পুলিশের হুমকি উপেক্ষা করে পূর্বঘোষিত ‘মার্চ ফর খিলাফত’ কর্মসূচি করেছে নিষিদ্ধ হিযবুত তাহ্‌রীর। গতকাল শুক্রবার বাদ জুমা বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের সামনে থেকে তাদের মিছিল শুরু হয়। হাজারো নেতাকর্মীর মিছিল শুরুতে পুলিশের দুর্বল চেষ্টার কারণে পল্টন মোড় হয়ে বিজয়নগরের দিকে যায়। পরে পুলিশ টিয়ার গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে এবং লাঠিপেটা করে ছত্রভঙ্গ করা হয়। তবে আবারও সংগঠিত হয়ে হিযবুতের নেতাকর্মী ইটপাটকেল ছুড়লে অ্যাকশনে যায় পুলিশ। উত্তেজনাকর পরিস্থিতির কারণে ঘণ্টাখানেক পল্টন মোড় হয়ে যান চলাচল বন্ধ ছিল।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর অবস্থানের ঘোষণা, দৃশ্যমান উপস্থিতির পরও নিষিদ্ধ সংগঠন কর্মসূচি করায় সমালোচনা হচ্ছে। বিশিষ্টজন বলছেন, এর পেছনে কোনো পক্ষের মদদ থাকতে পারে। সরকারের নমনীয় মনোভাব ছিল বলেও মনে করেন কেউ কেউ।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এস এন মো.

নজরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, হিযবুত তাহ্‌রীর মিছিলের চেষ্টা করলে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়। এ সময় অন্তত ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখানে পুলিশের কোনো ব্যর্থতা ছিল না। তারা নিষিদ্ধ, ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে মিছিলের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মসজিদ থেকে হাজার হাজার মুসল্লি একসঙ্গে বের হন। সেখানে কাকে চিনবেন? মুসল্লিদের থেকে আলাদা হয়ে মিছিলের প্রস্তুতি নিলে পুলিশ অ্যাকশনে গেছে।
সরেজমিন দেখা যায়, জুমার নামাজ শেষে বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেট থেকে মিছিল বের করেন হিযবুতের কয়েক হাজার নেতাকর্মী ও সমর্থক। তাদের হাতে ছিল প্ল্যাকার্ড, ব্যানার ও ফেস্টুন। স্লোগান দেন– মুক্তির এক পথ, খেলাফত খেলাফত; আসবে যখন খেলাফত, বিশ্ব হবে নিরাপদ; খেলাফত আসছে, দিল্লি কাঁপছে, ওয়াশিংটন কাঁপছে ইত্যাদি। মসজিদের সামনের সড়কে দাঁড়িয়ে কয়েক মিনিট স্লোগান দেওয়া হয়। এর পর মিছিল নিয়ে পল্টন মোড়ের দিকে গেলে ১০ জনের মতো পুলিশের একটি দল বাধা দেয়। বাধা ভেঙে হিযবুত কর্মীরা পল্টন মোড়ে আসেন। এখানে আরেক দফা বাধা ভেঙে তারা এগোতে থাকেন। এর পরই অ্যাকশনে যায় পুলিশ। তখন হিযবুত কর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করেন।

মিছিলকারীদের বড় অংশ বিজয় নগর পানির ট্যাঙ্কির দিকে যান। একটু পর আবারও সংঘবদ্ধ হয়ে মিছিল নিয়ে তারা পল্টন মোড়ের দিকে আসতে চাইলে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার গ্যাস ছুড়ে এবং লাঠিপেটা করে সরিয়ে দেয়। মিছিলকারীরা অলিগলিতে ঢুকে পড়ে। এর পর কয়েক দফা অলিগলিতে ধাওয়া দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। বেলা আড়াইটার দিকে পল্টন ও আশপাশের এলাকার অলিগলিতে অভিযান চালিয়ে হিযবুতের সদস্য সন্দেহে কয়েকজনকে ধরে পুলিশের গাড়িতে তুলতে দেখা যায়। সাউন্ড গ্রেনেড বিস্ফোরণে আহত হয়েছেন দৈনিক কালবেলার সাংবাদিক সুশোভন অর্ক।
ডিএমপির মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার শাহরিয়ার আলী বলেন, ‘ছত্রভঙ্গ করার সময় পাঁচজনকে আটক করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা হয়েছে।’
হিযবুতের কর্মসূচি ঘিরে সকাল থেকে বায়তুল মোকাররম মসজিদ এলাকায় ছিল সেনাবাহিনী, র‍্যাব ও পুলিশের যৌথ নিরাপত্তা। মসজিদে প্রবেশের সময় মুসল্লিদের তল্লাশি করা হয়। পল্টন মোড়ে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও এপিবিএন সদস্য ছিলেন। প্রস্তুত ছিল এপিসি, জলকামান ও প্রিজনভ্যান।
বৃহস্পতিবার রাতে উত্তরা-১১ ও ১২ নম্বর সেকশনে অভিযান চালিয়ে মার্চ ফর খিলাফত কর্মসূচি পালন-সংক্রান্ত পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত হিযবুত তাহ্‌রীরের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারা হলেন– মনিরুল ইসলাম, মোহতাসিন বিল্লাহ ও মাহমুদুল হাসান।

গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে হিযবুত তাহ্‌রীরের প্রকাশ্য কর্মসূচির মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা এবং তাদের কার্যক্রম ঠেকাতে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ব্যর্থতার প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রকাশ্যে তৎপরতা শুরু করে হিযবুত। সর্বশেষ তুরস্কে খিলাফত পতনের ১০১ বছরের প্রেক্ষাপটে তারা ঢাকায় ‘মার্চ ফর খিলাফত’ কর্মসূচি দেয়। এ প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার সংগঠনটির কার্যক্রমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দেয় ডিএমপি। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় পুলিশ সদরদপ্তরের এক বার্তায় বলা হয়, আইন অনুযায়ী হিযবুত তাহ্‌রীরের সব কার্যক্রম শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

আরমানকে ছাড়িয়ে ঢামেক নিলেন উপদেষ্টা
হিযবুত তাহ্‌রীরের মিছিল ছত্রভঙ্গ করার সময় রাজধানীর পল্টন থেকে আরমান আলীকে আটক করে পুলিশ। তবে গতকাল বিকেলে রাজধানীর মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয় থেকে তাঁকে ছাড়িয়ে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। সেখানে আসিফ জানান, আরমানকে সেনাবাহিনী সন্দেহভাজন হিসেবে ধরে ডিবি পুলিশে দিয়েছিল।
আরমান আলী জানান, তিনি কারওয়ান বাজারে একটি আড়তে কাজ করেন। বাসা ফকিরেরপুল পানির ট্যাঙ্কের কাছে। ঘটনার সময় তিনি বাসায় যাচ্ছিলেন। হিযবুত তাহ্‌রীরের সদস্যরা তাঁকে মারধর করেন। তখন সেখান থেকে তাঁকে আটক করা হয়। পল্টনের ঘটনায় অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, এক ব্যক্তিকে পুলিশ পেটাচ্ছে। তখন আরমানও লাঠি হাতে তার ওপর চড়াও হন।

সামনে ঘটতে পারে বড় ঘটনা
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রস্তুতি ঠিক থাকলেও মনোবল দৃঢ় ছিল না। কারণ বিপুলসংখ্যক মানুষ মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা ভালো না। তাই কৌশলগত কারণে হয়তো ভিন্ন পদ্ধতিতে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করেছে পুলিশ। যদিও যথেষ্ট সাফল্য দেখাতে পারেনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘নিষিদ্ধ সংগঠনের কর্মসূচির বিষয়ে সরকারের নমনীয় মনোভাব ছিল। তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও সেভাবে কঠোর হতে পারেনি। অনুকূল পরিবেশ পেয়ে সংগঠনটি পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। সামনে আরও বড় ঘটনা ঘটতে পারে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল‍্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, ‘প্রকাশ্যে কর্মসূচির পেছনে কোনো পক্ষের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মদদ আছে কিনা দেখা দরকার। তাদের এমন কর্মকাণ্ড গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিতে সংস্কার ও নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতে পারে।’

 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র সময় সদস য আরম ন মসজ দ গতক ল

এছাড়াও পড়ুন:

আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটতেই থাকবে?

সমকালসহ গতকালের সংবাদপত্রে প্রকাশিত দুটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। এক. মাসখানেক আগে ধর্ষণের শিকার এক তরুণী আত্মহত্যা করেছে। তার পিতা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একজন শহীদ। পটুয়াখালীর দুমকীতে পিতার কবর জিয়ারত করে ফেরার পথে সে আক্রান্ত হয়। এতে গ্রেপ্তার হয় অভিযুক্ত দু’জন। এর মধ্যে তারা জামিনও পায়। তারপর ঢাকায় আত্মহত্যা করে তরুণী। পরিবার বলছে, আসামিরা জামিন পেয়ে যাওয়ায় মর্মাহত হয়ে সে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। দুই. টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীতে একটি পাঠাগারের বইপত্র লুট করে ইউএনওর কাছে জমা দিয়েছে ‘তৌহিদি জনতা’। পাঠাগারে ধর্মবিরোধী বই রাখার অভিযোগে ওই ঘটনা তারা ঘটায়। মামলা হয়েছে। এদিকে ইউএনও বলেছেন, দু’পক্ষের সঙ্গে বসে বিষয়টির নিষ্পত্তি করা হবে। 

প্রথম ঘটনাকে সামাজিক অপরাধ বলে বিবেচনা করাই সংগত। অনেকে হয়তো বলবেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদের কন্যা ধর্ষিত হওয়ার ঘটনায় রাজনৈতিক উপাদান আছে। তেমনটি হলে মনে হয় না বর্তমান শাসনামলে আসামিরা সহজে জামিন পেত। তবে এ ধরনের মামলায় জামিন লাভ কতখানি গ্রহণযোগ্য– সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তারা ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছিল বলেই জানা যায়। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর যেসব ক্ষেত্রে তেমন পরিবর্তন আসেনি, তার মধ্যে রয়েছে বিচার বিভাগ। তদন্তকারী পুলিশের বিষয়েও অভিযোগ কমেনি। যা হোক, আসামি জামিন পাওয়ায় বিপর্যস্ত হয়ে ধর্ষিতার আত্মহত্যার ঘটনা মানুষকে ব্যথিত করবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদের কন্যাও ন্যায়বিচার না পাওয়ার ঘটনাটি হবে বিশেষভাবে আলোচিত। 

দ্বিতীয় ঘটনা ‘মব ট্রায়াল’ বলেই বিবেচিত হবে। হালে এগুলোকে ‘মব ভায়োলেন্স’ বলা হচ্ছে। এসব অনেক বেশি ঘটছে গণঅভ্যুত্থানের পর। এর শিকার কেবল ক্ষমতাচ্যুতরা নয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও আক্রান্ত। জনপ্রশাসনও বাদ যায়নি। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ওপরেও কিছু হামলা হয়েছে। একই ধর্মাবলম্বীর মধ্যে ভিন্নধারার প্রতিষ্ঠানও হয়েছে আক্রান্ত। এতে অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবমূর্তির সংকট কম উপস্থিত হয়নি। তা সত্ত্বেও সরকারকে কড়া ব্যবস্থা নিতে দেখা গেছে কমই। এর ধারাবাহিকতায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িসহ অনেক স্থাপনায় এক দল লোক বুলডোজার চালানোর মতো কাজও করেছে। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছিল– এসব আর ঘটতে দেওয়া হবে না। কিন্তু মব ভায়োলেন্স যে বন্ধ হয়নি– ধনবাড়ীর ঘটনাই তার প্রমাণ। ওই পাঠাগার থেকে রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের বইও বস্তায় ভরে নেওয়া হয়েছে বলে খবরে প্রকাশ। সালিশে এমন ঘটনার কী নিষ্পত্তি করা যাবে, কে জানে! কিছু লোকের একটা কিছু মনে হবে আর তারা দলবদ্ধ হয়ে যা খুশি করবে– এই বাংলাদেশ তো কেউ চায়নি। মব দ্বারা শতাধিক মাজার আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় বোঝা যায়, এদের হাতে স্বধর্মের ভিন্নধারাও নিরাপদ নয়। বিচারের দাবি উঠলেও এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি নেই। তৌহিদি জনতার নামে পাঠাগারে নৈরাজ্য চালানোর বিচারও কি হবে না? বিচার না হলে এমন ঘটনা আরও বড় পরিসরে ঘটার শঙ্কা অমূলক নয়। যেসব বইপত্র তারা বস্তায় ভরে নিয়ে গেছে, সেগুলো দেশের অন্যান্য পাঠাগার আর বইয়ের দোকানেও আছে নিশ্চয়। 

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর সমকালে দীর্ঘ প্রতিবেদন ও বিশেষজ্ঞ মন্তব্য ছাপা হয়েছে গত শনিবার। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে হওয়া মামলার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়– খুন, অপহরণ, ডাকাতি, ছিনতাইসহ ছয় ধরনের অপরাধ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে। এর মধ্যে নারী-শিশু নির্যাতন আছে বৈ কি। আছে আসামি ছিনতাই, থানায় হামলার ঘটনা। খোদ শাহবাগ থানায় এক নারী উত্ত্যক্তকারীকে ছাড়িয়ে নিতে এক দল লোক কী করেছিল, তা সবার জানা। ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ চলাকালেও এসব ঘটে চলেছে। এ পরিস্থিতিতে এক দিন মধ্যরাতে সংবাদ সম্মেলন করতে দেখা গেল স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কিছুদিন পরই মহলবিশেষের দাবির মুখে এ পদে পরিবর্তন এনে তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হলেও তিনি কতখানি সাফল্য দেখাতে পেরেছেন, তা পৃথকভাবে বলার কিছু নেই। চলমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিই সেটা বলছে। 

গেল বছরের প্রথম তিন মাসের সঙ্গে চলতি বছরের সরাসরি তুলনা অবশ্য যুক্তিযুক্ত নয়। এর মধ্যে নজিরবিহীন গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ বাহিনীও ভেঙে পড়ে। এর কারণ সবার জানা। পুলিশকে সক্রিয় করতে এখনও লড়তে হচ্ছে সরকারকে। মাঠে বিশেষ ক্ষমতাসহ থাকতে হচ্ছে সেনাবাহিনীকে। তাদের ওপর আস্থা আছে জনসাধারণের। তবে পুলিশের কাজে তাদের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সেনাবাহিনী অপেক্ষা করছে– কবে পুলিশ পূর্বাবস্থায় ফিরবে। কিন্তু সরকারের ৯ মাস হতে চলার সময়ও পুলিশকে সক্রিয় দেখা যাচ্ছে না। তাদের কাছে এসে অভিযোগ দাখিলে লোকে উৎসাহী হলেও এর নিষ্পত্তির চিত্র উৎসাহব্যঞ্জক নয়। সেনাবাহিনীকেও অভিযুক্তদের থানায় এনে সোপর্দ করতে হচ্ছে। এর পর থানা ও আদালতপাড়ায় যা ঘটছে, তার চিত্র কি উৎসাহব্যঞ্জক? 
গণঅভ্যুত্থানের পর কোথায় কোথায় আইনশৃঙ্খলার কতটা অবনতি ঘটেছিল, সে উদাহরণ টেনে অনেকে বাংলাদেশ পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছেন। এটা অযৌক্তিক নয়। অনেকে এমনও বলেন, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে গোটা পুলিশ বাহিনী নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ার ঘটনা বিরল। তবে আট-নয় মাস পরও অন্তর্বর্তী সরকার কেন পরিস্থিতিতে লক্ষণীয় উন্নতি ঘটাতে পারছে না, তার পক্ষে যুক্তি দেওয়া কঠিন। মাঝে রমজানে পণ্যবাজারের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সরকার এক ধরনের সাফল্য কিন্তু দেখিয়েছিল। ঈদের পর সেটা ধরে রাখা গেল না কেন? 

সামাজিক অপরাধের পাশাপাশি রাজনৈতিক অপরাধ যেন আরও বেশি করে ঘটছে। গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থের চেষ্টা বাড়তে পারে। এসব দেখা যেত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার হাতবদলের সময়ও। এবার স্বভাবতই তা সীমা ছাড়িয়েছে। সঙ্গে নতুন উপাদান হিসেবে চলছে মব ভায়োলেন্স। মবের ভয়ে মিডিয়াও কাজ যথাযথ  করতে পারছে না বলে অনেকের অভিমত। সরকার ঘোষণা দিলেও তা দমনে এখন পর্যন্ত ব্যর্থ। আর রাউজানের মতো কোনো কোনো অঞ্চলে খুনখারাবি মানুষকে রীতিমতো আতঙ্কিত করে তুলছে। 

রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর হানাহানি চলছে আর্থিক অপরাধের ক্ষেত্র দখলকে কেন্দ্র করেও। দেশ পরিচালনার দায়িত্বে থাকলে যে কোনো সরকারকেই দমাতে হয় এসব অপরাধ। বিশেষ কোনো পক্ষ অতিউৎসাহী হয়ে মব ভায়োলেন্স চালালে সেটাও দমন করতে হবে। নতুন পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলার উন্নয়নে বিশেষ নীতিকৌশল জরুরি হলে সে পদক্ষেপও সরকারকে নিতে হবে। সমধর্মী পট পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষাও নেওয়া যায়। সেগুলো কেবল বর্ণনা করা হলে অনেকেরই মনে হবে, সরকার হয়তো পরিস্থিতির উন্নয়নে অনিচ্ছুক! 

এমন ‘ষড়যন্ত্রতত্ত্ব’ও রয়েছে– অন্তর্বর্তী সরকার এসব হতে দিচ্ছে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার অজুহাত তৈরি করতে। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা তো স্পষ্টভাবেই জানিয়েছেন, আগামী বছরের জুনের মধ্যে হবে জাতীয় নির্বাচন। তার অনুকূল পরিবেশ তৈরিতেও আইনশৃঙ্খলার উন্নতি ঘটাতে তৎপর হতে হবে সরকারকে। এদিকে বিনিয়োগ বাড়াতে কম সচেষ্ট নয় সরকার। সে লক্ষ্য অর্জনেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে আনতে হবে। বর্ণাঢ্য বিনিয়োগ সম্মেলন চলাকালেও কিন্তু মব ভায়োলেন্সের শিকার হয়েছিল কয়েকটি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের দেশীয় প্রতিষ্ঠান!

হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলাম লেখক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটতেই থাকবে?
  • প্রেক্ষাপট বিবেচনা করা জরুরি