নারী ও কন্যাশিশুর আর্তনাদ, হাহাকার আর দীর্ঘশ্বাসে ক্রমেই ভারী হয়ে উঠছে বাংলাদেশের আকাশ–বাতাস। আমরা নারীরা ভালো নেই, শান্তিতে নেই, স্বস্তিতে নেই। শুধু নারী হওয়ার অপরাধে প্রতিমুহূর্তে নিরাপত্তার ঝুঁকিতে বসবাস করা কোনো সভ্য দেশের দৃষ্টান্ত হতে পারে না।
এ কি আদৌ সভ্য সমাজ, যেখানে দুধের শিশু থেকে বৃ্দ্ধা পর্যন্ত নারীরা ধর্ষণের শিকার হতে পারেন যেকোনো মুহূর্তে? যে কেউ যেকোনো সময়ে আমাদের পথ আগলে দাঁড়াতে পারে। আমাদের পরিধেয় বস্ত্র ধরে টানাহেঁচড়া করতে পারে। আমাদের অশ্রাব্য গালি দিতে পারে, ধর্ষণ করতে পারে। অথচ এই কাজগুলো যারা করে, সেই পুরুষগুলোই আমাদের সমাজে নারীদের বিচারের মানদণ্ড নিয়ে বসে থাকে।
মাগুরায় বোনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া আট বছরের শিশু ধর্ষণের ঘটনায় পুরো দেশ স্তম্ভিত। ধর্ষণের যেকোনো ঘটনায় মনের ওপর এতটাই চাপ সৃষ্টি হয় যে লিখতে বসলে মানসিকভাবে অসুস্থ বোধ করি। তখন হাত অসাড় ও মস্তিষ্ক ভোঁতা হয়ে আসে। আমরা দেখেছি, কিছু কিছু ধর্ষণের ঘটনায় দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। সেই ঝড় একসময় আবার থেমেও যায়। কিন্তু থামে না ধর্ষণের ঘটনা।
ক্ষমতা বদলায়, সময় বদলায়, আইন বদলায়, কিন্তু কিছুতেই থামে না ধর্ষণ। অধিকাংশ ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশিতই হয় না। মাগুরায় ধর্ষণের শিকার হওয়া আট বছরের শিশুটি যদি জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এসে না পৌঁছাত, তাহলে এ ঘটনাও হয়তো চাপা পড়ে যেত।
আরও পড়ুনমাগুরার মেয়েটা হেরে যেতে পারে না২ ঘণ্টা আগেবিগত দুই মাসে ধর্ষণের ঘটনা এমন জ্যামিতিক হারে বেড়ে চলেছে যে এ ধরনের খবরের ভার নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম দুই মাসেই সারা দেশে ৩৯৫ নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১১৫ জন।
বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের খবর আসছে। আছে বাসে কিংবা চলন্ত পরিবহনে ধর্ষণের ঘটনা, অটোরিকশা থেকে নামিয়ে ধর্ষণ, ট্রলারে দলবদ্ধ ধর্ষণ, অবকাশযাপন কেন্দ্রে বেড়াতে গিয়ে কিশোরী ধর্ষণ, শহীদ দিবসে ফুল কুড়াতে যাওয়া শিশুকে ধর্ষণ।
অন্যদিকে দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ধর্ষণের সাজাপ্রাপ্ত অনেক আসামি এরই মধ্যে জামিনে ছাড়া পেয়ে জেলের বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা হুমকি দিচ্ছে ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে। এ তালিকায় আছে ২০১৬ সালে দিনাজপুরে ৫ বছরের শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে সাজাপ্রাপ্ত এক আসামি, যে কিনা শিশুটির যৌনাঙ্গ ব্লেড দিয়ে কেটে ও সারা শরীরে সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়ে শিশুটিকে ধর্ষণ করেছিল। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই দেশ যেন ধর্ষণের এক অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে!
ধিক সেই দেশের পুরুষকে, যারা মাতৃগর্ভ থেকে জন্ম নিয়ে নারীকেই ধর্ষণ করে। যে দেশে ভাষা দিবসের ফুল কুড়াতে গিয়ে শিশু ধর্ষণের শিকার হয়, সে দেশ কি অভিশপ্ত এক দেশ নয়! নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুর দীর্ঘশ্বাসে একদিন হয়তো সেই দেশ রিক্ত হবে, নিঃস্ব হবে।বিষয়টি নিয়ে কথা উঠলেই কেউ কেউ বলেন, ‘ধর্ষণের ঘটনা তো বাংলাদেশে নতুন নয়। আগেও তো ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। গত ১৫ বছর আপনারা কোথায় ছিলেন?’ গত ১৫ বছর কী হয়েছে, সেই যুক্তিতে তো আর বর্তমানে সংঘটিত অপরাধ বৈধতা পেতে পারে না। ধর্ষণের ঘটনা যেকোনো পরিস্থিতিতেই অগ্রহণযোগ্য। কেউ আবার এ পরিস্থিতির জন্য মেয়েদের, তাঁদের পোশাক কিংবা চালচলনকে দায়ী করেন।
কেউ আবার বলেন, ‘পরিস্থিতি যত ভয়াবহ বলা হচ্ছে, আসলে পরিস্থিতি কিন্তু ততটা ভয়াবহ নয়।’ তাঁদের উদ্দেশে বলতে হয়, নারীরা নিরাপদে আছেন নাকি নেই, সে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর অধিকার একমাত্র নারীদেরই। কেউ নিরাপদ বোধ করলে তাঁকে বলে দেওয়ার প্রয়োজন হয় না যে ‘আপনি নিরাপদে আছেন’। ঠিক একইভাবে কেউ যদি তাঁর নিরাপত্তা নিয়ে উৎকণ্ঠিত থাকেন, তবে তাঁকে যতই আশ্বস্ত করা হোক না কেন তিনি অনিরাপদই বোধ করবেনই।
রাস্তায় হাঁটতে, গণপরিবহনে উঠতে, বাসের জন্য অপেক্ষা করতে, গণপরিবহনের ভেতরে, উবার, পাঠাও, এমনকি নিজের গাড়িতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, অফিসে–আদালতে, কলকারখানায়, বাড়ির ভেতরে, পার্কে, বিনোদনকেন্দ্রে, মিছিলের মাঝখানে, গণ–আন্দোলনে, লাইব্রেরিতে, খেলার মাঠে, হাসপাতালে, শহীদ মিনার কিংবা দর্শনীয় স্থানে, এটিএম বুথে, এমনকি গণশৌচাগারেও নিরাপদ নন নারী। পরিস্থিতে এমন দাঁড়িয়েছে যে আজকাল পাঁচ মিনিটও একা হেঁটে যাওয়ার সাহস করতে পারি না। অল্প বয়সী মেয়েগুলোর একা পথ চলার কথা তো ভাবতেই পারি না। দিনে–রাতে নিরাপত্তাহীনতার এই চক্র যেন নারীকে বিষণ্নতা আর হতাশার বলয়ে আটকে ফেলছে।
অনেকে ধর্ষণের ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন। না, এ ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এ ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্ন হিসেবে মেনে নিলে জঘন্য এই অপরাধের ভয়াবহতা গুরুত্ব হারায়। যিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, একমাত্র তিনিই জানেন, জীবনব্যাপী এই দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়ানো কী যন্ত্রণার!
জীবনে ঘটে যাওয়া এই ভয়ংকর বাস্তবতা থেকে বেরিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে যতই সন্তোষজনক বলুন না কেন, বাস্তবতা এই যে আমরা নারীরা এখন বাড়ির বাইরে বের হতে ভয় পাই। এমনকি বাড়ির মধ্যেও নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে ভীত আমরা।
আমরা মুক্তি চাই এই অভিশপ্ত পরিস্থিতি থেকে। ধর্ষণের শাস্তি যতই ভয়াবহ হোক না কেন, আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা না গেলে এর সুফল কখনোই পাওয়া যাবে না। যে দেশে ধর্ষণের শিকার ক্রন্দনরত নারীর আর্তচিৎকারের ভাষা মানুষের বিবেকের দুয়ারে নাড়া দেয় না, ধিক সেই দেশের দায়িত্বে থাকা মানুষগুলোকে।
ধিক সেই দেশের পুরুষকে, যারা মাতৃগর্ভ থেকে জন্ম নিয়ে নারীকেই ধর্ষণ করে। যে দেশে ভাষা দিবসের ফুল কুড়াতে গিয়ে শিশু ধর্ষণের শিকার হয়, সে দেশ কি অভিশপ্ত এক দেশ নয়! নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুর দীর্ঘশ্বাসে একদিন হয়তো সেই দেশ রিক্ত হবে, নিঃস্ব হবে।
নিশাত সুলতানা লেখক ও উন্নয়নকর্মী
[email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: পর স থ ত আম দ র ন র পদ বছর র
এছাড়াও পড়ুন:
সমঅধিকার কতদূর!
অন্তর্বর্তী সরকারের নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন ‘সর্বক্ষেত্রে সর্বস্তরে নারীর প্রতি বৈষম্য বিলুপ্তি এবং নারী-পুরুষের সমতা অর্জনের লক্ষ্যে পদক্ষেপ চিহ্নিতকরণ’ শীর্ষক প্রতিবেদন জমা দিয়েছে গত ১৯ এপ্রিল। প্রতিবেদনের ভূমিকায় বলা হয়েছে, এ কমিশনের প্রধান বিবেচনা হবে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য নিরসন এবং নারী-পুরুষ সমতা অর্জনে পদক্ষেপগুলো চিহ্নিত করা এবং সেগুলো বিভিন্ন মেয়াদে বাস্তবায়নে সুপারিশ তৈরি করা। সুপারিশ প্রণয়নে বিভিন্ন আর্থসামাজিক খাতে নারীর অবস্থা ও অবস্থান বিশ্লেষণ করে ১৭টি অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
কমিশনের এ প্রতিবেদনের পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনা দেখা যাচ্ছে; যা খুবই স্বাভাবিক। কেউ কেউ খুব ইতিবাচক হিসেবে এটিকে দেখছেন, আবার কেউ শুধু বিরোধিতার জন্য সমালোচনায় সীমাবদ্ধ। কমিশনও আশা করেছে, ‘এই প্রতিবেদন জনমানসে নাড়া দেবে, ভাবাবে এবং তর্ক-বিতর্ক সৃষ্টি করার মাধ্যমে নারীর সমতা অর্জনে সহায়তা করবে।’
সমাজে কোনো কালে সর্বসম্মতিতে কোনো বিষয় সমাধানের প্রান্তে নিয়ে আসা সম্ভব না; যা একজনের কাছে প্রগতিশীল বলে গণ্য, তা অন্যের কাছে অহেতুক বা বাড়াবাড়ি।
কমিশনের সুপারিশমালায় কয়েকটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়েছে। যেমন সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদের অধীনে নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্যমূলক বিধান বিদ্যমান রয়েছে। বিয়ে, তালাক, সন্তানের অভিভাবকত্ব ও ভরণপোষণের ক্ষেত্রে ধর্মীয় আইন অনুসরণ বাধ্যতামূলক হওয়ায় নারীরা বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকেন। কমিশন এ বৈষম্য দূর করার জন্য সংবিধানে পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে। এ ক্ষেত্রে অভিন্ন পারিবারিক আইন অর্জনের লক্ষ্যে অধ্যাদেশ জারির সুপারিশ করা হয়েছে।
আমরা কম-বেশি সবাই জানি, বাংলাদেশে উন্নয়ন খাতের অনেক সংগঠনই ‘নারী ও পুরুষ’– এই বাইনারি ধারণার বাইরে অন্যান্য লিঙ্গ বৈচিত্র্যের মানুষের অধিকার বিষয়ে জনমনে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করে থাকে। যদিও ধর্ষণ আইন সংস্কারের বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘লিঙ্গ, বয়স, ধর্ম, জাতীয়তা, ভাষা ও প্রতিবন্ধিতার পার্থক্য নির্বিশেষে নিরপেক্ষ বিচার ও আইনশৃঙ্খলা নিশ্চিত করা’র সুপারিশ রয়েছে। এখানে লিঙ্গ বৈচিত্র্যের মানুষের জন্য স্পষ্ট সুপারিশের অনুপস্থিতিতে বিষয়টি অস্পষ্ট রয়ে গেছে যে, এ বিষয়ে সংস্কার কমিশনের অবস্থান কী?
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন সম্পর্কে ‘নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী ও মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির বলেন, ‘প্রতিবেদনে নারীর সব বিষয় সার্বিকভাবে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। এটি একটি বড় পদক্ষেপ। এ জন্য কমিশনকে সাধুবাদ জানাই। এখন এর বাস্তবায়ন নির্ভর করবে এই সরকার এবং পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের ওপর। আমরা এর বাস্তবায়ন চাই; এমনকি পরবর্তী যে নির্বাচিত সরকার আসবে তারাও যেন তাদের মেনিফেস্টোতে বিষয়গুলো রাখে, আমরা তা নিশ্চিত করতে চাই।’ অভিন্ন পারিবারিক আইনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বাণিজ্য চলছে অভিন্ন আইন দ্বারা; এটা কোনো ধর্মীয় আইন দ্বারা চলছে না। এমনকি ক্রিমিনাল বা ফৌজদারি আইনও অভিন্ন। এগুলো যদি গ্রহণ করা যায়, তবে শুধু নারীর বিষয়ে এত আপত্তি কেন?’
তিনি আরও বলেন, ‘সংসদীয় আসন সংখ্যা বৃদ্ধি, নারী আসন বৃদ্ধি, সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদে আসা– এসব বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই।’
সম্প্রতি এক টেলিভিশন চ্যানেলে ‘টকশো’তে ব্যারিস্টার সারা হোসেনকে অভিন্ন পারিবারিক আইন নিয়ে খুবই ধৈর্য সহকারে যুক্তি দিয়ে একজন মাওলানাকে বোঝানোর চেষ্টা করতে দেখা গেছে। সারা হোসেন যুক্তি দিয়ে বোঝাচ্ছেন, ‘জামায়াতের সদস্য যারা ইংল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডা বা অন্য উন্নত দেশে আছেন, তারা তো সেখানকার অভিন্ন আইনের অধীনেই বিয়ে করছেন, শরিয়া আইনে বিয়ের কোনো সুযোগ সেখানে নাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘১৮৯০ সালে যে অভিভাবকত্ব আইন হয়েছে, সেটা নিয়ে তো আপনাদেরকে একবারও মাঠে নামতে দেখিনি। এমনকি পারিবারিক নির্যাতন আইন ২০১০ সবার জন্য অভিন্ন; মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান সবার জন্যই আছে। সব ধর্মের জন্য একই আইন আছে। আপনি আপনার ধর্মের আচার-আচরণ পালন করতে পারেন, কিন্তু আইনটা অভিন্ন থাকতে হবে। অভিন্ন আইন বিভিন্ন দেশে প্রচলিত।’
সারা হোসেন যতই তাঁকে যুক্তি দিয়ে বোঝাচ্ছেন, ততই তিনি ধর্মকে টেনে এনে ‘বিচার মানি, কিন্তু তালগাছ আমার’ জাতীয় কথা বলতে থাকলেন। ধর্ম নিয়ে যারা রাজনীতি করেন, তারা এই অভিন্ন পারিবারিক আইনের বিরোধিতা করবেনই। তাই এমন ধরনের কোনো কোনো সংগঠনের তৎপরতাও শুরু হয়ে গেছে। তাদের ভাষ্যমতে, অভিন্ন পারিবারিক আইন নাকি ইসলামবিরোধী! কারণ বিয়ে, তালাক ইত্যাদি ক্ষেত্রে সমানাধিকার মানেই হলো নারী আর অমর্যাদাকর জীবনযাপনে বাধ্য হবে না। কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গসমতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে মাতৃত্বকালীন অধিকার এবং নারীর প্রজনন অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র এসব বিষয়ে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নিয়ম হয়তো আছে, কিন্তু এগিয়ে যাওয়ার পথটা প্রশস্ত হবে নীতিমালা গ্রহণ ও সুপারিশ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে।
পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার টিকে থাকার প্রধান শর্ত হলো ‘মুনাফা’। তা সে যে প্রকারে হোক না কেন। কল্যাণরাষ্ট্রগুলো অর্থনৈতিক চরিত্রের দিক থেকে পুঁজিবাদী হলেও রাষ্ট্রের নাগরিকদের সব প্রকার মৌলিক অধিকারের জোগান দিয়ে থাকে। সেখানে একজন কর্মজীবী নারীকে শিশুসন্তান নিয়ে দুর্ভাবনায় থাকতে হয় না বিধায় তাঁর কাজ বাধাগ্রস্ত হয় না। বরং সর্বোচ্চ যেটুকু শ্রম দেওয়া যায়, তিনি তাঁর সবটাই দিয়ে থাকেন। যাতে রাষ্ট্রই লাভবান হয়। বিষয়টি উপলব্ধি করেছে উন্নত দেশগুলো। তাই তারা এগিয়ে গেছে। সেখানে নারীর প্রতি বৈষম্য অনেক কম। আমাদের দেশে ঠিক এর বিপরীত চিত্র দেখা যায়। একজন নারীকে ঘুম থেকে উঠে পরিবারের সব সদস্যের জন্য খাদ্যের সম্ভার সাজিয়ে রাখাতে ঘরের মধ্যেই নিরলস ছুটতে হয়। তারপর স্কুলপড়ুয়া সন্তানের জন্য টিফিন, স্বামী এবং তার নিজের জন্য দুপুরের খাবার তৈরি করে তা আবার ব্যাগে ভরে দেওয়া; সন্তানকে বারবার মনে করিয়ে দেওয়া– ‘টিফিনটা ঠিকমতো খেয়ো কিন্তু, পানি খেয়ো বেশি করে।’ তারপর আবার ছুট লাগাতে হয় অফিসের উদ্দেশে। যারা অফিসের গাড়ি পান, তাদের ভাগ্য ভালো; নয়তো পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নিতে গিয়েও কত রকম বিড়ম্বনা– ‘এই আপা উইঠেন না, লেডিস সিট নাই।’ তারপর অনেক বাস মিস করে রীতিমতো যুদ্ধ করে অফিসে পৌঁছানোর পর বসের মুখঝামটা, ‘সময়মতো অফিসে আসতে পারেন না তো চাকরি করেন কেন?’ বস মানুষটি ভুলে যান, শ্রেণিগত ও লিঙ্গীয় সুবিধার কারণে তাঁকে নারীর এই কাজগুলো করতে হয় না।
আমাদের মতো দেশে গৃহস্থালির কাজকর্ম করতে আসে একেবারে নিম্নবিত্ত মানুষ। মূলত নারীরা যুক্ত থাকেন এই কাজে। এ ধরনের চাকরির না আছে দীর্ঘস্থায়িত্বের নিশ্চয়তা, যথাযোগ্য মাইনে; না আছে ছুটিছাটা। তাই তাঁকে বিকল্প হিসেবে কয়েকটি বাসায় কাজ করে জীবনধারণের নিশ্চয়তা বিধান করতে হয়। তাই এই অপ্রাতিষ্ঠানিক সেক্টরের শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি, শ্রমঘণ্টা, বিশ্রাম, ছুটি ইত্যাদি বিষয় নির্ধারণ করে দেওয়া প্রয়োজন।
কমিশনের সুপারিশমালায় সব খাতে নারী ও পুরুষ শ্রমিকের জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করার কথা বলা হয়েছে। এ প্রতিবেদনের বাস্তবায়ন হতে পারে নারীর ক্ষমতায়নের পক্ষে এক বিশাল পদক্ষেপ।
অধিকারকর্মী ও আদিবাসী নেত্রী ইলিরা দেওয়ান বলেন, ‘আন্তরিকতা থাকলে এই সরকার অবশ্যই কমিশনের প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন শুরু করতে পারে। বিগত সরকারের আমলে বান্দরবানের ব্যাংক ডাকাতির ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিশুসহ আটক বম নারীদের এখনো (গত ৮ মাসে) কারাগারে আটক রাখা হয়েছে। নারীর মানবাধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বম নারীদের মুক্তি দেওয়া হলে তা হবে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।’
লেখক: সমন্বয়ক, সাংগাত বাংলাদেশ