মধ্যরাতে উত্তাল ঢাবি, ধর্ষকদের মৃত্যুদণ্ড দাবি
Published: 8th, March 2025 GMT
ধর্ষকদের প্রকাশ্যে ফাঁসির দাবি জানিয়ে মশাল মিছিল করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের ছাত্রীরা। এ ছাড়া রাত সাড়ে ১২টার দিকে ছাত্রীদের আরেকটি মিছিল বের হয়।
শনিবার সন্ধ্যায় সাড়ে ৭ টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের সামনে থেকে মিছিলটি শুরু হয়ে ভিসি চত্বর প্রদক্ষিণ করে পুনরায় রোকেয়া হলের সামনে আসে। মিছিলে তারা ধর্ষকদের প্রকাশ্য মৃত্যদণ্ড কার্যকর এবং বিগত বছরগুলোতে যারা ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিচার নিশ্চিতের দাবি জানান ছাত্রীরা।
মিছিলে তারা ‘ধর্ষকদের গদিতে, আগুন জ্বালো একসাথে’, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস, হ্যাঙ্গ দ্যা রেপিস্ট’, ‘সারা বাংলায় খবর দে, ধর্ষকদের কবর দে’সহ নানান স্লোগান দেন।
মিছিল শেষে রোকেয়া হলের শিক্ষার্থীরা হলের সামনে জড়ো হন। মাগুরায় একটি শিশুকে ধর্ষণের ঘটনায় তারা এক মিনিট নিরবতা পালন করেন। এরপর একজন নারী শিক্ষার্থী স্লোগান দেন, ‘আমরা কি ধর্ষকদের বাইরে দেখতে চাই?’ তখন বাকি ছাত্রীরা সমস্বরে ‘না’ বলে ওঠেন।
রোকেয়া হলের ছাত্রী ফারজানা আক্তার আরজু বলেন, ‘সম্প্রতি আছিয়া নামে একটি শিশুর সঙ্গে যে ঘটনা ঘটেছে, তার সঙ্গে দুজন পুরুষ ও একজন মহিলা জড়িত। এই ধর্ষকদের আমরা প্রকাশ্য ফাঁসি চাই। যে মহিলা সহযোগী ছিল, তারও ফাঁসি চাই। ধর্ষণ প্রমাণিত হলে, তার একমাত্র শাস্তি হবে প্রকাশ্য ফাঁসি। আমরা আর গ্রেপ্তার গ্রেপ্তার নাটক আর দেখতে চাই না। শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত আমরা শান্ত হব না।’ তিনি বলেন, ‘আমরা প্রশাসনকে সতর্ক করতে চাচ্ছি। বিগত বছরগুলোতে যতগুলো ধর্ষণ হয়েছে, সবগুলোর বিচার করতে হবে। সরকার যদি একটা ফাঁসি দেয়, তাই দৃষ্টান্ত হয়ে যাবে।’
হলের আরেক শিক্ষার্থী আদিবা সায়মা খান বলেন, ‘আমরা ধর্ষকদের স্থায়ী শাস্তি চাচ্ছি। আমরা যদি বাইরে বের হই এবং আমাদের যদি নিরাপত্তাই না থাকে, তাহলে এই রাষ্ট্র আমাদের কী দিচ্ছে। সরকারের দায়িত্ব আমাদের নিরাপত্তা দেওয়া। আইন-শৃঙ্খলা উন্নত করা। ধর্ষকদের এমন শাস্তি দেওয়া যেন অন্যকেউ পুনরায় সেরকম চেষ্টাও না করতে পারে।’
এ দিকে দেশব্যাপী সংগঠিত ধর্ষণ, নারী বিদ্বেষী মবের আগ্রাসন এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ধর্ষণবিরোধী গণপদযাত্রা করেছে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ। শনিবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য থেকে ক্যাম্পাসে পদযাত্রাটি অনুষ্ঠিত হয়।
গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের নেতারা বলেন, ফ্যাসিবাদী প্রশাসনিক কাঠামো ভাঙতে না পেরে আমাদের রাষ্ট্র নারীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। বয়স, পেশা, ধর্ম নির্বিশেষে নারীরা ধর্ষিত হচ্ছে, তাদেরকে হত্যা করা হচ্ছে।
গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের আহবায়ক আবু বাকের মজুমদার বলেন, নারীরা নিজের ঘরে নিরাপদ না, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিরাপদ না, কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ না। আইন শৃঙ্খলাবাহিনী নারীর প্রতি ঘটা সহিংসতাকারীদেরকে শনাক্ত করতে প্রায়ই ব্যর্থ হয়, আটক করলেও জামিনে ছেড়ে দেওয়া হয়। আইন মোতাবেক সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড লিখিত থাকলেও তা কার্যকর করা হয় না।
তিনি বলেন, আমরা মনে করছি, কাঠামোগতভাবে এই রাষ্ট্র ধর্ষণ প্রতিরোধ করতে সক্ষম না, আমরা মনে করি আইনগত দূর্বলতা বাংলাদেশে ধর্ষক তৈরি করে। আমরা এখানে দাঁড়িয়েছি ধর্ষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে, নারীবিদ্বেষী আগ্রাসী মব, বিচারহীনতার বিরুদ্ধে। এমতাবস্তায়, আইনের যথাযথ প্রয়োগ করে ধর্ষকদের শ্রেণি, বয়স, পেশা, ক্ষমতা নির্বিশেষে দ্রুততম সময়ে শনাক্তকরণ করতে হবে, আটক করতে হবে, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
ইসরায়েল হত্যা করে, মিথ্যা বলে, আর পশ্চিমা মিডিয়া তা বিশ্বাস করে
ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ও সিভিল ডিফেন্সের ১৫ জন সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। তাঁরা যোদ্ধা ছিলেন না। সন্ত্রাসীও ছিলেন না। তাঁদের কাছে কোনো রকেট বা অস্ত্র ছিল না। তাঁরা ছিলেন ত্রাণকর্মী, মানবতার সেবক। যখন যেখানে বোমা ফেলা হচ্ছিল, সেখানেই তাঁরা আহতদের সাহায্য করতে ছুটে গিয়েছিলেন। তাঁরা নিজের জীবন বাজি রেখে অন্যদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন।
এর আগে গত ২৩ মার্চ গাজার দক্ষিণে রাফা এলাকায় ইসরায়েলি বাহিনী একটি অ্যাম্বুলেন্স ও জরুরি সেবার গাড়ির বহরকে লক্ষ্য করে হামলা চালায়। এতে আটজন রেড ক্রিসেন্টের কর্মী, ছয়জন ফিলিস্তিনি সিভিল ডিফেন্সের কর্মী এবং একজন জাতিসংঘের কর্মী নিহত হন। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী দাবি করেছিল, এই গাড়িগুলো ছিল অপরিচিত। সন্দেহ করা হয়েছিল, গাড়ির মধ্যে যোদ্ধারা ছিলেন, কিন্তু এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ছিল।
রিফাত রাদওয়ান নামে নিহত চিকিৎসাকর্মীদের একজনের মোবাইল ফোন থেকে পাওয়া ফুটেজে দেখা যায়, গাড়িগুলোতে স্পষ্টভাবে লালবাতি জ্বলছিল; সেগুলো চিহ্নিত অ্যাম্বুলেন্স ছিল এবং কোথাও কোনো অস্ত্র দেখা যায়নি। তারপর শুরু হয় ইসরায়েলি বাহিনীর প্রচণ্ড গুলি।
পরে রিফাতের মরদেহ আরও ১৩ জনের সঙ্গে একটি গণকবরে পাওয়া যায়। তাঁদের কয়েকজনের দেহে সরাসরি হত্যার চিহ্ন ছিল—মাথা বা বুকে গুলি লেগেছিল। কারও কারও হাত বাঁধা অবস্থায় ছিলেন।
মৃত্যুর পরও তাঁদের প্রমাণ দিতে হলো যে তাঁরা ত্রাণকর্মী ছিলেন।
তারপরও পশ্চিমা গণমাধ্যমের বড় অংশ প্রথমেই ইসরায়েলের কথাই প্রচার করল, ‘ইসরায়েল বলছে…’, ‘আইডিএফ দাবি করছে…’, ‘একজন সামরিক সূত্র জানিয়েছে…।’ এসব কৌশলে সাজানো বাক্য যেন রেড ক্রিসেন্টের রক্তমাখা ইউনিফর্মের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়। যেন তারা সত্যের চেয়ে বেশি ‘সত্য’।
এটা নতুন কিছু নয়। এটা একবারের ভুলও নয়।
এটাই একটা সিস্টেম।
এখানে ফিলিস্তিনিদের শুধু বেঁচে থাকাই অপরাধের মতো মনে করা হয়। আমাদের অস্তিত্বকেও সন্দেহের চোখে দেখা হয়—প্রথমে সবাইকে বোঝাতে হয় যে আমরা কোনো হুমকি নই, আমাদের জীবনও মূল্যবান, তারপর হয়তো কেউ আমাদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করবে। এটাই হচ্ছে মানবতা হারানোর আসল রূপ।
আমি গাজায় জন্মেছি, সেখানেই বড় হয়েছি। আমি জানি, রেড ক্রিসেন্টের ইউনিফর্মের অর্থ কী। এর মানে হলো, সব শেষ হয়ে গেলেও আশার একটা আলো আছে। এর মানে হলো, কেউ আসছে সাহায্য করতে—লড়াই করতে বা হত্যা করতে নয়, জীবন বাঁচাতে। এর মানে হলো, ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও কারও কাছে জীবন এখনো মূল্যবান।
বিশ্বকে এখনই ফিলিস্তিনিদের প্রমাণ করতে বাধ্য করা বন্ধ করতে হবে যে তাঁরা মানুষ। আমরা মিথ্যা বলি আর আমাদের হত্যাকারীরা সত্য বলে—এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ফিলিস্তিনিদের মধ্যে যাঁরা শুধু ফেরেশতা, শুধু তাঁদের জন্য শোক প্রকাশ করা যাবে, এই ভাষ্যকে আর প্রচার করতে দেওয়া যাবে না।আমি এটাও জানি, সেই আশাকে হারালে কেমন লাগে। সেখানে চিকিৎসাকর্মীদের প্রথমে হত্যা করা হয়, তারপর তাঁদের সম্মান নষ্ট করা হয়। তাঁদের সততা নিয়ে বিতর্ক তোলা হয় আর তাঁদের সহকর্মীরা গণকবর খুঁড়ে মরদেহ উদ্ধার করেন। তাঁদের সন্দেহের চোখে দেখা হয়, তারপর ভুলে যাওয়া হয়।
মানবতা হারানো শুধু কথার কথা নয়, এটা শুধু গণমাধ্যমের কাঠামো বা রাজনৈতিক ভাষার সমস্যা নয়। এটা হত্যা করে। মুছে ফেলে। এটা পুরো জাতিগোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পরও বিশ্বকে চোখ ফিরিয়ে নিতে বলে। এটা আমাদের বলে দেয়: তোমার জীবন ততটা মূল্যবান নয়; তোমার শোক সত্যি কি না, তা আমরা যাচাই না করা পর্যন্ত শোক বলে বিবেচিত হতে পারে না; তোমার মৃত্যু দুঃখজনক কি না, তা আমাদের ছাড়পত্রের ওপর নির্ভরশীল।
এ কারণেই এই ১৫ জন চিকিৎসাকর্মী ও উদ্ধারকর্মীর মৃত্যু এত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটি শুধু একটি হত্যাকাণ্ডের গল্প নয়। এটি সেই অবিশ্বাসের প্রক্রিয়ার গল্প, যা প্রতিবার ফিলিস্তিনিরা নিহত হলে উঠে আসে। এটি সেই বাস্তবতা, যেখানে আমাদের নিজেদেরই ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ হতে হয়, নিজেদের আইনি লড়াই চালাতে হয়, নিজেদের প্রচারের কাজ করতে হয় এবং সবকিছুর সঙ্গে মরদেহের জন্য শোকও করতে হয়।
এই বোঝা আর কাউকে বইতে হয় না। যখন কোনো পশ্চিমা সাংবাদিক নিহত হন, তাঁদের সম্মান জানানো হয়। যখন কোনো ইসরায়েলি নাগরিক মারা যান, তখন তাঁদের নাম আর ছবি বিশ্বজুড়ে স্ক্রিনে ভেসে ওঠে। কিন্তু যখন কোনো ফিলিস্তিনি মারা যান, তখন তাঁর পরিবারের প্রথম কাজ হয় প্রমাণ করা, যে তিনি সন্ত্রাসী ছিলেন না।
আমাদের সব সময় দোষী ধরে নেওয়া হয়, যতক্ষণ না নির্দোষ প্রমাণিত হই। অনেক সময় সেটা প্রমাণ করাও সম্ভব হয় না।
অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, পশ্চিমা গণমাধ্যমে ইসরায়েলের কথা বেশি গুরুত্ব পায়, কিন্তু ফিলিস্তিনিদের কথা গুরুত্ব দেওয়া হয় কম। ইসরায়েল যদি কোনো দাবি করে, তা যাচাই-বাছাই ছাড়াই বিশ্বাস করা হয়; কিন্তু ফিলিস্তিনিরা কিছু বললে তা সন্দেহের চোখে দেখা হয়। এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যেন তাঁদের দুঃখ-কষ্ট, কান্না বা শোক তাঁদের কথাকে অবিশ্বাস্য বা অতিরঞ্জিত করে তোলে; অর্থাৎ ফিলিস্তিনিরা যা বলছেন, তা সত্য হলেও তাঁদের যন্ত্রণা দেখিয়ে তাঁরা বেশি বলছেন বা বাড়িয়ে বলছেন—এমন ধারণা তৈরি করা হয়।
এই গণমাধ্যমের ধারা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোকেও প্রভাবিত করে—অস্ত্র বিক্রি থেকে শুরু করে কূটনৈতিক দায়মুক্তি, আন্তর্জাতিক মঞ্চে নীরবতা থেকে জাতিসংঘে ভেটো দেওয়া পর্যন্ত। সবকিছু একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। ফিলিস্তিনিদের পুরোপুরি মানুষ বলে যেহেতু গণ্য করা হয় না, সেহেতু তাদের হত্যাকারীদেরও পুরোপুরি দায়ী করা হয় না।
এর মানসিক চাপও ভয়াবহ। আমরা শুধু শোক করি না; আমাদের শোকের স্বীকৃতির জন্যও লড়তে হয়। আমরা শুধু আমাদের মৃত ব্যক্তিদের দাফন করি না; তাঁদের মৃত্যু স্বীকার করানোর জন্যও সংগ্রাম করি। আমরা এমন এক মানসিক চাপে বাস করি, যা কোনো সম্প্রদায়ের সহ্য করা উচিত নয়। আমাদের প্রতিনিয়ত প্রমাণ করতে হয় যে আমরা তা নই, যা বিশ্ব আমাদের ভেবে নিয়েছে।
এই ১৫ জন চিকিৎসাকর্মী ও উদ্ধারকর্মী ছিলেন সত্যিকারের নায়ক। তাঁরা বিপদের দিকে ছুটে গিয়েছিলেন। তাঁরা তাঁদের জনগণের সেবা করেছিলেন। তাঁরা জীবনের পবিত্রতায় বিশ্বাস করতেন। তাঁদের স্মৃতি সম্মানের যোগ্য। অথচ তাঁদের গল্পও একটি বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্বকে এখনই ফিলিস্তিনিদের প্রমাণ করতে বাধ্য করা বন্ধ করতে হবে যে তাঁরা মানুষ। আমরা মিথ্যা বলি আর আমাদের হত্যাকারীরা সত্য বলে—এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ফিলিস্তিনিদের মধ্যে যাঁরা শুধু ফেরেশতা, শুধু তাঁদের জন্য শোক প্রকাশ করা যাবে, এই ভাষ্যকে আর প্রচার করতে দেওয়া যাবে না।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া
ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
আহমেদ নাজার একজন ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নাট্যকার।