বরিশালে প্রতিপক্ষের হামলায় ছাত্রদল নেতার দুই হাত ‘প্রায় বিচ্ছিন্ন’
Published: 9th, March 2025 GMT
ছবি: সংগৃহীত
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
বাংলাদেশ বিনিয়োগ আকর্ষণে কেন পিছিয়ে
বাংলাদেশ না পারছে বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে, না পারছে বাইরে বিনিয়োগ করতে—এ অভিযোগ বহুদিনের। কোনো অন্তর্বর্তী সরকারের সময় যদিও সাধারণত বিনিয়োগ আকর্ষণ প্রধান কাজ থাকে না, এরপরও এই সরকার অতীতের অনেক বিনিয়োগকারীর তিক্ত অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে গ্লানিমোচনে উদ্যোগী হয়েছে। তারই একটি বহিঃপ্রকাশ বিনিয়োগ সম্মেলনের উদ্যোগ।
স্থানীয় পুঁজির দারিদ্র্য কমাতে কিংবা প্রযুক্তি হস্তান্তরের নিমিত্তে বিশ্বের সব দেশের সরকারই বিনিয়োগ আকর্ষণের চেষ্টা করে থাকে। বিনিয়োগ পাওয়ার খাতিরে নানা সুবিধাও দেয়। আমরা জানি, কোভিড অতিমারি, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের নতুন করে আমদানি শুল্ক বৃদ্ধির পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ বাজার এখন অনেক বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ।
বিনিয়োগ থেকে আসে কর্মসংস্থান, বাড়ে রাজস্ব আয়, কমে দারিদ্র্য। তাই স্থানীয় পুঁজির দারিদ্র্য কমাতে কিংবা প্রযুক্তি হস্তান্তরের জন্য বিশ্বের সব দেশের সরকারই বিনিয়োগ আকর্ষণের চেষ্টা করে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই যেকোনো নতুন সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত নতুন বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। যারা ইতিমধ্যে বিনিয়োগ নিয়ে এসেছে, তাদের দেখভাল করা।
২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে নিট এফডিআই প্রবাহ কমেছে সাড়ে ৫ শতাংশ। এফডিআই বাড়াতে দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল ও ৩৯টি হাইটেক পার্ক তৈরি করা হয়েছে। নেওয়া হয়েছে ওয়ান স্টপ সার্ভিস ব্যবস্থা। তবু বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছায়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে আগের তুলনায় নিট এফডিআই প্রবাহ কমেছে ৫ দশমিক ৫২ শতাংশ। একই সময়ে নতুন বিদেশি মূলধনি বিনিয়োগ কমেছে ৪০ দশমিক ৯১ শতাংশ। আর ইকুইটি ক্যাপিটাল স্টক কমেছে ৪ দশমিক ৭ শতাংশ।
আঙ্কটাডের ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট ২০২৩ অনুসারে, ২০১৭-২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে বার্ষিক গড় এফডিআই এসেছে ২৯২ কোটি ডলার, যা জিডিপির শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ। ‘রূপকল্প ২০৪১’ অনুযায়ী, ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত অর্থনীতির দেশে পরিণত হতে হলে বার্ষিক মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ দশমিক ৬৬ শতাংশের সমপরিমাণ এফডিআই পেতে হবে।
যে দেশে দিনদুপুরে নামকরা বিদেশি প্রতিষ্ঠানে লুটপাট হতে পারে, সেই দেশ যে বিনিয়োগ আকর্ষণে অনেক পিছিয়ে পড়বে তাতে সন্দেহ নেই। অর্থনৈতিক সূচকগুলো ঠিক থাকলে, মুনাফা করা গেলে, এমনকি স্বৈরশাসনের দেশেও বিনিয়োগ হয়, কিন্তু যেখানে বিনিয়োগকারীর ওপর হামলা বা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট হয়, সেখানে সম্মেলন করে শত সুন্দর কথা বললেও বিনিয়োগ টানাটা কঠিন।বিশ্বের ৩৫তম বড় অর্থনীতির এই দেশ কেন আশানুরূপ বিদেশি বিনিয়োগ পাচ্ছে না? কেন দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়া সত্ত্বেও জিডিপির হিসাবে এফডিআইয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ? এ অঞ্চলে মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশও জিডিপির শতাংশ হিসাবে এফডিআইয়ে এগিয়ে। ২০২২ সালে মালদ্বীপ এফডিআই পেয়েছে ৭২ কোটি ২০ লাখ ডলার, যা জিডিপির প্রায় ১১ দশমিক ৭০ শতাংশ। ওই বছর ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে পড়া শ্রীলঙ্কা পেয়েছে ৮৯ কোটি ৮০ লাখ ডলার, যা দেশটির জিডিপির ১ দশমিক ২০ শতাংশ। দেশ দুটি মূলত এফডিআই সুরক্ষায় নীতিমালা প্রণয়ন করে তা কার্যকর করেছে। মালদ্বীপ যেমন পর্যটন খাতে মনোযোগ দিয়েছে, শ্রীলঙ্কাও কৃষি, পর্যটন ও তথ্যপ্রযুক্তিতে গুরুত্ব দিয়েছে।
এটি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে বাংলাদেশের নীতিগত ও পরিচালনগত দুর্বলতা রয়েছে। বিদেশি কোম্পানিগুলোর কাছে অনেক বিকল্প থাকায় তারা পছন্দমতো দেশ নির্বাচন করতে পারে। যেসব দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ নিরাপদ, পুঁজি আনয়ন ও প্রত্যাবর্তন সহজ, সুদের হার ও বিনিময় হার যৌক্তিক, দক্ষ শ্রমিক সহজলভ্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল এবং সুযোগ-সুবিধা বেশি, সেসব দেশ তারা বেছে নেয়।
আশির দশক-পরবর্তী ভিয়েতনাম, চীন, মেক্সিকো ও ভারতের মতো দেশ অর্থনৈতিকভাবে বিকাশ লাভ করে। সে সময় দেশগুলো উৎপাদন খাতে এফডিআই আকর্ষণ করতে পেরেছিল। মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূলেও রয়েছে এফডিআই। দেশটিতে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের ক্ষেত্রেও একই। অন্যদিকে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কালে বিনিয়োগ কমেছে। কারণ হিসেবে ব্যবসা সহজীকরণে বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকা, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা, তথ্যের ঘাটতি, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শ্রমিকের অভাবকে বিবেচনা করা যায়। আবার ডলার-সংকট, অর্থ পাচার, দুর্নীতি, অর্থনীতির অস্থিতিশীলতা ও জ্বালানিসংকটের মতো বিষয় তো রয়েছেই।
ইতিমধ্যে এসঅ্যান্ডপি, মুডিস ও ফিচ রেটিংয়ে আমাদের ঋণমানের অবনমন হয়েছে। পাশাপাশি বিদেশি নাগরিকদের কাজের অনুমতি পেতে দেরি কিংবা নিয়োগপ্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা, জমির ইজারা পাওয়ার সমস্যা ও বন্দরে শুল্ক জটিলতার মতো অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে পরিবহন, জ্বালানি, টেলিযোগাযোগ, বিনিয়োগবান্ধব করনীতি ও অবকাঠামোগত চ্যালেঞ্জও প্রকট।
যেকোনো দেশেই নতুন সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত নতুন বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। যারা ইতিমধ্যে বিনিয়োগ নিয়ে এসেছে, তাদের দেখভাল করা। এফডিআই আকর্ষণে সরকারকে ন্যূনতম সম্মানজনক সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায়ও জোর দিতে হবে। বিনিয়োগবান্ধব করনীতি, সহযোগী আইনি পরিবেশ, দ্রুত মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন, রাজনৈতিক টানাপোড়েন হ্রাস, নীতির ধারাবাহিকতা, ইউটিলিটি ও বিনিয়োগ সেবার দিকে একযোগে নজর দিলে বিনিয়োগের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা হয়তো দেখা যাবে। একটি গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক বন্দোবস্তও এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনায় আমাদের সুনাম নেই। বিনিয়োগ আকর্ষণে ৩০ পৃষ্ঠার একটি প্রসপেক্টাস বা ইনফরমেশন মেমোরেন্ডামে প্রায় ২৫ পৃষ্ঠা ধরে বলতে হয় কেন উদ্যোক্তা বা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবে বা করা উচিত। আর ৫ পৃষ্ঠায় বলা হয় কোথায়, কোন খাতে এবং কীভাবে বিনিয়োগ করতে হবে। এখানকার মানুষের মনের ভাব যথাযথভাবে প্রকাশে অদক্ষতা আর দুর্নীতির কথা না বললেই নয়। সেই সঙ্গে আবার যোগ হয়েছে সাম্প্রতিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা আর সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে শ্লথগতি।
যে দেশে দিনদুপুরে নামকরা বিদেশি প্রতিষ্ঠানে লুটপাট হতে পারে, সেই দেশ যে বিনিয়োগ আকর্ষণে অনেক পিছিয়ে পড়বে তাতে সন্দেহ নেই। অর্থনৈতিক সূচকগুলো ঠিক থাকলে, মুনাফা করা গেলে, এমনকি স্বৈরশাসনের দেশেও বিনিয়োগ হয়, কিন্তু যেখানে বিনিয়োগকারীর ওপর হামলা বা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট হয়, সেখানে সম্মেলন করে শত সুন্দর কথা বললেও বিনিয়োগ টানাটা কঠিন।
● মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক