প্রতীকী ছবি

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

নারীকে ট্রমাগ্রস্ত করার দায় রাষ্ট্রপক্ষকেই নিতে হবে

সম্প্রতি নিয়োগ বাতিল হওয়া সুপারিশপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষকেরা রাস্তায় নেমেছিলেন। তাঁদের বড় অংশই নারী। পুলিশ শক্তি প্রয়োগ করছিল। সংঘাত-সংঘর্ষের ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের দারুণ সুযোগ নিতে চাওয়া একটি স্ক্রিনশট দেখলাম।

পতিত সরকারি দলের নিষিদ্ধ ছাত্রসংগঠনের সাবেক ছাত্রনেতা কর্মীদের নির্দেশ দেন, ‘অন্তত দুজন আন্দোলনরত নারীর লাশ ফেলে দাও।’ উদ্দেশ্য নারীর হত্যাকাণ্ডকে অসিলা বানিয়ে অরাজক-অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করা। নারী হত্যার সংবেদনশীলতা দেশের ভেতরে-বাইরে বিক্ষোভ বাড়াবে। পলাতক সন্ত্রাসীরা ফিরে এসে জনতার কাতারে মিশবে; নাশকতায় নামবে।

গণ-অভ্যুত্থানের সাফল্যের পরও নারীর নিরাপত্তা বাড়েনি, বরং কমেছে। আগস্ট থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সহিংসতার সংবাদও গা শিউরে ওঠায়। আগস্টে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রাস্তার পাশে মিলল দুই মাদ্রাসাছাত্রীর লাশ। ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যার শিকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ষাটোর্ধ্ব এক নারী ধর্ষণের শিকার হন ৭ সেপ্টেম্বর। অক্টোবরে রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকায় উদ্ধার হয় মৃতপ্রায় ১৩ বছর বয়সী এক নির্যাতিত গৃহকর্মী। নির্যাতকেরা নির্যাতন করে তার দাঁত পর্যন্ত উপড়ে ফেলেছে। নভেম্বরে মস্তকবিহীন এক তরুণীর লাশ মেলে সাভারের একটি জঙ্গলে। ২৪ ডিসেম্বর নড়াইলে চাঁদা দাবি করে না পাওয়ায় সংরক্ষিত এক নারী ইউপি সদস্যকে দলবদ্ধ ধর্ষণ শেষে মুখে বিষ ঢেলে দেওয়া হয়।

নতুন বছরে নিরাপত্তা বাড়বে, এমন আশায় বুক বেঁধেছিল নারীরা। কিন্তু প্রথম দুই মাসের সহিংসতার দীর্ঘ তালিকার ছিটেফোঁটা কয়েকটিই রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলতে যথেষ্ট। মুন্সিগঞ্জে ট্রলারে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণ গৃহবধূকে; অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে ধলেশ্বরী নদীর তীরে দলবদ্ধ ধর্ষণ করা হয় এক পোশাককর্মীকে। এক কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে শেরপুরের নকলায়। সপ্তম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের চেষ্টা হয়েছে ভৈরবের শ্রীনগর উচ্চবিদ্যালয়ে। ঝিনাইগাতীর পিকনিক স্পটে বেড়াতে গিয়ে মাদ্রাসাছাত্রী হয়েছে ধর্ষণের শিকার। শহীদ দিবসের জন্য ফুল সংগ্রহে নামা ১১ বছরের স্কুলছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয় কুড়িগ্রামে। 

২০২৪ সালে স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনের প্রাণভোমরা ছিল নারীদের অভাবনীয় অংশগ্রহণ। তখন তাঁরা বর্মের রূপ না নিলে অনেক বেশি মানুষ মারা পড়ত। পুরুষদের সমাবেশে কামান–ট্যাংক চালিয়ে দিতেও পতিত স্বৈরাচারী পিছপা হতো না। কিন্তু নারীর লাশের দৃশ্য বিশ্ব-গণমাধ্যমকে নাড়িয়ে দেওয়ার ভয়ে সরকার সেই ঝুঁকি নেয়নি। নারীদের সমাবেশে লাঠিসোঁটা, হকিস্টিক ও কাঁদানে গ্যাসের ব্যবহার থাকলেও গুলি চালাতে সরকারপক্ষ দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। মায়েরা সন্তানদের, বোনেরা ভাইবোনদের বর্মের মতো আগলে রেখে রাস্তায় নেমে নৈতিক সমর্থন ও সাহস জুগিয়েছে।দুই.

বাংলাদেশে সহিংসতার শিকার নারীরা কতটা ট্রমাগ্রস্ত, মানসিক অপঘাত কতটা ভয়াবহ, তা নিয়ে কোনো গবেষণা নেই। কিন্তু অন্যান্য গবেষণায় মেলা তথ্য আতঙ্কজনক। ৭০ শতাংশ নারী জীবনে অন্তত একবার শিকার হয়েছেন সহিংসতার। ৯৩ দশমিক ৬ শতাংশ সহিংসতার শিকার নারী ট্রমাগ্রস্ত জীবন কাটান, কিন্তু আইনি আশ্রয় নেন না। মাত্র ৭ দশমিক ৪ শতাংশ নারী আইনের দ্বারস্থ হন। ৬৪ শতাংশ নারী মা-বাবা-বন্ধু-স্বজন-নিকটজন কাউকে জানতেই দেন না কী দুর্বহ যন্ত্রণা তাঁরা বয়ে বেড়াচ্ছেন।

গত ১২ মাসে বাংলাদেশে ৪১ শতাংশ নারী নানা রকম সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ যৌন সহিংসতাজনিত। গত সপ্তাহে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত ভায়োলেন্স এগেইনস্ট উইমেন জরিপের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, গত দশকে নারীর বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতা ১ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৫ সালে যৌন সহিংসতার হার ছিল ২৭ দশমিক ২ শতাংশ, ২০২৪ সালে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ; শহরে ৩১ দশমিক ৩ শতাংশ ও গ্রামে ২৮ শতাংশ।

নারী উন্নয়নে বাংলাদেশে প্রকল্পের পর প্রকল্প, বিদেশি অর্থসাহায্য-সহায়তা, বিদ্বজ্জনের দৃশ্যমান জ্ঞানজাগতিক অগ্রগতির চেষ্টার পরও এমন অবস্থা কেন? অপঘাতজর্জর নারীদের কেন এখনো বাকহীন বধির থাকতে হয়? রাষ্ট্রপক্ষকে প্রশ্নটির উত্তর দিতে বাধ্য করা দরকার।

তিন.

২০২৪ সালে স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনের প্রাণভোমরা ছিল নারীদের অভাবনীয় অংশগ্রহণ। তখন তাঁরা বর্মের রূপ না নিলে অনেক বেশি মানুষ মারা পড়ত। পুরুষদের সমাবেশে কামান–ট্যাংক চালিয়ে দিতেও পতিত স্বৈরাচারী পিছপা হতো না। কিন্তু নারীর লাশের দৃশ্য বিশ্ব-গণমাধ্যমকে নাড়িয়ে দেওয়ার ভয়ে সরকার সেই ঝুঁকি নেয়নি। নারীদের সমাবেশে লাঠিসোঁটা, হকিস্টিক ও কাঁদানে গ্যাসের ব্যবহার থাকলেও গুলি চালাতে সরকারপক্ষ দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। মায়েরা সন্তানদের, বোনেরা ভাইবোনদের বর্মের মতো আগলে রেখে রাস্তায় নেমে নৈতিক সমর্থন ও সাহস জুগিয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানের সাফল্যের বীজ বোনা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলগুলোতে। ছাত্রলীগ নেত্রীদের হলছাড়া-কলেজছাড়া করার ঘটনাগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, বাংলাদেশের নারী শিক্ষার্থীরাও জীবন বাজি রাখা দুঃসাহসী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। 

গণ-অভ্যুত্থানে নারীদের ব্যাপক ভূমিকার কারণ দুটি। এক. একটি ট্রমামুক্ত ও বাক্‌শক্তি ফিরিয়ে দেওয়া সহিংসতামুক্ত নিরাপদ স্বদেশের প্রত্যাশা। আইন ও সালিশ কেন্দ্র, মহিলা পরিষদ, অ্যাকশনএইডসহ অপরাপর মানবাধিকার সংগঠনসমূহের প্রতিবেদনগুলোতেই প্রমাণ মেলে, ১৬ বছরে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বছর বছর শুধু বেড়েছেই, কখনো কমেনি। কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি তাঁদের সহিংসতার বলি বানাচ্ছিল। প্রতিরোধ ছাড়া উপায় কী!

দ্বিতীয় কারণ, সমাজ পরিবর্তনের অপ্রতিরোধ্য ধারায় স্বনির্ভর শহুরে মধ্যবিত্ত বিশ্বনাগরিক নারীর উত্থান। নারী শিক্ষাদীক্ষা ও কর্মে পুরুষের সমকক্ষ হয়ে উঠছে। ক্ষেত্রবিশেষে পুরুষদের ছাড়িয়েও যাচ্ছে। রক্ষণশীল সমাজবলয়ে আটকে থাকার বাস্তবতা আর নেই। বিশ্বায়নলব্ধ চালচলন, ভাবভাবনায় তারা স্থানীয়তা-আঞ্চলিকতা ছাড়িয়ে ‘গ্লোবাল ভিলেজ’-এর বাসিন্দা। ‘ইনফরমেশন সুপার হাইওয়ে’তে তাদেরও সমান পায়ে সমতালে হাঁটা। সাত চড়েও রা না করা অবদমিত নারীমূর্তির দিন শেষ। আঘাতের মুখে প্রত্যাঘাত করতে পারার দিন শুরু। এটিই সমাজ পরিবর্তন—সময়ের দাবি—নদীর প্রবাহের মতো। নদীর প্রবাহকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা যায়? কারা বাঁধতে চায়? পুরুষতান্ত্রিক বোধ-বিশ্বাসে কট্টর ও প্রতিক্রিয়াশীল অংশটি চায়। সহিংসতা তাদের কৌশল। উদ্দেশ্য নারীকে ভীতসন্ত্রস্ত রাখা। লক্ষ্য নারীর অবদমন ও নিয়ন্ত্রণ।

চার.

বৈষম্য সহিংসতার জননী। বাংলাদেশ জাতিসংঘের সিডও সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ। ‘নারীর বিরদ্ধে সকল রকমের বৈষম্য বিলোপে’ আন্তর্জাতিকভাবেই অঙ্গীকারবদ্ধ। ধর্মীয় মূল্যবোধ, দেশীয় ভাবধারা, নৈতিকতা ইত্যাদি কোনো অজুহাতেই বৈষম্যকারীকে দায়মুক্তি দেওয়া আন্তর্জাতিক আইনেরই লঙ্ঘন। কারণ, ‘লিগ্যাল বাইন্ডিং’।

সহিংসতাগুলো বহুমাত্রিক অপরাধ। প্রথম মাত্রায় আন্তর্জাতিক ও দেশীয় আইন ভাঙার অপরাধ, দ্বিতীয়টি মাত্রায় ফৌজদারি অপরাধ। সংবিধান লঙ্ঘন বিচারে তৃতীয় মাত্রার অপরাধও বটে! ২৮ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্র অঙ্গীকারবদ্ধ, সব নাগরিকের সমান অধিকারের সুরক্ষা দেবে। তদুপরি নারী-শিশুসহ বৈষম্যের শিকার সব বর্গের প্রতি ন্যায়বিচার ও ন্যায্যতার প্রয়োজনে চাইলে ঐচ্ছিক ইতিবাচক কর্মপন্থামূলক (অ্যাফারমেটিভ অ্যাকশন) ব্যত্যয়ও ঘটাবে। ধারা ২৮(৪) সে রকমই বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছে রাষ্ট্রকে। উল্লেখ রয়েছে, ‘নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।’

সম্প্রতি মোহাম্মদপুর ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধূমপান ও শাহবাগে ওড়না–কাণ্ডে কয়েকটি ঘটনায় পুরুষালি দৃষ্টিভঙ্গিতে কয়েকজন নারীকে ট্রমাগ্রস্ত করা হয়েছে। তাঁরা আমৃত্যু ট্রমাটি বয়ে বেড়াবেন। রাষ্ট্রপক্ষের অবশ্যকর্তব্য জড়িত ব্যক্তিদের বহুমাত্রিক ফৌজদারি অপরাধে গ্রেপ্তার করা।

আইন নিজ হাতে তুলে নেওয়া, মোরাল পুলিশিং, মব ভায়োলেন্স, অর্গানাইজড ক্রাইম, পাবলিক নুইসেন্স, বৈষম্য করা, অন্যের অধিকার হরণ, নৈরাজ্য ও জনমনে ভীতির সঞ্চার...কোনো অপরাধই অপরাধীরা বাকি রাখেনি। মোহাম্মদপুরের ঘটনায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্য কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। তাঁর দায় ও দায়িত্ব ছিল, যে পক্ষই আইনভঙ্গ করেছে, তাকে আইন বা জরিমানার আওতায় আনা। সব নাগরিকের জন্য বৈষম্যমুক্ত সমতায় পাবলিক প্লেস আইনটি প্রয়োগের উদ্যোগ নেওয়া। সহিংসতার রাশ টানা না গেলে নারীকে ট্রমাগ্রস্ত করার দায় রাষ্ট্রপক্ষকেই নিতে হবে।

হেলাল মহিউদ্দীন অধ্যাপক, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বান্দরবানে পাঁচ বছর আগের ধর্ষণের মামলায় চারজনের যাবজ্জীবন
  • ভুক্তভোগীর চিৎকারে ছুটে যান লোকজন, পড়ে থাকা বাড়িটি ‘কিশোর গ্যাংয়ের আড্ডাস্থল’
  • কেরানীগঞ্জে নারীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ, গ্রেপ্তার ২
  • ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে অন্তঃসত্ত্বা নারীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ, গ্রেপ্তার ২
  • স্বামীর জামিনের ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিয়ে ডেকে এনে অন্তঃসত্ত্বাকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ
  • বন্ধুকে জিম্মি করে কলেজছাত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ
  • নারীকে ট্রমাগ্রস্ত করার দায় রাষ্ট্রপক্ষকেই নিতে হবে