দেশের অর্থনীতিতে নারীর ভূমিকা বেড়েছে। কিন্তু গৃহ থেকে জনপরিসরে নারী নির্যাতন কমেনি। সমাজ নারী নির্যাতনকে স্বাভাবিকীকরণ করছে। বিগত সরকারের সময় যে গোষ্ঠী নিপীড়নের শিকার হয়েছিল, তারাই এখন নারীর প্রতি ‘ফ্যাসিস্ট’ হয়ে উঠছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ রাস্তায় নেমেছিল অপশক্তির পুনর্বাসন করার জন্য নয়। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর হতে হবে।

আজ রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে ‘নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ সমাবেশে’ কথাগুলো বলেন বক্তারা। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক আয়োজিত এই সমাবেশে শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ অংশ নেন।

সমাবেশে সভাপ্রধানের বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন বলেন, গৃহ থেকে শুরু করে জনপরিসরে নারীকে নিপীড়ন করা হচ্ছে। এটা হঠাৎ করে হচ্ছে না। সমাজ এই নির্যাতনকে স্বাভাবিকীকরণ করছে। বাংলাদেশে নারীর অর্থনৈতিক ভূমিকা বেড়েছে। কিন্তু নির্যাতন টিকে আছে। ধর্ষণের শাস্তি পাওয়া অপরাধীও জেল থেকে ছাড়া পাচ্ছে। নির্যাতন যাদের থামানোর কথা, তারা চোখ বন্ধ করে রাখছে। নারী নির্যাতনের ভেতর দিয়ে মানুষকে দমিয়ে রাখা হয়। শুধু ধর্মই নয়, নির্যাতক যখন যেটা সুবিধা মনে করে, সেটাই ব্যবহার করে। নারী ও অন্যান্য লিঙ্গের ওপর নির্যাতন ঠেকানোর দায়িত্ব সবার। নতুন বাংলাদেশ যত দিন না বাস্তবায়িত হবে, তত দিন রাজপথে থাকবেন বলে জানান তিনি।

নারী নির্যাতনের অতীতের ঘটনাগুলোর প্রতিকার পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, নির্যাতনের সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা চলছে। জুলাই-আগস্টের যে চেতনা, তাতে ধর্মীয়ভাবে অন্ধ, সামাজিকভাবে গোরা গোষ্ঠীর পুনর্বাসনের চেষ্টা ছিল না। যারা এখন গর্ত থেকে বের হচ্ছে, তাদের বুঝতে হবে যে জুলাই-আগস্টে সমাজের বিভিন্ন স্তরের যাঁরা রাস্তায় নেমেছিলেন, তাঁরা এ ধরনের অপশক্তিকে পুনর্বাসন করার জন্য নামেননি। এই সরকার আগের সরকারের চেয়ে ভিন্ন কিছু করবে, সেটাই প্রত্যাশা। কিন্তু তা দেখা যাচ্ছে না। রাষ্ট্র ও সরকারের নিষ্ক্রিয়তা কাম্য নয়।

গণ-অভ্যুত্থানের পরের সরকার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না বলে অভিযোগ করেন অধ্যাপক ফাহমিদুল হক। তিনি বলেন, তাদের (অন্তর্বর্তী সরকার) দুর্বলতা প্রতিনিয়ত প্রকট হচ্ছে। এর সুযোগ নিয়ে ছিনতাইকারী, ধর্ষক, ধর্মীয় লেবাসের লোকজন নারীর ওপর পুরোনো ফ্যাসিজম করছে। গত ফ্যাসিজমের সময় ধর্মীয় জনগোষ্ঠী নানাভাবে নিপীড়নের শিকার ছিল। তাদের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের সমবেদনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তারা সেই অনুভূতি ধরে রাখতে পারছে না। তারা নিজেরাই ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠছে, নিপীড়ক হয়ে উঠছে। দুর্বল সরকারের সময় যে যার শক্তি প্রয়োগ করছে।

অধ্যাপক স্বপন আদনান বলেন, আট বছরের শিশুটি (মাগুরার) ধর্ষণের শিকার হয়েছে পরিবারের ভেতরেই। দেশে পরিবারের ভেতর মেয়েদের আশ্রয় ভেঙে যাচ্ছে। নারী নির্যাতনের বিষয়টিকে স্বাভাবিক করা হচ্ছে, সাফাই গাওয়া হচ্ছে। উত্ত্যক্তকারী বীরের সংবর্ধনা পাচ্ছে। সমস্যার শেকড় অনেক গভীরে। প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে। মনোজগৎ পরিবর্তনে কাজ করতে হবে।

সমাবেশে শিক্ষক নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা। তিনি বলেন, ৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক কর্মচারী দ্বারা ‘মোরাল পুলিশিং’ ও যৌন নিপীড়নের শিকার হন। সে ঘটনায় উগ্র সংগঠন থানায় মব সৃষ্টি করে। সন্ত্রাসী অবস্থা তৈরি করলে থানা তাদের কবজায় চলে যায়। তারা থানার ভেতর আটক ব্যক্তির লাইভ ভিডিও প্রচার করে। থানা থেকে বাদীর ব্যক্তিগত তথ্য ছড়িয়ে পড়ে। বাদীকে নানাভাবে হুমকি দেওয়া হয়। যেভাবে অপরাধীকে বিজয়ীর বেশে ছেড়ে দেওয়া হয়, তা সরকারের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার আরেকটি জঘন্য উদাহরণ। এ ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ।

সমাবেশে শিক্ষক নেটওয়ার্ক কতগুলো দাবি তুলে ধরে। এগুলো হলো, থানা থেকে ভুক্তভোগীর তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া এবং অভিযুক্ত ব্যক্তির আবার থানা থেকে অশালীন বক্তব্যে বাধা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় সংশ্লিষ্ট পুলিশের বিচার করা; যাঁরা সাইবার আক্রমণ করছেন, তাঁদের শাস্তি দেওয়া; মব তৈরি করে নারীর অমর্যাদা যাঁরা করছেন, তাঁদের বিচার করা; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সুষ্ঠু তদন্ত করা; যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা।

সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তাসনিম সিরাজ মাহবুব, মোশাহিদা সুলতানা, কাজী মারুফুল ইসলাম, কামাল উদ্দিন, সংস্কৃতিকর্মী সুস্মিতা রায়, ফেরদৌস আরা রুমী, শিক্ষার্থী মুস্তানিক বিল্লাহ। সমাবেশে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের আয়োজনে একই ধরনের প্রতিবাদী সমাবেশ নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সরক র র

এছাড়াও পড়ুন:

নারীর প্রতি সহিংসতা জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার বিরোধী

নারীর প্রতি সহিংসতার যে পরিস্থিতি এখন দেশে দেখা যাচ্ছে, তা জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার বিরোধী বলে মনে করেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারা। তাঁরা বলেছেন, দেশে নাগরিক নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন। এ কারণে নারীর নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়েছে।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসে আজ শনিবার বিকেলে রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে এনসিপি। ‘জনপরিসরে নারীর নিরাপত্তা ও সাইবার সুরক্ষার দাবিতে’ এই সমাবেশ করা হয়।

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রতিটি ধাপে নারীরা যে ভূমিকা দেখিয়েছেন, অভ্যুত্থানের পরে এটাকে অস্বীকার করার পাঁয়তারা চলছে বলে সমাবেশে অভিযোগ করেন এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন। তিনি বলেন, রাষ্ট্র পুনর্গঠনের যে স্বপ্ন তরুণেরা দেখছে, সেখানে রাজনৈতিক নেতৃত্বে নারীদের উঠে আসার জন্য জায়গা করে দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু পুরো রাজনৈতিক কাঠামো ও ব্যবস্থা এর উল্টো দিকে চলছে।

সামান্তা শারমিন বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতার যে পরিস্থিতি এই মুহূর্তে বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে, সেটা কোনোভাবেই জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, বরং বিরোধী। দেশে নাগরিক নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন। এ কারণেই নারীর নিরাপত্তাও হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। জুলাই অভ্যুত্থানে যে ফ্যাসিস্ট কাঠামোর বিলোপের কথা বলা হয়েছিল, সেই ফ্যাসিস্ট কাঠামো এখনো বিলোপ হয়নি। এই কাঠামো বিলোপের জন্য ধারাবাহিক লড়াইয়ের প্রয়োজন আছে। নারীদের অসংযত হতে বাধ্য করবেন না।

নারী ও পুরুষ সমাজে সমান সুযোগ ও অধিকার পাওয়ার যোগ্য—এ কথা এনসিপি দলীয়ভাবে বিশ্বাস করে বলে সমাবেশে উল্লেখ করেন দলের যুগ্ম আহ্বায়ক নুসরাত তাবাসসুম। তিনি বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা এমন চূড়ান্ত রূপে চলে গেছে যে নারীর নাগরিক মর্যাদা, আত্মমর্যাদা ও সামাজিক স্বীকৃতি প্রশ্নবিদ্ধ। ধর্ষণের মতো ঘটনা এখন সমাজে দৈনন্দিন অপরাধের মতো হয়ে গেছে।

সমাবেশে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের কেন্দ্রীয় সংগঠক শ্যামলী সুলতানা জেদনী বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েই চলেছে। নারীরা পারিবারিক সহিংসতার শিকার হচ্ছে, নানাভাবে নির্যাতিত হচ্ছে, নিপীড়িত হচ্ছে, ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশকে একটা ‘অথর্ব রাষ্ট্রে’ পরিণত করছে এই দেশের আইন, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উদ্দেশে শ্যামলী সুলতানা বলেন, ‘নারী নিপীড়ন ও ধর্ষণের সঙ্গে জড়িতদের অতি শিগগির আইনের আওতায় আনবেন এবং তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করবেন। যদি আপনারা সেটা না পারেন, তাহলে বাংলাদেশের নারীরা এই দায়িত্ব বুঝে নেবে।’

নারী দিবস পালন করার আগে নারীকে মর্যাদা দেওয়া, সম্মানের আসনে বসানো ও নারীর অধিকারগুলো সুরক্ষিত করার আহ্বান জানান মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ বস্তিবাসীর প্রতিনিধি ময়না।

‘রাষ্ট্র এক জিনিস, ধর্ম আরেক জিনিস’

শাহবাগের এই সমাবেশে অংশ নেন এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমও। জুলাই অভ্যুত্থানে নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণের কথা তুলে ধরেন তিনি।

সাম্প্রতিক সময়ে নারী নিপীড়ন, হেনস্তা ও ধর্ষণের কয়েকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে সারজিস বলেন, শকুনদের দৃষ্টি থেকে বোনদের রক্ষা করা এখন একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া নারীদের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার করা হচ্ছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন।

সারজিস আলম বলেন, ‘একটি জিনিস স্পষ্ট করে আমাদের দলের পক্ষ থেকে বলি, রাষ্ট্র এক জিনিস, ধর্ম আরেক জিনিস। রাষ্ট্রকে সব ধর্মকে ধারণ করতে হয়। সব চিন্তাধারার মানুষকে ধারণ করতে হয়। এখানে নির্দিষ্ট একটি ধর্মের মানুষ তার বিশ্বাস, রীতিনীতি ও প্রথাগুলো চাইলেই অন্য ধর্মে বিশ্বাসী মানুষের ওপর চাপিয়ে দিতে পারে না। আরেকজন মানুষ যিনি কোনো ধর্মে বিশ্বাসী নন, তাঁকেও চাপিয়ে দিতে পারে না।’

জনপরিসর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানান সারজিস। তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের বোনেদের এই অভ্যুত্থানে, হাসিনাবিরোধী লড়াইয়ে যেমন সামনের সারিতে পেয়েছি, আমরা আমাদের বোনদের আগামীর রাজনীতিতে নীতিনির্ধারণেও সামনের সারিতে চাই।’

সমাবেশে অন্যদের মধ্যে জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ মাসুদ রানার স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস, শিক্ষার্থী তাসমিয়া রহমান প্রমুখ বক্তব্য দেন। সমাবেশের সঞ্চালক ছিলেন এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন ও সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) দ্যুতি অরণ্য চৌধুরী।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নারীর প্রতি সহিংসতা জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার বিরোধী
  • পথে, মাঠে, ঘরে নারীর প্রতি বিদ্বেষ-সহিংসতা