যেভাবে প্রাণ-প্রকৃতি বিকল হচ্ছে সেই হিসাবে বলতে হয়, বহুদিন আগে– তা ২০০১ সালের দিকে, লাউয়াছড়া বনে আমরা লুমিনাস ছত্রাক ‘আবিষ্কার’ করেছিলাম। উদ্ভিদ রোগতত্ত্ববিদ অধ্যাপক আবুল খায়েরের সঙ্গে আমিও ঘণ্টাখানেক হাঁ হয়ে তাকিয়েছিলাম অন্ধকারে। হালকা নীলচে হলুদাভ আলো ঠিকরে পড়ছিল চারধারে। বনের ছড়াগুলোর আশপাশে জোনাকি পোকার ঝাঁক দেখেছি এই সেদিনও। এসব কিন্তু আগুন নয়। এমনকি এই বনে প্রাকৃতিক ‘ফরেস্ট ফায়ারের’ কোনো নজির নেই। তাহলে এই বনে বারবার কেন আগুন লাগে? ভূতেরা কি এখানে আগুন লাগায়? লাউয়াছড়াতে আমরা কোনোদিন ভূত-জিন-পেত্নির সাক্ষাৎ পাইনি। লাউয়াছড়াতে মানুষই আগুন লাগায়। মানুষের নির্দয় লোভ আর দখলের উন্মত্ত বাহাদুরি পুড়িয়ে দেয় সব। কেবল লাউয়াছড়া নয়; সুন্দরবন, রাজকান্দি, পাথারিয়া, মধুপুর বনেও আগুন দেয় মানুষ। অক্সিডেন্টাল আগুন দিয়ে অঙ্গার করেছিল মাগুরছড়া বন। ২০২১ সালের পর আবারও আগুন দিয়ে পোড়ানো হয়েছে লাউয়াছড়ার প্রায় দুই একর বন। ২০২৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি দিনদুপুরে ঝলসানো হয়েছে লাউয়াছড়ার বাঘমারা অঞ্চল। লাউয়াছড়ার ত্রিপুরা ও খাসি আদিবাসীদের কাছে শুনেছি একসময় এখানে চিতাবাঘ মারা পড়েছিল। তারপর জায়গাটি বাঘমারা নামে পরিচিত হয়। এই যে চোখের সামনে দেশের এক জটিল অরণ্য পুড়ল, কেউ কোনো বিচার চাইল? কোনো রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, নাগরিক কমিটি কিংবা কোনো নাগরিক প্রতিক্রিয়া? জুলাই গণঅভ্যুত্থানের দামাল জেনজি তরুণ প্রজন্ম কেন লাউয়াছড়া নিয়ে নিশ্চুপ রইল? মাত্র ছয় দিনের ব্যবধানে ৩ মার্চ আবারও লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে।
একে একে পোড়ে দেশের চারধারের বন। পুড়ে পুড়ে অঙ্গার হয় শত সহস্র বছরের জটিল সব অরণ্য বাস্তুতন্ত্র। প্রাকৃতিক বনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে জাতীয় পরিসরে খুব কমই আলোচনা হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান, বনবিদ্যা, উদ্ভিদ কী প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগগুলোও এসব ক্ষেত্রে নিশ্চুপ থাকে। পরিবেশ সংগঠনগুলোও থাকে নিরুত্তাপ। ১৯৯৭ সালে মার্কিন কোম্পানি অক্সিডেন্টালের আগুনে অঙ্গার হয় লাউয়াছড়া। দেশের সেই সর্ববৃহৎ পরিবেশ-গণহত্যার বিরুদ্ধে আমরা কতটা সোচ্চার ছিলাম? সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জে বছরে বছরে সংঘটিত হচ্ছে প্রশ্নহীন অগ্নিকাণ্ড।
২০২৩ সাল ছিল প্রাকৃতিক বনের জন্য নিদারুণ অশনিসংকেত। চা বাগানের আগুনে পুড়েছে হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্যের হাতিমারা। লোভের আগুনে পুড়ছে গাজীপুরের সখীপুর শালবন। চায়না ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের গ্যাস জরিপের নামে মৌলভীবাজারের রাজকান্দি সংরক্ষিত বনের সাঙ্গাইসাফি, কাঁঠালকান্দি ও বাঘাছড়া টিলাবন পুড়ে গেছে। আর পুড়েছে পাথারিয়া পাহাড়ের সমনবাগ বন। মৌলভীবাজারের জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলায় বিস্তৃত পাথারিয়া সংরক্ষিত বনে লাগানো আগুনে অঙ্গার হয়েছে ধলছড়ি ও মাকালজোরার প্রায় ৪০ হেক্টর বন।
লাউয়াছড়ার সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ-প্রকৃতির ক্ষয়ক্ষতির ধরন বিষয়ে আমরা এখনও জানি না। কোনো প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রে আগুন লাগলে কেবল এর আয়তন ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, বরং সেই অঞ্চলে বসবাসকারী সব বন্যপ্রাণীর বিচরণস্থল বিপন্ন হয়ে পড়ে। খাদ্য সংকট দেখা দেয় এবং যদি বাঁচতে পারে তবে বন্যপ্রাণীরা সেই স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এভাবে একটি অঞ্চলে ব্যাপক কৃত্রিম জৈবিক স্থানান্তর ঘটে। অগ্নিকাণ্ডে বনতল ও বনের প্রথম স্তর হয় সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত। বনতলে ঘুমিয়ে থাকা বীজ পরবর্তী মৌসুমে অঙ্কুরোদ্গমে বাধাগ্রস্ত হবে, নতুন বন বিকাশ ঝুঁকিতে পড়বে। গুল্ম, শৈবাল, ছত্রাক, লাইকেন, মস, ফার্ন, অণুজীব, পতঙ্গসহ খুদে প্রাণীদের জীবনে তৈরি হবে গভীর ক্ষত।
লাউয়াছড়ার সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে ‘বিচ্ছিন্নভাবে’ দেখার কোনো জো নেই। তদন্ত কমিটি গঠন করে পুরো ঘটনা খতিয়ে দেখা জরুরি। কর্তৃত্ববাদী রেজিমের দৃষ্টিভঙ্গি বাতিল করে দায়িত্বশীল ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তদন্ত এবং ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে যুক্ত করা জরুরি। একই সঙ্গে দেশব্যাপী প্রাকৃতিক বনে অগ্নিকাণ্ড নিয়ে আমাদের জাতীয় নীতিমালা গ্রহণ করা জরুরি। লাউয়াছড়ার সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার। অগ্নিকাণ্ডের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত বনের বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য তাৎক্ষণিক, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার। এ ক্ষেত্রে লাউয়াছড়ার বাস্তুতন্ত্রের উপযোগী দেশীয় প্রজাতির বীজ ও চারা বর্ষা মৌসুমের আগে রোপণ করা যেতে পারে। খুব সতর্ক থাকতে হবে পুনরুদ্ধারের নামে কোনো আগ্রাসী ইনভ্যাসিভ এলিয়েন গাছের বাণিজ্যিক বাগান যেন আবার তৈরি করা না হয়। কিংবা এই পুড়ে যাওয়া জায়গা দখল করে যেন কোনো বাণিজ্যিক ফসলের বাগান বা রিসোর্ট গড়ে না ওঠে। লাউয়াছড়া বনের আশপাশের খাসি, ত্রিপুরা, চা বাগানের আদিবাসী এবং দরিদ্র বাঙালিদের নিয়ে অংশীদারিত্বমূলক বন ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা জরুরি। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম, স্থানীয় সরকার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নানাভাবে যুক্ত থাকবে। সামগ্রিক সমন্বয়ের জন্য বন বিভাগের দক্ষতা এবং সক্রিয়তা বাড়ানো জরুরি।
২০২১ সালের ২৪ এপ্রিল বন বিভাগের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে লাউয়াছড়া বনের একটি অংশে আগুন লাগে ও পুড়ে যায় বন। কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় কমলগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস ইউনিট ও বন বিভাগ আগুন নেভাতে সক্ষম হয়। বন বিভাগ তৎক্ষণাৎ তদন্ত কমিটি গঠন করে। ঘটনার তিন দিন পর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় কমিটি। প্রাকৃতিক বনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সবচেয়ে দ্রুততম সময়ে তৈরি হয় এই তদন্ত প্রতিবেদন। করোনা মহামারির সময় কর্তৃত্ববাদী রেজিমের ভেতর থেকে সেই সময় যদি লাউয়াছড়া পারে, এখন গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে কেন বন বিভাগ তা পারবে না? সরকারে এখন পরিবেশ ও বনদরদি এবং দায়িত্বশীল উপদেষ্টা আছেন। লাউয়াছড়ার সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের দায় কি বন বিভাগ, স্থানীয় সরকার কিংবা প্রশাসন কর্তৃপক্ষ কেউ এড়াতে পারে? কারণ প্রাকৃতিক বনে অগ্নিকাণ্ড ‘বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২’ অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ।
পাভেল পার্থ: লেখক ও গবেষক
animistbangla@gmail.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: পর ব শ প র ক ত ক বন বন ব ভ গ পর ব শ তদন ত
এছাড়াও পড়ুন:
রাশিয়া সফরে ট্রাম্পের দূত, ইউরোপের উদ্বেগ
ইউক্রেন সংকট ঘিরে বিশ্বজুড়ে কূটনৈতিক ও সামরিক তৎপরতা আরও জোরদার হয়েছে। যুক্তরাজ্য ও জার্মানির উদ্যোগে শুক্রবার ব্রাসেলসে ৫০টি দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে ইউক্রেন প্রতিরক্ষা যোগাযোগ গ্রুপের গুরুত্বপূর্ণ এক বৈঠক। ব্রিটেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জন হিলি জানিয়েছেন, এ বৈঠকের মূল লক্ষ্য ছিল রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ওপর চাপ আরও বাড়ানো।
বৈঠকে ইউক্রেনকে অতিরিক্ত ৫৮ কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। এই প্যাকেজের আওতায় রাডার সিস্টেম, অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মাইন এবং বিপুল পরিমাণ ড্রোন সরবরাহ করা হবে। এ ছাড়া ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে থাকা সামরিক যান ও সরঞ্জাম মেরামতেও ব্যয় করা হবে এ অর্থের একটি অংশ।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ শুক্রবার রাশিয়ায় পৌঁছেছেন। ক্রেমলিন জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হতে পারে। এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হলে তা হবে উইটকফ ও পুতিনের মধ্যে তৃতীয় বৈঠক। এর আগে ফেব্রুয়ারিতে উইটকফ পুতিনের সঙ্গে তিন ঘণ্টারও বেশি সময় বৈঠক করে আমেরিকান শিক্ষক মার্ক ফোগেলকে মুক্ত করিয়েছিলেন। রাশিয়া সফরের আগে তিনি ওয়াশিংটনে রুশ আলোচক কিরিল দিমিত্রিয়েভের সঙ্গে বৈঠক করেন। দু’পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতি নিয়ে ‘একটি সমঝোতা’ হয়েছে বলে জানা গেছে।
তবে এই আলোচনার মধ্যেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে ইউক্রেন। ইউক্রেনের মানবাধিকার কমিশনার দিমিত্র লুবিনেৎস জানিয়েছেন, রুশ সেনারা ১৩ মার্চ জাপোরিঝিয়া অঞ্চলের পিয়াতিখাতকি গ্রামে চারজন নিরস্ত্র ইউক্রেনীয় যুদ্ধবন্দিকে গুলি করে হত্যা করেছে। ইউক্রেন ও রাশিয়ার ড্রোন ফুটেজ বিশ্লেষণ করে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস এই ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছে। লুবিনেৎস আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ও জাতিসংঘের কাছে বিষয়টি তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এটি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, বরং রাশিয়ার একটি প্রাতিষ্ঠানিক নীতি, যা সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে উৎসাহিত হচ্ছে।’ এ ঘটনায় যুদ্ধাপরাধের তদন্ত শুরু হয়েছে।
এরই মধ্যে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আলোচিত একটি বন্দিবিনিময় হয়েছে। বিশ্বাসঘাতকতার মামলায় রাশিয়ায় কারাবন্দি আমেরিকান নাগরিক ক্সেনিয়া কারেলিনাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তাঁর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র আর্থার পেত্রভ নামে এক রুশ-জার্মান নাগরিককে রাশিয়ার হাতে তুলে দিয়েছে। এই বিনিময় প্রক্রিয়ায় মধ্যস্থতা করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। কারেলিনার বাগদত্তা ক্রিস ভ্যান হেরডেন এই মুক্তির জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। তবে আরও কয়েকজন মার্কিন নাগরিক এখনও রাশিয়ার হেফাজতে আছেন, যাদের মুক্তির জন্য চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের অংশ হিসেবে সম্প্রতি তুরস্ক ও ইস্তাম্বুলে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। আলোচনায় কূটনৈতিক সম্পত্তি ফেরত দেওয়া, নিষেধাজ্ঞা শিথিলকরণ ও সরাসরি বিমান চলাচল শুরু করার মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল। বিশ্লেষকদের মতে, যুদ্ধক্ষেত্র ও কূটনৈতিক পরিসরে এই নতুন আলোচনাপ্রবাহ ইউক্রেন সংকটের সমাধানের পথ তৈরি করতে পারে, তবে এখনও বড় ধরনের অগ্রগতি অনিশ্চিত।