আদমদীঘিতে ২৪ ঘণ্টায় ৩ জনের অস্বাভাবিক মৃত্যু
Published: 9th, March 2025 GMT
বগুড়ার আদমদীঘিতে পৃথক স্থানে ২৪ ঘণ্টায় তিনজনের অস্বভাবিক মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে গলায় ফাঁস দিয়ে গৃহবধূ শম্পা বেগম (১৮), বিষাক্ত গ্যাসের ট্যাবলেট সেবনে ভ্যানচালক আব্দুস ছালাম (৩৫) ও ট্রেনে কাটা পড়ে রেল কর্মচারী ছায়ফুল ইসলাম (৩৮) মারা যান। এসব ঘটনায় আদমদীঘি ও সান্তাহার রেলওয়ে থানায় পৃথক অপমৃত্যু মামলা হয়েছে।
পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গত শনিবার বিকেলে সান্তাহার ইয়ার্ড কলোনি এলাকার এনামুল হকের স্ত্রী শম্পা বেগম ঘরের আড়ার সঙ্গে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। পুলিশ লাশ উদ্ধার করে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়।
একই দিন বেলা ১২টার দিকে উপজেলার সুদিন গ্রামের ভ্যানচালক আব্দুস ছালাম বাড়িতে বিষাক্ত গ্যাসের ট্যাবলেট সেবন করে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। পরে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সন্ধ্যায় তিনি মারা যান।
রোববার ছাতিয়ানগ্রাম রেলগেটের কাছে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান রেলওয়ে খালাসি সান্দিড়া গ্রামের ছায়ফুল ইসলাম। তিনি রেললাইনের পাথর টানার কাজ করার সময় ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা পঞ্চগড়গামী আন্তঃনগর নীলসাগর এক্সপ্রেসে কাটা পড়েন।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, রেললাইনে কাজ করার সময় পাশের একটি ট্রাক্টরের শব্দের কারণে ট্রেন আসার বিষয়টি বুঝতে পারেননি তিনি। এতে ছায়ফুল ট্রেনে কাটা পড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান। আদমদীঘি থানার ওসি এস এম মোস্তাফিজুর রহমান ও সান্তাহার রেলওয়ে থানার ওসি হাবিবুর রহমান এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
বগুড়ার দুই শিল্পপল্লিতে এক লাখ লোকের কর্মসংস্থান
দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলা বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার শাঁওইল বাজার এলাকার ১৬টি গ্রাম যেন এক শিল্পপল্লি। এই শিল্পপল্লির পুরোটাই তাঁতশিল্পনির্ভর। কম্বল, চাদর, মোজাসহ বিভিন্ন ধরনের কাপড় তৈরি হয় এখানে। আর বগুড়া সদরে গড়ে উঠেছে আরেক ধরনের শিল্প। এখানে তৈরি হচ্ছে নানা ধরনের হালকা প্রকৌশল (লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং) যন্ত্রপাতি।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুসারে, বগুড়ার হালকা প্রকৌশল শিল্পপল্লিতে বছরে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার এবং তাঁত শিল্পপল্লিতে বছরে ৭০০ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়। সব মিলিয়ে এ দুই শিল্পপল্লিতে প্রায় এক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
এ দুই শিল্পপল্লিতে সম্ভাবনার সঙ্গে রয়েছে চ্যালেঞ্জও। ছোট উদ্যোক্তারা দীর্ঘদিন ধরে অর্থায়ন, বিপণন ও বাজার সংযোগসহ নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে গেছেন। তবে এখন পরিস্থিতির অনেকটাই বদলে হয়েছে। কারণ, এসএমই ফাউন্ডেশন এসব উদ্যোক্তাকে নিয়ে বিশেষ ক্লাস্টার (গুচ্ছ/পল্লি) চিহ্নিত করেছে। তাতে ঋণ পাওয়া সহজ হয়েছে; অন্যান্য সুবিধাও মিলছে।
ঝুট কাপড় থেকে তাঁতের পণ্যএকসময় আদমদীঘির তাঁতিরা সুতি, সিল্ক প্রভৃতি সুতা দিয়ে শাড়ি, গামছা ইত্যাদি পণ্য তৈরি করে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করতেন। নব্বইয়ের দশকের শেষে তাঁতিরা উলের সুতা ও পণ্যের দিকে ঝোঁকেন। পরবর্তী সময়ে এটিকে ঘিরেই সেখানকার পুরো ব্যবসার পরিবেশ দাঁড়ায়।
আদমদীঘির তাঁতশিল্প বা হ্যান্ডলুম ক্লাস্টার মূলত স্থানীয় শাঁওইল বাজারকেন্দ্রিক। এখানে সুতা ও তাঁতের পণ্য—এ দুই ধরনের ব্যবসা রয়েছে। এই ক্লাস্টারে ছয় থেকে সাত হাজার তাঁতি এবং দেড় হাজার সুতা ব্যবসায়ী রয়েছেন। এ ছাড়া সুতা ছাড়ানো, ববিন (যার ওপর সুতা পেঁচানো থাকে) করা ও অন্যান্য সংযোগ শিল্পের সঙ্গে আরও প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক জড়িত রয়েছেন। এসএমই ফাউন্ডেশনের হিসাবে, এই ক্লাস্টারে সব মিলিয়ে প্রায় ৬০ হাজার লোকের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান রয়েছে।
সুতা ব্যবসায়ীরা প্রথমে ঢাকা, গাজীপুর, সাভার ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন তৈরি পোশাক কারখানা থেকে ঝুট কাপড় কিনে আনেন। দিনে ১০০ থেকে ১২০ টন ঝুট কাপড় আসে এই উপজেলায়। এরপর ধরন ও রংভেদে এসব সুতা আলাদা করে সেগুলো কুনিং যন্ত্রের সাহায্যে ববিন করা হয়। এ কাজটি করেন একদল শ্রমিক। তবে ঝুট কাপড় থেকে চাহিদা অনুসারে সব রঙের সুতা পাওয়া যায় না। এ জন্য ব্যবসায়ীরা সুতা ঢাকায় পাঠিয়ে রং (ডাইং) করিয়ে আনেন। ব্যবসায়ীরা জানান, কটন, অ্যাক্রিলিক, শ্যানেল (চেনিল), মশিয়ান, তামু, উল, পিভিটিসহ ৫০ ধরনের বেশি সুতা পাওয়া যায় এই বাজারে। ধরনভেদে এসব সুতা ১৫০ থেকে ৬০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়। এতে একজন ব্যবসায়ীর কেজিপ্রতি লাভ হয় ১০ থেকে ১২ টাকা।
ঝুট থেকে তৈরি সুতা কিনে নেন স্থানীয় তাঁতিরা। এরপর এই সুতা দিয়ে বানানো হয় কম্বল, গায়ের চাদর, তোয়ালে, বিছানার চাদর, পাপোশ, মোজা, মাফলারসহ নানা পণ্য। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, আদমদীঘির তাঁতশিল্প মূলত শীত মৌসুমকেন্দ্রিক। প্রতিবছর শীতকালে এখানে গড়ে ২০ লাখ কম্বল, ১ কোটি চাদর, ৫০ লাখ গামছা ও তোয়ালে তৈরি হয়।
স্থানীয় বাজার ছাড়াও ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রংপুর, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হয় এসব পণ্য। এ ছাড়া বিভিন্ন সরকারি কার্যালয়, কোম্পানি, বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) এবং ব্যক্তিপর্যায়ের ক্রেতারাও এখান থেকে বিভিন্ন শীতবস্ত্র কিনে থাকেন। শীতের সময় সারা দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের মাঝে যে কম্বল বিতরণ করা হয়, তার একটি বড় অংশ এখানে তৈরি।
সম্ভাবনার পাশাপাশি কিছু প্রতিবন্ধকতার কথাও জানান স্থানীয় ব্যবসায়ী ও তাঁতিরা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কাঁচামাল তথা ঝুটের দাম বেড়েছে। এ কারণে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও তাঁতিদের খরচও বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা মূলত মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে কাঁচামাল কিনে থাকেন। তাঁরা জানান, ঢাকার কারখানা থেকে সরাসরি কাঁচামাল আনা গেলে খরচ আরও কমত। তাঁতে পণ্যের দামও কমানো যেত। এ ছাড়া শাঁওইল এলাকার অধিকাংশ তাঁতশিল্পী হাতে ব্যবহৃত তাঁতযন্ত্র বা হ্যান্ডলুম ব্যবহার করেন। হ্যান্ডলুমে একটি কম্বল বানাতে তিনজনের সময় লাগে ৪৫ থেকে ৫০ মিনিট। এভাবে প্রতি ঘরে দিনে ১০ থেকে ১২টি কাম্বল বানানো যায়। সেখানে পাওয়ার লুমে দৈনিক ২৫ থেকে ৩০টি কম্বল তৈরি করা যায়। ফলে আয়ও দ্বিগুণ হয়। শাঁওইল বাজার হ্যান্ডলুম ক্লাস্টার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোজাম্মেল হোসেন বলেন, দেড়-দুই লাখ টাকা দিয়ে পাওয়ার লুম কেনার সামর্থ্য সবার নেই। তাই সহজ শর্তে অর্থায়ন বা ঋণসুবিধা পেলে অনেক তাঁতির পক্ষে এটি কেনা সম্ভব হতো।
হালকা প্রকৌশলে বড় সম্ভাবনাদেশে-বিদেশে বগুড়ার বিভিন্ন ধরনের কৃষিযন্ত্র ও হালকা প্রকৌশল শিল্পের এখন ব্যাপক সুনাম রয়েছে। ব্যবসায়ীরা জানান, দেশের কৃষি যন্ত্রপাতির বার্ষিক চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ পূরণ হয় এখানে তৈরি যন্ত্রে। বগুড়ার এই হালকা প্রকৌশল শিল্পের যাত্রা শুরু হয়েছিল কামারশালায় সারাইয়ের (রিপেয়ারিং) কাজ করা কয়েকজন কারিগরের হাত ধরে। সেটি গত শতকের চল্লিশের দশকে। বগুড়া সদর এলাকায় এখন কৃষি যন্ত্রাংশ তৈরির ৫০০টি ওয়ার্কশপ, অন্যান্য হালকা প্রকৌশল পণ্যের ৫০০টি এবং ঢালাইশিল্পের (ফাউন্ড্রি) ৭৫টি কারখানা রয়েছে। এ ছাড়া কৃষি যন্ত্রপাতি মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের কয়েক হাজার ওয়ার্কশপ রয়েছে। বগুড়া শহর ও শহরতলির আশপাশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে এসব কারখানা। প্রায় দুই হাজার ধরনের যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ তৈরি হয় এখানে। এর মধ্যে রয়েছে সেন্ট্রিফিউগাল পাম্প, সেচপাম্প, টিউবওয়েল, পিটি চেইন কভার, ফুয়েল পাইপ, অয়েল ক্যাচার, এয়ার ক্লিনার, সাইলেন্সার, চেইন কভার প্রভৃতি।
মাত্র সাত লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে ২০১৮ সালে কারখানা করেছিলেন এপি মেটাল ইন্ডাস্ট্রির স্বত্বাধিকারী আরিফুল ইসলাম। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক আয় ১২ কোটি টাকা। দেশের ৫৫টি জেলায় তাঁর প্রতিষ্ঠানের তৈরি পণ্য সরবরাহ হচ্ছে। আরিফুলের মতো আরও সফল ব্যবসায়ী রয়েছেন এখানে। বগুড়ার কৃষি যন্ত্র ও হালকা প্রকৌশল শিল্প বিদেশেও বাজার সৃষ্টি করছে। এসএমই ফাউন্ডেশন জানায়, ১৯৯৫ সালে ভারতে সেন্ট্রিফিউগাল পাম্প রপ্তানির মধ্য দিয়ে বিদেশের বাজারে প্রবেশ করে বগুড়ার কৃষি যন্ত্রের শিল্প।
বগুড়া লাইটিং ইঞ্জিনিয়ারিং ফাউন্ডেশনের সভাপতি গোলাম আযম বলেন, ‘বগুড়ার হালকা প্রকৌশল শিল্পের জন্য একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল করা হলে আমাদের বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সমস্যা দূর হবে। এতে উৎপাদন ব্যয় কমবে, বিদেশে রপ্তানিও বাড়বে।’
ভারী শিল্প হওয়ায় অনেক সময়ই ব্যাংকঋণ নিতে হয়। কিন্তু চড়া সুদহার আরেকটি সমস্যা। এ নিয়ে ব্যবসায়ীদের দাবি, আরও আধুনিক যন্ত্র বানাতে হলে ১০ শতাংশের নিচে ও সহজ শর্তে সুদহারের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন মুশফিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বগুড়ার তাঁত ও হালকা প্রকৌশলশিল্পের মতো এসএমইদের ব্র্যান্ডিং ও পণ্য বৈচিত্র্যকরণ বাড়ানো প্রয়োজন। একই সঙ্গে তাদের পণ্য তৈরির পদ্ধতিকেও আধুনিকায়ন করা দরকার। এটি করা গেলে আগামী তিন–চার বছরে শিল্প দুটি দেশের অর্থনীতিতে একটি সম্ভাবনাময় খাতে পরিণত হবে।