গণ-অভ্যুত্থান সফল হলেও নারীর লড়াই এখনো থামেনি
Published: 8th, March 2025 GMT
কোনো গণ-আন্দোলনই নারীর অংশগ্রহণ ছাড়া পূর্ণতা পায় না। ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান কিংবা ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন—প্রতিটি সংগ্রামে নারীদের রয়েছে সাহসিকতা ও নেতৃত্বের ভূমিকা; কিন্তু তাঁদের ভূমিকা প্রধানত সেবাদাত্রী, সম্ভ্রমহারা কিংবা বীরের মা হিসেবে চিত্রিত হয়েছে। ২০২৪-এর আন্দোলনেও নারীদের সাহসিকতা অন্য সবকিছু ছাপিয়ে গিয়েছিল।
২০২৪-এর ছাত্র আন্দোলন ছিল দীর্ঘদিনের অন্যায় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে একটি গণবিস্ফোরণ। যেমন ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭১, ১৯৯০-এর মতো সময়গুলোতে জনগণ শিকল ভেঙে অধিকার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন, তেমনই ২০২৪ সালেও ঘটে নতুন এক জাগরণ। এর সূচনা হয়েছিল ৬ জুন; ওই দিন আমরা কয়েকজন শিক্ষার্থী কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে ‘কোটা পুনর্বহাল চাই না’ ব্যানারে একটি ছোট মিছিল করি। শুরুতে আন্দোলনটি কোটা বাতিলের দাবি নিয়ে শুরু হলেও পরে সংস্কারের দাবিতে রূপ নেয়। ধীরে ধীরে এর ব্যাপকতা বাড়তে থাকে এবং ক্রমে একটি ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয়।
আন্দোলনে নারীদের সম্পৃক্ত করা সব সময়ই একটি চ্যালেঞ্জ। ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের শুরুর দিকে পুরুষ শিক্ষার্থীদের তুলনায় নারী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ছিল অনেক কম। পরবর্তী সময়ে নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে। আমরা চেষ্টা করেছিলাম যতটা সংগঠিত করা যায়। নারীদের উপস্থিতিই এই আন্দোলনকে একটি যৌক্তিক ও নৈতিক অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’ নামক এই আন্দোলনের অন্যতম মূল চালিকাশক্তিতে পরিণত হয় নারী শিক্ষার্থীরা।
’২৪-এর অভ্যুত্থানের এক অভিনব কর্মসূচি ছিল—‘বাংলা ব্লকেড’। দাবি আদায় না হলে আমরা রাস্তা অবরোধ করব, এই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রখর রোদে অনেক নারী শিক্ষার্থী বসে থেকেছেন, যেখানে অনেক পুরুষ শিক্ষার্থীরও ধৈর্য ছিল না। এমনকি একদিন প্রবল বৃষ্টিতে রাস্তায় কাদা ও নোংরা পানি চলে আসছিল; সেই বৃষ্টি, কাদা ও নোংরা পানি উপেক্ষা করেও আমরা রাজপথ ছাড়িনি। আন্দোলনের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে নারীরা হয়ে উঠেছিলেন সাহসের প্রতীক।
১৪ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এবং পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের রাজাকারের সঙ্গে তুলনা করেন। এই অপমান নারীরা মেনে নিতে পারেননি। তাঁরা সবার আগে হলের গেট ভেঙে রাস্তায় নামেন এবং রাজু ভাস্কর্যে অবস্থান নেন।
২৪-এর আন্দোলনে নারীরা যেমন দাবি আদায়ের জন্য এবং তাঁদের ভাই, বন্ধু বা সহপাঠীদের রক্ষা করতে রাস্তায় নেমেছিলেন, এখন তাঁরা নিজেদের রক্ষার জন্যই আন্দোলন করতে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু এবার তাঁদের পাশে সেই ভাই, বন্ধু বা সহপাঠীদের সেভাবে দেখা যাচ্ছে না; যাদের জন্য একসময় নারীরা সবকিছু উপেক্ষা করে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন।পরদিন খবর আসে যে ছাত্রলীগের নেতারা হলের ছেলেদের আন্দোলনে নামতে দিচ্ছেন না, তাঁদের মারধর করছেন। এ কথা শুনেই নারী শিক্ষার্থীরা তাঁদের রক্ষা করতে ছুটে যান। সম্ভাব্য আক্রমণের শিকার হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে তাঁদের বাঁচাতে গেলে, সেখানে নারী শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা অমানবিকভাবে নির্যাতন চালায়। এটা পুরো দেশের মানুষের হৃদয়ে দাগ কেটে যায়। এই নির্মমতার প্রতিবাদে পরদিনই দেশজুড়ে শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে আসেন।
নারীদের জন্য আন্দোলন সব সময় অনেক কঠিন। নানা সামাজিক ও শারীরিক বাধা অতিক্রম করেই সামনে এসে দাঁড়ায়। ২০২৪-এর আন্দোলনে তাঁরা শুধু সংগঠক ও নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিলেন না; বরং পুরুষ শিক্ষার্থীদের সামনে মিছিলের ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। ছাত্রলীগ-যুবলীগের হামলার ভয়, এমনকি পুলিশের গুলি উপেক্ষা করে মায়েরা তাদের সন্তানদের আন্দোলনে নামিয়ে দিয়েছিলেন। এই সংগ্রাম একসময় গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয় এবং ৫ আগস্ট বিজয়ের মাধ্যমে ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকে।
কিন্তু বিজয়ের উচ্ছ্বাসের পর নারীদের জন্য বাস্তবতা দ্রুত পাল্টে যায়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও সংস্কার কমিশনগুলোতে নারীদের যথাযথ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়নি, যদিও আন্দোলনের অন্যতম অংশীদার ছিলেন নারীরা। সবচেয়ে দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, স্বৈরাচারের পতনের পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ে আর তার প্রধান শিকার হয় নারী ও শিশু।
দেশে ধর্ষণ ও নারী নিপীড়নের মাত্রা বেড়ে গেছে। নারীদের ‘মোরাল পুলিশিং’ ও যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হচ্ছে। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, উপদেষ্টা হিসেবে সরকারে যে নারীদের নেওয়া হয়েছে, নারীর নিরাপত্তা ইস্যুতে তাঁদেরও তেমন কার্যকর কোনো ভূমিকা নিতে দেখা যাচ্ছে না।
২৪-এর আন্দোলনে নারীরা যেমন দাবি আদায়ের জন্য এবং তাঁদের ভাই, বন্ধু বা সহপাঠীদের রক্ষা করতে রাস্তায় নেমেছিলেন, এখন তাঁরা নিজেদের রক্ষার জন্যই আন্দোলন করতে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু এবার তাঁদের পাশে সেই ভাই, বন্ধু বা সহপাঠীদের সেভাবে দেখা যাচ্ছে না; যাদের জন্য একসময় নারীরা সবকিছু উপেক্ষা করে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন।
একটি ‘বৈষম্যহীন’ রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন দেখানো আন্দোলন এবং সফল গণ-অভ্যুত্থানের পর শুধু নারী হওয়ার কারণেই নারীরা আজ নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন কেন, এই প্রশ্নের জবাব আমাদের পেতেই হবে। নারীরা যদি সুরক্ষিত না থাকেন, এই বিজয় কতটুকু অর্থবহ? তাই আমাদের দাবি, যেকোনো মূল্যে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
সীমা আক্তার সদস্য, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সহপ ঠ দ র দ র জন য উপ ক ষ
এছাড়াও পড়ুন:
ইয়েমেন উপকূলে নৌকা ডুবে ১৮০ অভিবাসী নিখোঁজ
জিবুতি এবং ইয়েমেনের মধ্যবর্তী এলাকায় অভিবাসী বহনকারী চারটি নৌকা ডুবে ১৮০ জনেরও বেশি লোক নিখোঁজ রয়েছে। শুক্রবার আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা এএফপিকে এ তথ্য জানিয়েছে।
নৌকায় থাকা ব্যক্তিদের পরিচয় সম্পর্কে কোনো তথ্য জানায়নি অভিবাসন সংস্থা। তবে ইথিওপীয়রা প্রায়ই উপসাগরীয় দেশগুলোতে কাজ খুঁজে পেতে বা সংঘাত থেকে বাঁচতে এই পথটি ব্যবহার করে।
অভিবাসন সংস্থা এক বিবৃতিতে বলেছে, “গত রাতে জিবুতি এবং ইয়েমেন উপকূলে চারটি নৌকা ডুবির ঘটনায় ১৮০ জনেরও বেশি অভিবাসী নিখোঁজ রয়েছেন।”
সংস্থাটির দেওয়া তথ্য অনুসারে, এটি বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক অভিবাসী রুটগুলোর মধ্যে একটি। ২০২৪ সালে ইয়েমেনে এই পথ ব্যবহার করে ৬০ হাজারেরও বেশি অভিবাসীর আগমনের তথ্য নথিভুক্ত করা হয়েছে।
জানুয়ারিতে ইয়েমেনের উপকূলে নৌকা ডুবে ২০ জন ইথিওপীয় নিহত হন। ২০২৪ সালে এই পথে ৫৫৮ জন মারা গেছেন।
ঢাকা/শাহেদ