগ প্রস্তুতিতে সক্ষমতা বাড়াতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব রইল।
পাশাপাশি অনেক দেশের অনুকরণে দুর্যোগ প্রস্তুতিতে সর্বমহল তথা সরকারি-বেসরকারি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে দুর্যোগ কার্যক্রম পরিচালনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আচরণবিধি (কোড অব কন্ডাক্ট) ‘মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যক্তির প্রতি সম্মান’ এবং  ‘দয়া নয়, সাহায্যপ্রাপ্তি ক্ষতিগ্রস্তদের অধিকার’ প্রভৃতি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিধি ও অঙ্গীকার প্রতিপালনে চাই সবার আন্তরিকতা।

এম.

এ. হালিম: সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি; দুর্যোগ, জলবায়ু ও মানবিক-বিষয়ক বিশ্লেষক
halim_64@hotmail.com

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ২০২৪ স ল ভ ম কম প ঘ র ণ ঝড় র অন ক র জন য ব ষয়ক সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সের ২৫ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা

পুঁজিবাজারে বিমা খাতে তালিকাভুক্ত পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদ শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ২৫ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। এর পুরোটাই নগদ লভ্যাংশ।

২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত হিসাব বছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে শেয়ারহোল্ডারদের জন্য এ লভ্যাংশ ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে প্রতিটি ১০ টাকা মূল্যের শেয়ারের বিপরীতে ২.৫০ টাকা নগদ লভ্যাংশ পাবেন শেয়ারহোল্ডারা।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই-সিএসই) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

এর আগে বুধবার (৫ মার্চ) অনুষ্ঠিত কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে সর্বশেষ হিসাববছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা ও অনুমোদনের পর লভ্যাংশ সংক্রান্ত এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

ঘোষিত লভ্যাংশ শেয়ারহোল্ডারদের সম্মতিক্রমে অনুমোদনের জন্য কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) অনুষ্ঠিত হবে আগামী ৬ মে। আর ঘোষিত লভ্যাংশ শেয়ারহোল্ডারদের মাঝে বিতরণে রেকর্ড ডেট নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ এপ্রিল।

আলোচিত বছরে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) হয়েছে ৪.৭৯ টাকা। আগের হিসাব বছরের একই সময়ে মুনাফা ছিল ৪.৯৭ টাকা।

গত ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সমাপ্ত হিসাব বছরে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদ মূল্য (এনএভিপিএস) ছিল ৪৪.৬৫ টাকা।

ঢাকা/এনটি/ইভা 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কিশোরদের আজান শেখালেন তিনি
  • যবিপ্রবিতে পরীক্ষা ছাড়াই শিক্ষার্থীকে পাস করানোর অভিযোগ
  • লিস্ট ‘এ’ ইতিহাসে কোথায় আছে প্রাইম ব্যাংকের ৪২২
  • আরো ২ মামলায় ইনু গ্রেপ্তার  
  • প্রাইম ব্যাংকের চারশর ইতিহাস
  • পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সের ২৫ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা
  • জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সংশোধিত নম্বরবণ্টন প্রকাশ
  • জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেশনাল মাস্টার্সে ভর্তি, আবেদনের সময় বৃদ্ধি, ক্লাস ২২ এপ্রিল
  • মুদ্রস্ফীতি ধরে দেনমোহর পরিশোধের রায় কুমিল্লা আদালতের