নড়াইলে বিএনপি অফিসে ‘বোমা’ হামলা, আহত ৩
Published: 8th, March 2025 GMT
নড়াইলের সদর উপজেলার গোবরা স্ট্যান্ড এলাকায় শিংগাশোলপুর ইউনিয়ন বিএনপি অফিস লক্ষ্য করে তিনটি ‘বোমা’ নিক্ষেপ করেছে সন্ত্রাসীরা বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
শুক্রবার (৭ মার্চ) রাত সাড়ে ৯টার দিকে হওয়া এ ঘটনায় দলটির তিন নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে একজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।
নড়াইল সদর থানার ওসি সাজেদুল ইসলাম বলেন, “হামলার ঘটনায় জড়িতদের খুঁজে বের করতে পুলিশসহ অন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কাজ করছে।”
আরো পড়ুন:
কিশোরগঞ্জে জমি নিয়ে বিরোধে মৃত্যু, আটক ৫
বরিশালে যুবদল কর্মীকে কুপিয়ে হত্যা
আহতরা হলেন- শিংগাশোলপুর ইউনিয়ন বিএনপির সহ-সভাপতি ও গোবরা গ্রামের আব্দুল হামিদ শেখের ছেলে বাবু মোল্যা (৬০), একই গ্রামের আবুল হোসেনের ছেলে বিএনপি কর্মী নিউটন গাজী (৪৮) এবং সৈয়দ জাফর আলীর ছেলে বিএনপি কর্মী সৈয়দ ওয়াজেদ আলী টিটো।
এলাকাবাসী জানান, শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে গোবরা নতুন স্ট্যান্ডে শিংগাশোলপুর ইউনিয়ন বিএনপি অফিসে নেতাকর্মীরা বসে ছিলেন। এসময় মোটরসাইকেলে করে আসা সন্ত্রাসীরা বিএনপি নেতাদের লক্ষ্য করে তিনটি বোমা নিক্ষেপ করে পালিয়ে যায়। বোমা বিস্ফোরিত হলে বিএনপির তিন নেতাকর্মী আহত হন। পরে স্থানীয় লোকজন আহতদের উদ্ধার করে নড়াইল আধুনিক সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। গুরুতর আহত সৈয়দ ওয়াজেদ আলী টিটোকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় রেফার্ড করেন চিকিৎসক।
নড়াইল আধুনিক সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা.
ঢাকা/শরিফুল/মাসুদ
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর আহত ব এনপ
এছাড়াও পড়ুন:
সাপ্তাহিক পত্রিকা : সোনালি অতীত ও প্রসঙ্গকথা
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই দেশের সবচেয়ে আলোচিত পূর্ণাঙ্গ সাপ্তাহিক পত্রিকাটির (বিচিত্রা) জন্ম হয়। কয়েকজন সম্পাদকের হাত ঘুরে মুক্তিযোদ্ধা ও চিত্রশিল্পী শাহাদত চৌধুরী সম্পাদক হিসেবে নিয়োজিত হওয়ার পরেই প্রকৃতপক্ষে পত্রিকাটির উত্থান ও জনপ্রিয়তা। পত্রিকাটির ‘জীবনাবসান’ মধ্য নব্বুইয়ে। স্বাধীনতা লাভের ৪৩ বছর পরে, ২০১৪ সালে দেশের শেষতম মানসম্পন্ন পূর্ণদৈর্ঘ্য সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনটি মৃত্যুমুখে পতিত হয়। এর পর এক দশক পেরিয়ে গেলেও নতুন কোনো মানসম্পন্ন ও জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন সুসম্পাদিত সাপ্তাহিক পত্রিকার দেখা না পাওয়ায় আপাতত বাধ্য হয়ে ধরে নিতে হচ্ছে যে দেশে সাপ্তাহিক পত্রিকার ধারাটি অবলুপ্ত হয়ে গেছে। দৈনিক সংবাদপত্রগুলোও যেভাবে চ্যালেঞ্জের সম্মুখিন হয়েছে ২০২০ সালে কোভিড মহামারি আসার পরে, তাতে মনে হচ্ছে আগামী এক দশকে অনেক সংবাদপত্রই বন্ধ হয়ে যাবে। এমন একটি বাস্তবতায় নিকট ভবিষ্যতে কমিটেড প্রকাশক বা পুঁজি লগ্নিকারীর আবির্ভাব ঘটবে, এমন ভরসা পাই না। যদিও একজন পাকা সুঅভিজ্ঞ সম্পাদককে নিয়ে কোনো উদার অর্থ যোগানদাতা প্রকাশক এগিয়ে এলে এখনও দেশে একটি প্রতিনিধিত্বকারী সাপ্তাহিক পত্রিকার জন্মলাভের সম্ভাবনা রয়েছে। এটা কোনো কথা হতে পারে না যে, ১৮ কোটি বাঙালির বাংলাদেশ নামের একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় এবং মতভিন্নতায় দ্বন্দ্বপূর্ণ দেশে একটিও পূর্ণাঙ্গ সাপ্তাহিক পত্রিকা থাকবে না। এ নিয়ে লেখার শেষে কিছু কথা বলব।
ফিরে যাই শুরুর কথায়। অবাক হলেও সত্য যে ২০১৪ সালে ঘোষণা দিয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া পূর্বে উল্লেখিত পত্রিকার (সাপ্তাহিক ২০০০) প্রতিষ্ঠাকালীন সম্পাদক ছিলেন সেই একই ব্যক্তি, অর্থাৎ শাহাদত চৌধুরী। অবশ্য এই সম্পাদকের প্রয়াণের পরে একাধিক সম্পাদক নিযুক্ত হন, যাঁরা ওই বিচিত্রা-রই জাতক। শাহাদত চৌধুরী বেশ উচ্চাভিলাষী নাম দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন হয়তো এটি টিকে থাকবে ২৯৯৯ সাল পর্যন্ত। পরে এলিয়েনরা এসে বুঝি ২০০০ পত্রিকাকে আদিম যুগীয় বলে বাতিল করে দেবে যাতে ৩০০০ নামে একটা পত্রিকা প্রকাশ হতে পারে। হাজার বছর পরের সেই সাপ্তাহিক পত্রিকাটি ছাপানো বা অনলাইনে প্রকাশের দরকারই পড়বে না। বিশেষ একটি লেন্স চোখে দিয়ে নির্দিষ্ট পয়েন্টে টাচ করলে নতুন সংখ্যার কনটেন্টগুলো ছবিসহ ভেসে উঠবে।
যাহোক, সাপ্তাহিক ২০০০-এর মৃত্যুর অব্যবহতি আগের কয়েকটি মাসে পত্রিকার সম্পাদকের, মঈনুল আহসান সাবেরের, পরেই ছিল আমার অবস্থান, তবু সুযোগ পেলেই রিপোর্ট / ফিচার লিখতাম ( আমার যুক্ততা মাত্র সাত মাসের জন্য, কনটেন্টে লক্ষ্যযোগ্য পরিবর্তন আনার তাগিদে)। আশির দশকে অবশ্য বিচিত্রাতেও আমি কিছু লেখালেখি করেছি। শাহরিয়ার কবীর ও মঈনুল আহসান সাবেরের আগ্রহে, তবে সেটিতে আমি নতুন ধরনের মাত্র একটি বিষয় চালু করেছিলাম। বিচিত্রা নতুন জিনিসের গুরুত্ব বুঝতো, যদি সত্যিই সেটি নতুন হয়। মনে পড়ল, লেখকদের টুকরো খবর কয়েক কিস্তি ছাপা হয়েছিল এবং রিপোর্টে লেখকদের ছবি থাকায় বেশ একটা তারকা-তারকা ভাব চলে এসেছিল। সমস্যা হয়েছিল আখতারুজ্জামান ইলিয়াস একটা প্রতিবাদ দেয়ায়। আড্ডাচ্ছলে মজার মজার যেসব কথা তিনি বলেছিলেন, শতভাগ বাস্তব সত্য, সে-মতগুলো ছাপার অক্ষরে লাখো মানুষ পড়লে তার মাত্রা ভিন্ন হয়ে যায়। লেখক তখন ঢাকা কলেজের শিক্ষক। সহকর্মী কারো কারো কাছে তিনি বিরাগভাজন হন। সত্যিই আমার রিপোর্টে তাঁর উদ্ধৃতি তাঁর সহশিক্ষকদের জন্য বিব্রতকর হয়ে থাকতে পারে। যাহোক, ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ থাক। দেশের সাপ্তাহিক পত্রিকার সোনালি যুগের দিকে চোখ ফেরানো যাক।
পাঠক লক্ষ্য করবেন সাপ্তাহিক পত্রিকার আগে এ লেখায় আমি ‘পূর্ণাঙ্গ’ ও ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য’ দুটো শব্দ ব্যবহার করেছি। ৬৪ পাতার বিচিত্রধর্মী লেখা ও ছবির সমাহারে যে কয়টি পত্রিকা ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে তার ভেতর রয়েছে বিচিত্রা, সচিত্র সন্ধানী, রোববার, বিপ্লব, মূলধারা ও সাপ্তাহিক ২০০০। এর বাইরে সুলভ কাগজে ৩২ পাতার প্রধানত রাজনৈতিক কলাম ও হালফিল রাজনীতির বিশ্লেষণধর্মী যেসব কাগজ বেরুতো, সেগুলো ছিল মেজাজের দিক থেকে আলাদা। সেগুলোকে পূর্ণাঙ্গ ম্যাগাজিন বলা না গেলেও আশির দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনকালে বিপুল পাঠকপ্রিয় হয় কাগজগুলো। এর ভেতর উল্লেখ করতেই হবে এমন কয়েকটি পত্রিকা হলো যায়যায়দিন, দেশবন্ধু, পূর্বাভাস, খবরের কাগজ, আজকের সূর্যোদয় ও বিচিন্তা। একমাত্র বিচিন্তা ছাড়া সবগুলোতেই আমি নিয়মিত লিখতাম। আর পূর্ণাঙ্গ সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনগুলোর ভেতর মূলধারার (প্রধান সম্পাদক কবি শামসুর রাহমান, প্রকাশক সাবের হোসেন চৌধুরী) অন্যতম পরিকল্পনাকারী ছিলাম, এবং সচিত্র সন্ধানীতে নানা সময়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছি। তাই ঢাকার ম্যাগাজিনভুবনে আদ্যোপান্ত জড়িয়ে থাকা এই আমি বহু ইতিহাসের প্রত্যক্ষদর্শী।
পাঠক, খেয়াল করুন এই যে এতগুলো ম্যাগাজিনের নাম উল্লেখ করলাম, তার একটিও আজ জীবিত নেই। একেকটি প্রেম হারিয়ে ফেলার মতোই ছিল একেকটি কাগজের বন্ধ হয়ে যাওয়া। তাকে আর ইহজগতে দেখতে না পাওয়া। সাপ্তাহিক বিপ্লব পত্রিকার প্রতিষ্ঠাকালীন সম্পাদক ছিলেন কবি সিকদার আমিনুল হক, যার সঙ্গে আমার গভীর সখ্য হয়েছিল পত্রিকাটি মারা যাওয়ার বহু বছর পরে। অল্প ক’বছর বিপ্লব টিকলেও আমৃত্যু সেটির সম্পাদক প্রেমাচ্ছন্নের মতোই পত্রিকাটির স্মৃতিচারণ করে গেছেন আমাদের কাছে। আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় দেখেছি দেশে পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করা সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলোর ক্ষেত্রে দু’ধরনের সম্পাদক ছিলেন: এক দলের কাছে ভারতীয় পত্র-পত্রিকা ছিল আদর্শ, অন্যদিকে ক্ষীণসংখ্যক সম্পাদক ইওরোপ আমেরিকার ম্যাগাজিন টাইম নিউজ উইক ইকোনমিস্টের সমঝদার ছিলেন। ফলে পাঠকরাও কনটেন্টের বিচারে বৈচিত্র্যের স্বাদ পেয়েছেন।
এখানে আরেকটি কথা শুরুতেই বলে নেয়া ভালো যে, শফিক রেহমান সম্পাদিত অল্প পাতার ‘শস্তা’ যায়যায়দিন পত্রিকায় যা কিছু তুমুল পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল তার সব কটি ধারাবাহিক রচনাই বছরের পর বছর পূর্বতন পূর্ণাঙ্গ রুচিশীল সংস্কৃতিমনস্ক ম্যাগাজিন সচিত্র সন্ধানীতে ছাপা হতো। সত্তর দশকের বিচিত্রাকে অনুসরণ করেছিল নব্বুইয়ের শেষার্ধে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ২০০০, আর পেয়েছিল ডেইলি স্টার গ্রুপের আনুকূল্য (অন্যদিকে বিচিত্রা ছিল সরকারি ট্রাস্টের পত্রিকা)। তবু শেষপর্যন্ত পাঠকের কাছে পত্রিকা দুটির মৃত্যুসংবাদ পৌঁছে গিয়েছিল। আরেকটু পরিষ্কার করে না বললে আজকের পাঠকেরা বিভ্রমে পড়তে পারেন। ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল সরকারের মালিকানাধীন কোনো পত্রিকা রাখা হবে না। ক্ষমতায় আসার পর নির্বাচনী ইশতেহার অনুসারে ১৯৯৭ সালে দৈনিক বাংলা-টাইমস ট্রাস্ট বিলুপ্ত করে বিচিত্রাসহ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তিন পত্রিকা ও সাময়িকীর প্রকাশনা বন্ধ করে দেয় আওয়ামী লীগ সরকার।
সর্বাধিক জনপ্রিয় সাপ্তাহিক বিচিত্রার প্রচারসংখ্যা একসময় সর্বাধিকপর্যায়ে পৌঁছেছিল। এটির প্রচারসংখ্যা প্রায় ৭০ হাজারে পৌঁছে। আজকের দিনে প্রায় সব সংবাদপত্রই ঈদসংখ্যা প্রকাশ করে, রোজার মাসে ঈদসংখ্যার ছড়াছড়ি লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু দেশে বিচিত্রা ও সচিত্র সন্ধানীই সর্বপ্রথম প্রতি বছর ঈদ সংখ্যায় উপন্যাস প্রকাশ আরম্ভ করে। এদিক দিয়ে সন্ধানী ছিল বনেদি। দেশের সবচেয়ে খ্যাতিমান ও বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিকেরা ঈদ সংখ্যায় উপন্যাস লিখতেন। ইতিহাসের পাতায় চোখ দিলে আমরা দেখতে পাবো তরুণ হুমায়ূন আহমেদের ‘নন্দিত নরেক’ উপন্যাস সাপ্তাহিক বিচিত্রার ঈদ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। অন্যদিকে সন্ধানীর ঈদসংখ্যায় বা বিশেষ সংখ্যায় লিখেছেন শওকত ওসমান, শওকত আলী, সৈয়দ শামসুল হক, রিজিয়া রহমানেরা। কাইয়ুম চৌধুরীর অলঙ্করণে সেসবের একটা মাহাত্য ধরা দিয়েছিল পাঠকের কাছে।
বিচিত্রার সামাজিক বিষয় নিয়ে রচিত প্রচ্ছদকাহিনি বা বিশেষ প্রতিবেদনের দিকে ফিরে তাকানো যাক। ব্যক্তিত্বনির্ভর প্রচ্ছদ কাহিনী রচনা এবং প্রচ্ছদচিত্রের সঙ্গে শামসুর রাহমানের কবিতাংশের সংযোজনার কারণে অভিনবত্বের উদ্বোধন ঘটেছিল বিচিত্রায়। সরকারি ট্রাস্টের পত্রিকা বলে কর্মশক্তি ও অন্যান্য খাতে ব্যয় বাড়ানো সম্ভবপর ছিল। কিন্তু ব্যক্তি উদ্যোগে প্রকাশিত সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলোকে খরচের দিকে একটা চোখ সব সময়েই বিছিয়ে রাখতে হতো। অর্থকষ্ট ছিল বিচিত্রা বাদে সব ক’টি পত্রিকারই। সে যাক, রাজশাহীর বিশ্ববিদ্যালয়ের চাঞ্চল্যকর নীহার বানু হত্যাকা- সংক্রান্ত বিচিত্রার সংখ্যাটি ৭৫ হাজার কপি ছাপা হয়েছিল। শিল্পী রফিকুন নবীর ‘টোকাই’ কার্টুন ছিল বিচিত্রার অন্যতম আকর্ষণ। আজকের অন্তর্বর্তী সরকারের গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা আসিফ নজরুল নিয়মিত প্রতিবেদন লিখতেন বিচিত্রায়। অপরদিকে এই সরকারের আমলে অন্তরীণ শাহরিয়ার কবির ছিলেন বিচিত্রার নির্বাহী সম্পাদক।
আনু মুহাম্মদ ছাড়াও বিচিত্রায় যুক্ত ছিলেন কাজী জাওয়াদ, আশরাফ কায়সার, শামীম আজাদ এবং আরো অনেকে যারা পরবর্তীকালে যথেষ্ট খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন সমাজে। সম্পাদক শাহাদাত চৌধুরীর আইডিয়াগুলো ছিল অভিনব ও তৎকালীন সমাজের জন্য স্মার্ট ও অগ্রসর চিন্তার। সত্তর দশকের শেষদিকে অ্যাবর্শন বা গর্ভপাত নিয়ে প্রচ্ছদ করে বিচিত্রা, সেটি তৎকালীন সমাজে বজ্রাঘাতের মতোই। বিমানবালা, ছেলেদের চোখে মেয়েরা, মেয়েদের চোখে ছেলেরা, বেদের জীবন, শিশু পাচার, বেলী ফুলের বিয়ে নিয়েও প্রচ্ছদ করেছে বিচিত্রা। বিচিত্রা দেশে প্রথম আরম্ভ করে ঈদ ফ্যাশন প্রতিযোগিতা। নির্বাচিত পোশাক মডেলদের পরিয়ে, ছবি তুলে অ্যালবাম প্রকাশ করতে শুরু করে বিচিত্রা। সামাজিক অচলায়তন ভেঙে নারীদের সামনে নিয়ে আসার উদ্যোগ নিয়ে বিচিত্রা ফটো সুন্দরী প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। বিচিত্রার সাংবাদিকরাই প্রথম সরেজমিন ঘুরে ঘুরে যুদ্ধাপরাধীদের তথ্য সংগ্রহ করে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-আলামত হিসেবে যা কাজে লাগে।
গাজী শাহাবুদ্দীন আহমেদ ছিলেন মুদ্রণ সংস্থা কথাকলি প্রিন্টার্সের স্বত্বাধিকারী এবং সন্ধানী প্রকাশনীর প্রকাশক। জহির রায়হান, আনিস আহমেদ, সৈয়দ শামসুল হকের মতো দেশের শীর্ষ কথাশিল্পীদের বই যেমন এই প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছে, তেমনি প্রকাশিত হয়েছে জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলোর মতো মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কালজয়ী সব গ্রন্থ। এই গাজী শাহাবুদ্দীনই প্রকাশ করেন সাপ্তাহিক সচিত্র সন্ধানী, তিনিই ছিলেন সম্পাদক। তবে দেশের খ্যাতিমান কবি, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিকেরা নানা পর্যায়ে এই পত্রিকার হাল ধরেছেন বা নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আলোড়ন, সঙ্কটের মধ্যে স্বাধীনতার পূর্বাপর সময়ে ‘সচিত্র সন্ধানী’ পত্রিকাটি সাময়িক বিরতি দিয়ে বের হয়েছে তিনবার। অনস্বীকার্য যে, সচিত্র সন্ধানীই ছিল বাংলাদেশের সংস্কৃতির ঘনিষ্ঠ প্রতিনিধি। পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২৩ জুন ১৯৫৬ সালে। অল্পকালের মধ্যে পত্রিকাটি দেশের আলোচিত পত্রিকা হয়ে দাঁড়ায়। সচিত্র সন্ধানী থেকে চালু হয় বর্ষ শুরু সংখ্যা প্রকাশের রেওয়াজ। এই বর্ষ শুরু সংখ্যায় বেরিয়েছিল জহির রায়হানের উপন্যাস ‘হাজার বছর ধরে’ ও সৈয়দ শামসুল হকের উপন্যাস ‘খেলারাম খেলে যা’। সময়ের প্রয়োজনে নতুন আঙ্গিক, বিন্যাস এবং সময়োপযোগী সৃজনশীল রচনা, প্রচ্ছদ পরিচিতি, সম্পাদকীয়, ফিচার, নগরবাসীর উপভোগ্য ‘ঢাকা ডায়েরি’, গ্রাম-বাংলার বিষয়ের ‘বিশাল বাংলা’ হয়ে উঠেছিল পাঠকপ্রিয়। সচিত্র সন্ধানীর সামগ্রিক রূপ ও রুচি নির্মাণে এই পত্রিকার জন্য লেখালেখিতে সক্রিয় ছিলেন দেশের জ্যেষ্ঠ স্বনামধন্য কবি-সাহিত্যিক শওকত ওসমান, আবু জাফর শামসুদ্দিন, আহসান হাবীব, আবুল হোসেন, কামরুল হাসান, শামসুর রাহমান, সুচরিত চৌধুরী, আনিস চৌধুরী, হাসান হাফিজুর রহমান, আনিসুজ্জামান, কাইয়ুম চৌধুরী, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আবদুল গাফফার চৌধুরী, রশীদ করীম, শহীদ কাদরী, ফজল শাহাবুদ্দিন, আলাউদ্দিন আল আজাদ, রাজিয়া খান, লায়লা সামাদ, রাবেয়া খাতুন, এটিএম আবদুল হাই, মাহমুদুল হক, আল মাহমুদ, শহীদ আখন্দ, পরবর্তী সময়ে হাসান আজিজুল হক, বেলাল চৌধুরী, সিকদার আমিনুল হক, আবদুল মান্নান সৈয়দ, মোহাম্মদ রফিক, রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরী, রশীদ হায়দার, মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, মাহমুদ আল জামান, মালেকা বেগম, মফিদুল হক, সেলিনা হোসেন, মাকিদ হায়দার, শিহাব সরকার প্রমুখ।
ভাবতে ভালো লাগে আমার সাংবাদিক জীবন শুরু হয়েছিল এই সচিত্র সন্ধানীর মাধ্যমে, আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে। সচিত্র সন্ধানীর সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে যুক্ত ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা কথাসাহিত্যিক সুশান্ত মজুমদার। একটি স্মৃতিচারণে তিনি লিখেছেন: ‘স্বাধীনতা-উত্তরকালে অস্থির, অস্থিতিশীল সময়ে একটি পত্রিকার ছাপার জন্য ছিল অসংখ্য বিষয়। এই বিষয় ব্যবহার থেকে বেরিয়ে আসে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব। ওই সময় থেকে সস্তা বিনোদন উপহার দিয়ে পাঠকের পকেট হাতিয়ে নেয়ার সেরা ফন্দি শুরু। সচিত্র সন্ধানী বিপরীত ¯্রােতে সাঁতার কেটে এগিয়ে যেতে থাকে। কত লোকপ্রিয়, তাৎক্ষণিক মানসিক আরামের খোরাক ফেলে সন্ধানী বেছে নেয় সেই শিল্প-সাহিত্য-বাঙালী সংস্কৃতি যে সংস্কৃতির চরিত্র পরিচ্ছন্ন। শিল্প-সাহিত্য বিভিন্ন শাখার উন্নত, সফল কাজ নিয়ে সচিত্র সন্ধানী বের করেছে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন। কবি-সাহিত্যিক-বিজ্ঞানী-সাংবাদিক-খেলোয়াড়-চিত্র-সঙ্গীত-মঞ্চ-চলচ্চিত্র শিল্পী থেকে অনেক কৃতীজন সন্ধানীর বিষয় হয়ে এসেছেন। আজও তাই শিল্প-সাহিত্যের ইতিহাস বা গবেষণামূলক কাজে সচিত্র সন্ধানীর পুরনো সংখ্যার খোঁজ পড়ে। সন্ধানীর বিশেষ সংখ্যা লেখা-রেখা-চিত্রে ছিল সাহিত্যের সেরা সম্ভার। অনেক সুধীজনের কাছে এই পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা যতেœর সঙ্গে বাঁধাই অবস্থায় আছে। আজ দেশে সুলভ কম্পোজ, মুদ্রণ ব্যবস্থার সুবাদে পত্রিকা ও প্রকাশনা সংস্থার ছড়াছড়ি। সরকারী অর্থে বিভিন্ন একাডেমি প্রকাশ করছে বই ও বিভাগীয় পত্রিকা। বইয়ের বিষয় ও মুদ্রণ সৌকর্যে আজ অব্দি সন্ধানী প্রকাশনীকে এরা ছাপিয়ে যেতে পারেনি। আশার কথা, বাংলাদেশের প্রকাশকদের সম্মিলিত শ্রমে প্রকাশনা শিল্পের দৃষ্টিনন্দন শ্রী বিকশিত হচ্ছে; এর পেছনে সন্ধানীর অবদান কম নয়।’
দুই.
সাপ্তাহিক পত্রিকার ধারাটি যে বাংলাদেশ থেকে প্রায় বিলুপ্ত হয় গেল সেজন্য কাকে দুষবো? পাঠকের পড়ার স্পৃহা কমে যাচ্ছে, বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ছে, নিয়মিত কিনে পড়ার লোকের বড়োই অভাব। এ কথাগুলো কি আমরা অস্বীকার করতে পারব? একটি বই ৩০০ কপি বিক্রি হলে লেখক বা প্রকাশক তবু বেঁচে থাকতে পারেন কিন্তু পত্রিকা ৩০০ কপি বিক্রি হলে প্রকাশকের বিরাট লোকসান হয়, কর্মীদের বেতন অনিয়মিত হয়ে পড়ে, শুরু হয় পত্রিকার মৃত্যুযাত্রা। যুক্তি দিয়ে কেউ বলতে পারেন সুযোগ্য সম্পাদকের অভাবে পত্রিকার অপমৃত্যু ঘটে। এটাও আংশিক সত্য। সমাজবাস্তবতা বিশ্লেষণ করলে পাঠকের পাঠপ্রবণতা, পাঠ-চাহিদার বিষয়গুলো উঠে আসবে। পত্রিকার প্রচার সংখ্যার সঙ্গে বিজ্ঞাপন প্রাপ্তি অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। বেশি মানুষের হাতে পত্রিকা না গেলে কিংবা বেশি লোক পত্রিকা না কিনলে তাতে পণ্যের প্রচার-প্রসারের জন্য বিজ্ঞাপন দেয়া কতটুকু যুক্তিযুুক্ত। বিজ্ঞাপনদাতারো না আর চ্যারিটি খুলে বসেননি।
কালে কালে দেশের দৈনিক সংবাদপত্রগুলো রাজনৈতিক কলাম ও বিচিত্রধর্মী ফিচার প্রকাশের দিকে মনোযোগী হয়ে ওঠে। প্রতিদিনই দুই পাতায় সমকালীন সমাজ ও রাজনীতি নির্ভর নিবন্ধ ও কলাম প্রকাশের ফলে সিংহভাগ পাঠকই প্রথম ও শেষ পাতার খবরগুলোয় চোখ বুলিয়ে চলে যান ওই উপসম্পাদকীয় পাতায়। এধরনের লেখায় আশি ও নব্বুই দশকে সমৃদ্ধ হতো সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলো। সাপ্তাহিক পত্রিকা সাত দিনে একবার প্রকাশিত হয়, আর দৈনিক পত্রিকা প্রতিদিনই। এখানে একটি অসম প্রতিযোগিতা চলে আসে। অন্যদিকে সাহিত্য-সংস্কৃতি, ফ্যাশন, ঘর-সংসার, মানসিক স্বাস্থ্য, নারীসমাজ, বেড়ানো, কেনাকাটা রকমারি যেসব বিষয় ছিল সাপ্তাহিক পত্রিকার বিশেষ আকর্ষণ, যার সবকিছুকেই জায়গা করে দেয় সংবাদ ও তথ্য ধারণের উদ্দেশ্যে প্রকাশিত সংবাদপত্র। প্রতিদিন এক বা দুই পাতা হিসাবে সাতদিনে ফিচারের জন্য দৈনিক সংবাদপত্র যে পরিসর বরাদ্দ দেয় তা ম্যাগাজিন আকারে সাজালে ৪০ পৃষ্ঠার কম হবে না। ফলে এখানে আরেকবার মার খেলো সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন।
বছরের পর বছর ধরে এই চর্চার কারণে ধীরে ধীরে পাঠকের মানস ও পাঠ প্রবণতা সংবাদপত্রের দিকেই শেষাবধি ঝুঁকে পড়ে। আবার অনলাইনে বিনে পয়সাতেও মেলে সংবাদপত্রের ই-সংস্করণ, মানে ছাপা পত্রিকার হুবহু প্রতিলিপি। পাশাপাশি টিভি চ্যানেলের কথাও বলা চাই। প্রতিদিনের সামাজিক-রাজনৈতিক ইস্যু মধ্যরাতে টেলিভিশনে টক শোয়ে তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে উঠে আসছে। এই লঘু সংস্কৃতি সাধারণ সংবাদপত্র পাঠককে আকর্ষণ করছে। একান্ত পাঠের চাইতে ‘ঝগড়াঝাটি’ শোনার মজাই আলাদা এবং কম শ্রম ও মনোযোগের। এ প্রবণতাও সাপ্তাহিক পত্রিকার ক্ষতি করেছে। সাতদিন মানে অনেকগুলো দিন। অত ধৈর্য কোথায় মানুষের! যখন দিনশেষে রাতে ঘুমিয়ে পড়ার আগেই অপেক্ষা করছে দিনের আলোচিত বিষয় নিয়ে গালগল্প তর্কবিতর্ক।
তাই বলে কি সত্যি সত্যি দেশে সাপ্তাহিক পত্রিকার চাহিদা শেষ হয়ে গেছে? নতুন দিনে নতুন ধরনের সাপ্তাহিক পত্রিকার যথেষ্ট সম্ভাবনা দেখি আমি। বিশদ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের উত্তম জায়গা সংবাদপত্র নয়, একটি ম্যাগাজিনই। সমাজ বা রাষ্ট্রে সবচাইতে আলোচিত সাম্প্রতিক বিষয়, বার্নিং ইস্যু নানাকৌণিক বিশ্লেষণ ও পূর্বাপর প্রেক্ষাপটসহ সংবেদন-জাগানো আঙ্গিকে প্রকাশিত হতে পারে কেবল সাপ্তাহিক পত্রিকাতেই। সামাজিক প্রবণতা, মানুষের শক্তির জায়গা, ব্যক্তি ও গোষ্ঠির ইতিবাচক উদ্যোগকে প্রণোদিত করার জন্যে সাপ্তাহিক পত্রিকা ছাড়া ভালো আর কিছুই হতে পারে না। কারো মুখের দিকে না তাকিয়ে গণশত্রু ও সমাজশত্রুর অপতৎপরতার সার্বিক ছবি তুলে ধরার মোক্ষম স্থান সাপ্তাহিক পত্রিকা। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি সবিস্তারে প্রকাশের জন্য দৈনিক সংবাদপত্র নয়, ক্ষমতাশালী হয়ে উঠতে পারে সাপ্তাহিক পত্রিকাই। আমি আশা হারাই না। নতুন দিনের সংবাদকর্মীরা অভিজ্ঞ আইডিয়াবাজ সম্পাদনা টিমের মেলবন্ধনে দেশকে উপহার দিতে পারেন সিরিয়াস, শিক্ষণীয়, উপভোগ্য ও আকর্ষণীয় নিয়মিত সাপ্তাহিক পত্রিকা।
লেখক: কবি ও সম্পাদক