কখনও কখনও একটি সঠিক সিদ্ধান্ত জীবন বদলে দিতে পারে। শম্পা আক্তার ও তাঁর পরিবারের গল্পটা ঠিক এমনই। হঠাৎ একদিন সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর স্বামী জাকির হোসেন মারা যান। জাকির হোসেন ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে সুখের সংসার ছিল তাঁর। জাকির হোসেনকে হারিয়ে দুই সন্তান নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েন শম্পা আক্তার।
সন্তানদের নিয়ে কী করবেন, কীভাবে পরিবারের হাল ধরবেন বুঝতে পারছিলেন না তিনি। তবে জাকির হোসেন জীবদ্দশায় একটি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তা হলো তিনি ২০ লাখ টাকার একটি জীবন বীমা পলিসি করেছিলেন। ৩২ হাজার টাকা প্রিমিয়াম দিতে পেরেছিলেন তিনি। এরপরেও মাত্র তিন দিনের মধ্যেই তাঁকে বীমা পলিসির পুরো ২০ লাখ টাকাই পরিশোধ করে প্রতিষ্ঠানটি। এটিই হয়ে ওঠে শম্পা আক্তারের নতুন পথচলা শুরুর গল্প।
জাকির হোসেনের জমি ও দোকান ছিল। দোকানটি বন্ধক রেখেছিলেন তিনি। শম্পা আক্তার বলেন, ‘ইন্স্যুরেন্সের ১০ লাখ টাকা দিয়ে দোকানটা ছাড়িয়ে নিয়েছি। ওটা থেকে মাসে মাসে ভাড়া পাই। বাকি টাকা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে ফিক্সড করে রেখে দিয়েছি।’ এভাবেই ইন্স্যুরেন্সের পাওয়া টাকা থেকে শম্পা আক্তার পরিবারের জন্য নির্ভরযোগ্য আয়ের উৎস তৈরির পাশাপাশি সন্তানদের ভবিষ্যৎ ও শিক্ষা নিশ্চিত করেন।
জাকির হোসেনের পরিবারে এখন অনিশ্চয়তার কালো মেঘ নেই। সেখানে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। দুই সন্তান নিয়ে আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছেন শম্পা আক্তার। নতুন স্বপ্ন নিয়ে হাল ধরেছেন জীবনের। সবকিছু সম্ভব হয়েছে জীবদ্দশায় স্বামী জাকির হোসেনের নেওয়া সেই সিদ্ধান্তের কারণে; যা তাঁর দুই সন্তান ও স্ত্রীকে অর্থনৈতিক দৈন্যদশা থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশে বীমা কোম্পানি দ্বারা গ্রাহক হয়রানির ঘটনা আমরা প্রায়ই শুনে থাকি। এমনকি বীমাদাবি নিষ্পত্তির সময় গ্রাহকের বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার ঘটনা একবারেই যে নেই তা নয়। শম্পা আক্তারের অভিজ্ঞতা পুরোটাই আলাদা। কারণ, তাঁর স্বামী জাকির হোসেন এই বীমা পলিসিটি নিয়েছিলেন গার্ডিয়ান লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের কাছ থেকে। ২০১৪ সাল থেকে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। ইতোমধ্যে দেশের বীমা খাতে ভালো অবস্থান রয়েছে তাদের। প্রতিশ্রুতি রক্ষার অসংখ্য গল্প রয়েছে বলেও গার্ডিয়ান লাইফের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। বর্তমানে ১ কোটি ২০ লাখের অধিক মানুষকে আর্থিক সুরক্ষা দিয়ে চলেছে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ইন স য র ন স পর ব র র
এছাড়াও পড়ুন:
লেনিন কেন এখনও জরুরি
আজ ২২ এপ্রিল, ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের জন্মদিন। ১৯১৭ সালে সংঘটিত রুশ বিপ্লবের অগ্রনায়ক লেনিন ছিলেন মার্ক্সের সফল উত্তরাধিকারী। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ইতিহাসের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। একটি পশ্চাৎপদ পুঁজিবাদী দেশে বিপ্লব সংঘটনের পথ বের করেন তিনি। চিন্তা ও প্রয়োগের মেলবন্ধন ঘটানোর দক্ষতাই ছিল তাঁর সাফল্যের অন্যতম কারণ। মার্ক্স সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা বলেন। কিন্তু রাশিয়ার মতো দেশে যেখানে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটেনি, সেখানে শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক বিপ্লব করে নতুন পথ দেখালেন। লেনিনের এই গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পথ ধরেই চীনসহ পিছিয়ে পড়া পুঁজিবাদী দেশে বিপ্লব হয়েছে। ইতিহাসের কোনো পর্বকেই লাফ দিয়ে ডিঙিয়ে যাওয়া যায় না। বিপ্লবকে ইতিহাসের ভেতর দিয়েই যেতে হয়– এটি ছিল লেনিনের শিক্ষা।
লেনিন দেখিয়েছেন রাষ্ট্রযন্ত্র কোন প্রক্রিয়ায় বল প্রয়োগ করে টিকে থাকে এবং শাসক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করে। তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের ফ্যাসিস্ট রূপ বুঝতে সহায়তা করে। তিনি বল প্রয়োগের মাধ্যমে বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্র উচ্ছেদের কথা বলেন। গ্রামসি বলেন, শুধু বল প্রয়োগ নয়; শাসক শ্রেণি সাংস্কৃতিক ও মতাদর্শিক আধিপত্য বজায় রাখার মধ্য দিয়েও টিকে থাকে। ব্যবস্থার পক্ষে সম্মতি উৎপাদন করে। ফুকোর মতে, ক্ষমতা শুধু রাষ্ট্রে কেন্দ্রীভূত নয়; সমাজের পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকে। আধুনিক সমাজ শুধু বল প্রয়োগের মাধ্যমে শাসন করে না; তা মানুষের জীবন ও কর্তাসত্তার মনোজগৎ গঠনেরও নিয়ন্ত্রণ নেয়। ফুকো এর নাম দিয়েছেন বায়োপলিটিকস– জীবন ও মগজ দখল- নিয়ন্ত্রণের রাজনীতি। ফুকো ক্ষমতা কী করে কাজ করে তার বর্ণনা দিলেও ক্ষমতাকে কীভাবে প্রতিরোধ ও উচ্ছেদ করতে হয়, তা দেখাননি। সেটা দেখিয়েছেন লেনিন। তার মানে এই নয়, আমাদের বলশেভিক মডেলই অনুসরণ করতে হবে।
বাংলাদেশের রাষ্ট্র নিবর্তনমূলক ও দুর্নীতিবাজ। গণতন্ত্রের লোভ দেখানো নির্বাচন, উন্নয়ন, ধর্মরাষ্ট্র, স্বর্গ– এসব ফ্যান্টাসি তৈরি করে রেখেছে। এসব ফ্যান্টাসি ভাঙতে হবে। আমাদের মুক্তির বিকল্প বয়ান তৈরি করতে হবে। মানুষের কাছে সেটা তুলে ধরতে পারলে বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব। বুর্জোয়া রাষ্ট্রের খোলনলচে না বদলে শুধু কিছু সংস্কার দিয়ে বিদ্যমান সংকটের সমাধান সম্ভব হবে না।
লেনিনের শিক্ষার একটা বড় দিক হলো, অসংগঠিত স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন দিয়ে ব্যবস্থার অবসান ঘটানো যায় না। এ জন্য চাই বিপ্লবী মতাদর্শ ও সুসংগঠিত রাজনৈতিক সংগঠন। যাকে তিনি বলেছেন বিপ্লবী পার্টি। লড়াইকে তিনি স্বতঃস্ফূর্ততার ওপর ছেড়ে না দিয়ে সচেতন সংগঠিত রাজনৈতিক লড়াই চালানোর কথা বলেন। শুধু জীবনদান আর অভ্যুত্থান করলেই হবে না; সেই অভ্যুত্থানের রাজনীতি ও শ্রেণি প্রশ্নটি পরিষ্কার থাকতে হবে। অভ্যুত্থান-উত্তর পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে অভ্যুত্থানকারী শক্তির সংগঠন থাকতে হয়। চব্বিশের অভ্যুত্থানে এর কোনোটাই নেই। নেই কোনো সুনির্দিষ্ট রাজনীতি ও শক্তিশালী সংগঠন। এ ধরনের ভয়ানক দুর্বলতার পরিণতিতে পর্বতের মূষিক প্রসব ঘটতে পারে।
স্বৈরতান্ত্রিক জারের ভয়ানক নির্যাতনে লেনিনের জীবন কখনোই স্থির ছিল না। বন্দি ও পলাতক জীবন এবং নির্বাসনের মধ্যে স্ত্রী ক্রুপস্কায়াকে নিয়ে কেটেছে তাঁর জীবন। তবুও এক অমিত শক্তি নিয়ে তিনি অব্যাহত রেখেছেন বিপ্লবী কর্মযজ্ঞ। লিখেছেন অবিরাম ৫৫ খণ্ড। বিতর্কে লিপ্ত থাকতে হয়েছে তাঁকে সারাক্ষণ দলের ভেতর ও বাইরে। অব্যাহতভাবে প্রকাশ করেছেন ইস্ক্রা পত্রিকা। এভাবে একদিন নতুন সূর্যের ভোর আসে ১৯১৭ সালে; অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে।
রুশ বিপ্লবের পরে বেশি দিন বাঁচেননি লেনিন। ১৯১৮ সালে আততায়ীর গুলিতে আহত হন। এরপর কখনোই পুরোপুরি সুস্থ হননি। ১৯২৪ সালে লেনিন মস্কো থেকে দূরে তাঁর নিজ গ্রাম গোর্কিতে মারা যান।
১৯৪৮ সালে কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন, ‘ইউরোপ ভূত দেখেছে; কমিউনিজমের ভূত।’ বিশ শতকজুড়ে ইউরোপ ও আমেরিকাকে কমিউনিজমের এ ভূত তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। সমাজতন্ত্র ধ্বংস করতে তারা চালিয়েছে কখনও সরাসরি যুদ্ধ, কখনও স্নায়ুযুদ্ধ।
বামপন্থিদের ও সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সে যুদ্ধ এখনও জারি আছে। এ যুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের আপাত পরাজয় হলেও তা নতুন এক অনিরুদ্ধ শক্তি নিয়ে আবারও ইতিহাসে আবির্ভূত হবে। পুঁজির শোষণ ও শাসনমুক্ত একটি সভ্য মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন মার্ক্স ও লেনিন। সেটা এখনও আরাধ্য। তা অর্জনে লুটেরা পুঁজিতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কোনো বিকল্প নেই। এ সংগ্রামে লেনিন শুধু প্রাসঙ্গিক নন, জরুরিও বটে। লেনিনের জন্মদিনে তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
ড. আখতার সোবহান মাসরুর: লেখক ও নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম ছাত্রনেতা