জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে নারীরাই সামনের সারিতে ছিলেন। এখন সেই নারীদের বেঁচে থাকাই বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবাদ করলে মবের শিকার হতে হচ্ছে। গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে নারীদের হয়রানি করা হচ্ছে। নারীর প্রতি এই বিদ্বেষের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তী সরকারও নীরব। বাংলাদেশকে পরিবর্তনের জায়গায় নিতে হলে নারীদের আরও সক্রিয় ও সোচ্চার হতে হবে।

আজ ৮ মার্চ শনিবার আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে নারী সংহতি আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন বক্তারা।

রাজধানীর বাংলামোটরে অবস্থিত বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে ‘নারীমুক্তির আকাঙ্ক্ষা: গণ–অভ্যুত্থান পরবর্তী বাস্তবতা’ শিরোনামে মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। সভায় বক্তারা বলেন, স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে সবাই এক হয়েছিল। এখন নারী বিষয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আন্দোলনের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে তাড়ানো গেছে, কিন্তু ফ্যাসিজম রয়ে গেছে। একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী নারীদের সক্রিয় উপস্থিতি সহ্য করতে পারে না। সম্প্রতি লালমাটিয়ায় ধূমপান করাকে কেন্দ্র করে মব (উচ্ছৃঙ্খল জনতার দল) সৃষ্টি করে দুই নারীকে মারধর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ওড়না নিয়ে এক ছাত্রীকে হেনস্তা, মাগুরার শিশু ধর্ষণসহ নারী নির্যাতনের ঘটনা উল্লেখ করে নারীর নিরাপত্তাহীনতা ও অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বক্তারা।

মতবিনিময় সভায় অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, পোশাক, ধূমপান হচ্ছে উসিলা। অনেক বড় শক্তিশালী একটি গোষ্ঠী আছে, যারা নারীদের স্বাধীনতা, সক্রিয় উপস্থিতি সহ্য করতে পারে না। তারা চায় নারী নির্জীব ও অধীনস্থ থাকবে। তাই যেসব কাজে ওই গোষ্ঠীগুলোর আপত্তি আছে—যেমন খেলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, রাজনীতি, সেসব বিষয়ে নারীদের আরও সক্রিয় হতে হবে। গণ–অভ্যুত্থানের পর যে পরিস্থিতি হয়েছে, তা নিয়ে অনেকের হতাশা রয়েছে, যা যুক্তিযুক্ত নয়। স্বৈরাচার পতনের লক্ষ্য নিয়ে ঐক্য ছিল, স্বৈরাচার পতনের মধ্য দিয়ে সেই লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। কাঠামোগত পরিবর্তনের কোনো লক্ষ্য ছিল না। নারীর বিষয়কে সামনে এনে সেই ঐক্য তৈরি করতে হবে।

নারী নিপীড়নের অভিযোগ প্রসঙ্গে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, এসব অভিযোগের বিরুদ্ধে সরকারের সরব ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগের সময় বলা হতো, বিএনপি–জামায়াত চক্রান্ত করছে। তাহলে সরকারে ছিল কী কারণে? অন্তর্বর্তী সরকারের জন্যও এটা প্রযোজ্য। চক্রান্ত হলে তারা কী করছে?

অভ্যুত্থানের সময় দেয়াললিখন—গ্রাফিতিতে লিঙ্গীয়, জাতিগত, শ্রেণিগত বৈষম্য নিরসনের আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ছিল উল্লেখ করে সে আকাঙ্ক্ষা ধরে সম্মিলিতভাবে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।

নারী সংহতির সভাপতি শ্যামলী শীল বলেন, সংঘবদ্ধ নারীবিদ্বেষী তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। ব্যক্তিগত নিপীড়ন থেকে ঘটনার শুরু হচ্ছে। নারী যখন প্রতিবাদ করছে, তখন তার বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ চক্র জুটে যাচ্ছে। যেভাবে নিপীড়ন ও হয়রানি করা হচ্ছে, তা রীতিমতো ভীতিকর। এ ধরনের পরিস্থিতিতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা গ্রহণযোগ্য নয়। পুরোনো সরকারের মতোই তাঁর বক্তব্য। প্রতিবাদী নারীদের নানাভাবে ‘ট্যাগিং’ করা হচ্ছে। রাষ্ট্র সেখানে নীরব ভূমিকা পালন করছে।

সভায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্য সীমা আক্তার বলেন, জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে নারীরাই সামনের সারিতে ছিলেন। ৫–৬ আগস্টের পর থেকেই একটু একটু করে নারীদের স্বপ্ন ভাঙতে শুরু করে। নারীদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তারা ক্ষমতায় এসেছে। এখন নারীদের বেঁচে থাকাই বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবাদ করলে মবের শিকার হতে হচ্ছে, গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে হয়রানি করা হচ্ছে।

কণ্ঠশিল্পী কৃষ্ণকলি ইসলাম বলেন, আন্দোলনে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সাহসী উপকরণ হিসেবে কাজ করে। রাজনৈতিকভাবে সংস্কৃতি কর্মীদের বাজেভাবে ব্যবহার করা হয় ও পরে ছুড়ে ফেলা হয়। এবারও তাই হয়েছে। চারপাশে বৈষম্যের কোনো ঘাটতি নেই। ছাত্রদের যে রাজনৈতিক দল হয়েছে, সেখানে অন্য ধর্মের মানুষের উপস্থিতি নেই, নারীদের উপস্থিতি কম।

অন্তর্বর্তী সরকারকে টিকিয়ে রাখতে শিক্ষার্থীদের ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান নারীগ্রন্থ–প্রবর্তনার পরিচালক সীমা দাস সীমু। তিনি বলেন, নারী নির্যাতন বন্ধে এ সরকার ব্যর্থ হয়েছে। তাঁর প্রশ্ন, অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে এই সরকারকে পরাজিত শক্তি ব্যর্থ দেখাতে চাইছে কি না।

সভায় আরও বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোশাহিদা সুলতানা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফাতেমা সুলতানা শুভ্রা, শৈশব–এর প্রতিষ্ঠাতা ফারহানা মান্নান, জাসদ-রবের সহসভাপতি তানিয়া ফেরদৌসী, সমাজতান্ত্রিক নারী জোটের সহসভাপতি ফারজানা জামান, সংস্কৃতি কর্মী ঋতু সাত্তার, আইনজীবী সাদিয়া আরমান, এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফারজানা প্রমুখ।

সভা সঞ্চালনা করেন নারী সংহতির সাধারণ সম্পাদক অপরাজিতা চন্দ।

সভায় নারীর সমান মজুরি, রাজনীতিতে অংশগ্রহণ বাড়ানো, গৃহকর্মীদের নিরাপত্তা এবং তৃণমূল থেকে শুরু সব পর্যায়ের নারীদের ক্ষমতায়ন ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের আহ্বান জানানো হয়।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সরক র র উপস থ ত র জন ত

এছাড়াও পড়ুন:

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নীতির ধারাবাহিকতা জরুরি

স্থানীয় হোক, আর বিদেশি হোক– সকল বিনিয়োগকারীর জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং নীতির ধারাবাহিকতা সবচেয়ে জরুরি। অন্যদিকে নীতি যা আছে, তা বাস্তবায়ন করতে হবে। গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম সহনীয় রাখাও খুব প্রয়োজনীয় বিষয়। 

গতকাল বুধবার রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলনের তৃতীয় দিনে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই আয়োজিত এক সেমিনারে এমন মত দেন বক্তারা। 

তাদের মতে, এ দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অন্যতম বড় বাধা নীতির ধারাবাহিকতা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকা। এছাড়া সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতাসহ আরও কিছু বিষয়ে বিনিয়োগকারীদের নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। 

সেমিনারে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, বাংলাদেশ একটি পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এখনকার বিভিন্ন নীতি নিয়ে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। বিনিয়োগ-সংক্রান্ত ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা হয়েছে। এর সমাধান করা হচ্ছে। তিনি উল্লেখ করেন, কেন বাংলাদেশে বিদেশিরা বিনিয়োগ করবে– এ প্রশ্ন সবসময় আসে। এর উত্তরে তাঁর বক্তব্য হলো, বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের নবম ভোক্তা বাজার হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের শক্তিশালী জনবল আছে। বিনিয়োগবান্ধব নীতি আছে। 

গবেষণা সংস্থা সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, বিনিয়োগের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা জরুরি। বিনিয়োগকারীরা নীতির ধারাবাহিকতা চান। হঠাৎ নীতির পরিবর্তনকে তারা বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখেন। তাঁর মতে, এনবিআর এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে নীতির সমন্বয় নেই। বিনিয়োগ আকর্ষণে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যেও সংস্কার প্রয়োজন। তিনি বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ আনতে হলে দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রয়োজন। শিল্পায়ন থেকে শুরু করে সব জায়গায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি শক্তির ব্যবহার করতে হবে। 

বিটিএমএর সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্ক প্রত্যাহার করানোর উদ্যোগের উপায় প্রসঙ্গে বলেন, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিনা শুল্কে সুতা আমদানি করে। এটি অব্যাহত রাখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশের উচিত পণ্য ধরে ধরে আলোচনা করা। 

আমরা কি আসলেই বিনিয়োগ বান্ধব হতে পেরেছি– এমন প্রশ্ন রেখে এপেক্স ফুটওয়্যারের এমডি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, ‘আমাদের কাছে প্রশ্ন আসে বাংলাদেশে কেন বিনিয়োগ করব। বিনিয়োগকারীদের অনেক বিকল্প আছে। ভারত, চীন ও মালয়েশিয়া তাদের বড় বিকল্প। এখন আমাদের প্রয়োজন নীতির প্রাসঙ্গিকতা। নীতির বাস্তবায়ন।’ 

জাপান-বাংলাদেশ চেম্বারের সভাপতি তারেক রাফি ভূঁইয়া বলেন, যারা ইতোমধ্যে বিনিয়োগ করেছেন, তাদের প্রতি নজর বাড়াতে হবে। তাদের সুবিধা অব্যাহত রাখতে হবে। এর মাধ্যমে সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করা সম্ভব। 

বিল্ডের সিইও ফেরদৌস আরা বলেন, বাংলাদেশে ‘ভেঞ্চার ক্যাপিটাল’ খুবই কম। যারা আছে তাদের নিবন্ধন জটিলতা অনেক বেশি। বিএসইসিসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান থেকে নিবন্ধন নিতে হয়। তবে বিডা ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করেছে। এর মাধ্যমে নিবন্ধন আগের চেয়ে সহজ হয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ