জয়পুরহারের আক্কেলপুর উপজেলার গোপীনাথপুর হিমাগারে আলু সংরক্ষণের জন্য এসেছিলেন মামুদপুর গ্রামের কৃষক মাহবুব আলম। কিন্তু স্লিপ পাননি। তিনি বলছিলেন, ‘আমি বীজ ও খাওয়ার জন্য ৫০ বস্তা আলুর স্লিপ কাটতে এসে দেখি, দেওয়া বন্ধ হয়েছে। এবার সংরক্ষণের সুযোগ পাচ্ছি না। আমার মতো অনেকে এসে ঘুরে গেছেন। ব্যবসায়ীরা সব বুকিং স্লিপ আগেভাগে নিয়ে গেছেন। আমরা অল্প করে হলেও কী বুকিং পাব না?’
কালাইয়ের মোলামগাড়িহাট নর্থপোল কোল্ড স্টোরেজে আলু রাখতে পারেননি কাদিরপুর গ্রামের কৃষক মিরাজ আলি। তাঁর ভাষ্য, ‘হিমাগার মালিক মজুতদারদের কাছে আগেই স্লিপ বিক্রি করে দিয়েছেন। প্রকৃত কৃষক পাচ্ছেন না। বাধ্য হয়ে এখন কম দামে আলু বিক্রি করছেন কৃষক, যা বড় ক্ষতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ মাহবুব ও মিরাজের মতো আলু সংরক্ষণ করতে গিয়ে বিপদে পড়েছেন জয়পুরহাটের কৃষক। ক্ষেত থেকে ফসল তোলা শেষ না হতেই সংরক্ষণের স্লিপ শেষ হয়ে গেছে।
দরপতন ঠেকাতে এবং পরবর্তী মৌসুমের জন্য বীজ সংরক্ষণ করতে চাইলেও মজুতদার ও ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যে প্রকৃত কৃষক স্লিপ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। কৃষকরা বলছেন, সংরক্ষণ করতে না পেরে বাধ্য হয়ে কম দামে বিক্রি করছেন, যা তাদের লোকসানের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভালো ফলন হলেও বিপদ কাটছে না তাদের। হিমাগার মালিক মজুতদার ও ব্যবসায়ীদের অগ্রাধিকার দিলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তারা তদারকি বাড়িয়ে প্রকৃত কৃষকদের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করার দাবি জানান।
আলু উৎপাদনের অন্যতম জেলা জয়পুরহাটে এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে তিন হাজার ৪৭০ হেক্টর বেশি জমিতে আবাদ হয়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এবার আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৪০ হাজার হেক্টর জমি। আবাদ হয়েছে ৪৩ হাজার ৪৭০ হেক্টরে। এর মধ্যে কালাইয়ে ১০ হাজার ৯০৫, ক্ষেতলালে ৯ হাজার ২২০, পাঁচবিবিতে ৮ হাজার ৯৪৫, সদরে ৭ হাজার ৮০০ ও আক্কেলপুরে ৬ হাজার ৬০০ হেক্টর রয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৯ লাখ ৫৬ হাজার টন।
আলুর অন্তত ২৩ শতাংশ জেলার ১৯টি হিমাগারে সংরক্ষণ করা হবে। এতে প্রায় ২ লাখ টনেরও বেশি সংরক্ষণ থাকবে হিমাগারে। এরইমধ্যে কিছু ব্যবসায়ী ও কৃষক সংরক্ষণ শুরু করেছেন। আর অর্ধেকের বেশি ফসল মাঠে রয়েছে। এগুলো ওঠাতে আরও অন্তত এক সপ্তাহ সময় লাগবে। ফলে আলুর বেশির ভাগই হিমাগারে রাখার সুযোগ পাচ্ছেন না কৃষক। বাধ্য হয়ে কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
মাঠ থেকে আলু ওঠানোর আগেই হিমাগারের স্লিপ শেষ হয় কীভাবে, সে প্রশ্ন তুলেছেন কৃষক। তাদের অভিযোগ, হিমাগার মালিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আগেই স্লিপ কেটে নিয়েছে একটি চক্র। যদিও হিমাগার মালিকরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের ভাষ্য, আলু সংরক্ষণের জন্য দু’ধরনের বুকিং পদ্ধতি চালু রয়েছে– লুজ ও পেইড। যারা আগে আসবেন, তারাই বুকিং স্লিপ নিতে পারবেন। এখানে কৃষক ও ব্যবসায়ীর কোনো পার্থক্য নেই। তারপরও এবার কৃষকদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
শিয়ালমারী গ্রামের কৃষক মুকাব্বের হোসেন বলেন, ‘পল্লী হিমাগারে গিয়ে দেখি, কোনো স্লিপ নেই। তাহলে আমার এত আলু কোথায় রাখব? যদি সংরক্ষণ করতে না পারি, তাহলে অনেক লোকসান হবে। এ অবস্থায় মাথা ঠিক রাখতে পারছি না।’ আর ব্যবসায়ী বেলাল হোসেনের কথায়, ‘গত কয়েক বছর ধরে আলুর ব্যবসা করছি। এ বছর দুটি হিমাগারে দুই হাজার ৫০০ বস্তা আলুর বুকিং দিয়েছি। এ পর্যন্ত এক হাজার ৩০০ বস্তা সংরক্ষণ করেছি। আগামী সপ্তাহে পুরো সংরক্ষণ শেষ হবে।’
স্থানীয় বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাইকারিতে প্রকারভেদে প্রতি বস্তা (৬৫ কেজি) কার্ডিনাল ৫২০ থেকে ৫৭০, ডায়মন্ড ৫০০ থেকে ৫২০, স্টিক ৫০০ থেকে ৫২০ ও দেশি আলু ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছেন কৃষক। প্রতি মণ উৎপাদনে খরচ হয়েছে ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা। খাবার আলু ও বীজ সংরক্ষণ করতে না পারলে আরও লোকসান হবে বলে জানিয়েছেন কৃষক। তাদের অভিযোগ, হিমাগার মালিকরা বছরে ধারণ ক্ষমতার বাইরে ২৫ থেকে ৩০ হাজার বস্তা বুকিং স্লিপ বেশি ছাড়েন। এ বছর বাড়তি স্লিপও শেষ। মূলত হিমাগার মালিক মজুতদার ও ব্যবসায়ীদের কাছে আগেই বিক্রি করে দিয়েছেন। এতে প্রকৃত কৃষক আলু বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।
হিমাগার থেকে জানা গেছে, হিমাগারে আলু সংরক্ষণে লুজ বুকিং পদ্ধতিতে কৃষক বা ব্যবসায়ী আলু রেখে পরে বিক্রি করে ভাড়া পরিশোধ করেন। এবার প্রতি কেজির সংরক্ষণ খরচ ৬ টাকা ৭৫ পয়সা নির্ধারণ করেছে হিমাগার মালিক অ্যাসোসিয়েশন। আর পেইড বুকিং পদ্ধতিতে সংরক্ষণের আগেই পুরো টাকা পরিশোধ করতে হয়। জয়পুরহাটের কোনো হিমাগার এ পদ্ধতি অনুসরণ করে না।
হিমাগারের ধারণক্ষমতা অনুযায়ী ৩৫ ভাগ ব্যবসায়ী ও মজুতদারদের জন্য রেখে ৬৫ ভাগ কৃষকের জন্য রাখা হয়েছে বলে দাবি নর্থপোল কোল্ড স্টোরেজের ম্যানেজার মনোয়ার হোসেনের। তিনি বলেন, যারা আগে স্লিপ নিয়েছেন, তারাই সুযোগ পাচ্ছেন। এখন অনেকে স্লিপ সংগ্রহ করতে পেরে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। কিন্তু তারা ধারণ ক্ষমতার বেশি তো সংরক্ষণ করতে পারবেন না।
শুরু থেকে কৃষকদের অগ্রাধিকার দিয়ে বুকিং নিয়েছেন বলে দাবি তিলকপুর দীনা কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থাপক সুপন বড়ুয়ার। তাঁর ভাষ্য, এখন স্থানীয় ব্যবসায়ীদের বুকিং নেওয়া হচ্ছে। বাজারে আলুর দাম কম থাকায় অন্য বছরের তুলনায় এবার কৃষকদের চাহিদা চারগুণ বেশি। বাইরের ব্যবসায়ীদের অগ্রিম আলুর বুকিংয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, হিমাগারের সংরক্ষণে ব্যবসায়ীরাই প্রাণ। তারা সংরক্ষণ না করলে শুধু কৃষকের আলুতে হিমাগার ভরবে না। বাইরের নয়, স্থানীয় ব্যবসায়ীরা কার্ড নিয়েছেন। গত কয়েক বছর লাভ হওয়ায় এবার কৃষক সংরক্ষণে ঝুঁকেছেন। তার ওপর দাম কম, বাম্পার ফলনও হয়েছে।
পল্লী হিমাগারের ব্যবস্থাপক সাব্বির হোসেন বলেন, ‘প্রত্যেক কৃষকের জন্য ৫০ বস্তা করে
বুকিং চলমান আছে। আমরা এবার আগাম স্লিপ দিইনি। যিনি আগে আসবেন, তিনি সংরক্ষণের সুযোগ পাবেন। কোনো কারসাজি নেই।’ ব্যবসায়ী মিঠু ফকিরে কথায়, ‘হিমাগার যখন ফাঁকা
থাকে, তখন মালিকরা ব্যবসায়ীদের সংরক্ষণে অনুরোধ করেন। এবারের চিত্র আলাদা। বাজারে দাম কম হওয়ায় কৃষক সংরক্ষণে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। এবার অনেক ব্যবসায়ী সংরক্ষণ করবেন না। কৃষকরা রাখলেও ক্ষতি নেই। তাদের কাছ থেকে কিনে বাজারে সারা বছর বেচাকেনা চলবে।’
সংরক্ষণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকলে কৃষক ভবিষ্যতে আলুর আবাদ কমিয়ে দেবেন বলে মনে করেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মজিবুর রহমান। তাঁর ভাষ্য, বীজ আলু সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকলে পরবর্তী মৌসুমে উৎপাদন কমতে পারে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মেহেদী হাসান বলেন, যদি কোনো হিমাগার কর্তৃপক্ষ স্লিপ বিতরণে অনিয়ম করে বা মজুতদারদের সুবিধা দিয়ে কৃষককে বঞ্চিত করে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয়ে কঠোর নজরদারি রাখা হচ্ছে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: আল ব যবস য় দ র ব যবস য় র ও ব যবস য় র ব যবস থ ক ষকদ র র জন য আল র ব করছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
উচ্ছেদে প্রভাবশালী মহল বা শক্তিশালী মহলকে ছাড় নয়: রাজউক চেয়ারম্যান
ছবি: প্রথম আলো