হাওড়া ব্রিজের উপর গাড়ির চাপ আর পথচারীর সংখ্যা অনেক বেশি। ভিড় এতটাই যে মনে হচ্ছে, জনতার নির্বাচনী মিছিল যাচ্ছে ব্রিজের উপর দিয়ে। জীবনে এত মানুষের চলন্ত স্রোত কখনো চোখে পড়েনি। এখানে নাকি দৈনিক ৮০ হাজার যানবাহন এবং প্রায় ১০ লাখ পথচারী চলাচল করে। জনস্রোতের হাওড়া ব্রিজের উপরে হাট বসেছে। পথচারী চলাচলের রাস্তার একাংশ দখল করে কৃষক ও হকারদের দৌরাত্ম্য চলছে। ওরা পথচারীদের কাছে পেঁয়াজ, রসুন আলুসহ নানা রকমের সবজি বিক্রি করছে দেদারসে।
ব্রিজ অতিক্রম করার সময় অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করছে মনে। বেশ খানিকক্ষণ ফটোগ্রাফি আর ব্রিজে হাঁটাহাটির পর, আমরা ব্রিজের শেষ প্রান্তে চলে এলাম। পায়ে হেঁটে হাওড়া পাড়ি দিয়ে একটা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললাম। মনে হলো, ইচ্ছের ষোলোকলা পূর্ণ হয়েছে। অবশেষে ব্রিজ ছুয়ে আশীর্বাদ করে দিলাম- কলকাতার উপস্থাপনের অপরিহার্য প্রতীক হিসাবে ‘হাওড়া ব্রিজ’ তুমি স্বকীয় বৈশিষ্টে উজ্জ্বল হয়ে থাক শত শতাব্দী ধরে। ওপারে আর একটু গেলেই ভারতের সবচেয়ে বড় রেলস্টেশন, হাওড়া।
আমরা ফিরতি পথে ধর্মতলা হয়ে নিউমার্কেট চলে এলাম। নিউমার্কেটে কিছু শপিং করে হোটেলে ফিরে প্রথম দিন অতিবাহিত করলাম।
দ্বিতীয় দিন, সকালে ঘুম থেকে জেগে জানালার কাছে দাঁড়ালাম। আকাশের বুকে চোখ রেখে দেখছি কুয়াশার আড়ালে সূর্য কয়লার মতো জ্বলজ্বল করছে। পিঙ্গল ও কড়া লালের মাঝে উজ্জ্বল হয়ে আছে সূর্যের রঙ। কমলা আলো চারদিক আবছাভাবে ছেয়ে আছে। সফরসঙ্গী লিটু ভাই ভোরে চলে গেছেন তার অসুস্থ আত্মীয়কে দেখতে।
সঞ্জয়দাকে বললাম, দাদা, এত ঘুমালে শরীর খারাপ হয়ে যাবে। ওঠেন, সময় নষ্ট করার মতো সময় হাতে নেই। আজ কলকাতার কোন বিখ্যাত লেখকের বাসায় ঘুরে আসি। তিনি উত্তরে বললেন, দাদা, গতকাল খুব ধকল গেছে। আমাকে আরও ঘন্টাখানেক সময় দিন। একথা বলেই তিনি চোখের খোলা পাতা আবার বন্ধ করলেন। তিনশ বছর বয়সের শহরের অলিগলিতে ইতিহাস আক্ষরিক অর্থেই লেপটে আছে। বিশেষ করে বাংলাসাহিত্যে কলকাতার সাহিত্যিকদের অবদান অনেক। বিংশ শতাব্দীতে কলকাতাকেন্দ্রিক যেসব সাহিত্যিকদের হাত ধরে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বহন করে চলেন শহরের পরবর্তী প্রজন্মের খ্যাতিমান সাহিত্যিকেরা। এদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়সহ আরও অনেকে আছেন। কলকাতা শহরেই জন্মেছিলেন চিত্তরঞ্জন দাস, সত্যজিৎ রায়, সত্যেন্দ্রনাথ বসুসহ আরো অনেক প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব। জীবনমুখী গানের জন্য বিখ্যাত শিল্পী কবীর সুমন, নচিকেতা, অঞ্জন দত্তের জন্মও এই কলকাতায়। ভাবলাম, কলকাতা শহরে এসে অন্তত একজন বিখ্যাত সাহিত্যিকের বাসস্থান পরিদর্শন করা উচিত। আমরা সকালের নাস্তা শেষ করে গরম গরম চা পান করে নিলাম। আমাদের হাতে সময় খুব অল্প, একদিন পর ফিরতি পথের যাত্রী হয়ে রওনা দেব বাংলাদেশে। কলকাতার ঐতিহাসিক কোন স্থানে যাব তার হিসাব মিলাতে পারছি না।
অবশেষে, সঞ্জয়দাকে সাথে নিয়ে মারকুইজ স্ট্রিট থেকে রওনা হলাম জোড়াসাঁকোর উদ্দেশ্যে। কলকাতা শহরে অসংখ্য রোড, স্ট্রিট আর লেনের ছড়াছড়ি। কলকাতা শহরের বেশিরভাগ বিল্ডিংগুলো পুরাতন, যা চলতি পথে চোখে পড়ছে। ট্যাক্সির জানালার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দেখছি, বাতাসের ঝাপটায় রাস্তার দুই ধারের পুরাতন বাড়ির দেয়ালগুলো ক্ষয়ে খাঁজকাটা চিহ্নের সৃষ্টি হয়েছে। অধীর আগ্রহ নিয়ে ভাবছি কখন পৌঁছাব বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে। জোড়াসাঁকোতে প্রবেশের সময় মনে হচ্ছে ইতিহাসের কোন এক অধ্যায়ে প্রবেশ করছি। বিশ্বভারতীর গেট পেরিয়ে সবুজ আঙিনা। গেটের সঙ্গেই টিকিট কাউন্টার। ২০ রুপির টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম, প্রবশ করেই চোখে পড়ল বিশ্বকবির পদচারণায় মুখরিত চোখ ধাঁধানো লাল বিল্ডিং। স্থাপত্যটি ঔপনিবেশিক শৈলী অনুসরণ করে করা হয়েছে। যা লাল ইটের আকর্ষণীয় কাঠামো দেখেই বোঝা যায়। বাড়ির সামনে মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মহর্ষি রবীন্দ্রনাথ। কবিগুরু হাতে বই রেখে সাহিত্যচর্চায় মগ্ন হয়ে আছেন।
নীলমণি ঠাকুরের ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দে নির্মাণ করা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ নীলমণি ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত বাড়িটি আজ গোটা বিশ্বের কাছে পরিচিত। প্রত্যেকটি সাহিত্যমনা বাঙালির কাছে বাড়িটি সাহিত্যের পুণ্যভূমি। ১৮৬১ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ এই বাড়িতেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কবি এই বাড়িতেই তার শৈশব, যৌবন কাটিয়ে ৭ আগস্ট, ১৯৪১ সালে মারা যান। কবির স্মৃতি সংরক্ষণে বাড়িটির এক অংশে মিউজিয়াম এবং অন্য অংশে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সত্যি, ভালো কর্মফল থাকলে ইতিহাস তার পাতায় মৃত মানুষকে জীবন্ত রাখতে পারে অনন্তকাল।
সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলাম। ভবনটির দ্বিতীয় তলায় যাদুঘর এবং সংরক্ষণাগার। এটা ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে থাকা এমন একটা সুন্দর জায়গা, যা ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। সাউন্ড সিস্টেমে অবিরত রবীন্দ্রসংগীত বেজে চলেছে। রবীন্দ্র সুরে মাতোয়ারা হয়ে এক রুম থেকে অন্য রুমে যাচ্ছে দর্শনার্থীরা। বিল্ডিংয়ে রয়েছে সারি সারি রুম। প্রধান দর্শনীয় ঘরের নাম- রবীন্দ্র প্রয়াণকক্ষ। এই ঘরেই বিছানাতেই কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। বিছানাটি ঘেরা রয়েছে কাঠের বেষ্টনীতে। কবির শূন্য বিছানা দেখে মনে হচ্ছে আমরা মাটির মানুষ। তাই মাটিতে ফিরতে বাধ্য করে সময়! সময় সবাইকে স্রোতের মতো টেনে মাটিতে মিশিয়ে সবাইকে অতীত করে দেয়। হোক সে মহা পরাক্রমশালী বা জ্ঞানী!
পাশের রুমে চোখ পড়ল আর্কাইভ করে রাখা হয়েছে কবিগুরুর লেখার প্রয়োজনীয় উপকরণ। আছে কবির ব্যবহৃত পোশাক এবং তার নানান বয়সের ছবি। পাশেই সাহিত্যচর্চা বা লেখার ঘর, গান শোনার জন্য আলাদা আলাদা কক্ষ রয়েছে। কবিগুরু সংসার পেতেছিলেন মৃণালিনী দেবীর সাথে। কবিপত্নীর রান্নার কাজে ব্যবহৃত তৈজসপত্রগুলোও সংরক্ষণিত আছে যথাযথভাবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে ত্রিশটির অধিক দেশ ভ্রমণ করেছিলেন, কবির ভ্রমণকালীন স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য রয়েছে সংগ্রহশালা। চীন ও জাপান ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ইতালি, গ্রিস, তুরস্ক ও মিশর ভ্রমণের স্মৃতিময় বিভিন্ন পত্রপত্রিকার কাটিং ও আলোকচিত্র স্থান পেয়েছে গ্যালারীতে। রবীন্দ্রনাথ যে তরীতে পদ্মা নদীতে ঘুরে বেড়াতেন তার একটি প্রতিকৃতি শোভা পাচ্ছে গ্যালারীতে। জানা গেল, বাংলাদেশ সরকার স্মারক উপহার হিসাবে দিয়েছিলেন কাঠের জাহাজটি।
বাড়ির প্রতি তলার তত্ত্বাবধায়ক নিয়োজিত আছেন। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, দাদা একটা ছবি নেওয়া যাবে? উনি উত্তরে বললেন, জাদুঘরের ভিতরে ফটোগ্রাফি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ, কিন্তু বাইরে অনুমোদিত। আপনি ছবি নিলে কর্তৃপক্ষ আমার চাকরিটা নিয়ে নিবে!
যতই বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি। বাড়িটি কবিগুরু ও তার পূর্বপুরুষদের শিল্পকর্মে ভরপুর। গ্যালারিতে প্রদর্শিত আছে কবিগুরুর আগের কয়েক প্রজন্মের শিল্পকলা ও সাহিত্যকর্ম। আছে পুরুষদের বিভিন্নজনের ছবি ও ডায়াগ্রাম। শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ঠাকুর পরিবারের বিভিন্ন চিত্রকর্ম, তৈলচিত্র, ল্যান্ডস্ক্যাপ, ব্যবহৃত জিনিসপত্র দেখে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি। বিশ্বকবির বাপ-দাদারা কবির জন্মের কয়েকশো বছর আগেও শিল্প সংস্কৃতি ও সাহিত্যচর্চার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল। জোড়াসাঁকোর বাড়ি স্বচক্ষে কেউ পরিদর্শন না করলে তা অনুভব করতে পারবেন না।
ঠাকুরবাড়িতে প্রদর্শিত শিল্পকর্ম পরিদর্শন শেষে তৃতীয় তলার শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। মনে অনুভূত হচ্ছে আমি নিজেও ঠাকুর পরিবারের একজন সদস্য। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ধারণার অপূর্ণতা কেটে গেল তার জন্মস্থান পরিদর্শন করে। পরিদর্শন শেষে বাড়ির ছাঁদে এসে দাঁড়ালাম। পাশেই ছিল রমেশদা, তিনি বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নিয়োজিত আছেন। জোড়াসাঁকোর বাড়ির বিষয়ে তার কাছ থেকে আরও কিছু জানতে চাইলাম। হঠাৎ রমেশদা জোড়া চোখের পাতা উঁচু করে উৎসুকভাবে জানতে চাইলো- দাদা, আপনাদের বাংলাদেশে হিঁদুদের নাকি খুব অত্যাচার করা হচ্ছে? আগে বাংলাদেশের অপূর্ব নামক একটা ছেলের নাটক ভালো লাগতো। নাটক দেখা ছেড়ে দিয়েছি, জাত ভাইদের নির্যাতন করার কারণে! লোকটার কথাগুলো আমাকে চমকে দিল! ভাবলাম ভুলটা ভাঙিয়ে দিই। আমি চট করে সঞ্জয়দার কাঁধের উপর হাত রেখে বললাম, এই যে দাদা, আমরা হিঁদু-মুসলমান একসঙ্গে ভ্রমণে এসেছি। তারপর বললাম, বাংলাদেশে থাকা আপনার জাত ভাইদের নিয়ে যা ভাবছেন তা ঠিক নয়। বেশিরভাগ মিডিয়ার সৃষ্ট গুজব! কথা শুনে রমেশদা বলল, হতে পারে গুজব!
ঠাকুরবাড়ি থেকে মারকুইজ স্ট্রিটের হোটেলে এসে পৌঁছাতে দু’টো বেজে গেল। আমরা ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবারের জন্য বেরিয়ে পড়লাম। কলকাতার খাবার-দাবার দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। মারকুইজ স্ট্রিটের অলিগলিতে হোটেল রেস্তোরাঁয় পরিপূর্ণ। এখানে ভাত, মাছ, মাংস, সবজি, ডিম, আলু ভর্তা, ডালসহ সব ধরনের খাবার সুলভ মূল্যে পাওয়া যায়। খাবার তুলনামূলক ভাবে সস্তা এখানে। বিশেষ করে গরুর গোস্ত একেবারে হাতের নাগালে। কেউ ৫০ রুপি খরচ করল গরুর মাংস পেট ভরে আর ১০০ রুপি খরচ করলে কুরবানির ঈদের মতো খেতে পারবে। আমরা হোটেলে মেন্যুর বাইরে অতিরিক্ত কিছু খাবার আইটেম অর্ডার করলাম। অর্ডার নেওয়ার সময় হোটেল বয়ের চোখ চড়কগাছ হয়ে গেল। ও বলল- দাদা, এত আইটেম নিয়ে কেন পয়সার অবচয় করবেন! আমি আপনাদের অতিরিক্ত একটা বা দুটো আইটেম এনে দিচ্ছি। পাশ থেকে একজন বলল- হ্যাঁ দাদা, এটাই ভালো হবে। অহেতুক এত খাবার কেন কিনবেন? শুনেছিলাম এই কলকাতা শহরে গল্প হয়, আড্ডা হয়। তবে, এক কাপ চায়ের দাম মেটাতে 'আমি দিচ্ছি, আমি দিচ্ছি' বলে মুখে মুখে যুদ্ধ হলেও মন থেকে কেউ দাম মেটাতে রাজি নয়। কেউ কাউকে এখানে পুরো বা আধা সিগারেট বাড়িয়ে দেয় না আন্তরিকতায়। যার যার হিসাব ষোল আনা বুঝে সবাই। এটি যে ফাঁকা বুলি নয়, আমাদের অর্ডার করা খাবারে ওদের হিসেবের নমুনা দেখে আচ করতে পারলাম।
হোটেলে ফিরে ভাবছি, শেষ বিকেলে কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে পছন্দের লেখকের কিছু বই সংগ্রহ করব। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন শেষে, বিখ্যাত সেই কফি হাউসের কপির কাপে চুমুক হবে। সফরসঙ্গী লিটু ভাই দুই হাতে শপিং ব্যাগ নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে চলে আসলেন। সঞ্জয়দা জানিয়ে দিল, কিছুক্ষণ পর সবাই নিউ মার্কেটে যাব শপিং করতে। কলকাতার ‘নিউ মার্কেট’ ১৮৭৪ সালে ইংরেজদের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এটিই কলকাতার প্রথম মিউনিসিপ্যাল মার্কেট। মারকুইস স্ট্রিট থেকে পায়ে হেঁটে যাওয়ার পথ নিউ মার্কেট। আমরা বিকালে শপিং করতে যখন নিউ মার্কেটের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। আকাশের ঘন কুয়াশা তখন সূর্যকে ঢেকে রেখেছে। চলতি পথে চোখে পড়ছে বিলবোর্ডে বড় বড় অক্ষরে বাংলা লেখা। বিশ্বাসই হচ্ছে না আমরা বাংলাদেশ ছেড়ে অন্য দেশে এসেছি। মনে হচ্ছে, এ যেন কলকাতার বুকে এক টুকরো বাংলাদেশ। সবাই বাংলা বোঝেন, বাংলাতেই কথা বলেন।
বাংলাদেশের যত মানুষ কলকাতায় আসে, তার বেশিরভাগ আসে চিকিৎসা নিতে। ঈদে অল্প খরচে শপিংয়ে উৎসাহী বাঙালিদের প্রত্যাশিত গন্তব্য নিউ মার্কেটে। তখন নাকি বাংলাদেশের মানুষে নিউ মার্কেট, মার্কুইজ স্ট্রিট গিজগিজ করে। আগেই শুনেছিলাম, নিউ মার্কেটে অসংখ্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশিদের জন্য গড়ে উঠেছে। করোনাকালীন নিউ মার্কেটের ব্যবসা যেমন মন্দা ছিল বাংলাদেশীরা না-আসতে পারার কারণে, আমাদের ভ্রমণকালীনও একই অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কারণ শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ইন্ডিয়া পালিয়ে আসার পর অশান্তির জেরে ইন্ডিয়া বাংলাদেশীদের ভিসা দেওয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবের ধাক্কায় কলকাতায় বাংলাদেশি পর্যটক প্রায় নেই বললেই চলে। আমাদের মতো যারা আগে ভিসা নিয়েছিল তারাই আসতে পারছেন ইন্ডিয়া।
রাস্তার ধারে, চোখে পড়ছে মুখরোচক মোমো, ফুচকা, রোল, কাবাব, সিঙ্গারা, চপ, বিরিয়ানি, বিভিন্ন রকম ফলের জুস। স্ট্রিট ফুডের জন্যও বিখ্যাত এই শহর। আমরা মাঝপথে বিরতি নিয়ে প্রতি গ্লাস ৫০ রুপিয়া করে আঙুর আর আনারের টাটকা জুস খেয়ে নিলাম। নিউ মার্কেট পৌঁছে দেখছি, জুতা, কাপড়, আর প্রসাধনীর দোকানগুলোতে উপচে পড়া ভিড়। হাঁটতে গিয়ে অন্য পথচারীদের সঙ্গে ধাক্কা লেগে যাচ্ছে। এখানে সুবিধা হচ্ছে নির্দিষ্ট আইটেমের দোকান আলাদা ব্লকে সাজানো। আমরা শ্রী কালি লেদার থেকে জুতা, ব্যাগ, মানিব্যাগ সস্তায় কিনে নিলাম। শপিং করতে করতে সন্ধ্যা নেমে এলো। রঙিন ব্যানার ও আলোকসজ্জার মধ্যে ক্রেতা-বিক্রেতার দর কষাকষিতে প্রাণবন্ত হয়ে উঠলো নিউ মার্কেট। শোরুম ছাড়াও এখানে অস্থায়ী ছোট ছোট তাঁবু টেনে বসেছে স্বল্প দামের বিপণি। শত বছরের সংস্কৃতি মিশে থাকা কোলাহলপূর্ণ রাস্তায় আছে হরেকরকমের ফেরিওয়ালা। দোকানের বাইরের চকচকে লাইটগুলো রাস্তাকে আলোকিত করে রেখেছে।
উৎসবমুখর পরিবেশে কেনাকাটা করে ভ্রমণের আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে গেল। ইন্ডিয়ার হরেক রকম পণ্যগুলো শৈল্পিক ও শৌখিন হৃদয়ের মানুষকে হাত ছানিতে কাছে টানে। ভ্রমণের বাজেট যত ছিল তার পুরোটা খরচ করে আমাকে সহকর্মীদের থেকে দশ হাজার রুপি নিতে হলো। আমরা কলকাতা বাজার, বিগ বাজার হতে অন্য কিছুর তুলনায় কসমেটিকস বেশি নিলাম। ইন্ডিয়ান একই ব্র্যান্ডের কসমেটিকস বাংলাদেশের বাজারে তিনগুণ দামে কিনতে হয়। আমরা শপিং শেষে হোটেলে ফিরে এলাম। বাংলাদেশে ফিরতি পথের যাত্রার জন্য রতেই বাসের টিকেট কেটে রাখলাম।
পরদিন সকালে কলকাতা থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। কলকাতা শহরের প্রতি একটা টান অনুভব করছি মনের গহীনে। এই শহরে ঘুরে বেড়ানোর সদ্য স্মৃতি আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে পিছনে। ভাবছি, কলকাতা শহর ছেড়ে যাওয়ার পর স্মৃতিরা ভবিষ্যতেও মস্তিষ্কে ভিড় করবে। হয়ত মাস পেরিয়ে বছর আর বছর পেরিয়ে যুগ চলে আসবে। দীর্ঘ সময় দেখা না হলেও ওপার বাংলার কথা মস্তিষ্কের অন্দরমহলে স্থায়ী হয়ে থাকবে। ভ্রমণের স্মৃতিচারণা করে অনেক গল্প হবে পরিচিতদের সঙ্গে। দেশভাগের আগে দুই বাংলার মাঝে কোনো সীমানার দেয়াল ছিল না। এপার ওপার বাংলার মানুষ আনন্দ উৎসবে একসাথে উড়াত বিজয় কেতন। এক সময় দুই বাংলার মানুষের একে অপরের সাথে দেখা করতে ভিসা পাসপোর্ট লাগতো না। দেশভাগের সময় বৃটিশরা রাজনীতির কুটখেলায় অবিভক্ত বাংলাকে বিভক্ত করে দিয়ে গেছেন। এই বিভাজনের দেয়াল আর ভাঙবে না কখনো। এপারের বাংলা ওপারের বাংলার সান্নিধ্য আর সংস্কৃতি থেকে বঞ্চিত হবে অনন্তকাল। এটি হয়ত দেশ বিভাজনের সময় তলিয়ে দেখেনি বাঙালি। হয়ত দেখার মতো চোখও তখন তাদের ছিল না।
তারা//
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ক ইজ স ট র ট রব ন দ র ভ রমণ র কলক ত র কলক ত য় ইন ড য় আম দ র র জন য আইট ম র উপর পথচ র র সময় শহর র
এছাড়াও পড়ুন:
বিষ দিয়ে তিনটি গরুকে মেরে ফেলার অভিযোগ
মাটির দেয়ালে জং ধরা টিনের চাল। সেই চালের এক পাশে পোষা তিনটি গাভি, আরেক পাশে স্ত্রী–সন্তানদের নিয়ে বসবাস। গাভির দুধ বিক্রি করে চলত সংসার। বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন গাভি তিনটি হারিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন দিনমজুর আজিজুল ইসলাম।
আজিজুল ইসলামের অভিযোগ, তাঁর গরু তিনটিকে বিষ দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। এ ঘটনায় তিনি প্রতিবেশী মজনু মিয়ার নামে থানায় অভিযোগ দিয়েছেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মজনু মিয়া বলেন, ‘আমি কেন গরু মারতে যাব! আমাকে ফাঁসানোর জন্য মিথ্যা তথ্য রটানো হচ্ছে।’
আজিজুল ইসলামের বাড়ি রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ফাজিলপুর গ্রামে। গতকাল শনিবার রাতে তাঁর ঘরে থাকা গাভি তিনটি মারা যায়। প্রাণিসম্পদ বিভাগ মারা যাওয়া গরু তিনটির মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত করতে ময়নাতদন্ত করছে।
আজিজুলের পরিবার ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁর বসতভিটা ছাড়া কোনো জমি নেই। দরিদ্র হওয়ায় আজিজুল ইসলামের শ্বশুর মহির উদ্দিন ১০ বছর আগে একটি ফ্রিজিয়ান জাতের বকনা বাছুর দেন। সেই বাছুর লালন–পালন করার পর পূর্ণবয়স্ক হয়ে অনেকগুলো বাছুর জন্ম দেয়। এর মধ্যে তিনটি বকনা বাছুর পালন করে গাভিতে পরিণত করেন আজিজুল। সেই গাভির দুধ বিক্রি করে পাঁচ সদস্যের সংসার চলত। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার বাড়ির অদূরেই বাঁশঝাড়ে গাভি তিনটি বেঁধে রাখার পর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যায়। এরপর গতকাল শনিবার রাতে তিনটি গাভি মারা যায়। তিনটি গাভির মূল্য প্রায় তিন লাখ টাকা।
রোববার বিকেলে সরেজমিনে দেখা যায়, একসঙ্গে তিনটি গরু মারা যাওয়া আজিজুল ইসলামের বাড়িতে স্থানীয় লোকজনের ভিড়। উঠানের সামনে ময়নাতদন্ত করছে প্রাণিসম্পদের দল।
বাড়ির বারান্দায় বসে কাঁদছিলেন আজিজুলের স্ত্রী স্বপনা বেগম। এ সময় আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘হামার গ্রামের মজনুর সাথে মোর ঝগড়া চলছে। মজনু ২০ দিন আগোত হুমকি দিছিল, মোক নিঃস্ব করি দিবে, মোর সংসার ফকির করতে যা করা লাগে করবে। মজনু ওর কথা পালন করছে, মোক ফকির বানাইল। এ্যালা মুই নিঃস্ব। ওয় মোর গরু বিষ দিয়ে মারি ফেলাইছে। গরুগুলার কী দোষ? ওয় মোক মারত। মুই ওর বিচারের জন্যে থানায় অভিযোগ দিছি। মুই সঠিক বিচার চাই।’
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা এ কে এম ইফতেখায়ের বলেন, ‘অভিযোগ পাওয়ার পর টিম নিয়ে আজিজুল ইসলামের বাড়িতে যাই। গাভিগুলোর প্রকৃত মৃত্যুর কারণ ময়নাতদন্তের পর জানা যাবে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তারাগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাইদুল ইসলাম বলেন, তিনটি গরু মারা যাওয়ার ঘটনায় মালিক থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখা হচ্ছে।