সৌদিয়া হোটেলে অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের একজন সেচ্ছাসেবক লীগ নেতা
Published: 7th, March 2025 GMT
রাজধানীর শাহজাদপুরে গত সোমবার সৌদিয়া হোটেলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় চারজনের মৃত্যু হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলা সেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক এমদাদ সাগর (৩২)।
গতকাল বৃহস্পতিবার (৬ মার্চ) বিকেল ৩টার দিকে তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিজয়নগর থানার ওসি মো. রওশন আলী।
আরো পড়ুন: রাজধানীতে আবাসিক হোটেলে অগ্নিকাণ্ড, ৪ জনের মরদেহ উদ্ধার
আরো পড়ুন:
কিশোরগঞ্জে জমি নিয়ে বিরোধে মৃত্যু, আটক ৫
বরিশালে মৎস্য বিভাগের স্পিডবোটের সঙ্গে নৌকার সংঘর্ষ, জেলের মৃত্যু
মারা যাওয়া এমদাদ সাগর বিজয়নগর উপজেলার ইছাপুরা ইউনিয়নের মৃত জারু মিয়ার ছেলে। তিনি বিজয়নগর উপজেলার নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও সেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন।
ওসি রওশন আলী জানান, গুলশান থানার পুলিশ কল দিয়ে পাসপোর্টের ছবি পাঠিয়েছে। পরে পাসপোর্টে দেওয়া ঠিকানায় পুলিশ পাঠিয়ে নিহতের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। কীভাবে তার মৃত্যু হয়েছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা নেই বলেও জানান ওসি।
নিহতের মামাতো ভাই লিটন মুন্সি জানান, এক মাস আগে সাগর মালয়েশিয়ায় যান। সেখান থেকে শ্রীলংকায় গিয়ে গত ২ তারিখ দেশে এসে সৌদিয়া হোটেলে ওঠেন তিনি। হোটেলে আগুন লাগলে আহত অবস্থায় সাগরকে ঢাকা মেডিকেল নিয়ে যাওয়া হয়। গুলশান থানার পুলিশ বৃহস্পতিবার সাগরের মৃত্যু হয়েছে বলে জানায়।
তিনি আরো জানান, বাড়ির কেউ জানতো না সাগর হাসপাতালে ভর্তি। পুলিশ জানানোর পর সবাই জানতে পেরেছেন মৃত্যুর বিষয়টি।
সোমবার (৩ মার্চ) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সৌদিয়া হোটেলে আগুনের সূত্রপাত হয়। হোটেল ভবনটি ছয় তলা। দ্বিতীয় তলায় আগুন লাগে। আগুন নিয়ন্ত্রণের পর ফায়ার সার্ভিসের তল্লাশি দল হোটেলের ভেতরে চারজনের মরদেহ পায়। সবকটি মরদেহ পাওয়া যায় ষষ্ঠ তলায়।
ঢাকা/মাইনুদ্দীন/মাসুদ
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর আগ ন ব জয়নগর
এছাড়াও পড়ুন:
নারীর লড়াই, নিরাপত্তা, নেতৃত্ব ও সমাজের বাধা
শিরীন হক
প্রধান, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন
আমরা নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন থেকে চেষ্টা করছি শুধু আইনি বৈষম্য নয়, নারীর প্রতি যত প্রকারের বৈষম্য আছে, তা নিরসনে সুপারিশ রাখা। সুপারিশ রাখার ক্ষেত্রে আমরা তিনটি মেয়াদে ভাগ করেছি। প্রথমটি হচ্ছে, এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কী করতে পারে, এই স্বল্প মেয়াদে যেটা করা সম্ভব। তার পরের সরকারের কাছে কোনগুলো আমরা আশা করব, তা থাকছে দ্বিতীয় মেয়াদে। আর সর্বশেষ হচ্ছে আমাদের স্বপ্নগুলো জনপরিসরে নিয়ে আসতে চাই।
কোনটা আদতে সম্ভব হবে, আর কোনটা হবে না, তা আমরা বলতে পারছি না। কারণ, বাস্তবায়ন আমাদের হাতে নেই, আমাদের হাতে শুধু সুপারিশ। বাস্তবায়ন হোক বা না হোক এ বিষয়ে আমরা কার্যকর সুপারিশ রাখতে চাই। মানুষ শুনুক নারীরা কী চায়, নারীদের কী প্রাপ্য ও নারীদের কী হিস্যা। এটা সামনে আনাটাই আমার কাছে মনে হয় কমিশনের সবচেয়ে বড় অর্জন হবে।
আমরা বলতে চাই, বৈষম্য নিরসন ও সমতার লক্ষ্যে পদক্ষেপ চিহ্নিত করা খুবই জরুরি। পদক্ষেপগুলো যদি চিহ্নিত করতে পারি, তাহলে আমরা সে পথে এগুতে পারব। আমরা সবার কাছে সুপারিশমালা লিখিত আকারে চাই, যেন তা আমাদের সুপারিশে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি।
সম্প্রতি দেশের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে সব জনগণ বিশেষ করে নারীরা শঙ্কিত। এর সঠিক কোনো জবাব আমার কাছে নেই৷ যে সব ঘটনা ঘটছে এবং যা শুনছি, খবরের কাগজে পড়ছি তাতে আমি নিজেও কিছুটা আতঙ্কিত বোধ করছি। ধর্ষণের সব পরিসংখ্যান খবরের কাগজে আসে না। আমরা নারীকে কোন চোখে দেখছি, তার মর্যাদা দিচ্ছি কি না, সে বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। নারীপক্ষের একটা স্লোগান ছিল, ‘নারীকে মানুষ হিসেবে চিনুন, জানুন ও শ্রদ্ধা করুন’। এটুকু আমরা এখন পর্যন্ত ৫৩ বছরের করতে পারিনি। এটা আমাদের সামগ্রিক ব্যর্থতা বলা যায়। আমাদের নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। আমি মনে করি গণমাধ্যমের একটা বড় ভূমিকা আছে।
রাশেদা কে চৌধূরী
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও নির্বাহী পরিচালক, গণসাক্ষরতা অভিযান
আমরা তাকিয়ে আছি নতুন প্রজন্মের দিকে। এরা আমাদেরকে নতুন বাংলাদেশের পথ দেখাবে। যে বাংলাদেশ হবে সম–অধিকার, সমতা ও সমদর্শিতার। তারাই পরিবর্তনের ধারা সূচিত করবে। জুলাই আন্দোলনের মাধ্যমে তারা তা করেছেও। সে জন্য আমরা তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। একটা প্রশ্ন সবাই করছে, জুলাই–কন্যারা কি আসলেই হারিয়ে যাচ্ছে? আমি মনে করি, তারা হারিয়ে যাচ্ছে না। বরং তারা লড়াইটা অব্যাহত রাখছে। সেখানে রাষ্ট্রযন্ত্র তাদেরকে কতটা সাহায্য করছে, সে প্রশ্ন উঠতে পারে। সেখানে আমাদের কাজ করতে হবে।
আমরা একটা বিষয় বুঝতেই চাই না, সমতা থাকলেই সম–অধিকার হয় না। সমতার সঙ্গে ন্যায্যতাও থাকতে হবে। আমাদের লড়াইটা পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে, পুরুষের বিরুদ্ধে নয়। এ লড়াইয়ে পুরুষকেও আমরা পাশে চাই। সে জায়গায় আমাদের কাজ করার সুযোগ আছে।
আরেকটি বিষয় গণ–অভ্যুত্থানের পরে উঠে এসেছে। এটি হচ্ছে নারীর মানসিক স্বাস্থ্য। বিশেষ করে জুলাই আন্দোলনের পরে এই জায়গাটায় আমরা দৃষ্টি দিচ্ছি না। যাঁরা আহত হয়েছেন, তাঁরা যে কী ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের কথাগুলো শোনা প্রয়োজন। আমাদের ট্রমা কাউন্সেলিংয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। এই জায়গায় আমি মনে করি আমাদের জুলাই–কন্যারা আরও বেশি এগিয়ে আসবে। কারণ, তাদের কথাগুলো তাদের নিজেদেরই বলতে হবে। তারা হয়তো অনেক সময় আমাদেরও দৃষ্টির আড়ালে থাকে। ট্রমা কাউন্সেলিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উদ্যোগ নিচ্ছে বলে শুনেছি। এভাবে আমরা রাষ্ট্রকে তার দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ করে দিচ্ছি কি? এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করাটা খুব জরুরি। আমাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ অবস্থান থেকে এ বিষয়ে কাজ করতে হবে।
আমাদের অনেক আইনকানুন আছে। বাস্তবায়ন এবং ঠিকঠাক মনিটরিং নেই। প্রায়শই আমার মনে হয়, আমাদের রাডারে অনেককেই আমরা ধরতে পারি না। যেমন প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারী, গৃহকর্মী নারী। এঁদের কথাও তুল ধরতে হবে।
১৯৬৯–এর গণ–আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ছাত্র ইউনিয়ন করতাম। তখন আমরা স্লোগান দিতাম, ‘সংগ্রাম চলবেই’। সেই সংগ্রাম এতটাই দীর্ঘজীবী হয়েছে যে তাকে কোনোভাবেই আর বাগে আনা যাচ্ছে না। লড়াই চলবেই৷ বিশেষ করে এখন আমাদের জুলাই–কন্যারা যে পথ দেখিয়েছে, তাতে এটা আশা করাই যায়।
ফওজিয়া মোসলেম
সভাপ্রধান, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
বর্তমানের সময়টা জাতীয়ভাবে আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। সত্তরের নারীর সঙ্গে ২০২৫ সালের নারীর অনেক তফাত আছে। তাদের অনেক অর্জন আছে, আছে অনেক চ্যালেঞ্জ। আমরা যতটুকু অধিকার আদায় করেছি, তা ভোগ করতে গিয়েও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।
আমি পর্বতারোহী মেয়েদের জিজ্ঞেস করেছি তারা পাহাড়ে কেন গেছে। একজন জবাব দিয়েছে, পাহাড়ে যাওয়াটা তাদের কাছে একটা দর্শন।
আমিও মনে করি নারী আন্দোলন একটা দর্শন। সে দর্শনটা হচ্ছে সমতার দর্শন। পুরুষতান্ত্রিকতার যে বিভাজনের দর্শন আছে, তার বিপরীতে নারীর দর্শন হচ্ছে সমতা, মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার দর্শন।
মূলধারার রাজনীতিতে নারী এজেন্ডা যুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো নারীকে কীভাবে দেখছে, তা পরিষ্কার করতে হবে। ন্যায্যতা থাকতে হবে, কারণ ন্যায্যতা না থাকলে সাম্যতার প্রশ্ন আসবে না। এ জন্য আমাদের ন্যায্যতা নিয়ে ভাবতে হবে।
এ জন্য আমাদের তিনটি কাজ করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। বাংলাদেশ সিডও সনদের যে ধারাগুলো সংরক্ষণ করে রেখেছে, তা প্রত্যাহার করা হবে আমাদের প্রথম কাজ। দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণের জন্য সংসদে নারীর সরাসরি ভোটের ব্যবস্থা করতে হবে। সংরক্ষিত আসন রেখেই তাতে সরাসরি ভোটের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তৃতীয়ত, পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোকে ক্ষমতার যে অংশীদারত্ব আছে, সেখানে পরিবর্তনে সম্পত্তিতে নারীর সম–অধিকার থাকতে হবে। সব সময় ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীকে আর পেছনে রাখা চলবে না।
নারীর নিরাপত্তা সমস্যা সমাধানে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে হাইকোর্ট যে নির্দেশনা দিয়েছেন, তার ভিত্তিতে দ্রুত আইন প্রণয়ন করতে হবে। এ কয়েকটি কাজ করতে পারলে আমরা নারীকে নিয়ে সহজভাবে সামনে দিকে অগ্রসর হতে পারব।
সামিনা লুৎফা
সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
একাত্তরে বাংলাদেশের জন্মেরও বহু আগে থেকে ভাষা আন্দোলনসহ আমাদের গুরুত্বপূর্ণ যে বড় বড় আন্দোলন হয়েছে, প্রায় প্রতিটি আন্দোলনে বাংলাদেশের নারীরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, এখনো রাখছে।
জুলাই আন্দোলনের পর আমরা যখন এসব নিয়ে আলাপ করছি, তখন আমাদের আলাপ-আলোচনা অনেক সামনের দিকে থাকার কথা ছিল। আমাদের চিন্তার জায়গাগুলো থাকার কথা ছিল, কী করে আমরা জুলাইয়ের যে একটা প্রাগ্রসর আকাঙ্ক্ষা ছিল, তাকে ছড়িয়ে দেব কীভাবে। সেখানে দেখেছি আমরা অনেক জায়গায় পেছনে চলে গেছি। আগের অর্জন আমাদের হাত থেকে ছুটে যাচ্ছে বা ছুটে যাওয়ার অবস্থায় চলে যাচ্ছে। একই পরিস্থিতি কি ঘুরেফিরে ফেরত আসছে? এই প্রজন্ম আমাদের জুলাই আন্দোলনের ওই কয় দিন যে বাংলাদেশের চেহারা আমাদের দেখাচ্ছিল, সে বাংলাদেশ কিন্তু খুবই প্রগতিশীল। তারা নারীর প্রতি অসহনশীল বাংলাদেশ মেনে নেবে না। তারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি অসহনশীল বাংলাদেশ মেনে নেবে না। তারা সব ধরনের পরিচয়ের মানুষের সহাবস্থানমূলক বাংলাদেশ দেখতে চায়।
কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার সময় একজন অভিনয়শিল্পী, একজন সংগীতশিল্পী, একজন নৃত্যশিল্পী, একজন খেলোয়াড়—এরা যেন তার কাজটা ঠিকমতো করতে পারে। কারণ, যখন একজন খেলোয়াড়কে বাধা দেওয়া হয়, মনে হতে পারে এটা তো একটা বা দুইটা ঘটনা। কিন্তু এ ঘটনাগুলোর জন্য অনেকগুলো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। এটা একটা আন্তর্জাতিক সংবাদ। এটি বাংলাদেশের ইমেজের সঙ্গে সম্পর্কিত। নারীর প্রতি সহিংস হওয়া বা তাকে অধিকার না দেওয়ার বিষয়গুলো কোনোভাবেই ইতিবাচক ব্র্যান্ডিংয়ে কাজে লাগবে না।
বছর শেষে নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। সামনের নির্বাচনে মাথায় রাখতে হবে ৪০ বছরের কম বয়সী জনসংখ্যা বেশি। এদের একটা বড় অংশ সেসব ছেলেমেয়ে, যারা একটা প্রাগ্রসর বাংলাদেশ দেখতে চায়। রাজনীতি অনেক কিছুকেই নির্ধারণ করে। এখন যদি এই বার্তা দেওয়া হয় যে রাজনৈতিক শক্তিগুলো নারীকে পেছনে টেনে রাখতে চাইছে, তাহলে আমরা নারীরা কি পেছনে চলে যাব? সুতরাং রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে নারীর পক্ষে বা বিপক্ষে তার অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে।
এটা মাথায় রাখতে হবে বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৫১ শতাংশ নারী। সুতরাং আমাদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে আমাদের থামিয়ে রাখার চেষ্টা করে কেউ যেন রাজনীতি করতে না পারে, সেটাও দেখার সময় এসেছে। আগামী নির্বাচনে আসার আগে তারা তাদের ইশতেহারে নারীর বিষয়ে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে; যাতে আমরা বুঝতে পারি, সে আমার রাজনীতি করে কি না। সে আমার রাজনীতি না করলে আমি তাকে ভোট দেব না।
গীতা দাস
সভানেত্রী, নারীপক্ষ
নারী নেতৃত্বের কথা আমরা সব সময় বলে আসছি। নারীর লড়াইয়ে নারী নেতৃত্বের প্রয়োজন, নারীবাদী নেতৃত্বের প্রয়োজন। এখানে পুরুষও হতে পারে, কারণ অনেক পুরুষও নারীবাদী হন। এমনও দেখেছি রাজনীতিতে এমন অনেক নারী এসেছেন, যাঁরা পুরুষতান্ত্রিক চেতনাকে লালন করেন। সুতরাং শারীরিকভাবে নারী হলেই হবে না, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীবাদী চেতনায় বিশ্বাস করে অগ্রসর হতে হবে। বিষয়টি আমরা এখনো করতে পারিনি।
জাতীয় সংসদে নারী আসনের বিষয়ে আমরা কেউ চাইছি ৫০ শতাংশ, কেউ চাইছি এক-তৃতীয়াংশ। কিন্তু বিষয়টি এভাবে হবে না। প্রথমত, রাজনৈতিক দলের মধ্যে নেতৃত্বে বিভিন্ন স্তরে স্তরে নারীকে না নিয়ে এলে রাতারাতি আমরা নির্বাচনের জন্য নারী প্রার্থী পাব না। এখানেই রাষ্ট্রের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। রাজনৈতিক দলের মধ্যে নারীর অবস্থানকে শক্ত করতে সরকারকে চাপ সৃষ্টি করতে হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নারীরা সামনে থেকে অংশগ্রহণ করেছে। এখন কেন জানি মনে হচ্ছে দৃশ্যপট থেকে নারী অনুপস্থিত হয়ে যাচ্ছে। নারী কমিশন ব্যতীত অন্য সংস্কার কমিশনগুলোয় নারীর সংখ্যা একেবারেই কম।
নিরাপত্তা কেবল নারী হিসেবে নয়, নাগরিক হিসেবে প্রয়োজন। নিরাপদ পরিবেশ আমি তখনই বলব, যখন ‘একজন তরুণী নারী অলংকার পরে নির্জন পথে মধ্যরাতে একাকী নির্ভয়ে চলাচল’ করতে পারবে। আমরা সব নাগরিকের জন্য এ রকম সমাজ, এ রকম পরিবেশ চাই। রাতের বেলায় পুলিশ দিয়ে নিরাপত্তা দিতে হবে—এমন সমাজ আমরা চাই না। সাংস্কৃতিক পরিবেশ ও চিন্তাচেতনার পরিবর্তন করতে হবে। নারীকে সম্মান করার মনোভাব তৈরিতে আমাদের কাজ করতে হবে।
‘রাষ্ট্র এবং পরিবারে, সমান হব অধিকারে’ স্লোগানের মূলমন্ত্রে আমরা লড়াই করছি, আমরা লড়াই করেই যাব।
সারা হোসেন
আইনজীবী ও অনারারি নির্বাহী পরিচালক, ব্লাস্ট
আইনগতভাবে এখনো অনেক ক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্য রয়ে গেছে—এ নিয়ে কথা বলার এখন অবশ্যই একটা সুযোগ এসেছে। আমাদের সম্পত্তির অধিকারের ক্ষেত্রে, অভিভাবকত্বের অধিকারের ক্ষেত্রে, পারিবারিক আইনের ক্ষেত্রে এখনো বৈষম্য বিরাজ করছে। এ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন। আর যেসব জায়গায় আইন রয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন নিয়ে কথা বলা জরুরি।
একজন মেয়ের ঘর থেকে বের হওয়া তার জন্য সবচেয়ে বড় লড়াই। নারীদের ঘর থেকে বের হতে না দেওয়ার একটা বড় কারণ হিসেবে দেখানো হয় নিরাপত্তার বিষয়টিকে। নিরাপত্তার ভয়ে অনেক অভিভাবক ১৮ বছরের নিচে অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে করাতে বাধ্য হন।
রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন কাঠামো বা কর্তৃপক্ষের মধ্যে নারীদের নেতৃত্ব নিশ্চিত করলেই হবে না, সমাজের বিভিন্ন স্তরেও এর প্রতিফলন জরুরি। এ মুহূর্তে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণের বিষয়টি বড় একটি সমস্যা। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনে নারীরাই আছেন। কিন্তু অন্য সংস্থা–কমিশনগুলোতে নারীর উপস্থিতির চিত্র হতাশাজনক। সম্প্রতি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভার চিত্রও আপনারা সবাই দেখেছেন। জুলাই আন্দোলনে রাস্তায় অর্ধেক নারী ছিল। সেই চিত্র আর এখন ঐকমত্য কমিশনে উপস্থিতির চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন।
নেতৃত্বের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে নারীর বিষয়ে দলগুলোর অবস্থান স্পষ্ট করা জরুরি। তবে তার চেয়েও জরুরি হচ্ছে, অনেক রাজনৈতিক দলে নারীর উপস্থিতি এখনো শূন্য। এটি সবার আগে দূর করতে হবে। আগে নারীর ন্যূনতম উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকের যে চিত্র নিয়ে আমরা সবাই বলেছি, এ বিষয়ে সরকার নিজেই উদ্যোগ নিতে পারে। তারা রাজনৈতিক দলগুলোকে বলতে পারে, এ ধরনের বৈঠকে একজন নারী প্রতিনিধি হলেও রাখতে হবে।
সামান্তা শারমীন
মুখপাত্র, জাতীয় নাগরিক কমিটি ও জে্যষ্ঠ যুগ্ম আহবায়ক, জাতীয় নাগরিক পার্টি
বাংলাদেশের আনাচকানাচে নারীদের কথা বলার জন্য এবং তাঁদের অভিজ্ঞতা শোনার জন্য নানা ধরনের আয়োজন দেখতে পাচ্ছি। এসব আয়োজন আমাদের নানা মাত্রায় নিতে হবে। আলোচনা-সমালোচনা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, এর সঙ্গে রাজনীতিও গুরুত্বপূর্ণ।
২৪–এর গণ–অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমাদের জাতিগত একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে। এখানে সবার মধ্যে একধরনের বোধের জন্ম হয়েছে যে আমাদের একতা প্রয়োজন। এটি এখনো অস্পষ্ট, দৃশ্যমান হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার আপাতত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মিলে একে দৃশ্যমান করার চেষ্টা করছে। প্রতিটি সেক্টরের মধ্যে সংযোগের মাধ্যমে একতা গড়া প্রয়োজন। নারীদের ক্ষেত্রে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পুরো বাংলাদেশের সবকিছু বদলে গেছে ১৪ জুলাই রাতের কারণে। আওয়ামী লীগের যেই ন্যারেটিভ দিয়ে জুজুর ভয় দেখিয়ে ১৫ বছর শোষণ করেছে, তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ছাত্রীরা এক রাতেই ভেঙে দিয়েছেন। অভ্যুত্থানের সম্ভাবনার শুরু সেদিনই। আওয়ামী লীগ সরকার তার পুরো ফ্যাসিস্ট আমলে পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও রাজনৈতিকভাবে হেনস্তা করেছে। আমরা নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা বলছি। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এখানে যে পরিবর্তন ঘটেছে, একে ধরতে আমাদের অভ্যুত্থানের চেতনাকে ধারণ করতে হবে।
মনোনয়নের মাধ্যমে যেসব নারী সংসদে আসছেন, তাঁরা নারী সমাজকে সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারেন না। বরং তাঁরা দলীয় স্বার্থকেই তুলে ধরেন। সংরক্ষিত ও মনোনীত নারী আসন আসলে নারী নেতৃত্ব তৈরির উল্টো পথ। সরাসরি মানুষের ভোটে জয়লাভ করে উঠে আসার মধ্যে দুর্দান্ত আত্মবিশ্বাস কাজ করে।
রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর আমরা যদি চাপ প্রয়োগ না করি, সামনের দিনগুলোয় এটাই হতে থাকবে। আমি চাই না কেবল নারীর অংশগ্রহণের দোহাই দিয়ে যোগ্যতা না থাকলেও কোনো নারীকে কোথাও স্থান দেওয়া হোক। এ জন্য আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে, নারীদের যোগ্য করে গড়ে তোলা।
ব্যক্তিগত উদ্যোগ থেকে শুরু করে যত রকমভাবে নারীদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন করা যায়, তা আমাদের দায়িত্ব নিয়ে করতে হবে। সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের অবশ্যই যোগ্যতার ভিত্তিতে নারী নেতৃত্ব নির্বাচন করতে হবে। তবে অতি জরুরি কথা এই যে রাজনৈতিক, রাষ্ট্রিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ওয়াদা না করা গেলে নারীকে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে আসীন করা অসম্ভব।
ইলিরা দেওয়ান
মানবাধিকারকর্মী ও সদস্য, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন
জুলাই আন্দোলনের বড় একটা স্লোগান ছিল, অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ। আন্দোলনে আদিবাসী নারীরা সামনের সারিতে ছিলেন। নারীর লড়াইয়ের ক্ষেত্রে তাঁর নিরাপত্তার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ৫ আগস্টের গণ–অভ্যুত্থানের পর আমরা দেখতে পাচ্ছি, নারীরা আবার আক্রমণের শিকার হচ্ছেন, বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। আদিবাসী মেয়েরা ঢাকায় চলাফেরা করার সময় তাঁদের বিভিন্ন রকম কটূক্তি শুনতে হচ্ছে।
আমি আশা করি, আন্দোলনের মতো রাজনীতির মাঠেও নারীদের সামনের সারিতে, নেতৃত্বের আসনে দেখতে পাব। পাশাপাশি অন্যান্য জাতিসত্তার নারী প্রতিনিধিত্বও যেন থাকে, তা–ও প্রত্যাশা করছি। বৈচিত্র্যকে স্বীকার করে নিয়েই বাংলাদেশ গড়তে হবে।
আমাদের পার্বত্য অঞ্চলে হেডম্যান প্রথা বংশানুক্রমিক এবং ছেলেদের জন্য নির্ধারিত। যাঁর শুধু মেয়েসন্তান আছে, তাঁর কী হবে? তাই এ প্রথার পরিবর্তন ঘটিয়ে ছেলে–মেয়ে সবার জন্য উন্মুক্ত করতে হবে।
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের হয়ে আমরা মাঠপর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে জেনেছি, সংরক্ষিত আসনের নারীদের মূল্যায়ন হয় না। কারণ, তাঁর সুনির্দিষ্ট কোনো নির্বাচনী এলাকা বা আসন থাকে না। তাই স্থানীয় সরকার পর্যায়ে নারীর জন্য ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে আসন সংরক্ষণ করে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। যেসব দেশে এটি করা হয়েছে, সেখানে নারীর রাজনৈতিক অগ্রযাত্রায় ভালো ফল পাওয়া গেছে। শুধু স্থানীয় সরকারই নয়, জাতীয় নির্বাচনেও ঘূর্ণায়মান পদ্ধতির প্রবর্তন করতে হবে, যেখানে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা থাকবে।
তাসলিমা আখতার,
সভাপ্রধান, বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি ও সদস্য, শ্রম বিষয়ক সংস্কার কমিশন
নারী একা থাকুক বা কারও সঙ্গে থাকুক; নাগরিক হিসেবে নারীর মর্যাদা, সব অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।
বর্তমান সময়ে এসে ২০২৫ সালে আমরা যে নারীকে দেখছি, আর আঠারো বা উনিশ শতকের নারীরা এক নয়। পরিস্থিতির অনেকটা বদল হয়েছে। এখন নারী অনেক বেশি দৃশ্যমান শ্রমজীবী হিসেবে, পোশাকশ্রমিক হিসেবে, সাংবাদিক হিসেবে, খেলোয়াড় হিসেবে, পর্বতারোহী হিসেবে। এ বিষয়গুলো আমার কাছে একটা ভীষণ শক্তির জায়গা বলে মনে হয়।
নারী দিবসের সূত্রপাত পোশাকশ্রমিকদের মাধ্যমেই হয়েছে। বাংলাদেশের নতুন শ্রমশক্তি হিসেবে নারীরা তাঁদের জানান দিয়েছেন। ঘরের ভেতর থেকে বাইরে এসে তাঁরা এখন অর্থনৈতিক বাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন। বর্তমান সময়ে শ্রমজীবী নারীর নেতৃত্বের বিষয়টি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নারীর পরিচয়ের রাজনীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
নারীর মাতৃত্বকালীন ছুটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে থাকলেও সব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তা মেনে চলে না। এ বিষয়টি নিয়ে আমাদের এখনো লড়াই করতে হচ্ছে।
গার্হস্থ্য শ্রম থেকে নারীকে মুক্ত করা, তার অবসর বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে। নীতিনির্ধারণী জায়গায় নারী নেতৃত্ব কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারছে, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ লড়াইটা নারীকে শুরু করতে হবে। আমি প্রত্যাশা করি, নতুন বাংলাদেশের নারী-পুরুষ একসঙ্গে সমাজে বৈষম্য ও নেতৃত্বের যে বাধাগুলো আছে, তা আমরা পেরিয়ে আসতে পারব। লড়াইটা নারী শুরু করবে, কিন্তু পুরুষের বিরুদ্ধে নয়, নারী-পুরুষ একসঙ্গে।
এলিটা করিম
কণ্ঠশিল্পী
আপনারা দেখেছেন সম্প্রতি শোরুম উদ্বোধনে গিয়ে আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনের নামকরা দুজন অভিনেত্রী বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। ‘মব’ এসে তাঁদের থামিয়ে দিয়েছে। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে তারা কারা? কেন এমন করল? আমরা চাই না, কোনো শিল্পী কাজ করতে গিয়ে হয়রানির শিকার হোক বা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হোক। দিন শেষে আমরা সবাই নিরাপদ থাকতে চাই, নিরাপদে কাজ করতে চাই।
আমরা যাঁরা সংস্কৃতি অঙ্গনের কর্মী, আমাদের বাসার বাইরে গিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে ঘুরেফিরে একটি বিষয় বারবার আসে, তা হচ্ছে নিরাপত্তা। বিশেষ করে আউটডোর শুটিং বা কনসার্টে নিরাপত্তা বড় একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যখন কোনো হাউসে শুটিং করতে যাই, সেখানে কোনো নিরাপত্তা থাকে না, যে কেউ প্রবেশ করতে পারে। এরই সুযোগ নিয়ে মব এ কাজ শুরু করেছে। একদল মানুষ প্রবেশ করে বলছে, আমরা এখানে শুটিং করতে দেব না। এই অবস্থা বন্ধ করতে ব্যবস্থা নিতে হবে।
নারী ও পুরুষ শিল্পীর মজুরির বৈষম্য অনেক বড় একটি বিষয়। একই রকম কাজ করেও নারী পুরুষের তুলনায় অনেক কম মজুরি পাচ্ছেন। ক্রীড়ায় নারীরা এত অর্জন দেখানোর পর মজুরিবৈষম্য কমানোর জন্য লড়াই করতে হয়েছে৷
আমাদের সাংস্কৃতিক, ক্রীড়াঙ্গনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যাগুলো কীভাবে সহজে সমাধান করা যায়, তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে কাজ করতে হবে। আমরা নতুন বাংলাদেশের কথা বলছি। সামনে নির্বাচন আছে। তাই সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আরও ভালো পরিবেশ কীভাবে তৈরি করা যায়, তা নিয়ে কথা বলার সবচেয়ে ভালো সময় এখনই।
শিরিন আক্তার
১৬ বারের দ্রুততম মানবী
খেলাধুলার ক্ষেত্রে একজন ছেলে যে পরিমাণ বাধার শিকার হয়, একজন মেয়ে তার চেয়ে অনেক বেশি বাধার সম্মুখীন হন। আমি সাতক্ষীরার ছোট একটি গ্রামে বড় হয়েছি। খেলাধুলা যে পেশা হতে পারে এবং এটা দিয়ে আমি অর্থ উপার্জন করে আমার পরিবারের খরচ চালাতে পারব, তা সে সময় ভাবিনি।
আমরা চার বোন। বাবা কৃষক, মা ঘরের কাজ করেন। ক্লাস নাইনে ওঠার আগেই আমার বড় বোনের বিয়ে হয়ে যায়। ছোটবেলা থেকেই আমি চিন্তা করতাম আমি কি মেয়ে হওয়ার কারণে বাড়ির গণ্ডি থেকে বের হতে পারব না?
প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত আমার খেলাধুলায় কোনো সমস্যা হচ্ছিল না। স্কুলড্রেস যেটি ছিল তা পরেই খেলাধুলা করতাম। সমস্যা শুরু হলো যখন আমি প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিকে ভর্তি হলাম তখন থেকে। বলা হলো আমাকে আর খেলাধুলা করতে দেওয়া হবে না। তবে আমি আমার রাস্তাটা ঠিক করে নিতে পেরেছিলাম। অনেক বাধা পেরিয়ে তাই আমি আমার গন্তব্যে ঠিকই পৌঁছাতে পেরেছি।
এখন আমার ভালো লাগে, যখন দেখি হাজারো মেয়ে খেলাধুলায় এগিয়ে আসছে। আমি মনে করি ছোট ছোট স্বপ্নগুলো সব মেয়ের মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় থাকে, যা সবাই প্রকাশ করতে পারে না। আমি হয়তো করতে পেরেছিলাম। আমি আমার পরিবার ও শিক্ষকদের হতাশ করিনি। খেলাধুলার পাশাপাশি আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছি।
আমি চাই মেয়েরা আরও বেশি করে সব ধরনের খেলাধুলায় এগিয়ে আসুক। আর বলব, খেলাধুলা করে যেন মেয়েরা ভালো উপার্জন করতে পারে, সেই দিকে সুধীজনদের দৃষ্টি দিতে বলব।
নাজিফা জান্নাত
শিক্ষার্থী, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় ও সমন্বয়ক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ২০২৪
জুলাইয়ে আমাদের সংগ্রাম ছিল, আমরা আগের চেয়ে অপেক্ষাকৃত ভালো একটি বন্দোবস্তের জন্য গণ–অভ্যুত্থানের দিকে গিয়েছি। আমরা ভেবেছিলাম, আমাদের নিরাপত্তার বিষয়টি আরও জোরদার হবে৷ কিন্তু এরপর আমরা নারীরা দেখছি, পরিস্থিতি কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও খারাপ হচ্ছে। ৪৮ ঘণ্টায় ১৭টি ধর্ষণের কথাও আমরা জেনেছি!
আমরা দেখেছি কিছু মানুষ গিয়ে নারীদের ফুটবল খেলা বন্ধ করে দিয়েছেন। বইমেলায় বই ও বইয়ের স্টল নিয়ে হট্টগোল হয়েছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, নারীর ওপর আগ্রাসন নানাভাবে আসছে। বিনোদন জগতের তারকারা শোরুম উদ্বোধন করতে গেলে বাধা প্রদান করা হয়েছে। কিছু মানুষ তাঁদের ব্যক্তিগত মতাদর্শ বা পছন্দ দিয়ে আইনের শাসনকে উপেক্ষা করেছেন। আমি কোন পোশাক পরব, কখন ঘরের বাইরে বের হব, নেতৃত্ব দেব কি দেব না, এসব বিষয় নিজস্ব মতাদর্শের ভেতরে এনে ঠিক করে দেওয়ার জন্য বল প্রয়োগ করা হচ্ছে। এসব জায়গায় রাষ্ট্রের জোরালো ভূমিকা থাকা জরুরি।
নারীর প্রতি আমাদের সার্বিক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে অবহেলার। বেশির ভাগ গণমাধ্যমে নারীকে এখনো দুর্বল করে উপস্থাপন করার প্রবণতা লক্ষণীয়। বাংলাদেশের রাজনীতিচর্চা পুরুষকেন্দ্রিক ও পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গিকেন্দ্রিক। রাজনীতি ব্যতিত সমাজের সব ক্ষেত্রেই নারীরা নিজেদের নেতৃত্বের জায়গায় প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পটপরিবর্তনের জন্য কেবল নারীদের ক্ষমতায়নের চিন্তাভাবনা দিয়ে হবে না, পুরুষ নেতাদেরও জেন্ডার বৈষম্যের দৃষ্টিভঙ্গি ভাঙতে হবে।
আমি দুটো লাইন নিয়ে ঘুরছি যা আমাকে খুবই অনুপ্রেরণা দিচ্ছে। লাইন দুটি হচ্ছে: ‘ধূ ধূ জ্বলে ওঠো ধূমায়িত অগ্নি, /জাগো মাতা, কন্যা, বধূ, জায়া, ভগ্নী!’
গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন: শিরীন হক, প্রধান, নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন। রাশেদা কে চৌধূরী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও নির্বাহী পরিচালক, গণসাক্ষরতা অভিযান। ফওজিয়া মোসলেম, সভাপ্রধান, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। গীতা দাস, সভানেত্রী, নারীপক্ষ। সারা হোসেন, আইনজীবী ও অনারারি নির্বাহী পরিচালক, ব্লাস্ট। সামিনা লুৎফা, সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ইলিরা দেওয়ান, মানবাধিকারকর্মী ও সদস্য, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন। সামান্তা শারমীন, মুখপাত্র, জাতীয় নাগরিক কমিটি ও জে্যষ্ঠ যুগ্ম আহবায়ক, জাতীয় নাগরিক পার্টি। তাসলিমা আখতার, সভাপ্রধান, বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি ও শ্রম বিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য। এলিটা করিম, কণ্ঠশিল্পী। শিরিন আক্তার, ১৬ বারের দ্রুততম মানবী। নাজিফা জান্নাত, শিক্ষার্থী, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় ও সমন্বয়ক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ২০২৪। সঞ্চালনা করেন সুমনা শারমীন, সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো।