গাইবান্ধা পৌরসভার উপসহকারী প্রকৌশলী (সিভিল) শফিউল ইসলামের ঘুষ চাওয়ার একটি অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে প্রকৌশলীকে প্রকল্পের টাকা ছাড়ে এক ঠিকাদারের কাছে ৬ শতাংশ ঘুষ দাবি করতে শোনা যায়।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে ১০ মিনিট ১৬ সেকেন্ডের ওই অডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। ভুক্তভোগী ঠিকাদারের নাম ফিরোজ কবির। তিনি প্রকৌশলীকে ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছেন বলে দাবি করেছেন। তবে অভিযুক্ত প্রকৌশলী শফিউল ইসলাম এ ব্যাপারে কথা বলতে রাজি হননি।

সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া অডিওতে প্রকৌশলীকে একটি প্রকল্পের কাজের টাকা (ঘুষ) চাইতে শোনা যায়। কাজের বরাদ্দ অনুসারে তিনি ৬ শতাংশ টাকা দাবি করছেন। কম দিতে চাইলে প্রকৌশলী বলেন, একটি টাকাও কম দেওয়া যাবে না। টাকা কম দিলে বিল পার করা যাবে না। ১০ মিনিট ১৬ সেকেন্ডের অডিওতে আরও অনেক কিছু নিয়ে কথা বলতে শোনা যায়। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে অডিওটি যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

ঘুষ চাওয়ার অডিওটি গতকাল রাতে ছড়িয়ে পড়লেও গত ১৫ জানুয়ারি ওই প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাসহ সরকারি কয়েকটি দপ্তরে অভিযোগ করেছেন ফিরোজ কবির নামের ওই ঠিকাদার। অভিযোগের সময় একটি পেনড্রাইভে তিনি ঘুষ চাওয়ার কথোপকথনের একটি অডিও জমা দেন। অভিযোগের পর এ নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়।

এ ঘটনায় গত ৫ ফেব্রুয়ারি সরেজমিন তদন্ত করেন গাইবান্ধার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আল মামুন। কিন্তু তদন্তের এক মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো প্রতিবেদন দেওয়া হয়নি। জানতে চাইলে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আল মামুন বলেন, তদন্ত চলমান। প্রতিবেদন দাখিল করার আগে কিছু বলা যাবে না।

অভিযোগে ঠিকাদার উল্লেখ করেন, আওয়ামী লীগের আশীর্বাদপুষ্ট প্রকৌশলী শফিউল ইসলাম প্রায় ১৩ বছর ধরে গাইবান্ধা পৌরসভায় কর্মরত। দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ম করলেও ভয়ে তাঁর বিরুদ্ধে কেউ ব্যবস্থা নিতে পারেনি। ওই প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে ঘুষ–বাণিজ্য ছাড়াও দুর্ব্যবহার, অনিয়ম-দুর্নীতির অনেক অভিযোগ আছে। প্রকল্পের বরাদ্দ টাকার শতকরা ৬ ভাগ ঘুষ দিয়ে ফাইল ছাড় করতে হয়। যোগদানের পর থেকে তিনি পৌরসভার নকশা অনুমোদনের দায়িত্ব পালন করেন। বাড়ি নির্মাণে নকশা অনুমোদনের জন্য তিনি চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ নেন। টাকা না দিলে নানাভাবে হয়রানি করেন সেবাগ্রহীতাদের। এভাবে তিনি অবৈধভাবে টাকা আয় করে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন।

জানতে চাইলে ঠিকাদার ফিরোজ কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই প্রকৌশলীর সঙ্গে কত তারিখে কথোপকথন হয়েছে সঠিক মনে করতে পারছি না। তবে গত বছরের জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ের দিকে হবে। ওই প্রকৌশলী বিল প্রদানে প্রায় এক বছর আমাকে হয়রানি করেন। পরে বাধ্য হয়ে মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিয়ে বিল নিই। অতিষ্ঠ হয়ে ঘুষ চাওয়ার কথোপকথন রেকর্ড করি। কিন্তু তখন প্রকাশ করতে পারিনি। কারণ ওই প্রকৌশলী সাবেক পৌর মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মতলুবর রহমানের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। তাঁর ছত্রচ্ছায়ায় তিনি এসব করেছেন। ৫ আগস্টের পর মেয়র ক্ষমতাচ্যুত হন। এখন দেশের পটপরিবর্তন হয়েছে। প্রতিবাদ না করলে প্রকৌশলী এ রকম অনিয়ম করেই যাবেন। তাই এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাকে অভিযোগ দিয়েছি। কথোপকথনটি ভাইরাল হয়েছে। আমি তদন্ত সাপেক্ষে এই ঘটনার দ্রুত বিচার চাই।’

ঘুষ দাবির অডিও ফাঁস ও অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে শফিউল ইসলাম মুঠোফোনে বলেন, ‘অভিযোগটি তদন্তাধীন। তাই এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রকল প র তদন ত

এছাড়াও পড়ুন:

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা পায় না সীমান্তের মানুষ

বহির্বিভাগের কক্ষে নেমপ্লেট লাগানো মেডিকেল অফিসারের (চিকিৎসা কর্মকর্তা)। ভেতরে রোগী দেখছিলেন উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় হৃদরোগ, গাইনিসহ অন্য জটিল রোগীরা প্রাথমিক সেবা নিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। জরুরি বিভাগেও দায়িত্ব পালন করছিলেন উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার। লেবার ওয়ার্ডের অপারেশন থিয়েটার বন্ধ। অন্তঃসত্ত্বা কোনো নারীও ভর্তি নেই। সাধারণ অস্ত্রোপচার কক্ষে ধুলা-ময়লার স্তর পড়েছে। সরেজমিন এমন চিত্র পাওয়া গেছে ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।
সীমান্তবর্তী এ উপজেলায় প্রায় ৪ লাখ মানুষের বসবাস। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রতিদিন গড়ে ৩৫০ জন সেবা নেন। গাইনি সমস্যা নিয়ে আসেন অন্তত ২০ জন। ৫০ শয্যার বিপরীতে ৬০ জনের বেশি রোগী ভর্তি থাকেন। কিন্তু চিকিৎসক সংকটে প্রয়োজনীয় সেবা পাচ্ছেন না মানুষ। অস্ত্রোপচার বন্ধ ১৮ বছর ধরে। অ্যানেসথেসিয়ার চিকিৎসক না থাকায় ছয় মাস বন্ধ সিজার। হয় না এক্স-রে, আলট্রাসনোগ্রাফি। পাঁচ চিকিৎসা কর্মকর্তা বহির্বিভাগ ও অন্তঃবিভাগে চিকিৎসা দিচ্ছেন। সর্বশেষ কবে এখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন, তা জানা নেই কারও।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি ছিলেন উপজেলার হাবাশপুর গ্রামের হাবিবুর রহমান। তাঁর ভাষ্য, সীমান্তবর্তী হওয়ায় দুর্গম স্থান থেকেও এখানে রোগী আসেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা তারা পান না। এখানে যে ক’জন চিকিৎসা কর্মকর্তা ও সহকারী আছেন, তারা তাদের মতো চেষ্টা করেন। সীমান্তের মানুষের কষ্টের কথা চিন্তা করে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এখানে দেওয়া জরুরি।  
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে জানা গেছে, বর্তমানে কর্মরত কেউ কেন্দ্রটিতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখেননি। আগে কখনও ছিলেন কিনা, তাও বলতে পারেননি। ২০২২ সালের জুন থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত মাসে গড়ে ১৪ থেকে ১৮টি সিজার হতো। অ্যানেসথেসিয়ার চিকিৎসক চলে যাওয়া অক্টোবরের পর তাও বন্ধ হয়ে যায়। এ সময়ে সাধারণ কোনো অস্ত্রোপচার হয়নি। ২০২২ সালের আগে ১৮ বছর বন্ধ ছিল সব ধরনের অস্ত্রোপচার। ল্যাবে কিছু রোগ শনাক্তের পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ১০টি পদই শূন্য। প্রথম শ্রেণির ২০টি পদের মধ্যে কর্মরত আছেন পাঁচজন। চিকিৎসক সংকট থাকায় ১০ উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (স্যাকমো) দিয়ে রুটিন অনুসারে বহির্বিভাগ, জরুরি বিভাগ ও অন্তঃবিভাগে সেবা দেওয়া হয়। নার্স ও মিডওয়াইফ পদে জনবল সংকট নেই। স্বাস্থ্য পরিদর্শক, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, এমএলএসএসসহ অন্য পদগুলোয় লোকবল সংকট বেশি। ফলে কাঙ্ক্ষিত সেবা না পেয়ে রোগীকে ছুটতে হয় জেলা সদর, যশোর কিংবা ঢাকা ও খুলনার হাসপাতালে।
বহির্বিভাগে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায় উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার রাবেয়া খাতুনকে। তিনি বলেন, ‘রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা আমরা দিয়ে থাকি।’ এদিন চিকিৎসা নিতে আসা দারিয়াপুর গ্রামের মোহাম্মদ ইব্রাহীমের ভাষ্য, হৃদরোগের সমস্যা নিয়ে এলেও কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। চিকিৎসা কর্মকর্তাকেও পাননি। 
উপজেলার গেড়ামারা গ্রামের আফরোজা বেগম অন্তঃসত্ত্বা পুত্রবধূকে নিয়ে এসেছিলেন চিকিৎসকের কাছে। কিন্তু গাইনি চিকিৎসক না পেয়ে উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারের মাধ্যমে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে ফিরে যান। তিনি বলেন, এখানে যদি গাইনি চিকিৎসক থাকতেন, তাহলে ভালো হতো। 
সংকটের মধ্যেও সাধ্যমতো রোগীর সেবা দেওয়া হচ্ছে বলে জানান উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মাহমুদ বিন হেদায়েত। তিনি বলেন, চিকিৎসা কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পদায়নসহ অন্য সংকট সমাধানে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বারবারই বলা হচ্ছে। এতে শতভাগ সেবা দেওয়া যেত। বরাদ্দ অনুসারে সরকারি ওষুধ বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে।
জনবল সংকটের কারণে এ অবস্থা বলে জানান ঝিনাইদহের সিভিল সার্জন ডা. মো. কামরুজ্জামান। তিনি বলেন, অ্যানেসথেসিয়া, সার্জারি ও গাইনি বিশেষজ্ঞ নেই। ফলে সব অস্ত্রোপচার বন্ধ। পদোন্নতি পাওয়া অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রত্যন্ত এলাকায় আসতে চান না। অনেক চিকিৎসক আছেন, যাদের ডিগ্রি থাকলেও পদোন্নতি হয়নি। এসব কারণে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কবে নিয়োগ দেওয়া যাবে, সেটিও নিশ্চিত না। চিকিৎসক নিয়োগ বা প্রমোশন হলে বিশেষজ্ঞ সেবা চালু করা সম্ভব হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ