‘চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে নারীর বীরত্ব অসামান্য’
Published: 7th, March 2025 GMT
রোকেয়া সুলতানা, প্রথিতযশা চিত্রশিল্পী। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও খ্যাতি অর্জন করেছেন। দেশ-বিদেশের নানা চিত্রপ্রদর্শনীতে তাঁর চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হয়েছে। পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। সম্প্রতি একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর নিবিষ্ট শিল্পচর্চায় নারী, মাতৃত্ব, প্রকৃতি, জলবায়ু, সংগ্রাম, সম্পর্ক বর্ণাঢ্য হয়ে ধরা দেয়। তিনি কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে।
আপনার জন্ম ও বেড়ে ওঠা সম্পর্কে জানতে চাই?
১৯৫৮ সালে আমার জন্ম। রাওয়ালপিন্ডি গেলাম। আমার বয়স যখন দুই বছর, তখন বাবার পোস্টিং সূত্রে আমরা অনেক দূরে চলে গেলাম। পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে, ১৯৬০ সালে। ওখানে আমরা অনেকদিন ছিলাম, প্রায় ১০ বছর। সেটা এমন একটা জায়গা ছিল যেখানে একদম গাছপালা ভরা। এমনকি আমাদের বাসার সামনে বড় বড় মাঠ ছিল, যেখানে গলফ খেলতে আসতেন দূতাবাসের লোকেরা। আমি বিদেশিদেরও দেখেছি তখন। বিমানবাহিনী, সেনাবাহিনীর লোকেরাও খেলতেন। এ জন্যই বড় বড় সবুজ মাঠ। আমি তো প্রকৃতি ভালোবাসি, মানে প্রকৃতি আমার সঙ্গে কথা বলে। এটা আমার সবসময় বলাও হয়ে উঠে না– আমি সবচেয়ে বেশি ইনফ্লুয়েন্সড হয়েছি বা হই প্রকৃতি দ্বারা। প্রকৃতির পরিবর্তনগুলো আমাকেও পরিবর্তন করতে থাকে। কাজেও এটার ছাপ পড়ে আর বাংলাদেশ তো সবুজ শ্যামলী মা, আমার নদীমাতৃক বাংলাদেশ।
আপনার নামের মধ্যে ‘রোকেয়া’ এবং ‘সুলতানা’– রোকেয়ার চিন্তা বা সৃষ্টিকর্ম। এই নাম কে রেখেছেন?
বাবা। আমার বাবা কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ছিলেন তখন। এখন সেটা মাওলানা আবুল কালাম আজাদ কলেজ। সেখান থেকে তিনি তার ব্যাচেলর এবং মাস্টার্স করেন। তিনি একটা গ্রামে বড় হয়েছেন এবং ম্যাট্রিকে ফার্স্ট ডিভিশন পান এবং আমার ধারণা, স্ট্যান্ড করা লেভেলে তিনি গিয়েছিলেন। কিন্তু শুনতাম, কলেজে পড়াকালীন লেখক শওকত ওসমান তাঁর বন্ধু ছিলেন। ‘সওগাত’সহ আরও কিছু পত্রিকায় লিখতেন।
শুনেছি, আমার বাবা যখন গ্রামে আসতেন তখন মহিলাদের যে গীতি থাকে প্রচলিত, সেগুলো তিনি সংগ্রহ করতেন।
আমাদের ছোটবেলায় পশ্চিম পাকিস্তানে কিছু বাঙালি পরিবার খুব শক্তভাবে বাংলা সংস্কৃতি ধরে রেখেছিল। আমরা বাংলা মিডিয়ামে পড়েছি সেখানে। আমার বাবা পুলিশ বিভাগে চাকরি করতেন। আমার সুযোগ হয়েছিল বাবার একটা ডায়েরি পড়ার। ডায়েরির লেখা ছিল এমন– ‘আজ ভাষা দিবস, সবাই শহীদ মিনারে ফুল দিতে যাবে; কিন্তু আমি আমার চাকরির কারণে যেতে পারছি না।’ খুবই দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে তিনি তা লিখেছিলেন। আমরা ভাইবোনরা যখন কাজ করেছি, সাবজেক্ট বেছে নিয়েছি, আমার বাবা আমাদের অনেক উৎসাহ দিয়েছেন।
আপনার শিল্পকর্ম ‘ম্যাডোনা’ সিরিজ ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ। এর শুরুটা কীভাবে?
l l এমনিতে কারণটা খুবই সিম্পল, আমরা যদি আর্টের ইতিহাস দেখি তাহলে প্রায় প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী ম্যাডোনা নিয়ে কাজ করেছেন; বিশেষ করে রেনেসাঁর সময়কালে। যখন আমার মেয়ের জন্ম হলো, তখন আমারও মনে হচ্ছিল যে একটা কালজয়ী ম্যাডোনা আমাকে রচনা করতে হবে। আমি যদি আমার শিল্পকলার জীবনকে ভাগ করি ৩০-৩৫ বছর তাহলে আমি চার-পাঁচটা সিরিজের কথা যদি বলি তার মধ্যে ম্যাডোনা সিরিজটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সম্ভবত ’৯১-এ আমি আমার লিভিং রুমে পেন্সিল চারকোল ইত্যাদি দিয়ে আঁকিবুঁকি করছিলাম, তখন ম্যাডোনাটা চলে আসে। যে একটা মা তার মেয়ের হাত ধরে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। এই যে রাস্তাটা এটা কি ঢাকার রাস্তা নাকি অন্য কোথাকার রাস্তা সেটা। এখানে আমি একটা মেটাফরিক ট্রিক ইউজ করেছি, এটা আসলে আমার একটা কাজেরই অংশ। আমার পুরো কাজ বলে দিতে ইচ্ছে করে না, যেন দর্শকরাও কিছুটা ভেবে নিতে পারেন। এভাবেই আমার ম্যাডোনা সিরিজের শুরু।
ম্যাডোনা সিরিজে নারীর সংগ্রাম এবং নারীর অধিকার ক্ষমতায়নের একটা চিত্র আমরা দেখতে পাই। এ বিষয়টিকে আপনি কীভাবে আনলেন আপনার শিল্পতে?
l l ছোটবেলা থেকে নারী হিসেবে একটা পারিপার্শ্বিক ব্যাপার সমাজ আমাকে বুঝিয়েছে। তাই আমার মধ্যে একটা অস্তিত্বের সংকট থেকে লড়াই বহিঃপ্রকাশ হয়েছে, যত বড় হয়েছি সেটি আরও প্রকট হয়েছে। ছোটবেলা থেকে আমাদের মাকে বাসায় কাজ করতে দেখেছি। তাদের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টিও আমি দেখেছি। সেখান থেকে আমার ম্যাডোনার মা আর তখন বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পের বিকাশটাও শুরু হয়। তখন থেকে আমি দেখেছি বাংলাদেশের নারীরা অর্থনীতিতে একটা বিশাল ভূমিকা রেখে চলেছেন। গ্রাম থেকে তারা এসে গার্মেন্টসে কাজ করতেন এবং তখন আসলে মানে প্রতিটি পাড়ায় পাড়ায় গার্মেন্টস ছিল– এমন একটা বিকাশ হয়েছিল বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পের। তো এগুলো আমরা দেখতাম, নারীরা টিফিনের বাক্স হাতে নিয়ে কাজে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের মতো কনজারভেটিভ একটা রাষ্ট্রে কাজ করছেন, মেসে থাকছেন। তখন আমি মা ও মেয়েকে এক্সপ্রেস করলাম। এটা শুধু একটি মা-মেয়ের গল্পই থাকল না, এটাকে আপনি নারীর স্বাধীনতা বলতে পারেন, তার অর্থনৈতিক মুক্তি বলতে পারেন, তার মনের বিকাশের জায়গাটা বলতে পারেন। তার যে পাওয়া না পাওয়া। এই পাওয়া না পাওয়া বলতে অস্তিত্ব রক্ষার যে মানুষ হিসেবে নিজেকে রক্ষার যে পাওয়া না পাওয়া সেই পর্যায়ে যেন মেয়েটি যেতে পারে তার মায়ের হাত ধরে। যেখানে হ্যাঁ বা না বলার যেন তার রাইট থাকে। আরও একটা বিষয় যেটা হচ্ছে আমি একজন মা এবং সন্তানের জীবনে মায়ের একটা বিরাট ভূমিকা থাকে। তবে মা কিন্তু একজন মানুষও। এই মানুষ বিষয়টা একটা মেয়ে যখন মা হয়, তখন আমরা অনেক সময় ভুলে যাই। এখনও আমার একটা say ছিল যে মা আমি একটা ম্যাজেন্টা রঙের শাড়ি পরিয়েছি, তার গালে আমি একটা স্কার দিয়েছি, একটা আঁচড় দিয়েছি– কারণ আমি এখানে একটা যুদ্ধ দেখাতে চেয়েছি, আমি এখানে স্ট্রাগল দেখাতে চাইনি ও কিন্তু দুঃখ-দুর্দশায় নুয়ে পড়ছে না, মিছমার হয়ে যাচ্ছে না। ও কিন্তু ফাইট করছে। তার মেয়েকে নিয়ে সে আনন্দিত। ও বাসে যাচ্ছে, নৌকায় যাচ্ছে; তবে ও যে একটা মানুষ ও যে কোনো দেবী নয়, তাই আমি ওকে একটা ম্যাজেন্টা রঙের শাড়ি পরিয়েছি। সবসময় এটা আমি মেটাফোরিকালি রাখতাম।
এই ম্যাডোনাতে তো আপনাকেও খুঁজে পাওয়া যায়?
l l আসলে আমরা যে কোনো কাজই করি না কেন, আমাদের সেই কাজে নিজেদের একটা আয়না থাকে, যেখানে আমরা নিজেরা প্রতিফলিত হই। তাই আমার শিল্পকর্ম ম্যাডোনাতে আমি প্রতিফলিত হয়েছি।
২০২৫ সালের নারী দিবস আমরা এমন একটা সময় পার করতে যাচ্ছি, যখন এর আগের বছরই একটা গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। কিন্তু আমরা দেখছি, নারী নির্যাতন তো কমেনি। আগেও চলছিল, এখনও চলছে।
l l আসলে গণঅভ্যুত্থানের যে ভিডিও ক্লিপগুলোতে আমরা যা দেখছিলাম, রাস্তায় তাদের অগ্নিকন্যা বলে সম্বোধন করা হচ্ছে। তারা কিন্তু পুরুষের ঢাল হয়ে এগিয়ে এসেছে। নারীদের বলা হয় মায়ের জাতি। তারা তাদের সন্তানদের রক্ষা করতে সবকিছু করতে পারে। গণঅভ্যুত্থানে এই মেয়েদের মধ্যে রক্ষা করার যে বিষয়টি, সেটি অনেকাংশে ফুটে উঠেছে। তারা খুবই অসাধারণ কাজ করেছে। গণঅভ্যুত্থানে নারীর বীরত্ব, সাহস, ডেডিকেশন ছিল অসামান্য। আমার মনে হয়, এবার সেটির মূল্যায়ন হবে। এবারের নারী দিবসে নারীর যে দেশমাতৃকার প্রতি ভূমিকা, তাঁর যে সাহস– এটাই মুখ্য হয়ে উঠুক।
নারীর পোশাক নিয়ে সম্প্রতি কটূক্তি শোনা যাচ্ছে.
..
l l সৌন্দর্য একেকজনের কাছে একেকরকম। সংস্কৃতি, সৌন্দর্য দেশ ও কাল ভেদে ভিন্ন হয়। পোশাকও একইরকম। একেকজনের কাছে একেক রকম পোশাক পছন্দ হতে পারে। পোশাকের পছন্দ অবশ্যই নারীর অধিকার। কেউ ভুল বা অন্যায় করেছে মনে করলে তার প্রতিকার চাইতে হবে। আমি কাউকে সঠিক মনে করি না বলে আরেকজনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে এমন তো নয়। আইন নিজ হাতে তুলে নেওয়াটা সমাধান নয়। সরকারের কাজ সরকার করছে। সরকারের যেমন দায়িত্ব আছে, নাগরিকেরও দায়িত্ব রয়েছে। স্বাধীনতা উদযাপন যখন সুন্দর থাকে না, তখন সেটা আর স্বাধীনতা থাকে না। আমার দেশে সেই স্বাধীনতা নারী-পুরুষ সবারই আছে। আবার রাতারাতিই তো সব বদল হবে না। এজন্য সময় লাগবে। সেই অনুযায়ী কাজও করতে হবে।
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।
l l সমকালকেও ধন্যবাদ।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গণঅভ য ত থ ন আম র ব ব আম দ র জ কর ছ ক জ কর আম র ম ব ষয়ট আপন র র একট
এছাড়াও পড়ুন:
সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতির পথরেখা
বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর ছাত্রদের মধ্য থেকেই দাবি করা হয়েছিল, ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা হোক। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পরও ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি উঠেছে ছাত্রদের মধ্য থেকেই। এর বহু আগে থেকেও ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি করা হয়েছিল। তবে সমগ্র ছাত্রসমাজ দলমত নির্বিশেষে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি করেছে, তা বলা যাবে না। ছাত্রদের মধ্যে সহিংস ঘটনা বা লেজুড়বৃত্তি রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন বা অনৈতিক কর্মকাণ্ড যখন চরম আকারে পরিলক্ষিত হয় কিংবা সাধারণ জনমনে একশ্রেণি ছাত্রের প্রতি চরম ঘৃণার উদ্রেক হয়, তখন ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবিও সামনে চলে আসে। এটি সত্য, শাসকগোষ্ঠীর অনুসৃত বা অঙ্গসংগঠন বা সহযোগী ছাত্র সংগঠনের অপকীর্তির কারণেই ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি এসেছে বারবার।
ছাত্র রাজনীতির একটি ছোট্ট ইতিহাস আছে। উনিশ শতকের সত্তর দশকের গোড়ার দিকে এ ভূখণ্ডে ছাত্র রাজনীতি সংগঠিত হতে শুরু করে। ভারতীয়দের মধ্যে সমাজ ও রাজনৈতিক চেতনা বিকাশের স্বার্থে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় একটি ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। জাতীয় কংগ্রেসের উদ্যোগে ১৯২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় নিখিল বঙ্গ ছাত্র সমিতি। এর আগেও পাশ্চাত্য শিক্ষায় প্রচলিত ধ্যান-ধারণার বিরুদ্ধে ইয়ং বেঙ্গলের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলন ইতিহাসে সাক্ষী হয়ে আছে। ১৯৩২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. শহীদুল্লাহর নেতৃত্ব গড়ে তোলা হয় নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্র সমিতি। তবে বিশ শতকের প্রথম দিকেই ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী আন্দোলন, স্বদেশি আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্র রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা বাড়তে থাকে। ছাত্র রাজনীতি শুধু শিক্ষা সংক্রান্ত দাবির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। ইতিহাসের সেই গড়ে ওঠা ছাত্র সংগঠন ও ছাত্র রাজনীতির ধারাবাহিকতাই আজকের স্বৈরাচারবিরোধী ’২৪-এর গণঅভ্যুত্থান।
আমাদের ছাত্র রাজনীতি কলুষিত হয়েছে। ছাত্র রাজনীতির মধ্যে শিক্ষাগত মান কমেছে। কমেছে নিষ্ঠা, মানবিকতা ও আদর্শবাদিতা। ভীষণভাবে কমেছে আদর্শবাদিতার অব্যাহত চর্চা। স্বার্থবাদিতা ও সুবিধাবাদিতা বিশালভাবে আশ্রয় নিয়েছে ছাত্র রাজনীতির মধ্যে। ছাত্র রাজনীতিকে খুবরে খুবরে খাচ্ছে দিন দিন। গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতা প্রায় উঠেই যাচ্ছে। বেড়েছে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি, স্বার্থবাদিতা, টেন্ডারবাজি, হিংসাপরায়ণতা ও সহিংসতা। স্বাধীনতার পর থেকেই ছাত্র রাজনীতির এসব নেতিবাচক দিক ক্রমবিকশিত হলেও বেশ কয়েক বছর হলো চরম আকার ধারণ করেছে। অনেক ক্ষেত্রে শাসকগোষ্ঠীগুলোর প্রচ্ছন্ন ছত্রছায়ায়ই ঘটেছে এসব অপকীর্তি। জনগণের অনাস্থা গ্রথিত হতে হতে ক্রমশ ঘনীভূত হয়েছে। ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি উঠেছে সে কারণেই। এ দাবিও নতুন নয়। বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি উঠেছে। রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থায় বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেও অনেকে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি করে আসছেন। বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ার অশুভ শক্তি ঘোলাটে রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে মাঝে মধ্যেই ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি নিয়ে সামনে আসে। সাদা চোখে দেখলে এ দাবি মোটেই অমূলক নয়। তবে বিষয়টিকে বিশ্লেষণাত্বক দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখা প্রয়োজন।
ছাত্র রাজনীতি মানে হচ্ছে, ছাত্রদের স্বার্থ নিয়ে কথা বলা। ছাত্ররা শিক্ষা গ্রহণ করবে, মেধা চর্চা করবে, মেধার বিকাশ ঘটাবে, গবেষণায় মনোনিবেশ করবে, মুক্তভাবে কথা বলবে, শিক্ষাসংক্রান্ত ন্যায়সংগত দাবি তুলবে, অধিকারের কথা বলবে, সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা বলবে, সুশাসনের কথা বলবে, সমাজ প্রগতির পক্ষে সাংস্কৃতিক চর্চা করবে, প্রচার করবে, পরমতসহিষ্ণু হবে, ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারী সম্পর্ক স্থাপিত হবে, সংগঠিত হবে, ছাত্র সংসদ নির্বাচনের নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবে, নেতৃত্বের বিকাশ ঘটাবে। ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক চর্চা ও সংগঠিত করা ছাত্রদের দায়িত্বের বাইরে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে লেজুড়বৃত্তি ও ছাত্র রাজনীতি এক বিষয় নয়। লেজুড়বৃত্তি ও অন্যান্য নেতিবাচক বিষয় ছাত্র রাজনীতিকে দুর্বৃত্তায়িত করে, কলুষিত করে। এগুলো বন্ধ করতে হবে। শাসকগোষ্ঠীর ইচ্ছার ওপরেই নির্ভর করছে ছাত্র রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করা। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর ইতিবাচক ভূমিকা হবে অগ্রগণ্য। লেজুড়বৃত্তি পরিহার করে ছাত্রদের সংগঠিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
অন্যদিকে আইন করে এ রকম ছাত্র রাজনীতি বন্ধ থাকলে কালক্রমে মেধাচর্চা বা মেধার বিকাশও রুদ্ধ হতে পারে। মেধার পরিসীমাও সীমাবদ্ধ হয়ে যেতে বাধ্য। ছাত্ররা পাঠ্যক্রমের আওতার মধ্যেই হাবুডুবু খাবে। মেধাশূন্য হয়ে যেতে পারে জাতি। জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে যেতে পারে কালক্রমে। মনে রাখতে হবে ছাত্রনেতৃত্বের মধ্য থেকেই সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব বেরিয়ে আসে। গ্রাম-শহরে সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নে ছাত্রনেতৃত্বের অপরিসীম ভূমিকাকে আমরা অবমূল্যায়ন করতে পারি না। আমরা সবাই জানি, ১৯৫২, ১৯৬২, ১৯৬৯, ১৯৭১, ১৯৯০ ও ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে রাজনৈতিক ছাত্রনেতৃত্বের ভূমিকাই ছিল অগ্রগণ্য। এই অভ্যুত্থানগুলো বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে অসামান্য ভূমিকা রেখেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই সামান্য ইতিহাসটুকু আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও সংস্কৃতি বিনির্মাণে ছাত্র রাজনীতির বিরাজমান ঐতিহাসিক ভূমিকা। সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতির চর্চার মধ্য দিয়েই তা সম্ভব হয়েছে। শাসকগোষ্ঠীর হীন শ্যেনদৃষ্টি না পড়লে হয়তো ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবিই উত্থাপিত হতো না।
সে জন্য সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সেই ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব সবার। সব বুদ্ধিদীপ্ত মানুষের। সমাজের সব প্রতিনিধিত্বশীল রাজনীতিক, সুশীল ব্যক্তি, পেশাজীবী, সাংবাদিক, ছাত্রনেতৃত্বসহ সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতির জন্য গ্রহণযোগ্য বিধিমালা ও প্রয়োগবিধি প্রণয়ন করতে হবে। সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতির স্বার্থে ব্যাপক মানুষের মধ্যে প্রণীত বিধিমালা ব্যাপক প্রচার করতে হবে। ছাত্র ও জনগণের মধ্যে সুস্থ মনোভাব প্রস্তুত করতে হবে। জনগণের মধ্যেও সুস্থ মনোভাব প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে ছাত্র রাজনীতির হারানো ঐতিহ্য ও গৌরব ফিরিয়ে আনা সবারই কর্তব্য। সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতি প্রতিষ্ঠার পক্ষে এ দেশেই সংগ্রাম চলছে অব্যাহতভাবে। সংগ্রামের ধারা আরও বিকশিত হোক। আমরা সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতি চাই।
সিরাজুমমুনীর: জাতীয় পরিষদ সদস্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)