সম্প্রতি জাপানে মারাত্মক এক ঘটনা ঘটেছে। জাপানি লেখক ইয়োশিমোতো বানানার নামে একটি বই অ্যামাজনে ছাড়া হয়েছে, যেটি তিনি লেখেননি। তাহলে এই বইটির লেখক কি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই? জালিয়াতির বলয় কি মানুষের সৃজনশীলতার জগৎকেও প্রভাবিত করছে? এসব প্রশ্নের জবাবের আগে চকিতে ইয়োশিমোতো বানানার দিকে নজর দেওয়া যাক।

ইয়োশিমোতো বানানা জাপানের আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত লেখকদের একজন। ৬০ বছর বয়সী এই নারী ঔপন্যাসিক নিজের ব্যক্তিগত জীবন আড়ালে ঢেকে রাখতে পছন্দ করেন। ১৯৮৮ সালে ‘কিচেন’ উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে সাহিত্যের আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাঁকে নিয়ে আলোচনা শুরু হলেও হারুকি মুরাকামির মতো সে রকম ব্যাপক জনপ্রিয়তা তিনি পাননি। তবে সস্তা জনপ্রিয়তার আশায় তিনি ব্যাকুল ছিলেন, এমন অভিযোগও তাঁর বেলায় খাটে না। হয়তো এ কারণেই সৃজনশীল রচনার গভীরতা ভিন্ন এক আঙ্গিকে জনপ্রিয় করে তুলেছে তাঁকে। রান্নাঘরের জাপানি একটি প্রতিশব্দ থাকলেও জাপানের আধুনিক বাড়িঘরে রান্নাঘর ‘কিচেন’ নামেই পরিচিত। আর ইয়োশিমোতোর প্রথম উপন্যাস সেই শিরোনাম নিয়েই প্রকাশিত হয়েছে। জাপানে এই উপন্যাসের ৬০টির বেশি মুদ্রণ হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে উপন্যাসটির অনুবাদ। কোনো কোনো বিদ্যালয়ে এটি শিক্ষাক্রমেরও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ইয়োশিমোতো এ পর্যন্ত ১২টি উপন্যাস ছাড়াও অন্যান্য রচনার ৭টি সংকলন প্রকাশ করেছেন, জাপানে যেসব বইয়ের সম্মিলিত বিক্রির সংখ্যা ৬ কোটির বেশি।

বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার বাইরে ব্যক্তির ওপর রয়েছে পরিবার ও গৃহের প্রভাব এবং মানবচেতনার অবক্ষয়ের প্রতিক্রিয়া, মোটাদাগে এগুলোই ইয়োশিমোতো লেখার বিষয়বস্তু। খোলামেলা অর্থে রাজনৈতিক বক্তব্য নিয়ে তিনি নিজের লেখায় উপস্থিত না হলেও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের ভিন্ন একটি বলয় তাতে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়।

ইয়োশিমোতো বানানার জীবনের ব্যতিক্রমী একটি দিক হচ্ছে তাঁর পারিবারিক পরিচয়। পিতা তাকাআকি ইয়োশিমোতো কবি ও সাহিত্য সমালোচক হিসেবে পরিচিত। বোন হারুনো ইয়ুইকো হলেন জাপানের পরিচিত একজন কার্টুনশিল্পী। সাহিত্যিক-জীবনের শুরুতে বানানা নাম তিনি গ্রহণ করেছেন কলাগাছের ফুলের সৌন্দর্য দেখার পর থেকে। যদিও জন্মের সময় থেকে পরিবারের সদস্যদের রাখা নাম মাহোকো আনুষ্ঠানিক প্রয়োজনে ব্যবহার করা তিনি বজায় রেখেছেন। স্বামী হিরোইয়োশি তাহাতা এবং এক পুত্রসন্তান নিয়ে টোকিওতে তাঁর বসবাস। সমকালীন জাপানে তরুণদের অনুভব করা ক্লান্তি তাঁর উপন্যাসের অন্যতম প্রধান একটি বিষয় হলেও জীবনের চলার পথে সামনে দেখা দেওয়া ব্যতিক্রমী ও ভয়ংকর অভিজ্ঞতা ব্যক্তিগত জীবনে কীভাবে ছাপ রেখে যায়, তা-ও লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন তিনি।

জাপানের সুপরিচিত এই নারী লেখক সম্প্রতি ভিন্ন যে কারণে সংবাদ শিরোনামে এসেছেন, তা হলো তাঁর নাম ব্যবহার করে লেখা বানোয়াট এক উপন্যাসের আত্মপ্রকাশ এবং সারা বিশ্বে অনলাইনে পণ্য বিক্রির বৃহত্তম মাধ্যম অ্যামাজনে বইটির ব্যাপক বিক্রয়। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে নিজের পরিচিত কিছু লোকজনের কাছ থেকে ‘পৃথিবীর সময় ফুরিয়ে আসছে’ নামের সেই বই সম্পর্কে তিনি জানতে পারেন। এরপর কালবিলম্ব না করে বইয়ের বিক্রি জব্দ করার অনুরোধ তিনি জানান অ্যামাজনকে। অ্যামাজন অবশ্য দ্রুতই ইয়োশিমোতো অনুরোধে সাড়া দিয়ে বিক্রির তালিকা থেকে তুলে নিয়েছে বইটি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুলে ধরা বার্তায় ই-বুক সংস্করণে প্রকাশিত সেই উপন্যাস না কেনার জন্য পাঠকদের সতর্ক করে দিয়েছেন ইয়োশিমোতো। ওই বার্তায় তিনি বলেন, ‘এ ধরনের ভিন্নমাত্রার নতুন জালিয়াতি বন্ধ করার জন্য আইনি পদক্ষেপ নেব আমি।’ জাপানের নেতৃস্থানীয় দৈনিক ‘আসাহি শিম্বুন’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ব্যক্তির সৃজনশীলতা নিয়ে এমন জালিয়াতি এবং এতটা খোলামেলাভাবে বইটি যে বিক্রি হবে, তা ছিল তাঁর কল্পনার বাইরে।

আধুনিক বিশ্বে এমন জোচ্চুরি কল্পনাতীত হলেও সাহিত্যিক জোচ্চুরির শুরু অবশ্য প্রাচীন গ্রিস থেকে, যা থেমে থেমে সব যুগেই কিছু না কিছু ঘটেছে। এই জালিয়াতি থেকে বাদ পড়েননি উইলিয়াম শেক্‌সপিয়ারও। ১৭৯৬ সালে ১৯ বছর বয়সী উইলিয়াম হেনরি আয়ারল্যান্ড নামে একজন ‘ভর্টিজার্ন অ্যান্ড রোওয়ানা’ নামক নিজের লেখা ও প্রকাশিত এক ঐতিহাসিক নাটককে শেক্‌সপিয়ারের অনাবিষ্কৃত লেখা বলে চালিয়ে দিয়েছিলেন। এ ছাড়া ১৯৮০ দশকে ষাট খণ্ডের দিনলিপি দিয়ে সাজানো ‘হিটলারের ডায়েরি’র উল্লেখও এখানে করা যেতে পারে। যদিও এটি সরাসরি সাহিত্যকর্ম নয়, তবু হিটলারের সেই ডায়েরি পশ্চিম জার্মানির ‘স্টার্ন’ ম্যাগাজিন কিনে নিয়েছিল প্রায় ৩৭ লাখ ডলারে। পরে ব্রিটেনের ‘দ্য সানডে টাইমস’ অনুসন্ধান করে বের করে এটি ছিল ভুয়া একটি ডায়েরি, যার আসল লেখক অ্যাডলফ হিটলার নন, বরং পূর্ব জার্মানির কনরাড কুজাউ নামের এক ব্যক্তি।

বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক জায়গায় কপিরাইট ফাঁকি দিয়ে বিখ্যাত লেখকের নানা বই হুবহু প্রকাশ করা হলেও নিজে লিখে অন্য কোনো বিখ্যাত লেখকের নামে চালিয়ে দেওয়ার মতো অপকর্মের ঘটনা আধুনিক বিশ্বে এখন অবশ্য কিছুটা কঠিনই বটে। তবে তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগেও অ্যামাজনের মতো বিশ্ববিখ্যাত বিক্রয় প্ল্যাটফর্মে এ ধরনের প্রতারণার শিকার হলেন জাপানি লেখিকা ইয়োশিমোতো বানানা। বিষয়টি তদন্তসাপেক্ষ হলেও সাম্প্রতিক কালে অতি জনপ্রিয় এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির এতে ভূমিকা থাকার বিষয়টি একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। একদিকে এআইয়ের সৃজনশীল ব্যবহার যেমন মানুষের জীবিকার ওপর আঘাত হানতে শুরু করেছে, অন্যদিকে জোচ্চুরির সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানোর সামর্থ্য বিজ্ঞানের এই আবিষ্কারের রয়েছে। যেকোনো বিখ্যাত শিল্পীর মতো ছবি আঁকা, গান গাওয়া কিংবা বিখ্যাত লেখকের ঢংয়ে লেখা দাঁড় করানো এখন প্রযুক্তির কল্যাণে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক সহজ। কিন্তু দেখার বিষয় হলো, ইয়োশিমোতো বানানার নামে বই জালিয়াতির নেপথ্যে থাকা ব্যক্তি বা চক্র, উইলিয়াম হেনরি আয়ারল্যান্ড কিংবা কনরাড কুজাউর মতো নিজস্ব পরিশ্রমে এই লেখা লিখেছেন নাকি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির শরণাপন্ন হয়েছেন। উত্তর যা–ই হোক না কেন, ইয়োশিমোতো বানানা যে দ্রুত এই জালিয়াতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়েছেন, সেটিই আপাতত লেখক এবং পাঠক উভয়ের জন্যই স্বস্তি ও সতর্কতার বিষয়।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: অ য ম জন উপন য স জনপ র য় স জনশ ল পর চ ত

এছাড়াও পড়ুন:

নারায়ণগঞ্জে গ্যাস লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে আরও একজনের মৃত্যু

নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার সিদ্ধিরগঞ্জে গত সোমবারের গ্যাস লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে দগ্ধ আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। নিহত রূপালী (২০) একজন পোশাক শ্রমিক।

রোববার ভোর পৌনে ৬টায় মারা যান তিনি। এতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৩ জনে।

জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন শাওন বিন রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার ঝগড়াচর গ্রামের বিল্লাল মিয়ার মেয়ে ও সোহাগের স্ত্রী রুপালি ৩৪ শতাংশ দগ্ধ হয়ে হাসপাতালের বিছানায় জীবন-মরণের লড়াই করছিলেন।  

এর আগে শনিবার জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে মোহাম্মদ হান্নান (৪০) এবং রূপালীর দেড় বছর বয়সী শিশু কন্যা সুমাইয়ার মৃত্যু হয়।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, হান্নানের শরীরের ৪৫ শতাংশ এবং সুমাইয়ার ৪৪ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল।

গত সোমবার (৩ মার্চ) গভীর রাতে সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইল চেয়ারম্যান বাড়ি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। টিনশেডের একটি বাড়িতে গ্যাস পাইপলাইনে লিকেজ থেকে সৃষ্ট আগুনে দুটি পরিবারের চার শিশুসহ আটজন গুরুতর দগ্ধ হয়। পরে তাদের উদ্ধার করে বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়।

দগ্ধদের মধ্যে চিকিৎসাধীন রয়েছেন রূপালির স্বামী সোহাগ (২৩), হান্নানের স্ত্রী নূরজাহান আক্তার লাকী (৩০), তাদের মেয়ে জান্নাত (৩), সামিয়া (৯) এবং ছেলে সাব্বির (১৬)।

তাদের অনেকেরই অবস্থা আশংকাজনক বলে জানিয়েছেন আবাসিক চিকিৎসক শাওন বিন রহমান।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ধর্ষণের বিরুদ্ধে অভিনয় শিল্পীর প্রতিবাদ
  • রোজার দিনে কড়া রোদে দীর্ঘ অপেক্ষা
  • ‘ধর্ষককে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করুন’
  • রূপগঞ্জে প্রবাসীদের গাড়ীতে ডাকাতি: ২ পুলিশসহ গ্রেপ্তার ৫
  • আমার কোমরে সেই দাগটা ১০ বছর ছিল: শিল্পা
  • ফিলিস্তিনি পতাকা নিয়ে লন্ডনের বিগ বেন টাওয়ারে ওঠা সেই ব্যক্তি গ্রেপ্তার
  • ট্রাম্পকে যারা ভোট দিয়েছিলেন চাকরিচ্যুত করলেন তাদেরও
  • যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট ভ্যান্স কত দূর যেতে পারেন
  • ভাগ্য ফেরাতে কিনছেন ‘ব্যাংকের মাটি’
  • নারায়ণগঞ্জে গ্যাস লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে আরও একজনের মৃত্যু