গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ আত্মপ্রকাশ করা রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ (এনসিপি) নিজেদের মধ্যপন্থার দল হিসেবে দাবি করেছে। আমরা জানি, ফরাসি বিপ্লবের সময় থেকেই রাজনৈতিক বর্গের বামপন্থা, ডানপন্থা পরিচিতি শুরু হয়েছিল। ফরাসি আইনসভায় সাবেকি ব্যবস্থার সমর্থকরা সভাপতির ডান দিকে এবং বিপ্লবপন্থিরা বাম দিকে বসতেন। সেখান থেকে বামপন্থি ও ডানপন্থি ধারণা প্রথমে ইংল্যান্ডে, তারপর বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।
বর্তমানে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বামপন্থি, ডানপন্থি, মধ্যপন্থি, লিবারেল, কনজারভেটিভ, মধ্য-বামপন্থি, মধ্য-ডানপন্থি নানা পন্থার কথা শোনা যায়। সহজ কথায় বামপন্থিরা বিশ্বাস করেন, ব্যক্তিমালিকানা থাকার বদলে সামষ্টিক মালিকানা থাকলে সমাজে অসাম্য দূর হবে। ডানপন্থিরা মনে করেন, ব্যক্তি অধিকার শীর্ষে রাখা হলে এবং সরকার কম জড়িত হলে সর্বোত্তম ফল পাওয়া যায়। মধ্যপন্থিরা ব্যক্তিমালিকানা ও সামষ্টিক মালিকানার অর্থনীতিতে বিশ্বাস করেন। লিবারেলরা ধর্মীয়ভাবে উদার ও ধর্মীয়ভাবে উদারীকরণ সমাজ ব্যবস্থা গঠন করার পক্ষপাতী। কনজারভেটিভরা ধর্মকে যতটা সম্ভব কঠোরভাবে অনুশীলন এবং সমাজ ব্যবস্থাতেও অনুরূপ করার পক্ষপাতী।
কোনো দেশের রাজনীতি কেমন হবে তা নির্ভর করে সে দেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও রাজনৈতিক চেতনার ওপর। অর্থাৎ নাগরিকরা তাদের দেশকে কোথায় দেখতে চায়, নিজেদের অধিকারের প্রশ্নে কতটা নির্ভার থাকতে চায়– এর প্রতিফলন তারা রাজনৈতিক দলের মধ্যে দেখতে চায়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নাগরিকদের শাসনের অধিকার এমন কারও হাতে তারা ন্যস্ত করতে চায়, যার মধ্য দিয়ে শাসক এবং নাগরিকের মধ্যে একটি সহজ জবাবদিহি নিশ্চিত করা যায়। এই শাসক নির্বাচনের প্রধান পদ্ধতি হচ্ছে নির্বাচন। নির্বাচনে একাধিক রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সেটি চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়।
রাজনৈতিক মতাদর্শের এই ধ্রুপদি বিভাজন মনে রাখলে, সদ্য গঠিত এনসিপিতে ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শ থেকে আসা নেতাদের একই চরিত্র ধারণ করে মধ্যপন্থার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যেতে পারাই বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে। এই প্রশ্নও আছে, শেষ পর্যন্ত মধ্যপন্থার দল হিসেবে এনসিপি গন্তব্যে পৌঁছুতে পারবে কি?
এনসিপির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানের ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, ‘সকল ধরনের গণতান্ত্রিক ও মৌলিক অধিকারের শক্তিশালী সুরক্ষাই হবে আমাদের রাজনীতির মূলমন্ত্র। আমরা রাষ্ট্রে বিদ্যমান জাতিগত, সামাজিক, লিঙ্গীয়, ধর্মীয় আর সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও বৈচিত্র্য রক্ষার মাধ্যমে একটি বহুত্বপূর্ণ ও সমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মাণ করতে চাই।’ যদি দলটির উদ্দেশ্য থাকে মধ্যপন্থার কথা বলে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে জায়গা করে নেওয়া, সেটি ভিন্ন বিষয়। জনগণের মুখোমুখি হতে হলে অবশ্য অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। দলটিতে মধ্যপন্থার চর্চা কতটা থাকে, সেটি দলটির দর্শন, কর্মসূচি ও ইস্যুভিত্তিক বক্তব্য থেকে পরিষ্কার হবে ভবিষ্যতে। দলটিতে বিভিন্ন মতাদর্শের সংগঠন থেকে আসা লোকজন রয়েছে এবং মধ্যপন্থার নীতিতে যেতে হলে তাদের সবাইকে সেই একই আদর্শের চর্চা করতে হবে। সামনে বিভিন্ন ধরনের ইস্যু আসবে। তখন কারা ছিটকে যাবে, কারা টিকে থাকবেম সেটার ওপরেও নির্ভর করবে আসলে দলটির বৈশিষ্ট্য কেমন হবে।
ইতোমধ্যে যা দেখা গেছে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে বিভিন্ন ঘটনায় নতুন দলের নেতাদের কারও কারও যে ভূমিকা ছিল, সেটা মধ্যপন্থার নীতির সঙ্গে কতটা সংগতিপূর্ণ– সন্দেহ রয়েই যায়। সংখ্যাগত দিক থেকেও নতুন দলের মূল নেতৃত্বে নৃতাত্ত্বিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপস্থিতি নগণ্য। নতুন বিতর্ক এলজিবিটিকিউ নিয়েও দলের নেতাদের অবস্থান পরিষ্কার নয়।
জাতীয় নাগরিক পার্টির প্রথম কমিটি ঘোষণার পর কমিটির একজন নেতার লিঙ্গীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে দলটির ভেতর থেকেই। এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে নানা ধরনের বিতর্কের পর দলের দুই প্রভাবশালী নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ ও সারজিস আলম ফেসবুকে নিজেদের ভেরিফায়েড পেজে লিখে জানিয়েছেন– রাজনীতির আগে তাদের পরিচয় তারা মুসলমান।
সবচেয়ে বড় কথা, দলটির আত্মপ্রকাশ হলেও সেখানে দলীয় দর্শন ঘোষণা করা হয়নি। ফলে মধ্যপন্থার কথা বললেও শেষ পর্যন্ত দলীয় আদর্শ কী হয়– তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। দলীয় দর্শন ও আদর্শ জানিয়েই মাঠে নামতে হয়। কিন্তু এই দলের আদর্শিক অবস্থান কোথায় এবং তারা দল ও দেশকে কোথায় নিতে চায়, তা তারা পরিষ্কার করতে পারেনি। মতাদর্শ পরিষ্কার না হলে এবং লিখিত দর্শন ও কর্মসূচি না আসা পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন বক্তব্য আসতে থাকবে। লক্ষণীয় বিষয়, গত ছয় মাসে বিভিন্ন ঘটনায় তাদের ভূমিকা মানুষ দেখেছে। সেখান থেকে তাদের রাজনীতি কোন দিকে যাবে, মানুষ কিছুটা ধারণা করতে পেরেছে। দলটির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখা যায়নি সম্ভবত সে কারণেই। রাজনীতির মাঠ যে ভিন্ন বিষয়, সেটা দেখা গেল। অভ্যুত্থানের জনজোয়ারের রেশ দলের অনুষ্ঠানে দেখা যায়নি।
অতীত থেকে বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঐক্যের ইতিহাসের দিকে নজর দিলে সেটিকে দুর্লভ মনে হতে পারে। স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনৈতিক ঐক্যের অভাবে বিভিন্ন সময়ে সংকটে আবর্তিত হয়েছে। আমরা একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পরও ঐক্যের অভাব দেখতে পেয়েছি।
বাংলাদেশের ৫৪ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে মাত্র একবারই বৃহৎ রাজনৈতিক ঐক্য চেষ্টার নজির স্মরণ করতে পারি; ১৯৯০ সালের এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময়। সেই সময়ে প্রায় রাজনৈতিক দলই একমত হয়েছিল– স্বৈরাচার এরশাদকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হবে। সেই ঐক্যের বাস্তবায়ন কতটা হয়েছে, তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক এখনও থেমে নেই। এমন পরিস্থিতিতে চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে স্বৈরাচার তকমা নিয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হওয়া শেখ হাসিনা পর্বের সমাপ্তির পর রাজনৈতিক ঐক্য নিয়ে তাই আশাবাদী হওয়ার সুযোগ কম।
বিশেষত নতুন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে মধ্যপন্থি হয়ে হাজির হওয়ার ঘোষণা ও বাস্তবতার যে ফারাক; একই সময়ে নির্বাচনের মতো গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার খুঁটিকে যেভাবে পিছিয়ে নেওয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে, তা বড়ই আশঙ্কার। এমন বাস্তবতায় নতুন এই রাজনৈতিক দলের বরং মধ্যপন্থি হওয়ার চেয়ে নির্বাচনমুখী হওয়াই দেশের জন্য কল্যাণের। ছাত্র-জনতার চেতনাকে ধারণ করে নেতৃত্বে আসা নতুন দলের নেতারা দেশকে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এগিয়ে নিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবেন– এটিই প্রত্যাশিত।
এহ্সান মাহমুদ: সহকারী সম্পাদক, সমকাল; কথাসাহিত্যিক
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ন গর ক গণত ন ত র ক র র জন ত পর ষ ক র ব যবস থ ড নপন থ ব মপন থ আদর শ দলট র এনস প
এছাড়াও পড়ুন:
চবির ‘এ’ ইউনিটের ফল প্রকাশ, পাসের হার ৩২.০৬ শতাংশ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত 'এ' ইউনিটের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাত ১১টায় ফলাফল প্রকাশ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট অথবা ভেরিফাইড ফেইসবুক পেজ থেকে ফলাফল দেখা যাবে।
এবারের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন ২৯ হাজার ৪১১ জন; পাসের হাস শতকরা ৩২ দশমিক ০৬ শতাংশ। অকৃতকার্য হয়েছেন ৫৯ হাজার ৫১১ জন শিক্ষার্থী। মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অর্জন করা শিক্ষার্থী পেয়েছেন ৯৭ দশমিক পাঁচ নম্বর।
বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, প্রকৌশল ও মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ অনুষদ নিয়ে গঠিত হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের 'এ' ইউনিট।
ভর্তি পরীক্ষার কো-অর্ডিনেটর ও প্রকৌশল অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সানাউল্লাহ চৌধুরী বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং ভর্তি পরীক্ষা কমিটির সঙ্গে মিটিং করে সাবজেক্ট চয়েস ও ভর্তি কার্যক্রম শুরুর বিষয়ে আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব।'
ফলাফল দেখুন এখানে।