একজন ক্ষুদ্র কাঁচা তরকারি ব্যবসায়ী মুন্নি চাকমা (৩৮)। চার বছর আগে তাঁর স্বামী মারা গেছেন। এর পর সংসারের যাবতীয় ভার তাঁকে একাই সামলাতে হচ্ছে। রাঙামাটি শহরের কল্যাণপুর এলাকায় রাস্তার পাশে ফুটপাতে পসরা বসিয়ে তরকারি বিক্রি করেন মুন্নি। দিনে যা আয়, তা দিয়ে চলে কোনোক্রমে সংসার। তাঁর দুই মেয়ে। বড় মেয়ে রাঙামাটি সরকারি মহিলা কলেজে ডিগ্রিতে, আর ছোট মেয়ে রাঙামাটি সরকারি কলেজের এইচএসসির শিক্ষার্থী। তাঁর আশা দুই মেয়ে পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করে পরিবারের দুঃখ ঘোচাবে।
কল্যাণপুর এলাকায় মুন্নির পাশে কাঁচা তরকারি বিক্রি করেন সান্ত্বনা চাকমা (৪০)। তিন বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় পা ভেঙে গেছে সান্ত্বনার স্বামীর। বর্তমানে পঙ্গু অবস্থায় ঘরে পড়ে রয়েছেন। কাঁচা তরকারি বিক্রির আয় দিয়েই তাঁর সংসার চলে। তাঁরও দুই সন্তান। দু’জনকেই লেখাপড়া করাচ্ছেন। কর্মজীবী নারী মুন্নি ও সান্ত্বনার বিশ্ব নারী দিবস সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। শুধু তারা জানেন, তরিতরকারি বিক্রি করে দুই পয়সা আয় করে কীভাবে সংসার চালাবেন।
এমনই অবস্থায় পাহাড়ে আজ (শনিবার) আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপিত হচ্ছে। এবারে পাহাড়ে নারী দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘নারী সমাজে ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করি, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে অধিকতর ভূমিকা রাখি’।
দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এই তিনটি পার্বত্য জেলা নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম। এই অঞ্চলে রয়েছে এগারো ভাষাভাষী ১৫টি জাতিসত্ত্বা। পাহাড়ি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর রয়েছে নিজস্ব ভাষা, ঐতিহ্য, ইতিহাস, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি। আদিকাল থেকে এসব আদিবাসী জনগোষ্ঠী পাহাড়ে জুম চাষ করে এলেও কালের পরিবর্তনের সঙ্গে চাষ পদ্ধতি ও পেশার পরিবর্তন ঘটেছে। পুরুষের পাশাপাশি পাহাড়ি নারীরাও পরিবারের আয়-উপার্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।
বহুবিধ অর্থনৈতিক কাজে সম্পৃক্ত পাহাড়ি নারীরা যেমন কর্মঠ, তেমনি সম্পৃক্ত হতে পারেন বিভিন্ন পেশা ও কাজকর্মে। গৃহস্থালির দৈনন্দিন কাজকর্মসহ পারিবারিক আয় থেকে শুরু করে উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত, ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি, হস্ত ও ক্ষুদ্রশিল্প, আউটসোর্সিং, চাকরিসহ বিভিন্ন পেশায় জড়িত হয়ে উপার্জন করছেন।
একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার জরিপে দেখা গেছে, পার্বত্য তিন জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের ৮০ শতাংশের বেশি নারী ঘরের বাইরে কাজ করে থাকেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পাহাড়ি নারীদের সম্পত্তির অধিকার, ক্ষমতায়ন, সমতা, শ্রমের মজুরি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে এখনও পেছিয়ে রয়েছেন।
বাঘাইছড়ি ইউপির নারী ওয়ার্ড মেম্বার রাশিকা চাকমা জানান, তিনি একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বলেই হয়তো সমাজে তাঁর অবস্থান ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু গ্রামে যারা সাধারণ নারী রয়েছেন, পরিবারে তাদের সিদ্ধান্ত বা মতামত গ্রহণসহ সবকিছুতেই পিছিয়ে রাখা হয়েছে।
উইমেন্স রিসোর্স নেটওয়ার্কের (ডব্লিউ আর এন) কোর মেম্বার নুকু চাকমা মনে করেন, পাহাড়ি সমাজে নারী-পুরুষের সমান অধিকার না থাকায় নারীদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার নেই। এ অধিকার পেলে নারীদের ক্ষমতায়ন হতো।
সিএইচটি নারী হেডম্যান-কার্বারি নেটওয়ার্কের সভাপতি জয়া ত্রিপুরা বলেন, নারী হেডম্যান-কার্বারিদের অংশগ্রহণ বাড়লেও একজন মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য ভূমির অধিকার ও বিয়ের ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশন বিষয়টি এখনও নিশ্চিত হয়নি।
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য নিরূপা দেওয়ান বলেন, দেশে নারী সহিংসতা ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইন থাকলেও তা কার্যকর নয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এখনও নারীরা পথেঘাটে পোশাক-আশাক, স্বাধীনতা নিয়ে হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। সারাদেশে নারীদের যেখানে অবস্থা খারাপ, সেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিসেবে নারীদের আরও অবস্থা খারাপ পর্যায়ে রয়েছে।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
‘সন্ত্রাসী’ সাজ্জাদকে সঙ্গে নিয়ে পুলিশের ‘সচেতনতামূলক’ মাইকিং
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের তালিকাভুক্ত ‘সন্ত্রাসী’ সাজ্জাদ হোসেন ওরফে ছোট সাজ্জাদকে নিয়ে জেলার রাউজান ও নগরের বায়েজিদ বোস্তামীতে মাইকিং করেছে পুলিশ। তবে রিমান্ডে থাকা এই ‘সন্ত্রাসীর’ কোনো সহযোগীকে গ্রেপ্তার কিংবা অস্ত্র উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। পুলিশ বলছে, অভিযানে ফেরার পথে ‘সচেতনতা’ সৃষ্টির জন্য মাইকিং করা হয়েছে। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ‘রিমান্ডে নেওয়া হয় আসামির কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উদ্ঘাটনের জন্য। কার কাছে অস্ত্র আছে, কে অর্থ দেয়, নেপথ্যে কে ইত্যাদি জানার বিষয় আছে। মাইকিং করে আসামিকে প্রদর্শনের নজির নেই। এতে পলাতক আসামিরা পালানোর সুযোগ পান।’
গত ১৫ মার্চ ঢাকার একটি শপিং মল থেকে সাজ্জাদকে ধরিয়ে দেন লোকজন। এর আগে গত ২৯ জানুয়ারি তাঁকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করেন নগর পুলিশ কমিশনার। তার আগের দিন সাজ্জাদ বায়েজিদ বোস্তামী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) ফেসবুক লাইভে এসে পেটানোর হুমকি দেন। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্রসহ ১৫টি মামলা রয়েছে।
সাজ্জাদকে গ্রেপ্তারের পর চট্টগ্রামে জোড়া খুনের ঘটনা ঘটে। ৩০ মার্চ নগরের বাকলিয়া এক্সেস রোড এলাকায় একটি প্রাইভেট কারকে ধাওয়া দিয়ে গুলি করে ঝাঁঝরা করা হয়। এতে দুই আরোহী নিহত হন। ‘সন্ত্রাসী’ সরোয়ার হোসেন ও সাজ্জাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের জেরে এ ঘটনা ঘটেছে বলে পুলিশের ধারণা। সাজ্জাদকে ধরিয়ে দেওয়ার জেরে তাঁর অনুসারীরা সরোয়ারের সহযোগীদের ওপর হামলা চালান বলে অনুমান করছে পুলিশ। এ ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের একজন বখতিয়ার হোসেনের মা ফিরোজা বেগম গত মঙ্গলবার বাকলিয়া থানায় মামলা করেন। মামলায় সাজ্জাদ, তাঁর স্ত্রী তামান্না শারমিনসহ সাতজনকে আসামি করা হয়। মামলার অন্য পাঁচ আসামি হলেন মো. হাছান, মোবারক হোসেন, মো. খোরশেদ, মো. রায়হান ও মো. বোরহান। তাঁরা সাজ্জাদের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। এদিকে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে পুলিশ মো. বেলাল, মো. মানিক ও সজীব নামের তিনজনকে শনাক্তের পর গ্রেপ্তার করে। সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, সাতটি মোটরসাইকেলে ১৩ জন হামলায় অংশ নেন। তাঁদের হাতে ১০টি পিস্তল ও শটগান ছিল। কিন্তু এখনো কোনো অস্ত্র উদ্ধার করা যায়নি।
গতকাল রোববার চান্দগাঁও থানার ইট ও বালু ব্যবসায়ী আফতাব উদ্দিন হত্যা মামলায় দ্বিতীয় দফায় সাজ্জাদের পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। গত বছরের ২১ অক্টোবর দুপুরে গুলি করে খুন করা হয় আফতাব উদ্দিনকে। এরপর রাতে সাজ্জাদকে নিয়ে রাউজানের কদলপুর এলাকায় যায় পুলিশ। সেখানে তাঁকে নিয়ে মাইকিং করে পুলিশ। পরদিন আজ সোমবার বিকেলে বায়েজিদ বোস্তামী এলাকায়ও মাইকিং করা হয়।
গ্রেপ্তার সাজ্জাদকে নিয়ে পুলিশের মাইকিং করার ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে দেখা যায়, চান্দগাঁও থানা–পুলিশ ও পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট কাউন্টার টেররিজমের সোয়াতের সদস্যরা সাজ্জাদকে ঘিরে হাঁটছেন। হাতকড়া পরা সাজ্জাদের গায়ে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও মাথায় হেলমেট ছিল। পুলিশের একজন হ্যান্ডমাইকে ঘোষণা দিচ্ছেন ‘সন্ত্রাসী ও ত্রাস ছোট সাজ্জাদকে সিএমপি কমিশনার স্যারের নির্দেশে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রাষ্ট্রের কাছে কোনো সন্ত্রাসের জায়গা হবে না। আপনাদের এলাকায় যদি কোনো সন্ত্রাসী নাড়াচাড়া দিয়ে ওঠে, তাহলে ছোট সাজ্জাদের মতো তাদের পরিণতি হবে।’
জানতে চাইলে চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আফতাব উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, সাজ্জাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাউজানে অভিযান চালানো হয়। সেখান থেকে ফেরার পথে লোকজনকে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য মাইকিং করা হয়েছে।