দাস প্রথা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধ হয় ১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত, যেখানে প্রায় আট হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। সেই যুদ্ধের এক পর্যায়ে পেনসিলভানিয়ার গেটিসবার্গ মুক্ত হয়। সেখানে মৃতদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধে– ১৮৬৩ সালের ১৯ নভেম্বর– তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন ঐতিহাসিক এক ভাষণ দেন। ভাষণটি এতই সংক্ষিপ্ত ছিল যে উপস্থিত সাংবাদিকরা তাদের ক্যামেরা সেট করার আগেই তা শেষ হয়ে যায়। সেই বক্তৃতা থেকেই গণতন্ত্রের আধুনিক সংজ্ঞা– ডেমোক্রেসি অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল অ্যান্ড ফর দ্য পিপল– লোকমুখে প্রচারিত হওয়া শুরু করে। কিন্তু যা প্রচারিত হয় না তা হলো ভাষণের শুরুর কথা। যেখানে বলা হয়েছে, ‘সব মানুষ সমান।’ ধর্ম-বর্ণ, জাতি-গোত্র নির্বিশেষে সবাই দেশের নাগরিক পরিচয়ে বেড়ে উঠবে। 


লিঙ্কনের গেটিসবার্গ ভাষণের প্রায় ১০০ বছর পরে– ১৯৬৩ সালের ২৮ মার্চ– যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনের লিঙ্কন মেমোরিয়াল সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে খ্রিষ্টান পাদ্রি ও নাগরিক আন্দোলনের নেতা মার্টিন লুথার কিং আরেক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তাঁর নেতৃত্বে তখন যুক্তরাষ্ট্রে বিশেষত কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের ভোটাধিকারসহ আরও কিছু নাগরিক অধিকার নিয়ে প্রবল আন্দোলন চলছিল। হাজার হাজার মানুষের সামনে প্রদত্ত ভাষণটি তিনি ‘আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম– আমার একটা স্বপ্ন আছে’ বলে শুরু করেন। ভাষণটির নাম হয়ে যায় ‘আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম’, দুনিয়াব্যাপী যা ব্যাপক আলোড়ন তোলে। সেই ভাষণে মার্টিন লুথার কিং একটি সাম্য, শোষণমুক্ত সমাজ, সর্বোপরি ‘সকল মানুষ সমান’– এমন স্বপ্নের কথা বলেছেন। পৃথিবীতে সাড়া জাগানো ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্যে লিঙ্কন ও মার্টিন লুথার কিংয়ের ভাষণ অন্যতম। দুটো ভাষণই ছিল ইংরেজিতে। দুটো ভাষণই মার্কিন সমাজে বিশেষত নাগরিক অধিকার প্রশ্নে বিরাট পরিবর্তন সূচিত করে।


মার্টিন লুথার কিংয়ের ভাষণের ১০০ বছরের কিছু বেশি সময় পরে– ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ– পৃথিবীর মানুষ আরেকটি ভাষণ শোনে, যেটি দেওয়া হয় বাংলায়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (আজকের বাংলাদেশ) রাজধানী ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (আজকে যা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)। ভাষণটি দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ইতোমধ্যে বিশ্বের ১০০টি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত এই ভাষণ বাংলাদেশ নামে নতুন এক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বার্তা বহন করে। তৎকালীন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান মহাকাব্যিক ছন্দে এবং অত্যন্ত বলিষ্ঠ স্বরে ভাষণটি দেন। তা ব্রিটিশ ও পাকিস্তান মিলিয়ে ২২৩ বছরের ঔপনিবেশিক জঞ্জাল মুক্ত হতে নিপীড়িত বাঙালির মনে আশা-ভরসা এবং প্রতিজ্ঞার শিখা জাগ্রত করে। এ ভাষণের পর শেখ মুজিবুর রহমানকে দ্য নিউজউইক ম্যাগাজিন ‘পোয়েট অব পলিটিকস’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। 


ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ শুরু হয়েছে দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ের আর্তনাদ দিয়ে। ভাষণের প্রতিটি ছত্রে অসাধারণ বাগ্মিতা ফুটে ওঠে, যেখানে নিপীড়িত মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটছিল। এতে ছিল মুক্তি কোন পথে আসতে পারে তার স্পষ্ট নির্দেশনা। যে নির্দেশনার জন্য বাঙালি শতাব্দীর পর শতাব্দী লড়াই করেছে। একই কারণে তা বিশ্বের যে কোনো নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর জন্যও মুক্তির বার্তাস্বরূপ। 


ভাষণ শেষ হয়েছে অসাধারণ প্রতিজ্ঞা দিয়ে। অনেকে আক্ষেপ করে বলেছেন, সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা কেন দেওয়া হলো না। সে বিতর্ক এখনও চলমান। তবে এ মত পোষণকারী লোকও কম নয় যে, ৭ মার্চের ভাষণে সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করা হলে শেখ মুজিব বোকামি করতেন। কারণ ওইদিন জনসভায় বাসে, ট্রাকে, হেঁটে প্রায় বিশ লাখ নিরস্ত্র জনতা ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত হয়েছিল। স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে সুসজ্জিত সামরিক বাহিনীর গুলির মুখে তাদের ঠেলে দেওয়া হতো। এর ফলে নিষ্ঠুর ও বর্বরতম হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হতো। তা হতে পারত ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগের বর্বর হত্যাকাণ্ডের চেয়েও নির্মম কিছু। বেঁচে যাওয়া মানুষগুলো হয়তো নানা গুপ্তহত্যা, গ্রেপ্তার ও হয়রানির শিকার হতো। ফলে ৭ মার্চ স্বাধীনতার কৌশলী ঘোষণা সঠিক সিদ্ধান্ত বলে মনে করেন অনেকে। যার মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব অসাধারণ ও দক্ষ এক রাজনৈতিক কুশলীর পরিচয় দেন। 


৭ মার্চের ভাষণের আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কয়েক দফায় ছাত্রনেতা ও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে সবার কথা শোনেন। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে নিজের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তার ওপর নির্ভর করেন। নেতৃত্বের অন্যতম শর্ত বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত। শেখ মুজিবের এমন দূরদর্শিতা নতুন প্রজন্মের জন্য শিক্ষা।  


গত বছরের ৫ আগস্ট এক গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনীতিতে নতুন মেরূকরণ ঘটেছে। জন্ম নিয়েছে নতুন এক সম্ভাবনা। কিন্তু সেই সম্ভাবনা কাজে লাগানোর পরিবর্তে যেভাবে খোদ শাসক মহল থেকে ৭ মার্চসহ মুক্তিযুদ্ধের সেরা মুহূর্ত ও ঘটনাবলিকে অস্বীকার ও হেয় করা হচ্ছে, তা দুর্ভাগ্যজনক। এখানেই মার্কিন জনগণসহ বিশ্বের অন্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আমাদের পার্থক্য ফুটে ওঠে। আমেরিকাতেও আব্রাহাম লিঙ্কন ও মার্টিন লুথার কিংয়ের বিপরীত চিন্তার মানুষ ক্ষমতাসীন হয়েছেন, কিন্তু কখনোই সেখানে ঐতিহাসিক ওই দুই ভাষণকে হেয় করার চেষ্টা দেখা যায়নি। বিগত প্রায় ১৬ বছরের শাসকেরা মুক্তিযুদ্ধ ও শেখ মুজিব নিয়ে নানা বয়ানে অতিরঞ্জন ঘটিয়েছেন, সন্দেহ নেই। কিন্তু তাতে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে ৭ মার্চের ভাষণের অনন্য ভূমিকা খর্ব হয় না। এমনকি স্বাধীনতার পরোক্ষ ঘোষণা হিসেবেও তাকে দেখা যায়। বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে। সেই যুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুতে শেখ মুজিবের সংগ্রাম এবং নেতৃত্ব সারা দুনিয়ায় উজ্জ্বল আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। 

রিয়াজ মাহমুদ: কবি ও প্রাবন্ধিক
 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: শ খ ম জ ব র রহম ন বছর র

এছাড়াও পড়ুন:

মানুষ বলছে, আপনাদেরকে আরো ৫ বছর দেখতে চাই: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা 

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, “দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো। এসব দেখে মানুষ আমাকে বলছে, আপনাদেরকে আরো ৫ বছর দেখতে চাই।” 

তিনি বলেন, পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের প্রতিটি ঘটনার প্রতি সজাগ ও সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছি। পুলিশের কর্মতৎপরতা আগের চেয়ে বাড়ছে। আরো বাড়ানো হবে।

বৃহস্পতিবার (১০ এপ্রিল) দুপুর ২টায় সুনামগঞ্জ জেলার শান্তিগঞ্জ থানা পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন তিনি। 

শেখ হাসিনাকে ফেরত আনা প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, স্বরাষ্ট্র ও কৃষি দেখার জন্য আমি এখানে এসেছি। ফরেন দেখার জন্য ফরেন অ্যাডভাইজার আছেন। তবে, ভারতের সাথে আমাদের একটি চুক্তি আছে। চুক্তিতে বন্দিবিনিময় করার কথা বলা আছে। এ চুক্তির আলোকে ক্রিমিনালকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করব। চিকেন নেক ইস্যু নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কোনো যুদ্ধের শঙ্কা নেই।

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা তো আমাদের নিজস্ব কিছু হাতিয়ার হারিয়েছি। এগুলো উদ্ধার করতে হবে।

দেশে মব জাস্টিস নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, যেখানেই মব হচ্ছে, সেখানেই অ্যাকশনে যাচ্ছি আমরা। যারা ঘটনা ঘটাচ্ছে, তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসছি। ভবিষ্যতে যদি কেউ মব সৃষ্টি করতে চায়, তাহলে কঠোর হাতে দমন করা হবে।

শান্তিগঞ্জ থানা এলাকায় ঘন ঘন সংঘর্ষের বিষয়ে তিনি বলেন, শুধু পুলিশকে দোষ দিলে হবে না। এ কাজ শুধু পুলিশের না, জনসাধারণকে বেশি করে সচেতন করতে হবে। 

আগ্নেয়াস্ত্র বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, এ অস্ত্র যাতে ব্যবহার করা না হয়, সেদিক নজর রাখবে পুলিশ।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন সিলেট বিভাগীয় কমিশনার খান মোহাম্মদ রেজা-উন-নবী, জেলা প্রশাসক ড. ইলিয়াস মিয়া, পুলিশ সুপার তোফায়েল আহম্মেদ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সমর কুমার পাল, শান্তিগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা সুকান্ত সাহা, শান্তিগঞ্জ থানার ওসি আকরাম আলী প্রমুখ। 

এর আগে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা শান্তিগঞ্জ থানা ভবনে অভ্যর্থনা কক্ষ, হাজতখানা প্রভৃতি ঘুরে দেখেন। 

বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৩টায় সুনামগঞ্জ সদর উপজেলায় হাওরে বোরো ধান কাটার অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর। 

ঢাকা/মনোয়ার/রফিক 

সম্পর্কিত নিবন্ধ