আগে স্থানীয় নির্বাচন করাটা যৌক্তিক, সংস্কার শেষ করাও গুরুত্বপূর্ণ
Published: 8th, March 2025 GMT
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দেওয়া যৌক্তিক বলে এক সভায় মত দিয়েছেন একাধিক আলোচক। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারকাজ শেষ করা এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনার ওপর জোর দেন তাঁরা।
আজ শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনবিষয়ক সংলাপ’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব পরামর্শ দেন। সেন্টার ফর পলিসি অ্যানালাইসিস অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি (সিপিএএ) নামের একটি সংগঠন ওই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক শাফিউল ইসলাম। ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন আয়োজন করাটা যৌক্তিক’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, দুটি সংস্কার কমিশন জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করার কথা বলেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত জনমত জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ৬৫ শতাংশ মানুষ আগে স্থানীয় নির্বাচন চান।
আগে স্থানীয় নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে শাফিউল ইসলাম বলেন, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে জনপ্রতিনিধি না থাকায় মানুষ সেবাবঞ্চিত হচ্ছেন। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন হলে শিক্ষিত ও যোগ্য ব্যক্তিরা জনপ্রতিনিধি হওয়ার জন্য এগিয়ে আসবেন। দলীয় সরকারের অধীনে স্থানীয় নির্বাচন হলে প্রার্থী কেনা-বেচা হয়, এর বাইরে সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীরা নিজের ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী ও আত্মীয়স্বজনকে প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করান। তাঁদের বিজয়ী করতে দলীয় ও প্রশাসনিক প্রভাব বিস্তার করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্যও আগে স্থানীয় নির্বাচন হওয়া প্রয়োজন। কারণ, স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি থাকলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা সহজ হয়। আগে স্থানীয় নির্বাচন হলে নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা যাচাই করারও সুযোগ হবে। রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন বলে তিনি আশা করেন। তিনি শুধু এবার নয়, সব সময় নির্দলীয় সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করার দাবি জানান।
আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে মত দিয়ে সাবেক সচিব মোহাম্মদ আবদুল কাইয়ূম বলেন, নির্বাচনে পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এখনো পুলিশ নিষ্ক্রিয়। প্রশাসনেও সমস্যা আছে। প্রশাসন নিরপেক্ষ আচরণ করবে, তা আশা করা যায় না।
নিরাপদ সড়ক চাই–এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে অনেক উপকার হবে। তবে সবার আগে রাজনীতিবিদদের মধ্যে পরিবর্তন প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। তিনি প্রশ্ন রাখেন, রাজনীতিবিদদের মধ্যে কি কোনো পরিবর্তন এসেছে? নতুন রাজনৈতিক দল যাঁরা করেছেন, তাঁদের মধ্যে কি পরিবর্তন এসেছে?
বেশির ভাগ আলোচক আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে মত দিলেও আগে জাতীয় নির্বাচন করা প্রয়োজন বলে মত দেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান। তিনি বলেন, সব নির্বাচনই অপরিহার্য। জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য নির্বাচন প্রয়োজন, ৫৩ বছরে সেটা হয়নি। অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র না হলে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন হবে না। তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য ছিল স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণ। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে সেটা হবে না। তিনি বলেন, অতীতে দেখা গেছে, অনির্বাচিত যেসব সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তারা আগে স্থানীয় নির্বাচন দিয়ে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছে। বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক অভিলাষ না থাকলে আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন না হওয়ার কথা নয় বলে তিনি মনে করেন।
এবি পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি আসাদুজ্জামান বলেন, ১৬ বছর ধরে রাজনৈতিক দলগুলো একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি করে আসছে। অন্যদিকে তরুণদের নেতৃত্বে গণ-অভ্যুত্থানের পর কোনো দেয়াললিখনে তিনি দেখতে পাননি যে তারা নির্বাচন চায়। তারা নতুন বাংলাদেশ চায়। সরকারকে পুরো দেশকে ধারণ করতে হবে। তিনি বলেন, যাঁরা নতুন বন্দোবস্ত চেয়েছিলেন, তাঁরাই ইতিমধ্যে পুরোনো বন্দোবস্তে ঢুকে গেছেন।
রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলাতে সংস্কার প্রয়োজন উল্লেখ করে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান বিন হাদী বলেন, তিনি নির্বাচনের বিপক্ষে নন। কিন্তু আগে সংস্কার হতে হবে। এখন ছাত্রদের দলও সেভাবে সংস্কারের কথা বলছে না। প্রথমে ছিল নির্বাচন না সংস্কার—এই প্রশ্ন। এখন সেটা হয়ে গেছে আগে স্থানীয় নির্বাচন, নাকি জাতীয় নির্বাচন। তিনি বলেন, মানুষের ভোগান্তি কমাতে নির্বাচন ছাড়া স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে প্রশাসক নিয়োগ করা হলে শত শত কোটি টাকার বাণিজ্য হবে।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব ও সঞ্চালনা করেন সিপিএএর সভাপতি অধ্যাপক মো.
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ক অন ষ ঠ ন ল ইসল ম সরক র র ন র জন
এছাড়াও পড়ুন:
শকুনদের দৃষ্টি থেকে বোনদের রক্ষা করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে
দেশে চলমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির ফলে নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে। কয়েকদিন ধরে দেখা যাচ্ছে, ঢামেকের আইসিউতে মাগুরার ছোট্ট আছিয়া মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। এই শকুনদের দৃষ্টি থেকে আমাদের বোনদের রক্ষা করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শনিবার রাজধানীর জাতীয় জাদুঘরের সামনে আন্তর্জাতিক নারী দিবস-২০২৫ উপলক্ষে জনপরিসরে নারীর নিরাপত্তা ও সাইবার সুরক্ষার দাবিতে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তারা এসব কথা বলেন।
সমাবেশে জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, জাতি হিসেবে এবং বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে আমরা একটি বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আজকে নারী দিবস, তবে এই পরিস্থিতিতে নারীরা যতটুকু নিরাপদ বোধ করার কথা তা আমরা নিশ্চিত করতে পারছি না।
তিনি বলেন, অভ্যুত্থানে দেখেছি প্রত্যেক মিছিলে ভাইয়েরা-বোনেরা ছিল। মিছিলের সামনের সারিতে যখন একশ’ জন নারী দাঁড়িয়ে যেত সেটি আমাদের কয়েক হাজার ভাইয়ের চেয়ে বেশি মনোবল এবং সাহস যোগাতো। কিন্তু কয়েকদিন ধরে দেখছি, ঢামেকের আইসিউতে মাগুরার ছোট্ট আছিয়া মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। এই শকুনদের দৃষ্টি থেকে আমাদের বোনদের রক্ষা করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে হেনস্তার ঘটনা উল্লেখ করে সারজিস বলেন, আমরা দেখেছি কীভাবে একজন বোনকে কোনো একজন তার মতের ওপর তার বিশ্বাসকে চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করেছে, তার পোশাকের ওপর দৃষ্টি করে যেভাবে ইচ্ছা কথা বলেছে। এর পরের ঘটনা আরও বেশি ক্ষতিকর। রাষ্ট্রের জন্য বিব্রতকর। ঘণ্টার পর ঘণ্টা থানায় দাঁড়িয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যদি একদিনের মধ্যে জামিন নিতে বাধ্য করি, এই সামগ্রিক প্রক্রিয়া রাষ্ট্রের সঠিকভাবে চলার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
সারজিস আরও বলেন, আমাদের পার্টির পক্ষ থেকে স্পষ্ট বলে দিতে চাই- রাষ্ট্র এক জিনিস আর ধর্ম আরেক জিনিস। রাষ্ট্রকে সকল ধর্ম, সকল চিন্তাধারাকে ধারণ করতে হয়। এখানে নির্দিষ্ট ধর্মের মানুষ তার বিশ্বাস-রীতিনীতি চাইলেই অন্য ধর্মের মানুষ বা যিনি কোনো ধর্মে বিশ্বাসী নয় তাকে চাপিয়ে দিতে পারে না। আমাদের বুঝতে হবে কোন কথাটি কোথায় বলতে পারব? কোন পরিসরে চাপিয়ে দিতে পারব।
অভ্যুত্থানে নারীদের ভূমিকা তুলে ধরে সারজিস বলেন, রাজপথে বোনেরা যখন সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে লড়াই করেছে তখন কেউ ওভাবে কথা বলতে পারেনি, তখন বরং সমর্থন দেখেছি কিন্তু যখনই তারা রাজনীতিতে এসেছে, স্পেসিফিকভাবে আমাদের পার্টিতে এসেছে তাদের নামে মিথ্যা প্রপাগান্ডা, অপপ্রচার করা হচ্ছে। নারীরা এমন নয়, যখন প্রয়োজন তখন ব্যবহার করব যখন মনে করব তখন অপপ্রচার চালাবো।
পলিসি মেকিংয়ে নারীদের অংশগ্রহনের কথা বলে সারজিস বলেন, আমরা বোনেদের অভ্যুত্থানে হাসিনার বিরোধী লড়াইয়ে সামনের সারিতে পেয়েছি আগামীর রাজনীতিতে পলিসি মেকিংয়ে সামনের সারিতে চাই। আমাদের বোনেরা বাংলাদেশের সংসদে যোগ্যতায় অংশগ্রহণ করে নারীদের প্রতিনিধিত্ব করবে।
তিনি আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে, সরকারকে বোনেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কেউ যেন তার ব্যক্তিগত বিশ্বাস সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ বা নারীদের ওপর চাপিয়ে দিতে না পারে। বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিবেশ বুঝতে হবে, এগুলোর বাইরে গিয়ে বোনেদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার চেষ্টা করে তাহলে বাহিনী ব্যর্থ পরিগণিত হবে। আমরা কাজ দেখতে চাই, নারীদের বোনদের ন্যায্য অধিকার সেফটি সিকিউরিটি নিশ্চিত করতে হবে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন বলেন, মাগুরায় আট বছরের একটি শিশুকে ধর্ষণের শিকার হতে দেখি এবং সেটার বিচার পাওয়ার জন্য আমাদেরকে এখনও রাস্তায় খেদিয়ে মরতে হয়। সেটাই বলে দেয় যে ফ্যাসিস্ট কাঠামো এখনও বিলোপ হয়নি।
তিনি বলেন, অভ্যুত্থানের প্রত্যেকটি ধাপে ধাপে নারীরা তাদের যে ভূমিকা দেখিয়েছেন, তারপরও অভ্যুত্থানের পরে আমরা দেখতে পাচ্ছি এটাকে অস্বীকার করার পাঁয়তারা চলছে। রাষ্ট্রীয় কাঠামো যেন আর প্রতারণামূলক আচরণ করতে না পারে।
তিনি বলেন, রাষ্ট্র পুনর্গঠনের যে স্বপ্ন আমরা দেখতে চাচ্ছি, নারীদেরকে এখানে নেতৃত্বে আসার পুরো উল্টোদিকে রাজনৈতিক কাঠামো চলছে। আগামীতে নারী নেতৃত্ব তৈরির জন্য সংরক্ষিত আসন কোনো ভূমিকা রাখবে না, তবে সংরক্ষিত আসনের ভূমিকা কীভাবে ইলেকটোরাল জায়গায় ধারণ করা যায় সেটা চিন্তা করতে হবে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নারীদের নিরাপত্তা সুযোগ, নেতৃত্ব তৈরির জন্য উদ্যোগী হতে হবে।
সমাবেশে জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ মাসুদ রানার স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদাউস বলেন, আদৌ কি আমরা সম্মান পাই? আমি জানি না। আন্দোলনে আমাদের হাসবেন্ড নিহত হওয়ার পর প্রতি পদে পদে হেনস্তার শিকার হচ্ছি। আমরা যেখানে যাই, সেখানে অপমান করা হয়। একটা মেয়ে বিধবা হলে তার কি ব্যক্তিত্ব থাকে না?
তিনি বলেন, আমার স্বামী যাওয়ার পরে ছোট বাচ্চাদের কীভাবে মানুষ করছি, তা শুধু আমরাই জানি। সাত মাস আগেও সুখের সংসার ছিল আজ আমরা প্রতিনিয়ত অপমানিত হচ্ছি। নারীদের ন্যায্য অধিকার দেওয়া হোক। সাতটা মাস কীভাবে চলছি কেউ একটাবারও খোঁজ নেয়নি।
শহীদ অপুর স্ত্রী আমেনা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী মারা যাওয়ার পর সবাই অবহেলা করে, কেন? এর কোনো উত্তর কেউ দিতে পারবেন না। একটা গুলিতে আমার স্বামী শেষ। দুঃখের কথা বলে শেষ করতে পারব না। আমি পায়ের সমস্যার জন্য কাজ করতে পারি না। নারী দিবসে একটা কথা বলি- আপনারা আমাদেরকে সম্মান দিয়েন, আমাদের ন্যায্য অধিকার বুঝিয়ে দিয়েন।’
সমাবেশে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমীনের সঞ্চালনায় পার্টির যুগ্ম আহবায়ক নুসরাত তাবাসসুম, গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের কেন্দ্রীয় সংগঠক শ্যামলী সুলতানা জেদনী, মোহাম্মদপুর বেড়িবাধ বস্তির প্রতিনিধি ময়না, ওয়েস্টিন হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী তাসমিয়া রহমান প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।