গণঅভ্যুত্থানের পরে সমাজে কোনো পরিবর্তন আসেনি
Published: 9th, March 2025 GMT
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো না থাকলে অন্য ঘটনার সঙ্গে নারীর ওপর অভিঘাত বেশি হয়। নির্যাতন, হামলা ও ধর্ষণের ঘটনা বাড়ে। আদতে গণঅভ্যুত্থানের পর সমাজে কোনো পরিবর্তন আসেনি। এর মানে এটা না, ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের আমলের
চেয়েও পরিস্থিতি অনেক খারাপ হয়ে গেছে। তবে কয়েক দিনের ঘটনায় সরকারের পক্ষ থেকে নির্যাতকের পক্ষে সাফাই গাওয়ায় অনেক বেশি প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। বিশেষত নারীরা অনেক বেশি ক্ষুদ্ধ হয়েছেন।
লালমাটিয়ায় ভুক্তভোগী নারীর ওপর হামলা হয়েছে, যা ফৌজদারি অপরাধ। কিন্তু সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে এ ঘটনায় হামলাকারীদের তো আইনের আওতায় নেওয়াই হয়নি বরং সরকারের পক্ষ থেকে হামলাকারীদের মুরব্বি বলে তাদের পক্ষালম্বন করা হয়েছে। এর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী নির্যাতনের ঘটনায় এ রকম একটা পরিস্থিতি তৈরি করা হলো, নির্যাতনের পক্ষে একটা গোষ্ঠী সারারাত থানার সামনে অবস্থান করল। স্বীকৃত নির্যাতকের মুক্তির দাবি জানানো হলো। সর্বশেষ সরকার এ রকম একটা অপরাধীকে এক দিনের মাথায় জামিন দিতে বাধ্য হলো। পরে সেই অপরাধীকে নির্ধারিত গোষ্ঠীটি বীরের বেশে বরণ করে নিল। একজন অপরাধীকে যদি বীর হিসেবে দেখানো হয়, তবে অন্যরাও একই অপরাধ করতে অনুপ্রাণিত হবে। আর বাদী নিরাপত্তাহীন হয়ে ভাববে, সে মামলা চালাবে কিনা?
এই পরিস্থিতিতে নারীরা দেখতে পেল সমাজ ও রাষ্ট্রে ধর্ষণ আর হত্যাকাণ্ড বেড়ে যাওয়ার পরও সরকার ও বিভিন্ন গোষ্ঠী নারীর বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকেও সহযোগিতা পাচ্ছে না তারা। গত শনিবার পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দল এসব নিয়ে কথা বলেনি। আর আট বছর বয়সী শিশু ধর্ষণের ঘটনাটি নারীদের মধ্যে ক্ষোভের স্ফুলিঙ্গ হিসেবে কাজ করে। তারা তাদের আত্মসম্মান ও অধিকার ফিরে পেতে রাস্তায় নেমেছে। তাই শনিবার আন্তর্জাতিক নারী দিবসটি কেটেছে অত্যন্ত বেদনার মধ্যে। এর চেয়ে আরও বেদনাদায়ক হচ্ছে, আমাদের
সমাজে নির্যাতনের শিকার একজন নারীকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়। আমাদের মূলধারার গণমাধ্যম এসব বিষয়ে সতর্ক থাকলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নির্যাতনের শিকার নারীর নাম, পরিচয় ও ছবি প্রকাশ
করা হচ্ছে। এসব বিষয়ে আমরা একবারও খেয়াল করছি না, মেয়েটা যদি বেঁচে যায় তাহলে সে কি সমাজে যেতে পারবে? তার পরিবার সমাজে কীভাবে চলবে? নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুর পরিচয় প্রকাশে বিধিনিষেধ আছে। কিন্তু এই আইন মানছে না কেউ। নির্যাতনের শিকার নারীর পরিচয় প্রকাশের ক্ষেত্রে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে।
সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনায় নারী নির্যাতনকারীকে জনসমক্ষে বিচারের মুখোমুখি করার দাবি আবার উঠেছে। এটা আরও ভয়াবহ। শাস্তি যত কঠোর, মামলায় জেতার সম্ভাবনা তত কম। কারণ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভিকটিমকে বাঁচতে দেওয়া হবে না। সাম্প্রতিক সময়ে ফ্যাসিস্ট সরকারের লোকজন নারী নির্যাতনকে ঘিরে মিথ্যা তথ্যও ছড়াচ্ছে। তবে প্রতিটি ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনার বিচার করতে হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: পর স থ ত সরক র র অপর ধ ক র ঘটন ঘটন য়
এছাড়াও পড়ুন:
সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতির পথরেখা
বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর ছাত্রদের মধ্য থেকেই দাবি করা হয়েছিল, ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা হোক। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পরও ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি উঠেছে ছাত্রদের মধ্য থেকেই। এর বহু আগে থেকেও ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি করা হয়েছিল। তবে সমগ্র ছাত্রসমাজ দলমত নির্বিশেষে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি করেছে, তা বলা যাবে না। ছাত্রদের মধ্যে সহিংস ঘটনা বা লেজুড়বৃত্তি রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন বা অনৈতিক কর্মকাণ্ড যখন চরম আকারে পরিলক্ষিত হয় কিংবা সাধারণ জনমনে একশ্রেণি ছাত্রের প্রতি চরম ঘৃণার উদ্রেক হয়, তখন ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবিও সামনে চলে আসে। এটি সত্য, শাসকগোষ্ঠীর অনুসৃত বা অঙ্গসংগঠন বা সহযোগী ছাত্র সংগঠনের অপকীর্তির কারণেই ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি এসেছে বারবার।
ছাত্র রাজনীতির একটি ছোট্ট ইতিহাস আছে। উনিশ শতকের সত্তর দশকের গোড়ার দিকে এ ভূখণ্ডে ছাত্র রাজনীতি সংগঠিত হতে শুরু করে। ভারতীয়দের মধ্যে সমাজ ও রাজনৈতিক চেতনা বিকাশের স্বার্থে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় একটি ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। জাতীয় কংগ্রেসের উদ্যোগে ১৯২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় নিখিল বঙ্গ ছাত্র সমিতি। এর আগেও পাশ্চাত্য শিক্ষায় প্রচলিত ধ্যান-ধারণার বিরুদ্ধে ইয়ং বেঙ্গলের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলন ইতিহাসে সাক্ষী হয়ে আছে। ১৯৩২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. শহীদুল্লাহর নেতৃত্ব গড়ে তোলা হয় নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্র সমিতি। তবে বিশ শতকের প্রথম দিকেই ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী আন্দোলন, স্বদেশি আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্র রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা বাড়তে থাকে। ছাত্র রাজনীতি শুধু শিক্ষা সংক্রান্ত দাবির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। ইতিহাসের সেই গড়ে ওঠা ছাত্র সংগঠন ও ছাত্র রাজনীতির ধারাবাহিকতাই আজকের স্বৈরাচারবিরোধী ’২৪-এর গণঅভ্যুত্থান।
আমাদের ছাত্র রাজনীতি কলুষিত হয়েছে। ছাত্র রাজনীতির মধ্যে শিক্ষাগত মান কমেছে। কমেছে নিষ্ঠা, মানবিকতা ও আদর্শবাদিতা। ভীষণভাবে কমেছে আদর্শবাদিতার অব্যাহত চর্চা। স্বার্থবাদিতা ও সুবিধাবাদিতা বিশালভাবে আশ্রয় নিয়েছে ছাত্র রাজনীতির মধ্যে। ছাত্র রাজনীতিকে খুবরে খুবরে খাচ্ছে দিন দিন। গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতা প্রায় উঠেই যাচ্ছে। বেড়েছে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি, স্বার্থবাদিতা, টেন্ডারবাজি, হিংসাপরায়ণতা ও সহিংসতা। স্বাধীনতার পর থেকেই ছাত্র রাজনীতির এসব নেতিবাচক দিক ক্রমবিকশিত হলেও বেশ কয়েক বছর হলো চরম আকার ধারণ করেছে। অনেক ক্ষেত্রে শাসকগোষ্ঠীগুলোর প্রচ্ছন্ন ছত্রছায়ায়ই ঘটেছে এসব অপকীর্তি। জনগণের অনাস্থা গ্রথিত হতে হতে ক্রমশ ঘনীভূত হয়েছে। ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি উঠেছে সে কারণেই। এ দাবিও নতুন নয়। বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি উঠেছে। রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থায় বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেও অনেকে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি করে আসছেন। বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ার অশুভ শক্তি ঘোলাটে রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে মাঝে মধ্যেই ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি নিয়ে সামনে আসে। সাদা চোখে দেখলে এ দাবি মোটেই অমূলক নয়। তবে বিষয়টিকে বিশ্লেষণাত্বক দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখা প্রয়োজন।
ছাত্র রাজনীতি মানে হচ্ছে, ছাত্রদের স্বার্থ নিয়ে কথা বলা। ছাত্ররা শিক্ষা গ্রহণ করবে, মেধা চর্চা করবে, মেধার বিকাশ ঘটাবে, গবেষণায় মনোনিবেশ করবে, মুক্তভাবে কথা বলবে, শিক্ষাসংক্রান্ত ন্যায়সংগত দাবি তুলবে, অধিকারের কথা বলবে, সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা বলবে, সুশাসনের কথা বলবে, সমাজ প্রগতির পক্ষে সাংস্কৃতিক চর্চা করবে, প্রচার করবে, পরমতসহিষ্ণু হবে, ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারী সম্পর্ক স্থাপিত হবে, সংগঠিত হবে, ছাত্র সংসদ নির্বাচনের নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবে, নেতৃত্বের বিকাশ ঘটাবে। ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক চর্চা ও সংগঠিত করা ছাত্রদের দায়িত্বের বাইরে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে লেজুড়বৃত্তি ও ছাত্র রাজনীতি এক বিষয় নয়। লেজুড়বৃত্তি ও অন্যান্য নেতিবাচক বিষয় ছাত্র রাজনীতিকে দুর্বৃত্তায়িত করে, কলুষিত করে। এগুলো বন্ধ করতে হবে। শাসকগোষ্ঠীর ইচ্ছার ওপরেই নির্ভর করছে ছাত্র রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করা। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর ইতিবাচক ভূমিকা হবে অগ্রগণ্য। লেজুড়বৃত্তি পরিহার করে ছাত্রদের সংগঠিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
অন্যদিকে আইন করে এ রকম ছাত্র রাজনীতি বন্ধ থাকলে কালক্রমে মেধাচর্চা বা মেধার বিকাশও রুদ্ধ হতে পারে। মেধার পরিসীমাও সীমাবদ্ধ হয়ে যেতে বাধ্য। ছাত্ররা পাঠ্যক্রমের আওতার মধ্যেই হাবুডুবু খাবে। মেধাশূন্য হয়ে যেতে পারে জাতি। জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে যেতে পারে কালক্রমে। মনে রাখতে হবে ছাত্রনেতৃত্বের মধ্য থেকেই সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব বেরিয়ে আসে। গ্রাম-শহরে সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নে ছাত্রনেতৃত্বের অপরিসীম ভূমিকাকে আমরা অবমূল্যায়ন করতে পারি না। আমরা সবাই জানি, ১৯৫২, ১৯৬২, ১৯৬৯, ১৯৭১, ১৯৯০ ও ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে রাজনৈতিক ছাত্রনেতৃত্বের ভূমিকাই ছিল অগ্রগণ্য। এই অভ্যুত্থানগুলো বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে অসামান্য ভূমিকা রেখেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই সামান্য ইতিহাসটুকু আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও সংস্কৃতি বিনির্মাণে ছাত্র রাজনীতির বিরাজমান ঐতিহাসিক ভূমিকা। সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতির চর্চার মধ্য দিয়েই তা সম্ভব হয়েছে। শাসকগোষ্ঠীর হীন শ্যেনদৃষ্টি না পড়লে হয়তো ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবিই উত্থাপিত হতো না।
সে জন্য সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সেই ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব সবার। সব বুদ্ধিদীপ্ত মানুষের। সমাজের সব প্রতিনিধিত্বশীল রাজনীতিক, সুশীল ব্যক্তি, পেশাজীবী, সাংবাদিক, ছাত্রনেতৃত্বসহ সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতির জন্য গ্রহণযোগ্য বিধিমালা ও প্রয়োগবিধি প্রণয়ন করতে হবে। সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতির স্বার্থে ব্যাপক মানুষের মধ্যে প্রণীত বিধিমালা ব্যাপক প্রচার করতে হবে। ছাত্র ও জনগণের মধ্যে সুস্থ মনোভাব প্রস্তুত করতে হবে। জনগণের মধ্যেও সুস্থ মনোভাব প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে ছাত্র রাজনীতির হারানো ঐতিহ্য ও গৌরব ফিরিয়ে আনা সবারই কর্তব্য। সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতি প্রতিষ্ঠার পক্ষে এ দেশেই সংগ্রাম চলছে অব্যাহতভাবে। সংগ্রামের ধারা আরও বিকশিত হোক। আমরা সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতি চাই।
সিরাজুমমুনীর: জাতীয় পরিষদ সদস্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)