দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ও প্রকাশ্য দিবালোকে চাঁদাবাজি নিয়েও অনেক কথা হচ্ছে। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতও প্রকট হচ্ছে। দ্রুতই দৃশ্যপট পরিবর্তন হতে দেখছি আমরা।

এর মধ্যে একটা বিষয় খুব গভীরভাবে পুরো সমাজকে নাড়া দিয়েছে। যে বিষয়টা হয়তো আমাদের সমাজের অস্তিত্বের ওপর একধরনের কালো ছায়া ফেলছে।
নারীর ওপর নিপীড়ন আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষার্থীর সঙ্গে যে ঘটনা ঘটে গিয়েছে, সেই ঘটনার প্রভাব ভবিষ্যতে আমাদের সমাজকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে, এটি নিয়ে বোধকরি ভাবার সময় এসেছে।

নিপীড়ককে থানা-হাজত থেকে ছাড়িয়ে নিতে যে নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। এরপর সেই নিপীড়ককে গলায় মালা ও মাথায় পাগড়ি পরিয়ে যেভাবে হিরো বানানোর চেষ্টা করা হয়েছে। সেই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই আমরা মাগুরার ঘটনা জানতে পেরেছি।

আট বছরের বাচ্চা মেয়েটি, যে কিনা এখনো নারী-ই হয়ে উঠতে পারেনি। সেই বাচ্চা মেয়েটি বড় বোনের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিল। এতটুকু একটা বাচ্চা মেয়ে ধর্ষণের (বোনের শ্বশুর ও জামাইয়ের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে) শিকার হয়েছে।

হাসপাতালের স্ট্রেচারে অর্ধমৃত মেয়েটির ছটফট করার দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছিল, মেয়েটি ছটফট করছে, নাকি বাংলাদেশ নামের এই জনপদের পুরো সমাজ হাসপাতালের স্ট্রেচারে অর্ধমৃত হয়ে মৃত্যুর অপেক্ষায় রয়েছে!

নারীর ওপর ধর্ষণ ও নির্যাতন কেন সমাজে এত বেড়ে গিয়েছে? এর কারণ কিন্তু খুব সহজেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব। জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া ওই ঘটনা। যে সমাজে নিপীড়ককে শাস্তি না দিয়ে উল্টো পুরস্কার দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ফুলের মালা পরিয়ে স্বাগত জানানো হয়। সেই সমাজে নারী কি আদৌ নিরাপদ?

এই ঘটনার পর ধর্ষক হিসেবে বাবা এবং ছেলের নাম বারবার আসছে। তবে ভুলে গেলে চলবে না, শিশুটির মা ও বোন নিজ মুখে বলেছে, ধর্ষণের ঘটনায় শিশুটির বোনের শাশুড়িরও হাত ছিল কিংবা সম্মতি ছিল। তাই যথাযথ তদন্ত করে ওই নারীকেও শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

মাগুরার শিশুটির সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা কেবল বর্বরতার নিদর্শন নয়, এটি মানবতার বিরুদ্ধে একটা অপরাধ। মানুষ নামের কিছু পশু যখন এমন কাণ্ড ঘটায়; তখন পুরো সমাজের উচিত লজ্জা পাওয়া। প্রশ্ন করা, আমরা কোন পথে এগোচ্ছি? সভ্যতা থেকে আমরা কত হাজার মাইল দূরে দাঁড়িয়ে?

এটি কেবল একটা মেয়ের জীবনে ঘটে যাওয়া অপরাধ নয়, এটি আমাদের পুরো সমাজের অস্তিত্বের ওপর আঘাত। এমন সমাজে কোনো সভ্য মানুষের পক্ষে কি বসবাস করা সম্ভব? যারা এমন কাণ্ড ঘটায়, তারা তো সমাজে বসবাসের অযোগ্য। অথচ আমরা কী দেখতে পাই?

অপরাধীরা উল্টো বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করে। আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে ঠিকই বের হয়ে যায়। আর কন্যা শিশু ও নারীরা  হয় মরে কিংবা বেঁচে থেকে হাজারবার মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে। নৈতিকতা, মূল্যবোধ বিষয়গুলো বোধকরি সমাজ থেকে খুব দ্রুতই হারিয়ে যাচ্ছে। অপরাধীরা ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে পড়ছে সমাজের সব স্তরে। এদের কেউ চুরি-ডাকাতি করছে। কেউ ছিনতাই করছে। কেউ ধর্ষণের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে।

এত সব অপরাধ চারদিকে ঘটেই চলেছে। অথচ দেখেও যেন দেখার কেউ নেই। তাহলে কী ক্যানসারের মতো এসব অপরাধ ক্রমে ছড়িয়ে পড়তেই থাকবে? এই সমাজে কি আমাদের মা-বোনেরা নিরাপদে চলাচল করতে পারবেন না?

এসব অপরাধীর বিরুদ্ধে যদি অতি দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থা করা না যায়। তাহলে এমন ঘটনা কিন্তু ঘটতেই থাকবে। তাই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা খুব দ্রুত করতে হবে। ঘটনার রেশ থাকতে থাকতেই ব্যবস্থা নিতে হবে।

এই ঘটনার পর ধর্ষক হিসেবে বাবা এবং ছেলের নাম বারবার আসছে। তবে ভুলে গেলে চলবে না, শিশুটির মা ও বোন নিজ মুখে বলেছে, ধর্ষণের ঘটনায় শিশুটির বোনের শাশুড়িরও হাত ছিল কিংবা সম্মতি ছিল। তাই যথাযথ তদন্ত করে ওই নারীকেও শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

সরকারের উচিত ও দায়িত্ব এই ঘটনার দ্রুত বিচার করা। এসব ঘটনার যদি বিচার না হয়, তবে আমাদের মেয়েরা হেরে যাবে। হেরে যাবে পুরো সমাজ। যেই নারীরা একাত্তরে এই দেশের মুক্তির সংগ্রামে শামিল হয়েছিলেন। যে নারীরা চব্বিশের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে নেমে এসেছিলেন। সেই নারীরা যদি হেরে যান, তাহলে হেরে যাবে পুরো সমাজ। সমাজের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে।

দেশের আপামর জনগণকে এ লড়াইয়ে শামিল হতে হবে। আমাদের মেয়েরা হারবে না। কারণ, আমাদের মেয়েরা হেরে গেলে, হেরে যাবে বাংলাদেশ।

আমিনুল ইসলাম জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, এস্তোনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি
[email protected]

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আম দ র ম ব যবস থ ই ঘটন র অপর ধ র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

প্রতিমা মাত্র

বাবেলের অধিবাসীরা যখন হজরত ইবরাহিমের (আ.) কথা কর্ণপাত করল না, শক্ত যুক্তিও মেনে নিতে রাজি হলো না, তখন তিনি দাওয়াত দেওয়ার ভিন্ন একটি কৌশল অবলম্বন করলেন। তাদের মন্দিরে অনেকগুলো কাঠের দেবদেবী ছিল, এর মধ্যে একটি ছিল প্রধান দেবতা। তিনি পরিকল্পনা করলেন তার জাতিকে দেখাবেন এই প্রতিমাগুলো কত দুর্বল—নিজের শরীর থেকে একটি মাছি তাড়াবারও শক্তি এদের নেই।

একদিন বাবেলে ধর্মীয় মেলা হবে, লোকজন ইবরাহিমকে (আ.) সেখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগল। ইবরাহিম (আ.) আকাশের তারকার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি অসুস্থ।’ তিনি ঠিক মিথ্যা বলেননি, তার জাতির কুফরি কাজকর্মে তিনি আত্মিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তারা তার কথা বিশ্বাস করে। (সুরা সফফাত, আয়াত: ৮৮-৯০) ইবরাহিম (আ.) আস্তে আস্তে বললেন, ‘আল্লাহর কসম, তোমরা চলে যাওয়ার পর আমি অবশ্যই তোমাদের প্রতিমাগুলোর কায়দা করব।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত: ৫৭)

আরও পড়ুন‘রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া’ কখন পড়ব০৪ মার্চ ২০২৫

এরপর তারা যখন চলে যায়, তিনি চুপি চুপি প্রতিমাগুলোর কাছে গেলেন। যাদের সামনে ছিল থরেথরে সাজানো ফলমূল আর সুস্বাদু খাবার। তিনি বললেন, ‘তোমরা কি খাবে না? তোমাদের কী হয়েছে, কথা বলছো না কেন?’ (সুরা সফফাত, আয়াত: ৯১-৯৩) তিনি সজোরে মূর্তিগুলোর ওপর আঘাত হানলেন। কিন্তু বড় মূর্তিটাকে কিছু করলেন না, যেন ওটার ওপর সব দোষ চাপানো যায়।

লোকজন ধর্মমেলা থেকে ফিরে যখন মন্দিরের এই হাল দেখল, রেগেমেগে একদম বেহাল হয়ে হয়ে গেল। তারা বলল, ‘কে আমাদের দেবদেবীর এই অবস্থা করল? সে নিশ্চয় সীমালংঘনকারী। কেউ কেউ বলল, এক যুবককে দেখেছি এদের সমালোচনা করতে, তার নাম ইবরাহিম। তারা বলল, তাকে জনতার সামনে উপস্থিত করো, যেন তারা তাকে দেখতে পারে।’

ইবরাহিমকে (আ.) উপস্থিত করার পর তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘তুমিই কি আমাদের দেবদেবীদের এই হাল করেছ? ইবরাহিম (আ.) বললেন, ওই বড় দেবতাটাই এসব করেছে, ওটাকে জিজ্ঞেস করো, যদি কথা বলতে পারে!’

এ কথা শুনে তারা চিন্তায় পড়ে গেল। তারা একে অপরকে বলল, তোমরা দেবদেবীদের অরক্ষিত রেখে গেছ, তোমরাই বরং সীমালঙ্ঘনকারী। তারপর লজ্জায় তাদের মাথানত হয়ে গেল। তারা ইবরাহিমকে (আ.) বলল, ‘তুমি তো ভালো করেই জানো এরা কথা বলতে পারে না।’

আরও পড়ুনসুরা ইয়াসিনের সার কথা১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ইবরাহিম (আ.) এই মন্তব্য শোনারই অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি বললেন, ‘তবে কি তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর ইবাদত করো, যা তোমাদের কোনো উপকার করতে পারে না এবং কোনো ক্ষতিও করতে পারে না? ধিক তোমাদের এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাদের ইবাদত কর তাদের। এরপরও কি তোমরা বুঝবে না?’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত ৫৯-৬৭)

মূর্তিপূজার অসারতার এমন স্পষ্ট প্রমাণের পর বাবেলের অধিবাসীদের উচিত ছিল এক আল্লাহয় বিশ্বাস করা, হজরত ইবরাহিমকে (আ.) নবী বলে মেনে নেওয়া। কিন্তু তারা তা না করে ফন্দি আঁটতে থাকে কীভাবে মূর্তি ভাঙার প্রতিশোধ নেওয়া যায়, কীভাবে তাকে কঠিন শাস্তি দেওয়া যায়।

আল্লাহর শরিয়ত কোনো প্রাণীকেই জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার অনুমতি দেয় না, আর মানুষ তো সবচেয়ে সম্মানিত প্রাণী, তার বেলায় তো আরও আগে না। (মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস: ৩,৫৪২) কিন্তু কাফেরদের নীতিতে ইনসাফ নাই, মানবতা নাই, আছে কেবল পাশবিকতার জয়গান। আর তাই বাবেলের মূর্তিপূজারীরা সিদ্ধান্ত নেয়—এই যুবককে নিরস্ত করার একটাই উপায় আছে, আর তা হলো জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা।

আরও পড়ুনআল্লাহর কাছে যে দোয়া করেছিলেন নবী সোলায়মান (আ.) ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ