শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ আন্দোলন: দায়িত্ব কার?
Published: 7th, March 2025 GMT
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা দুই দশকের বেশি সময় ধরে শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের আন্দোলন করে যাচ্ছেন। তবে আন্দোলনটি বেশি মাত্রায় হচ্ছে এক দশক ধরে। দেশের ৩১ হাজার এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা ৫ লাখের বেশি। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের ৯৭ শতাংশ শিক্ষার নেতৃত্ব দিচ্ছে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। একই বই, একই সিলেবাস, একই যোগ্যতার শিক্ষক অথচ সরকারি-বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে বৈষম্য উৎকট রূপ নিয়েছে।
আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য না বুঝে সাধারণ মানুষের মধ্যে কেউ কেউ মনে করছেন, শিক্ষকরা শুধু তাদের বেতন-ভাতা সুবিধাদির জন্য আন্দোলন করছেন। অন্যদিকে ছাত্র সংগঠনগুলোকে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট আন্দোলনের চেয়ে জাতীয়-আন্তর্জাতিক রাজনীতিকেই বেশি প্রাধান্য দিতে দেখা যাচ্ছে। শিক্ষা উপকরণের দাম অতিমাত্রায় বৃদ্ধি, সময়মতো শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তক না পাওয়া, ভুলে ভরা পাঠ্যপুস্তক হওয়ার পরও উল্লেখযোগ্য কোনো আন্দোলন ছাত্র সংগঠনগুলো গড়ে তুলতে পারেনি।
যে কারণে রাজপথে শিক্ষকসমাজ
এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন শিক্ষক ১২ হাজার ৫০০ টাকা বেতনে চাকরিতে যোগদান করছেন। কর্মচারী পান ৮ হাজার ২৫০ টাকা। ১ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া, ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা– এটা সবার জন্য। উৎসব বোনাস দেওয়া হয় ২৫ শতাংশ। কর্মচারীদের দেওয়া হয় ৫০ শতাংশ। বৈশাখী ভাতা দেওয়া হয় ২০ শতাংশ। বৈশাখী ভাতায় সরকারি-বেসরকারি কোনো বৈষম্য নেই। উৎসব বোনাস ছাড়া বেতন-ভাতাদি থেকে গ্রাচ্যুইটির জন্য সরকার আবার ১০ শতাংশ কেটে নিচ্ছে। এমন নির্মম সিদ্ধান্ত সরকারি চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রেও নেই। ২০১৮ সাল থেকে ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্টে যুক্ত হয়েছেন শিক্ষকরা। একজন এন্ট্রি লেভেলের শিক্ষক প্রথম বছরে কর্তনের পর বেতন পাচ্ছেন ১২ হাজার ৪০০ টাকা।
অধিকাংশ তরুণ শিক্ষক অনার্স-মাস্টার্স পাস। এনটিআরসিএ নির্ধারিত যোগ্যতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ সবাই। অর্থাৎ যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও যোগ্যতার বিচার নেই। অন্যদিকে কয়েক হাজার পদ এখনও শূন্য। গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করেও যোগদান করেননি অনেকে। ফলে শিক্ষক সংকটও চরমে। নামমাত্র বেতনে জীবনযাপন যদি দুরূহ হয়, মেধাবীরা কেন এ পেশায় আসবেন?
দেখা গেছে অধিকাংশ শিক্ষকের কর্মস্থল নিজ বসত থেকে অনেক দূরে। ভিন জেলায় হলে পরিবার-পরিজন ছেড়ে থাকতে হয় বাসা ভাড়া করে। একজন শিক্ষককে বাসা থেকে কর্মস্থলে যেতে আসতে প্রতিদিন যদি ১০০ টাকা ভাড়া গুনতে হয়, মাসে ২২ দিন আসা-যাওয়া করলে ২২শ টাকা যাতায়াতে খরচ হয়। কর্মস্থলে দুপুরের খাবারও রয়েছে। গড়ে প্রতিদিন ১০০ টাকা খরচ হলে এখানেও গুনতে হয় ২২শ টাকা। যাতায়াত ভাড়া ও দুপুরের খাওয়া বাবদ ৪ হাজার ৪০০ টাকা ব্যয় হয়। ওই শিক্ষক মাস শেষে পরিবারের জন্য কিই-বা রাখতে পারবেন? ফলে সংসারের টানাপোড়েনে পড়তে হয় শিক্ষককে। স্ত্রী-সন্তান এবং বাবা-মায়ের ন্যূনতম চাহিদা পূরণ করা অসম্ভব। ২৫ শতাংশ উৎসব বোনাসে আসে ৩ হাজার ১০০ টাকা। এ টাকা দিয়ে একজনেরই ঈদের পোশাক কেনা সম্ভব না। পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্য থাকে কী? ঈদের অন্যান্য খরচ সুদূরপরাহত।
আন্দোলনকারী শিক্ষকদের প্রস্তাব
দেশের ৩১ হাজার এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব আয় রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা নিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের প্রস্তাব দিয়েছে
বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন। তারা প্রমাণসহ দেখান যে, প্রচলিত অবস্থায় প্রতিষ্ঠানের সব আয় নিয়ে গেলে রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে কোনো অর্থ ব্যয় করতে হবে না। যদি শিক্ষার্থীদের বেতন ৫০ টাকা হারে ধরা হয় তাহলে রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে কিছু পরিমাণ টাকা লাগবে, যা রাষ্ট্রের জন্য ন্যূনতম বোঝাও হবে না।
এ বিষয়ে বিগত সরকার নীতিগতভাবে জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত নিয়েও কার্যত ধোঁকাবাজি করেছে। শিক্ষক সমাজের বিশ্বাস, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নির্দ্বিধায় শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের পদক্ষেপ নিয়ে শিক্ষা উন্নয়নের গতি বাড়িয়ে তুলবে। যে বৈষম্যহীন স্লোগানে উদ্দীপ্ত হয়ে ছাত্র-জনতা গণঅভ্যুত্থান করল, তাতে সবাই আশা করতেই পারে আর কোনো বৈষম্য হয়তো থাকছে না।
বিগত আমলে আন্দোলনকারী শিক্ষকরা জাতীয়করণের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে আমলা, বড় বড় শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সভাপতি, এমপি, মন্ত্রী এবং রাজনৈতিক নেতাদের দায়ী করছেন। বড় বড় শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যাপক মাত্রায় শিক্ষা ব্যবসা হয়ে থাকে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা বেতন ও সেশন ফি নিচ্ছে এবং সে টাকা স্থানীয় কমিটি, প্রতিষ্ঠানপ্রধানসহ আত্মসাৎ করার ব্যাপক অভিযোগও আছে। নিবিড় পর্যালোচনায় উঠে এসেছে শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানরাই বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠনের কেন্দ্র থেকে মহানগর, জেলা-উপজেলায় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন। এসব নেতা কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলছেন না। কারণ প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বড় অঙ্কের বেতনসহ বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করছেন। এমনকি নামে-বেনামে ব্যয়ের ভাউচার সন্নিবেশন করে প্রতিষ্ঠানের অর্থ লোপাট করছেন। এর সঙ্গে জড়িত থাকেন ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা। কার্যত এসব প্রতিষ্ঠানপ্রধান আন্দোলনে আগ্রহী নন এবং পদও কুক্ষিগত করে রাখেন কিংবা তার অধীন শিক্ষকদের আন্দোলনে আসতে উৎসাহিত করছেন না।
দেশে শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের জন্য আরেকটি আন্দোলন কেন অনিবার্য হয়ে উঠবে? মানুষ প্রত্যাশা করতেই পারে দেশকে এগিয়ে নিতে রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরাই এটি উপলব্ধি করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। যাতে সমাজ ও সভ্যতা এগিয়ে যায়। এ দেশের শিক্ষার্থীরা যেন বিশ্ব নাগরিক হয়ে উঠতে পারে। একটি টেকসই মানবিক সমাজ গড়ে উঠতে পারে। মনে রাখতে হবে শিক্ষকদের অভুক্ত রেখে ভালো শিক্ষা আশা করা যায় না, ভালো কিছু অর্জন হয় না। সরকারি-বেসরকারি বৈষম্য রেখে কার্যত ভালো জাতিও গড়ে উঠবে না।
জাহাঙ্গীর হোসেন: সভাপতি, বাংলাদেশ মাধ্যমিক সহকারী শিক্ষক সমিতি, কেন্দ্রীয় কমিটি
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: জ ত য করণ র শ ক ষকদ র শ ক ষকর ব যবস থ র জন য সরক র করছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
গাজায় ইসরায়েলের বোমাবর্ষণ অব্যাহত, নিহত আরো অর্ধশতাধিক
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর নৃশংসতা থামছেই না। গতকাল রবিবার (৬ এপ্রিল) গাজাজুড়ে ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৫০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এতে করে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ভূখণ্ডটিতে ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার ৭০০ জনে পৌঁছে গেছে।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, দেইর আল-বালাহের পাঁচটি এলাকার বাসিন্দাদের তাদের এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়ার পর ইসরায়েল গাজার মধ্যাঞ্চলে গতকাল রবিবার নতুন করে ব্যাপক বোমাবর্ষণ করেছে।
আনাদোলু এজেন্সি জানিয়েছে, গাজা শহরের পূর্বে আল-নাখিল স্ট্রিটে ইসরায়েলি কামানের গোলাবর্ষণে আট শিশুসহ দশজন নিহত এবং আরও বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন বলে একটি চিকিৎসা সূত্র জানিয়েছে।
আরো পড়ুন:
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিবাদে ফেনীতে বিক্ষোভ
গাজায় স্বাস্থ্যকর্মী হত্যার ঘটনায় ভুল স্বীকার করল ইসরায়েল
ওই সূত্র আরো জানিয়েছে, কেন্দ্রীয় শহর দেইর আল-বালাহেও ইসরায়েলি বিমান হামলায় পাঁচজন নিহত হয়েছেন। আরেকটি মেডিকেল সূত্র জানিয়েছে, গাজা শহরের পূর্বে শুজাইয়া পাড়া লক্ষ্য করে বিমান হামলায় তিনজন নিহত হয়েছেন।
একই শহরের জেইতুন পাড়ায় আইন জালুত স্কুলের কাছে একটি বাড়িতে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান হামলায় আরো দুইজন নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। সূত্র জানিয়েছে, উত্তর গাজা উপত্যকার জাবালিয়ার সালাম পাড়ায়ও কামানের গোলাবর্ষণে আরো চারজন নিহত হয়েছেন।
এছাড়া কেন্দ্রীয় গাজার জাওয়াইদা এলাকায় একটি বাস্তুচ্যুত শিবিরে ড্রোন হামলায় আরো একজন ফিলিস্তিনি নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। আরেকটি মেডিকেল সূত্র জানিয়েছে, দক্ষিণাঞ্চলীয় খান ইউনিস শহরে একটি বাড়িতে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান থেকে চালানো হামলায় আটজন নিহত হয়েছেন।
দক্ষিণাঞ্চলীয় খান ইউনিসের কিজান রাসওয়ান এলাকায় বেসামরিক নাগরিকদের একটি দলকে লক্ষ্য করে আরেকটি হামলায় আরো একজন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
অন্যদিকে খান ইউনিসের পশ্চিমে আল-মাওয়াসিতে বাস্তুচ্যুতদের আশ্রয়কেন্দ্রে ইসরায়েলি গুলিবর্ষণে এক ফিলিস্তিনি শিশু নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। খান ইউনিসের পূর্বে আবাসন আল-কাবিরায় কামানের গোলাবর্ষণে আরো একজন নিহত এবং আরো চারজন আহত হয়েছেন।
এদিকে আল জাজিরার লাইভ খবরে বলা হয়েছে, আজ সোমবার সকালেও গাজার আল-আকসা হাসপাতালের কাছে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী।
কুদস নিউজ নেটওয়ার্কের বরাত দিয়ে আল জাজিরা বলেছে, গাজার বাস্তুচ্যুত নিরুপায় মানুষেরা আল–আকসা হাসপাতালের কাছে তাঁবুতে আশ্রয় নিয়েছিল। সেখানেও হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। এ হামলায় প্রচুর হতাহতের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা জানা যায়নি। তবে আহত বেশ কয়েকজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
ঢাকা/ফিরোজ