টান পড়বে রোহিঙ্গাদের খাবারে, বিপর্যয়ের শঙ্কা
Published: 7th, March 2025 GMT
কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া লাখ লাখ রোহিঙ্গার খাবার জোগাতে সামনে আসছে কঠিন সময়। খাদ্য সংকটের তীব্র ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে তারা। জাতিসংঘের খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) এরই মধ্যে খাদ্য সহায়তার পরিমাণ অর্ধেক কাটছাঁট করার ঘোষণা দিয়েছে। মাথাপিছু রেশন ৬ ডলারে নামিয়েছে তারা, যা আগে ছিল ১২ দশমিক ৫ ডলার। খাদ্য সহায়তা ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনার চিঠি বুধবার পেয়েছে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়।
এ বাস্তবতায় রোহিঙ্গা পরিস্থিতি ভয়ানক সংকটে পড়ার শঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। স্বাস্থ্য ও পুষ্টিহীনতার পাশাপাশি ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলায়ও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। মাদক, অবৈধ অস্ত্র ও পাচারের ঘটনায় রোহিঙ্গাদের জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা আরও বাড়বে। পুরো পরিস্থিতিকে বেশ উদ্বেগজনক বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লাখ লাখ রোহিঙ্গা নিয়ে আগে থেকেই নানামুখী সংকটে বাংলাদেশ। অনেক দেনদরবারের পরও তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যাচ্ছে না। যৌথ সাড়াদান কর্মসূচির (জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান-জেআরপি) আওতায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে। ডব্লিউএফপির আওতায় বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়। তবে প্রতিবছরই প্রতিশ্রুত সহায়তার চেয়ে বরাদ্দ কম আসছে। এমন বাস্তবতায় নতুনভাবে রোহিঙ্গা প্রবেশ ও বাজেট কাটছাঁট বাংলাদেশের জন্য নতুন চাপ তৈরি হতে যাচ্ছে।
এ ব্যাপারে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান সমকালকে বলেন, রোহিঙ্গা নিয়ে আগে থেকেই সংকটে আছি। ডব্লিউএফপির বাজেট কাটছাঁটে ক্যাম্পে ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এপ্রিল থেকে দিনে জনপ্রতি একজন রোহিঙ্গা ২৪ টাকা পাবেন। দিনে ২৪ টাকায় একজন মানুষ কী আর খেতে পারবে। স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সংকটের পাশাপাশি পুরো এলাকায় আইনশৃঙ্খলার অবনতির শঙ্কা আছে। ডব্লিউএফপিওর যে বাজেট, তার প্রায় ৮০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্র দিয়ে থাকে। বাজেট নিয়ে দেশটি এখন যে নীতি নিয়েছে, এর প্রভাব রোহিঙ্গাদের ওপর পড়ছে। তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গারা যখন ক্ষুধার্ত থাকবে, তখন তাদের ক্যাম্পে আটকে রাখা কঠিন হবে। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে নতুন সংকট তৈরি হবে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.
সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা সমকালকে জানান, চার দিনের সফরে ১৩ মার্চ ঢাকায় আসছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। পরদিন উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তাঁর যাওয়ার কথা রয়েছে। তিনি সেখানে রোহিঙ্গাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনবেন। খাবারের বাজেট কাটছাঁটসহ বিভিন্ন সমস্যার কথা রোহিঙ্গারা তুলে ধরবেন। জাতিসংঘ মহাসচিব উখিয়ায় রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ইফতারেও অংশ নেবেন।
বাংলাদেশে বর্তমানে ১১ লাখের বেশি নিবন্ধিত রোহিঙ্গা আছেন। নিবন্ধন ছাড়াও আছেন অনেকে। এখনও নানা কৌশলে অনেকে বাংলাদেশে ঢুকছেন। মিয়ানমার থেকে আসা ও এ দেশে জন্মগ্রহণ মিলিয়ে বাংলাদেশে এখন ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আছে। সম্প্রতি এসেছে ৬০ হাজার রোহিঙ্গা। ৩৭ হাজার রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়। তাদের মধ্যে ৭ হাজার রোহিঙ্গার হদিস নেই। তারা ফের কক্সবাজারের ক্যাম্পে ফিরে এসেছে বলে জানান শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ের দুই কর্মকর্তা।
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে প্রায়ই ঘটছে খুনোখুনি। মাদক কারবার, চোরাচালান, অপহরণ ও চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধে জড়াচ্ছে নানা গ্রুপ। বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী দেশের জন্য বোঝা হয়ে উঠছে। কক্সবাজার থেকে তারা দেশের বিভিন্ন এলাকায়ও ছড়িয়ে পড়ছে; পরিচয় গোপন করে নিচ্ছে বাংলাদেশি পাসপোর্ট। দিন যত যাচ্ছে, ততই ভারী হচ্ছে রোহিঙ্গা বোঝা। এখন ‘গোদের ওপর বিষফোড়া’ হয়ে উঠছে বাজেট সংকট।
এ ছাড়া দীর্ঘদিন রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে মিয়ানমারের আরাকান স্যালভেশন আর্মিসহ (আরসা) ১১টি সশস্ত্র গ্রুপ সক্রিয়। অন্যদের মধ্যে রয়েছে আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও), ইসলামী মাহাজ, মাস্টার মুন্নার দল, চাকমা ডাকাত দল, নবী হোসেন ডাকাত দল, পুতিয়া ডাকাত দল, জাকির ডাকাত দল, সালমান শাহ ডাকাত দল, খালেক ডাকাত দল ও জাবু ডাকাত দল। রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও আশপাশে প্রায় ঘটছে অপহরণও। বাঙালিরা অপহরণের শিকার হচ্ছেন।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২৪ সালে রোহিঙ্গাদের জন্য ৯০০ মিলিয়ন চেয়ে পাওয়া গেছে ৬০০ মিলিয়ন। ২০২৩ সালে রোহিঙ্গাদের জন্য ৮৭ কোটি মার্কিন ডলার বা প্রায় ৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা চেয়ে মিলেছে এর ৫০ শতাংশ। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় জেআরপিতে ৪৩ কোটি ৪০ লাখ ডলারের প্রতিশ্রুতি থাকলেও পাওয়া যায় ৩১ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ২০১৮ সালে প্রতিশ্রুত ১০০ কোটি ডলারের বিপরীতে ৬৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার এবং ২০১৯ সালে ৯২ কোটি ডলারের বিপরীতে ৬৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার পাওয়া গিয়েছিল। ২০২০, ২০২১ ও ২০২২ সালে প্রতিশ্রুতির চেয়ে যথাক্রমে ৬০, ৭৩ ও ৬৩ শতাংশ সহায়তা পাওয়া গেছে।
একাধিক কর্মকর্তা জানান, মাসে জনপ্রতি ১২ দশমিক ৫০ মার্কিন ডলার হিসেবে খাদ্য সহায়তা দিয়ে আসছে ডব্লিউএফপিও। এ হিসাবে প্রতি মাসে খাবার খরচ বাবদ প্রায় ১৪৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়। এটা কমে এখন ৭০ থেকে ৭৫ কোটিতে দাঁড়াবে। ২০২৩ সালে তহবিল ঘাটতির কারণে রোহিঙ্গাদের মাথাপিছু খাদ্য সহায়তা ১২.৫০ মার্কিন ডলার থেকে ১০ ও এর পর ৮ মার্কিন ডলার করা হয়। পরে ফের সেটি ১২.৫০ মার্কিন ডলার করা হয়েছে।
জানা গেছে, জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান-জেআরপির বাইরে কয়েকটি দাতা সংস্থার সঙ্গে বাজেটের ব্যাপারে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। তবে এখনও কাঙ্খিত ফল মেলেনি। এক কর্মকর্তা বলেন, জেআরপির তুরস্কের কয়েকটি সংস্থা রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করছে। তারা একটি ফিল্ড হাসপাতাল ও সাতটি স্কুল চালাচ্ছে।
একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, খাদ্য সহায়তার পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের বাসস্থান, বিশুদ্ধ পানি, পয়ঃনিষ্কাশন, লিগ্যাল সাপোর্ট, প্রটেকশনসহ বেশ কিছু বিষয়ে জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানের বাজেট থেকে রোহিঙ্গাদের সরবরাহ করা হয়। তবে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা দিতে গিয়ে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) আড়াই হাজারের মতো ফোর্স রয়েছে। তাদের খরচ জোগাচ্ছে বাংলাদেশ। আবার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ে ৪২ জন কাজ করছেন। তাদের বেতন-ভাতাও দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার।
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি, ঘুমধুম, তুমব্রু, জামছড়ি, লেবুছড়ি, আলীকদম, পশ্চিমকুল সীমান্তে পাহাড়ি অঞ্চলসহ টেকনাফের হোয়াইক্যং ও হ্নীলা এলাকা দিয়ে রোহিঙ্গারা ঢুকছে। এসব সীমান্তে একাধিক দালাল সক্রিয়। তারা ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা নিয়ে অনুপ্রবেশকারীকে সহায়তা করছে। মিয়ানমারের দালালের পাশাপাশি একাধিক স্থানীয় দালালও রয়েছে। এ ছাড়া কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন এলাকা, চট্টগ্রামেও নামে-বেনামে রোহিঙ্গারা স্থানীয়দের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘাত ও যুদ্ধে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি মংডু শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। সেখানে অনেক রোহিঙ্গার বাস। জান্তা সরকার সেখানে আরাকান আর্মির কাছে পরাস্ত হওয়ার পর চাপে পড়ে রোহিঙ্গারা। অনেকের ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। জীবন বাঁচাতে মংডু ছেড়ে অনেক রোহিঙ্গা নানা কৌশলে বাংলাদেশে ঢুকছে।
২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। মিয়ানমারে যুদ্ধ চলার মধ্যে তাদের সে দেশে ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনা নিয়ে তেমন কাজ হচ্ছে না।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ক কর মকর ত ড ক ত দল শরণ র থ র জন য আর ক ন এক ধ ক জ আরপ
এছাড়াও পড়ুন:
একঝলক (১১ এপ্রিল ২০২৫)
ছবি: প্রথম আলো