মধ্যপ্রাচ্যকে ছাড়িয়ে প্রবাসী আয়ের শীর্ষে পশ্চিমা দেশগুলো
Published: 9th, March 2025 GMT
দেশের প্রবাসী আয়ের গতিপথে বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। একসময় বাংলাদেশের প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সের সবচেয়ে বড় উৎস ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), কাতার, ওমান, কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে পেছনে ফেলে এখন প্রবাসী আয়ের বড় উৎস হিসেবে উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। গত বছরের আগস্টে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর প্রবাসী আয়ের শীর্ষ উৎস হিসেবে তালিকায় উঠে আসে যুক্তরাষ্ট্রের নাম। সর্বশেষ গত জানুয়ারি মাসে সৌদি আরব ও ইউএইকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠেছে যুক্তরাজ্য।
প্রবাসী আয়সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে এ চিত্র পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বশেষ প্রবাসী আয় প্রেরণের শীর্ষস্থানীয় উৎসগুলোর জানুয়ারি মাসভিত্তিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, জানুয়ারিতে প্রবাসীরা দেশে যে পরিমাণ প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন, তার প্রায় এক–তৃতীয়াংশই এসেছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে। এই মাসে মোট প্রবাসী আয় এসেছিল প্রায় ২১৯ কোটি মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ৬৮ কোটি ডলার বা ৩১ শতাংশই এসেছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে।
গত ডিসেম্বর মাসেও প্রবাসী আয় প্রেরণকারী শীর্ষ দেশের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)। সে মাসে দেশটি থেকে ৩৭ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় এসেছিল। ডিসেম্বরের এ–সংক্রান্ত তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে ছিল সৌদি আরব। ওই মাসে দেশটি থেকে এসেছিল ২৯ কোটি ডলার। আর চতুর্থ অবস্থানে ছিল মালয়েশিয়া। মে মাসে মালয়েশিয়া থেকে প্রায় ২৬ কোটি ডলার প্রবাসী আয় এসেছিল। ডিসেম্বরে প্রবাসী আয়সংক্রান্ত তালিকায় পঞ্চম অবস্থানে ছিল যুক্তরাজ্য। ওই মাসে দেশটি থেকে প্রবাসী আয় এসেছিল প্রায় ২৫ কোটি ডলার।
ডিসেম্বরে পঞ্চম অবস্থানে থাকা যুক্তরাজ্য জানুয়ারিতে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে আসে। এই মাসে সে দেশ থেকে প্রায় সোয়া ২৭ কোটি ডলার প্রবাসী আয় দেশে এসেছে। এক মাসের ব্যবধানে যুক্তরাজ্য থেকে প্রবাসী আয় সোয়া ২ কোটি ডলার বা সোয়া ৯ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এর বিপরীতে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ও সৌদি আরব থেকে প্রবাসী আয় ডিসেম্বরের তুলনায় জানুয়ারিতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। এ কারণে প্রবাসী আয় প্রেরণকারী দেশের তালিকায় শীর্ষ দুই আসন দখল করে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য।
তবে প্রবাসী আয় প্রেরণকারী দেশের তালিকায় যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষস্থানে থাকলেও ডিসেম্বরের তুলনায় জানুয়ারিতে দেশটি থেকে রেমিট্যান্স আসা কমেছে। ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রবাসী আয় এসেছিল সাড়ে ৫৬ কোটি ডলার। জানুয়ারিতে দেশটি থেকে এসেছে প্রায় ৪১ কোটি ডলার। সেই হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রবাসী আয় আসা প্রায় ১৫ কোটি ডলার কমেছে। তা সত্ত্বেও দেশটি শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে।
যদিও ডিসেম্বরের তুলনায় জানুয়ারিতে প্রবাসী আয় আসা সার্বিকভাবে কমেছে। ডিসেম্বরে যেখানে ২৬৪ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় এসেছিল, জানুয়ারিতে তা কমে ২১৯ কোটি ডলারে নেমেছে। বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসী আয় কমে যাওয়ায় সার্বিকভাবে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের আগস্ট মাসেও দেশে প্রবাসী আয় প্রেরণকারী দেশের তালিকায় শীর্ষে ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)। সেপ্টেম্বরে দেশটিকে পেছনে ফেলে শীর্ষে জায়গা করে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। এর পর থেকে শীর্ষস্থানে রয়েছে দেশটি। সেপ্টেম্বরের পর জানুয়ারিতে এসে আরেকটি বড় পরিবর্তন দেখা যায় তালিকায়। এবারে পঞ্চম স্থান থেকে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে যুক্তরাজ্য।
প্রবাসী আয় প্রেরণকারী বড় প্রতিষ্ঠানগুলো এখন সব দেশ থেকে আয় সংগ্রহ করে এরপর তা নির্দিষ্ট একটি দেশ থেকে তা গন্তব্যে (প্রাপক দেশ) পাঠায়। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশ থেকে প্রবাসী আয় আসার পরিমাণ হঠাৎ বেড়ে গেছে। সৈয়দ মাহবুবুর রহমান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রবাসী আয় প্রেরণের ক্ষেত্রেও বিশ্বজুড়ে বড় পরিবর্তন এসেছে। বড় যেসব প্রতিষ্ঠান প্রবাসী আয় প্রেরণের সঙ্গে যুক্ত, সেগুলো এখন সমন্বিত পদ্ধতিতে প্রবাসী আয় সংগ্রহ ও প্রেরণ করে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠান যে দেশে নিবন্ধিত সেখান থেকেই প্রবাসী আয় প্রেরণ করছে। ফলে দেশে আসা প্রবাসী আয় ওই দেশের আয় হিসেবে নথিভুক্ত হচ্ছে।
জানতে চাইলে বেসরকারি খাতের মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, প্রবাসী আয় প্রেরণকারী বড় প্রতিষ্ঠানগুলো এখন সব দেশ থেকে আয় সংগ্রহ করে এরপর তা নির্দিষ্ট একটি দেশ থেকে তা গন্তব্যে (প্রাপক দেশ) পাঠায়। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশ থেকে প্রবাসী আয় আসার পরিমাণ হঠাৎ বেড়ে গেছে।
ব্যাংকাররা বলছেন, প্রবাসী আয় প্রেরণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন, মানিগ্রামসহ বড় প্রতিষ্ঠানগুলো অ্যাগ্রিগেটেড (সমন্বিত) পদ্ধতিতে প্রবাসী আয় সংগ্রহের পর তা প্রেরণ করে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় যে দেশে সে দেশ থেকে প্রবাসী আয় আসা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে প্রবাসী আয়ের উৎস দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নাম নথিপত্রে লিপিবদ্ধ হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারিতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, কুয়েত, ওমান, কাতার, বাহরাইন, জর্ডান, ইরাক ও লেবানন থেকে মোট প্রবাসী আয় এসেছে ৯৫ কোটি ডলার। এর বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে এসেছে ৬৮ কোটি ডলার। এর বাইরে প্রবাসী আয় আসার বড় উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে ইউরোপের দেশ ইতালি, ফ্রান্স, গ্রিস, পতুর্গালও।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ত য় অবস থ ন ড স ম বর র র প রব স পর ম ণ
এছাড়াও পড়ুন:
চীন ও ইউরোপ কীভাবে মার্কিন শুল্ক ঝড় রুখবে
অ্যাডাম স্মিথের লেখা বিখ্যাত বই দ্য ওয়েলথ অব ন্যাশনস অর্থনীতির জগতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছিল। স্মিথ বলেছিলেন, ভাগ ভাগ করে কাজ করলে উৎপাদন ও দক্ষতা বাড়ে। দেশগুলোর মধ্যেও এই একই নিয়ম প্রযোজ্য। যে দেশ যেটা সবচেয়ে ভালো করতে পারে, সেটাই উৎপাদন করবে এবং অন্য দেশের সঙ্গে বিনিময় করবে। কিন্তু শুল্ক বা ট্যারিফের মতো বাধাগুলো এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে, অর্থনীতিকে করে তোলে অকার্যকর এবং শেষ পর্যন্ত ক্ষতিই বেশি হয়।
এই সুপ্রতিষ্ঠিত তত্ত্বের পরও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও শুল্কনীতির পক্ষে সওয়াল করছেন। তিনি দাবি করেন, শুল্ক আরোপের মাধ্যমে ‘আমেরিকাকে আবার মহান’ করে তোলা যাবে। ট্রাম্পের ‘পারস্পরিক শুল্কনীতি’ অনুযায়ী, যেসব দেশ আমেরিকান পণ্যে শুল্ক বসায়, তাদের পণ্যের ওপর আমেরিকাও পাল্টা শুল্ক আরোপ করবে। এতে নাকি আমেরিকার শিল্প এবং চাকরি রক্ষা পাবে এবং রাজস্বও বাড়বে।
শুল্ক আসলে কী করেকিন্তু বাস্তব চিত্রটা ভিন্ন। শুল্ক মূলত ভোক্তা ও ব্যবসার ওপর একধরনের করের মতো কাজ করে। এতে আমদানি করা পণ্যের দাম বাড়ে, যার ফলাফল হয় মূল্যস্ফীতি। যেসব শিল্প বিদেশি কাঁচামাল ব্যবহার করে, তাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায় আর এই বাড়তি খরচ পড়ে সাধারণ ক্রেতার ঘাড়ে। অন্যদিকে প্রতিশোধমূলক শুল্ক বসিয়ে অন্যান্য দেশও পাল্টা পদক্ষেপ নেয়। ফলে মার্কিন রপ্তানিকারকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বিদেশি বাজার হারায় এবং এর প্রভাবে চাকরি হারান বহু মানুষ। এককথায়, সাময়িক যে রাজস্ব আসে, তা এই আর্থিক ক্ষতির তুলনায় নেহাতই সামান্য।
বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, এই ‘পারস্পরিক শুল্কনীতি’ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রাজিল এবং ভারতকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির আশঙ্কায় আছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইইউ। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের মূল লক্ষ্য ইউরোপের এমন সব খাত, যেগুলোর প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান অনেক শক্তিশালী। বিশেষ করে ইউরোপের গাড়িশিল্প এই শুল্কের বড় শিকার হতে পারে।
সেই সঙ্গে যন্ত্রপাতি, ওষুধ এবং মহাকাশপ্রযুক্তি—এ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ খাতও মারাত্মকভাবে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে শুল্কসংক্রান্ত উত্তেজনা চলতে থাকলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিতে পারে।
সব মিলিয়ে বিশ্বব্যাপী পারস্পরিক সহযোগিতা ও মুক্তবাণিজ্যের বদলে যদি দেশগুলো একে অপরের ওপর শুল্ক চাপিয়ে দেয়, তাহলে ক্ষতিটা সবারই হবে।
আরও পড়ুনবিশ্ব চালাবে কে—চীন নাকি ইউরোপ২০ ঘণ্টা আগেইউরোপ যে ঝামেলায় পড়েছেএই মুহূর্তে ইউরোপীয় গাড়ি নির্মাতারা কঠিন এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন। একদিকে বৈদ্যুতিক গাড়ির উৎপাদনে চীন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। অন্যদিকে ট্রাম্প প্রশাসনের চাপও ক্রমেই বাড়ছে। চীনা কোম্পানিগুলোর উদ্ভাবন ও উৎপাদনদক্ষতা ইউরোপীয় গাড়িশিল্পের জন্য একটা বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে ইউরোপ এখনো পুরোপুরি প্রস্তুত নয়।
এর মধ্যে আরও চাপ তৈরি করছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বড় বড় ইউরোপীয় কোম্পানিকে যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদনকেন্দ্র সরিয়ে আনার জন্য চাপ দিচ্ছেন। তাঁর যুক্তি, এতে আমেরিকায় চাকরি তৈরি হবে এবং অর্থনীতি মজবুত হবে।
অথচ ইউরোপ ও অন্যান্য দেশ থেকে আসা শিক্ষিত পেশাজীবীদের অভিবাসনের মাধ্যমেও যুক্তরাষ্ট্র অনেক লাভবান হচ্ছে। ইলন মাস্কের কথাই ধরা যাক। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় বড় হয়েছেন, পড়ালেখা করেছেন কানাডায় এবং পরে যুক্তরাষ্ট্রে এসে টেসলা ও স্পেসএক্সের মতো বৈপ্লবিক কোম্পানি গড়ে তুলেছেন।
ইউরোপিয়ান কাউন্সিল প্রেসিডেন্ট, চীনা প্রধান মন্ত্রী ও ইউরোপিয়ান কমিশন প্রেসিডেন্ট বেইজিং-এ এক সংবাদ সম্মেলনে, জুলাই ২০১৮