প্রতিষ্ঠিত সত্যকে অস্বীকার মিথ্যার নামান্তর
Published: 6th, March 2025 GMT
গণঅভ্যুত্থানের জোয়ারে শেখ হাসিনা দেশ ও দশকে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থায় রেখে দেশ ত্যাগ করেছেন। অরাজক অবস্থার খেসারত দিতে হচ্ছে সমগ্র জাতিকে। শেখ হাসিনা ও তাঁর সহযোগীরা হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট ও পাচার করেছেন, এটা প্রমাণিত। মসনদ টিকিয়ে রাখার জন্য অসংখ্য প্রাণ সংহার করেছেন, এ সত্য অনস্বীকার্য। কিন্তু তাতে শেখ হাসিনার পিতা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দায় কী? বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর অবিস্মরণীয় অবদান তো প্রতিষ্ঠিত সত্য!
শেখ হাসিনা-পরবর্তী বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন ড.
আমরা জানি, ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের গণপরিষদে কংগ্রেস সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রথম বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের প্রস্তাব করেন। সেখান থেকে ক্রমেই গড়ে ওঠে যে ভাষা আন্দোলন; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তার অন্যতম জননেতা। ১৯৫৫ সালের ৫ জুন তিনি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে ১৯৪৮ সালে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উপস্থাপিত বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন। ওদিকে রাজপথে আওয়ামী লীগ ১৭ জুন স্বায়ত্তশাসন ও রাষ্ট্রভাষা বাংলাসহ ২১ দফা দাবি ঘোষণা করে। সে বছর ১৫ আগস্ট করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের নাম, রাষ্ট্রভাষা, স্বায়ত্তশাসনসহ পূর্ব বাংলার স্বার্থসংশ্লিষ্ট দাবিগুলো উত্থাপন করেন।
১৯৫৫ সালের ৯ নভেম্বর শেখ মুজিবুর রহমান গণপরিষদে বাংলায় তাঁর বক্তব্য উপস্থাপনের দাবি করেন এবং শেষ পর্যন্ত অধিবেশনের সভাপতি ডেপুটি স্পিকার তা মেনে নেন। অবশেষে পাকিস্তান সরকার ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে নিলেও চক্রান্ত থাকে অব্যাহত। এ থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ‘৬ দফা’ দাবি জাতির সামনে পেশ করেন। ফলে তাঁকে আসামি করে পাকিস্তান সরকার আগরতলা মামলা দায়ের ও কারাবন্দি করে। গণঅভ্যুত্থানের তোড়ে শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি পেয়ে ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে ওঠেন। অতঃপর ৬ দফা হয়ে স্বাধীনতা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের রাহুমুক্ত হয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন দেশরূপে বিশ্বমানচিত্রে আপন অস্তিত্ব ঘোষণা করে।
শেখ মুজিবুর রহমান হুজুগে নয়; স্কুলজীবন থেকেই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে উঠেছেন। কোনো গোষ্ঠী বা রাজনৈতিক দল নয়; বাঙালি জাতি গভীর শ্রদ্ধায় তাঁকে এই উপাধি দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই একাত্তরের ৭ মার্চ তিনি হয়ে উঠেছিলেন গোটা বাংলাদেশের অঘোষিত প্রতিনিধি।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকেও ইদানীং সুযোগসন্ধানী অনেকে গুরুত্বহীন প্রমাণের অপচেষ্টা করছে। অন্তর্বর্তী সরকারও জাতীয় দিবসের তালিকা থেকে ৭ মার্চ বাতিল করেছে। এ সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে– অন্তর্বর্তী সরকারও ইতিহাসের সত্য আড়াল করতে চায়। অন্যথায় যে বক্তৃতায় স্বাধীনতার ঘোষণা উচ্চারিত হয়েছে এবং বাঙালিকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য উজ্জীবিত করেছে, সেই ঐতিহাসিক দিনকে ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে মুছে ফেলার চেষ্টার আর কী কারণ থাকতে পারে? অথচ ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে ইউনেস্কোর ওয়েবসাইটে ‘মেমরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ সেকশনে স্পষ্ট বলা হয়েছে– ‘ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি বাংলাদেশের জনগণকে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার জন্য নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।’ সেখানে আরও বলা হয়েছে, ‘এই ভাষণ কার্যকরভাবেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। উপনিবেশ-পরবর্তী জাতি-রাষ্ট্রগুলির অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তুলতে ব্যর্থতা কীভাবে বিভিন্ন জাতিগত, সাংস্কৃতিক, ভাষাগত বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর জনসংখ্যাকে বিচ্ছিন্ন করে তোলে, তার একটি বিশ্বস্ত দলিল এই ভাষণ।’
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের অর্ধশত বছর পর শুধু ঐতিহাসিক ৭ মার্চ নয়; ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসও বাতিল করা হয়েছে। বস্তুত বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে যে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, সেটাও কি তাহলে অস্বীকার করতে চায়? শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দেশ-বিদেশে ইতিবাচক ভাবমূর্তি রয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান, ৭ মার্চের ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিয়ে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি তাঁর উপদেষ্টা পরিষদের অগ্রাধিকার নিয়েই প্রশ্ন তুলছে। অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাবের বদলে ইতিহাসের প্রতিষ্ঠিত সত্য সম্পর্কে বিতর্ক তোলা অপ্রয়োজনীয়। প্রতিষ্ঠিত সত্যকে অস্বীকার মিথ্যারই নামান্তর। ইতিহাসের ইঞ্জিনিয়ারিং বাদ দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে অন্তর্বর্তী সরকারের সসম্মানে বিদায় নেওয়াই বরং সময়ের দাবি।
ড. নূরুর রহমান খান: প্রাক্তন অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: শ খ ম জ ব র রহম ন সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
গণপরিষদ ও সংসদ নির্বাচন একসঙ্গে চায় জাতীয় নাগরিক পার্টি
‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠায় নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) যে গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি করছে, সেটা সংসদ নির্বাচনসহ একসঙ্গেই হতে পারে বলে মনে করছে দলটি। দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম আজ মঙ্গলবার বিষয়টি সামনে এনেছেন।
নাহিদ ইসলাম বলেছেন, গণপরিষদ নির্বাচন ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন একসঙ্গে হতে পারে। এর মাধ্যমেই নতুন কাঠামো ও নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে। গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রকৃত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণে সহায়তা করবে।
সকালে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন জাতীয় নাগরিক পার্টির শীর্ষ নেতারা। এরপর নাহিদ ইসলাম দলের নেতাদের নিয়ে ঢাকার রায়েরবাজার কবরস্থানে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে শহীদ ছাত্র–জনতার কবর জিয়ারত করেন।
উভয় স্থানেই নাহিদ ইসলাম গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন। স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, পুরোনো সংবিধান ও পুরোনো শাসনকাঠামো রেখে একটি নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ সম্ভব নয়। কেবল সরকার পরিবর্তন করেই জনগণের কল্যাণ ও প্রকৃত গণতন্ত্র বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তিনি বলেন, চব্বিশের যে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে, ছাত্র-জনতা রক্ত দিয়েছে, তাতে কেবল সরকার পরিবর্তন নয়; বরং শাসনকাঠামো ও সাংবিধানিক পরিবর্তন করে নতুন একটি বাংলাদেশের যাত্রা শুরু করতে চাই, যেখানে প্রকৃত গণতন্ত্র, ইনসাফ ও সাম্য নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
সেকেন্ড রিপাবলিকের (দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র) জন্য নতুন সংবিধান ও গণপরিষদ নির্বাচনের লক্ষ্যে নতুন দল কাজ করে যাচ্ছে উল্লেখ করে নাহিদ আরও বলেন, ‘১৯৪৭ থেকে ২০২৪-এর সব লড়াইয়ের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে আমরা নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ করব এবং সেই লক্ষ্যে এনসিপি কাজ করে যাচ্ছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পেলেও আমাদের সার্বভৌমত্ব বারবার হুমকির মুখে পড়েছে। আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো বারবার ভেঙে পড়েছে। আমরা একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান গড়ে তুলতে পারিনি। একটি একদলীয় সংবিধানের মাধ্যমে ফ্যাসিজম এবং একদলীয় স্বৈরতন্ত্রের বীজ বপন করা হয়েছিল।’
পরে রায়েরবাজারে নাহিদ সাংবাদিকদের বলেন, গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রকৃত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণে সহায়তা করবে। গণপরিষদ নির্বাচন ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন একসঙ্গে হতে পারে। এর মাধ্যমেই নতুন কাঠামো ও নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে জুলাই অভ্যুত্থান এবং গত ১৫ বছরে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের দাবি জানান নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, ‘বিচারের পর সংস্কার কার্যক্রম করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দ্রুত জাতীয় সংলাপে গিয়ে আমাদের জুলাই সনদ ও জুলাই ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন আমরা দেখতে চাই।’
গত শুক্রবার আত্মপ্রকাশের পর আজ শ্রদ্ধা নিবেদন ও কবর জিয়ারতের মধ্য দিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এ সময় দলীয় প্রধান নাহিদ বলেন, এ মুহূর্তে তাঁর দলের প্রথম লক্ষ্য হচ্ছে, সাংগঠনিকভাবে তার কার্যক্রম বিস্তৃত করা, তৃণমূলে সাংগঠনিক কার্যক্রম বিস্তৃত করা। এ ছাড়া দলের নিবন্ধন নিতে যে ধরনের শর্ত পূরণ করা প্রয়োজন, সে শর্তাবলি দ্রুততম সময়ের মধ্যে পূরণ করে নিবন্ধনের প্রক্রিয়া শুরু এবং এ মাসের মধ্যে দলের গঠনতন্ত্র প্রণয়নের কাজ শুরু করার কথা জানান তিনি।
‘খুনি হাসিনাকে ফাঁসির মঞ্চে নিতে হবে’রায়েরবাজারে শহীদদের কবর জিয়ারতের পর এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম বলেন, ‘যত দিন না পর্যন্ত খুনি হাসিনাকে ফাঁসির মঞ্চে দেখছি, তত দিন যেন কেউ ভুলক্রমেও নির্বাচনের কথা না বলে।’
মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, সরকার ছাত্র-জনতার রক্তের ওপর এসেছে। তাদের মনে রাখতে হবে বিচার নিশ্চিত করতে না পারলে পুরো প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হবে। দ্রুততম সময়ে বিচার নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষভাবে ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়িয়ে বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন, মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদসহ কেন্দ্রীয় নেতারা শ্রদ্ধা নিবেদন ও কবর জিয়ারতের এ কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন।