চা-বাগানের ভেতরে উঁচু এক টিলা। সেখানে একটি আধা পাকা ঘরের সামনের উঠানে পাতা মাদুরে কয়েকজন বয়স্ক নারী বসে আছেন। ঠিক পাশে বসে আরেকজন অল্প বয়স্ক নারী। অল্প বয়স্ক ওই নারী হাতে-কলমে বয়স্ক নারীদের নাম লেখা শেখাচ্ছেন। বয়স্ক নারীরা মনোযোগ দিয়ে নিজেদের নাম লিখছেন।
সিলেট সদর উপজেলার দলদলি চা-বাগানে সম্প্রতি গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা যায়। অল্প বয়স্ক যে নারী নাম লেখা শেখাচ্ছেন, তাঁর নাম বিজলী নায়েক (২৪)। স্বামী কৃষ্ণ দাস, পাঁচ বছরের একমাত্র ছেলে আর শ্বশুর-শাশুড়িসহ ছয় সদস্যের সংসার তাঁর। নিজে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন।
বিজলী জানান, বিভিন্ন সময়ে চা-শ্রমিকদের ত্রাণ, অনুদানসহ বিভিন্ন সামগ্রী স্বাক্ষর করে নিয়ে আসতে হয়। বয়স্কদের অনেকে নিরক্ষর। এই কারণে তাঁদের সই না করে টিপসই দিতে হয়। এটা বিবেচনায় নিয়ে তিনি চা-শ্রমিক নারীদের পড়ালেখা শেখানোর উদ্যোগ নেন। এ জন্য বয়স্ক শিক্ষার পাঠশালা চালু করেন। এখানে বিনা পয়সায় অনেকে বর্ণমালা শেখার পাশাপাশি সইসহ হাতেখড়ি নিচ্ছেন। সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার বেলা ১১টা থেকে আধা ঘণ্টাব্যাপী এমন পাঠদান চলে। চার মাস ধরে এমন কার্যক্রম চলছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থা গ্লোবাল ফান্ড ফর চিলড্রেনের (জিএফসি) সহযোগিতায় উদ্যোক্তাদের সামাজিক কাজে উৎসাহিত করেছে এথনিক কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (একডো)। একডো নিয়োজিত একজন সহায়কের কাছ থেকে উৎসাহ পেয়ে বিজলী নায়েক নিজেদের জনগোষ্ঠীর নারীদের এগিয়ে নিতে বিনা মূল্যে পড়ালেখা শেখানোর দায়িত্ব নেন।
একডোর নির্বাহী পরিচালক লক্ষ্মীকান্ত সিংহ বলেন, ‘স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে গতানুগতিক পদ্ধতিতে কোনো প্রকার টাকা বা প্রশিক্ষণ না দিয়ে তাঁদের মধ্যে ইতিমধ্যে থাকা ব্যক্তিগত ন্যূনতম কোনো সম্পদ বা দক্ষতা দিয়ে নিজের এবং নিজ জনগোষ্ঠীর মানুষের উন্নয়নের জন্য স্ব-উদ্যোগে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে বিভিন্ন উন্নয়ন উদ্যোগ গ্রহণ করতে উৎসাহিত করেছি আমরা। এমন উৎসাহ পেয়ে বিজলী বয়স্ক শিক্ষার পাঠশালা চালু করেছেন।’
দলদলি চা-বাগানের মিনতি দাস (৩৭), জানকী দাস (৩৯), গীতা দাস (৪০), অনিতা দাস (৪৫) ও বাদলী দাস (৫০) বয়স্ক শিক্ষার পাঠশালায় নাম ও সই লিখতে শিখেছেন। তাঁরা এখন অন্যান্য অক্ষর চেনার পাশাপাশি প্রাত্যহিক জীবনে চলার জন্য গাণিতিক হিসাবও শিখছেন। তাঁরা জানান, প্রতি শুক্রবার প্রায় আধা ঘণ্টা বিজলী নায়েকের বাসার সামনে পাঠদান কার্যক্রম শুরু হয়। কয়েক মাস ধরে তাঁরা একটু একটু করে অক্ষর শিখেছেন। এখন তাঁরা নাম–দস্তখত করতে পারেন। পাশাপাশি টুকটাক অঙ্কও শিখছেন।
বয়স্ক শিক্ষার পাঠশালার ছাত্রী জানকী দাস জানান, বিজলী তাঁদের বিনা পয়সায় নাম-দস্তখত শেখাচ্ছেন। আগে তাঁরা যেকোনো সরকারি-বেসরকারি অনুদান কিংবা সম্মানী নিতে টিপসই দিতেন। এখন দস্তখত দেন।
বিজলী নায়েক জানান, চা-বাগানের আরেকটি পাড়ার কিছু নারীও এখন অক্ষর ও নাম দস্তখত শেখার জন্য তাঁকে অনুরোধ জানিয়েছেন। তিনি তাঁদের নিয়েও পৃথক আরেকটি পাঠশালার কার্যক্রম শিগগির শুরু করবেন।
সিলেটের নাট্যকার হুমায়ুন কবির জুয়েল দলদলি চা-বাগানের শ্রমিকদের নিয়ে সবুজ বৃক্ষে নীল কষ্ট শীর্ষক একটা নাটক নির্দেশনা দিয়ে কয়েক মাস ধরে নিয়মিত সিলেটের বিভিন্ন চা-বাগানে মঞ্চস্থ করছেন। চা-শ্রমিক জনগোষ্ঠীর জীবনের সুখ-দুঃখ অবলম্বনে রচিত এ নাটকে বিজলী নায়েক এনজিও আপা চরিত্রে অভিনয় করছেন।
হুমায়ুন বলেন, ‘নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে বিজলী নায়েক যেমন তাঁর নিজের চা-জনগোষ্ঠীর অসংগতি দূর করতে কাজ করছেন, তেমনি নিজেও সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে বয়স্ক শিক্ষার একটি পাঠশালা চালু করেছেন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: বয়স ক ন র জনগ ষ ঠ র উৎস হ
এছাড়াও পড়ুন:
যুক্তরাষ্ট্রের আরও ১০০ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেবে বাংলাদেশ
যুক্তরাষ্ট্রে সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে আরও ১০০ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেবে বাংলাদেশ। সরকারে এমন উদ্যোগের কথা জানিয়ে আজ সোমবার সন্ধ্যায় যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) কাছে চিঠি লিখেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এর আগে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা বাড়তি ৩৭ শতাংশ তিন মাসের জন্য স্থগিত চেয়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চিঠি দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশি পণ্যের ওপর যে অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা প্রত্যাহার করে। এরপর থেকে বাংলাদেশের সকল রপ্তানি পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়। অথচ বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর গড়ে ৬ দশমিক ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। উল্লেখ্য, কাঁচা তুলা ও লোহার স্ক্র্যাপের ক্ষেত্রে আমাদের শুল্ক হার যথাক্রমে শূন্য ও এক শতাংশ।
চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বড় তুলা আমদানিকারক দেশ, যা দিয়ে তৈরি পোশাক শিল্প চালিত হয়। অথচ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির ক্ষেত্রে আমাদের পণ্যগুলোর ওপর বেশি শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে। বর্তমানে আমাদের শুল্ক তালিকায় ১৯০টি পণ্যের ওপর শুল্ক হার শূন্য এবং আরও ১০০টি পণ্যকে শুল্কমুক্ত তালিকায় যুক্ত করার চিন্তাভাবনা চলছে।
এতের আরও বলা হয়, ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর স্বাক্ষরিত বাংলাদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম চুক্তি (টিকফা) অনুযায়ী, উভয় দেশ বাণিজ্য ও বিনিয়োগের পথে প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করে তা যৌথভাবে দূর করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশ সব সময় গঠনমূলক সংলাপ ও সহযোগিতায় বিশ্বাসী। যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানিতে যদি কোনো বাধা থাকে তা দূর করতে প্রস্তুত। এ বিষয়ে ঢাকায় অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসের বাণিজ্য শাখার সঙ্গে একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার শুল্ক হার কমানো, সব ধরনের অশুল্ক বাধা দূর করা এবং পারস্পারিক বাণিজ্যকে আরও লাভজনক করতে বিভিন্ন সংস্কারমূলক উদ্যোগ নিয়েছে। এসব উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে: আমদানি নীতির হালনাগাদ, কাস্টমস প্রক্রিয়া সহজীকরণ, মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ, ট্রেডমার্ক ও পেটেন্ট সুরক্ষা ইত্যাদি।
এছাড়া আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি চুক্তি, মার্কিন অটো নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশে কারখানা স্থাপনের প্রস্তাব, বেসরকারি উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে সয়াবিন, গম, তুলা ইত্যাদি বড় আকারে আমদানির উদ্যোগ এবং যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি খাতকে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সেবামূলক খাতে বিনিয়োগে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
চিঠিতে বাণিজ্য উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, তার বিশ্বাস এসব উদ্যোগ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ভারসাম্য আনতে এবং উভয় দেশের জনগণের জীবনমান উন্নয়নে সহায়ক হবে। প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুস এবং তাঁর সরকারসহ বাণিজ্য উপদেষ্টা ব্যক্তিগতভাবে ইউএসটিআর দপ্তরের সঙ্গে গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্ক আরও মজবুত করতে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ হারে পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ ঘোষণা দেন। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের বেশির দেশের পণ্যে এমন শুল্ক আরোপ করেন ট্রাম্প। যে দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য–ঘাটতি বেশি, সেই দেশের ওপর বেশি হারে শুল্ক আরোপ হয়েছে। এ নিয়ে বিশ্বজুড়ে তোলপাড় চলছে। বাংলাদেশেও সরকারের উচ্চমহল ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে আলোচনা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আজ প্রধান উপদেষ্টা ও বাণিজ্য উপদেষ্টা এ বাড়তি শুল্কের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রে দুই চিঠি দেন।