বেপরোয়া মব ভায়োলেন্স, পুলিশেরও নিরাপত্তা কোথায়
Published: 8th, March 2025 GMT
শুক্রবার প্রথম আলো অনলাইনে একজন পাঠকের মন্তব্য দিয়েই লেখাটি শুরু করি। তিনি লিখেছেন, ‘মানুষ নিরাপত্তাহীন ও আতঙ্কিত বোধ করছে। কেউ কথা বলে না। কারণ, তারা এই “হিংস্র জনতার” মুখোমুখি হতে ভয় পায়। সাংবাদিকেরা চুপ হয়ে গেছে, এমনকি নিজেদের রক্ষা করতেও ভয় পেয়েছে। সবাই নিরাপদে থাকার জায়গা খুঁজছে। ভাবছি, লেখক-সাংবাদিকদের কী হয়েছে? কোথায় মানবাধিকার সংগঠন ও কর্মীরা? তারা সবাই নিশ্চুপ থাকে।’
প্রথমেই পরিষ্কার করে নিই পাঠক যাদের ‘হিংস্র জনতা’ বলছেন, তারা আসলে জনতা নয়, সংঘবদ্ধ অপরাধী। আইনের প্রতি অনুগত মানুষ একত্র হলে আমরা তাদের জনতা বলি। কিন্তু গুজব ছড়িয়ে যখন কিছু ব্যক্তি পরিকল্পিতভাবে অপরাধ সংঘটিত করে, ব্যক্তি বা স্থাপনায় হামলা করে, তখন তারা জনতা থাকে না, অপরাধী হয়।
যেকোনো সমাজ বা রাষ্ট্র টিকে থাকে কতগুলো মৌলিক নীতি ও আদর্শের ওপর। সেখানে কেউ কারও ওপর হস্তক্ষেপ করবে না, একজন অপরজনের ওপর মত চাপিয়ে দেবে না। দিলে সরকার তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। যদি সরকার ব্যর্থ হয়, নৈরাজ্য তৈরি হয়। মানুষ আতঙ্কিত বোধ করে। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী, অন্তর্বর্তী সরকারের সাত মাসে দেশে মব ভায়োলেন্সে অন্তত ১১৪টি ঘটনায় ১১৯ জন নিহত ও ৭৪ জন আহত হয়েছেন। আইনের শাসন থাকলে এটি হওয়ার কথা নয়।
আওয়ামী লীগের আমলে যখন মব ভায়োলেন্স বা আইনশৃঙ্লা পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে কথা উঠত, তখন ক্ষমতাসীনেরা পাত্তা দিতেন না। বলতেন, ‘সাংবাদিকদের চোখ খারাপ’ বলে ভালো কিছু দেখতে পায় না। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও কেউ কেউ এ রকম দোহাই দেওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁরা বলেন, গত ১৫ বছর নিশ্চুপ ছিলেন কেন? এটাও নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার কৌশল। চেয়ারের মানুষ বদলায়, চরিত্র বদলায় না।
সাম্প্রতিক কালের কয়েকটি উদাহরণ দিলেই মব ভায়োলেন্স কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, সেটা বোঝা যাবে। গত সপ্তাহে গুলশানে ৮৮ নম্বর সড়কের একটি বাড়িতে প্রচুর অবৈধ অস্ত্র, কোটি কোটি টাকা ও আওয়ামী লীগের দোসররা পালিয়ে আছেন বলে গুজব ছড়িয়ে মধ্যরাতে দুর্বৃত্তরা অভিযান চালাল; এর আগে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় ডাকাত পড়েছে বলে দুই ব্যক্তিকে হত্যা করা হলো; লালমাটিয়ায় ধূমপানকে কেন্দ্র করে বাগ্বিতণ্ডায় দুই নারীকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হলো। কিন্তু এসব ঘটনায় সরকারকে তেমন উদ্বিগ্ন হতে দেখি না।
অপারেশন ডেভিল হান্টে গ্রেপ্তারের সংখ্যা ১০ সহস্রাধিক। এরপরও অপরাধীরা কেন বেপরোয়া, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। মব ভায়োলেন্সের ক্ষেত্রে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিও পরিষ্কার নয়। আইনের ভাষায় যারা অপরাধ করবে, তারাই ডেভিল। কিন্তু সরকার কোনো কোনো ডেভিলকে ধরেছে, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখেও না দেখার ভান করছে। বিভিন্ন স্থানে যারা আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে, যারা অন্যের বাড়ি দোকান–অফিস, বাস টার্মিনাল, লঞ্চ ঘাট ইত্যাদি দখল করে আছে, তাদের বিরুদ্ধে জোরালো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
আরও পড়ুননারীকে দমন–পীড়নের নতুন পন্থা, কোনো সমাধান নেই? ৬ ঘণ্টা আগেএর সঙ্গে পেশাদার অপরাধীরাও যুক্ত হয়েছে কিংবা কারও রাজনৈতিক স্বার্থে তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। অপরাধ দমনে সরকারের ভূমিকা প্রধান হলেও নাগরিকদেরও দায় আছে। সরকার তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। কিন্তু আমরা নাগরিকেরাই কি দায়িত্ব পালন করছি?
যখন কোথাও মব হয়, নারীকে হেনস্তা করা হয়, নাগরিকদের দায়িত্ব আক্রান্তের পাশে দাঁড়ানো ও আক্রমণকারীকে আইনের হাতে সোপর্দ করা। কিন্তু অনেক ঘটনায় নাগরিকেরাই আইন নিজের হাতে তুলে নেন। লালমাটিয়ার ঘটনাটি উল্লেখ করা যায়। দুই তরুণীকে নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা যে মন্তব্য করেছেন, তা অত্যন্ত আপত্তিকর। একদিকে তিনি দুই তরুণীর প্রকাশ্যে সিগারেট খাওয়া নিয়ে কথা বলেছেন। কিন্তু তাঁদের যাঁরা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করলেন, তাঁদের সম্পর্কে কিছু বললেন না।
আরেক উপদেষ্টা বলেছেন, সেখানে আপসরফা হয়ে গেছে। কিসের আপসরফা? দুই তরুণী যেভাবে লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন, সে ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। এভাবে নারীকে হেনস্তাকারীকে কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া যায় না। ওই নারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে বিধি মোতাবেক সেটিরও ব্যবস্থা নেওয়া যেত। তা নিশ্চিত করাই তো স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার দায়িত্ব, আপসরফা করা তো তাঁর কাজ নয়।
আবার আসি পাঠক বন্ধুর শেষ মন্তব্যে। যে সমাজে সাংবাদিকেরা নিশ্চুপ থাকেন, মানবাধিকারকর্মীরা অন্যায়কে মুখ বুজে মেনে নেন, সে সমাজে মব সংস্কৃতিই জোরালো হয়। কেবল সাধারণ মানুষ নয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও এর সংস্কৃতির শিকার হন। প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, গত ছয় মাসে পুলিশের ওপর ২২৫টি হামলার ঘটনা ঘটেছে।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রাতে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থানা এলাকার আউটার রিং রোডে এক পুলিশ সদস্যের পোশাক ছিঁড়ে ফেলে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যাতে দেখা যায়, হামলা করে এসআই ইউসুফ আলীর পোশাক ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। অসহায় অবস্থায় অঝোরে কাঁদছেন তিনি। গত সোমবার তিনি প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘যখন পুলিশের পোশাক ছিঁড়ে ফেলে, তখন আর আবেগ ধরে রাখতে পারিনি, কেঁদে ফেলেছি।’
যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মব থেকে রেহাই পান না, তখন সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে, কার কাছে প্রতিকার চাইবে?
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: মব ভ য় ল ন স প রথম আল সরক র র আইন র অপর ধ র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
উগ্রপন্থা ও হিমশৈলের ‘নিমজ্জিত অংশ’
আমাদের সমাজে উগ্রপন্থা সব সময়ই ছিল। কেবল ধর্ম নয়, রাজনীতির নামেও। ক্ষমতাসীনেরা যখন মনে করেন, বিরোধী পক্ষ বা মতকে শায়েস্তা করতে হবে, তখনই উগ্রপন্থার আশ্রয় নেন। আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী দলকে গণতান্ত্রিকভাবে মোকাবিলা না করে উগ্রপন্থার আশ্রয় নিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষা ও প্রতিষ্ঠার নামে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন-পীড়ন কোনোভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হতে পারে না।
একইভাবে গণ-অভ্যুত্থানের আট মাস পরও আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িঘরে হামলা চালানোকে ‘বিক্ষুব্ধ জনতার’ প্রতিক্রিয়া বলে চালানোর সুযোগ নেই। প্রশ্নটা হলো আইনের শাসনের। কেউ অপরাধ করলে সরকার তাঁর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবে, কিন্তু আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার কারও নেই।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে যে গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়, তার লক্ষ্য ছিল সব ধরনের বৈষম্যের অবসান ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, যেখানে কেউ কারও ওপর জবরদস্তি করবে না। নারী-পুরুষনির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিক তাঁর রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ভোগ করবেন। অথচ আমরা লক্ষ করলাম, একশ্রেণির উগ্রপন্থী মানুষ কখনো ধর্মের নামে, কখনো রাজনৈতিক মতাদর্শের নামে নিজের মত অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতে জোরজবরদস্তি করছেন। বাড়ি–ঘর–স্থাপনায় হামলা চালাচ্ছেন।
সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমস অভ্যুত্থান–উত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পালাবদলের একটি চিত্র তুলে ধরেছে, যার শিরোনাম ছিল ‘অ্যাজ বাংলাদেশ রিইনভেন্টস ইটসেলফ, ইসলামিস্ট হার্ড লাইনারস সি অ্যান ওপেনিং’; অর্থাৎ বাংলাদেশ যখন নতুন রূপে গড়ে উঠছে, তখন ইসলামি কট্টরপন্থীরা নতুন সুযোগ দেখছে।
বাংলাদেশের নতুন রূপটি এখনো দৃশ্যমান নয়। সরকার সংস্কার ও নির্বাচনের লক্ষ্যে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে। এটা ইতিবাচক। কিন্তু উদ্বেগের ঘটনা হলো নারীর প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে, তাদের পোশাক নিয়ে কটাক্ষ চলছে, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু ও আহমদিয়াদের ওপর একের পর এক হামলার ঘটনা ঘটছে, মাজার, দরগাহ আক্রান্ত হচ্ছে। একদল লোক বাউলগানের আসর ভেঙে দিচ্ছে, নাটক ও মেয়েদের খেলা বন্ধ করে দিচ্ছে।
নিউইয়র্ক টাইমস-এর উল্লিখিত প্রতিবেদন এ ধরনের কিছু ঘটনা তুলে ধরেছে। সবটা নয়। পত্রিকাটি বলছে, কট্টরপন্থীদের এসব বেআইনি তৎপরতা বন্ধে সরকারকে যতটা সাহসী ভূমিকা নেওয়ার কথা, সেটা তারা নিতে পারছে না। তাদের নমনীয়তার সুযোগে বাংলাদেশে উগ্রপন্থার প্রসার ঘটছে।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নিউইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের একটি বিভ্রান্তিকর ও একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছে, যা ইঙ্গিত দেয় যে দেশটি ধর্মীয় চরমপন্থীদের নিয়ন্ত্রণের দ্বারপ্রান্তে। এই বয়ান কেবল দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক গতিশীলতাকে অতিরঞ্জিত করে না, বরং ১৮ কোটি মানুষের একটি সমগ্র জাতিকে অন্যায়ভাবে কলঙ্কিত করার ঝুঁকির মুখেও ফেলে দেয়।
সরকার যে ভাষায় প্রতিক্রিয়া দেখাল, তা বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সরকারের অস্বীকারের সংস্কৃতির কথা মনে করিয়ে দেয়। দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমে নেতিবাচক কিছু প্রকাশ করা হলে তারা শোরগোল তুলত। এর মধ্যে ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে পেত। নিউইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদন পড়ে আমাদের মনে হয়নি, তারা সরকার বা জাতিকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করেছে, বরং উগ্রপন্থার বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছে।সরকার যে ভাষায় প্রতিক্রিয়া দেখাল, তা বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সরকারের অস্বীকারের সংস্কৃতির কথা মনে করিয়ে দেয়। দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমে নেতিবাচক কিছু প্রকাশ করা হলে তারা শোরগোল তুলত। এর মধ্যে ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে পেত। নিউইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদন পড়ে আমাদের মনে হয়নি, তারা সরকার বা জাতিকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করেছে, বরং উগ্রপন্থার বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছে।
নিউইয়র্ক টাইমস-এ যেসব ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে, সেগুলো নতুন নয়। সব কটি স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে এসেছে। এর বাইরেও অনেক ঘটনা ঘটেছে। কাউকে নিশ্চিহ্ন করা পিষে মারার হুংকার দেওয়া হচ্ছে। গত কয়েক মাসে বিভিন্ন স্থানে যে নারীদের হেনস্তা, লাঞ্ছিত হওয়া, নারী তারকাদের শোরুম উদ্বোধনের করতে না দেওয়ার ঘটনা কী সরকার অস্বীকার করতে পারবে? কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকার অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করলেও বেশির ভাগ থেকেছে আইনের ঊর্ধ্বে । পরিবেশটাই এমন হয়েছে যে মানুষ অভিযোগ করতেই ভয় পাচ্ছে। চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি ‘তৌহিদি জনতা’, তথা ‘বিক্ষুব্ধ মুসল্লিদের’ দাবির মুখে বাংলাদেশের দিনাজপুর ও জয়পুরহাটে নারীদের ফুটবল ম্যাচ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
বিশ্ব সুফী সংস্থার দাবি, গত ছয় মাসে ৮০টি মাজারে হামলা হয়েছে। ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার উত্তরায় চাপের মুখে বস্ত উৎসব বন্ধ করে দিতে হয়। ১২ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলে লালন উৎসবও হতে পারেনি বাধার মুখে। এর আগে নারায়ণগঞ্জে লালনভক্তদের মিলন মেলা পণ্ড করে দেন এক দল লোক। এরপরও যদি সরকার উগ্রপন্থার উত্থান অস্বীকার করে, সেটি সত্যের অপলাপই বলতে হবে।
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সম্মুখসারিতে থাকা একজন ছাত্রী যখন বলেন, ‘পাঁচ-ছয় মাস পর দেখছি, পুরো ব্যাপারটা উল্টে গেল’, তখন নিউইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদনকে বিভ্রান্তিকর বলার সুযোগ থাকে না।
তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছেন, ‘বাংলাদেশে কোনোভাবেই উগ্রপন্থার অবস্থান হবে না। আমাদের সরকার এ বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। যদি দেখি আলোচনা ও সতর্কতা যথেষ্ট নয়, তবে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
আমরাও মনে করি, যেকোনো সমস্যা সমাধানে আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যাঁরা আলোচনায় বিশ্বাসী নন, যাঁরা নিজের মতের বাইরে কিছুই শুনতে চান না, তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করে কতটা ফলপ্রসূ হবে, সেই প্রশ্ন আছে।
গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলায় কী ঘটেছে। ৩ এপ্রিল গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলায় স্থানীয়দের বাধায় একটি নাটকের মঞ্চায়ন বাতিল করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের রানীগঞ্জ উদয়ন সংঘ মাঠে আপন দুলাল নামের নাটকটি মঞ্চস্থ হওয়ার কথা ছিল। মাসখানেক ধরে আপন দুলাল নাটক মঞ্চস্থের জন্য রিহার্সেল চলেছে। রানীগঞ্জ উদয়ন সংঘ মাঠে ৫২ বছর ধরে স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মীদের আয়োজনে নাটক, গীতিনাট্য, পালাগানের মঞ্চস্থ হয়ে আসছিল।
প্রথম আলোয় নাটক বন্ধের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর সরকার শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করে। বলা হয়, মুসল্লি নয়, একটি রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের আপত্তির কারণে নাটক মঞ্চায়ন বন্ধ করা হয়েছিল। পরে উর্ধ্বতন মহলের হস্তক্ষেপে স্থানীয় প্রশাসন ফের নাটক মঞ্চায়নের ব্যবস্থা করে।
একশ্রেণির মানুষ আছেন, যাঁরা মনে করেন নাটক হলে সমাজ ‘খারাপ’ হয়ে যাবে, ছবি আঁকলে সমাজ ‘খারাপ’ হয়ে যাবে, গান গাইলে সমাজ ‘খারাপ’ হয়ে যাবে। মেয়েরা ঘরের বাইরে এলে সমাজ ‘খারাপ’ হয়ে যাবে। একুশ শতকে এসেও এরা একটা কূপমণ্ডূক সমাজ তৈরি করতে চায় এবং ক্ষেত্র বিশেষে সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের তাদের পক্ষ সাফাই গাইতেও দেখা যায়।
উগ্রপন্থার দাপট আমাদের সমাজে সব সময়ই ছিল। বিএনপি সরকারের আমলে ৬৩ জেলায় বোমা হামলা, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হলি আর্টিজান হত্যাকাণ্ড (নিহতদের বেশির ভাগই ছিলেন বিদেশি) বাংলাদেশে উগ্রপন্থার ভয়ংকর দৃশ্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। রামু, নাসিরনগর, কুমিল্লা, পীরগঞ্জসহ নানা জায়গায় সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনাও ঘটেছে।
সরকারের নীতিনির্ধারকদের মনে রাখতে হবে, অন্ধ হলেই প্রলয় বন্ধ থাকে না। নিউইয়র্ক টাইমস কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কিংবা বর্তমান সরকারকে কলঙ্কিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিবেদন করেছে, এই যুক্তি কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।
সাংবাদিক-গবেষক আলতাফ পারভেজ নিউয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদনকে হিমশৈলের সামান্য চূড়ামাত্র বলে অভিহিত করেছেন। অর্থাৎ বাংলাদেশে উগ্রপন্থার বিপদটি গুরুতর। আর উগ্রপন্থার তাণ্ডব কেবল ধর্মবিশ্বাসের কারণে ঘটছে, তা–ও নয়। সমাজে যখন সর্বত্র আইন না মানার সংস্কৃতি বেড়ে যায়, যুক্তির বদলে জবরদস্তি দিয়ে সব প্রশ্নের মীমাংসা করতে চায়, তখনই বিপদ বেড়ে যায়।
অতএব, সত্য অস্বীকার না করে সরকারের উচিত উগ্রপন্থার হিমশৈলের ‘নিমজ্জিত অংশ’ খুঁজে বের করা।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি