ছোটবেলায় আমাদের পাড়ার ছোট্ট মনোহারী দোকানের মালিক ছিলেন তিনি। পাড়ার বড়রা তাঁকে ডাকতেন ‘ফেল্টু’ বলে, আমরা ছোটরা তাঁকে বলতাম ‘ফেল্টু কাকা’। বাইরের অন্যদের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন ‘ফেল্টু বাবু’ বলে। বহুকাল জানতাম না এবং আমি ধারণা করি, অন্যেরাও হয়তো একদম ভুলে গিয়েছিলেন তাঁর আসল নাম কী ছিল। কিন্তু একদিন পাড়ার সবজান্তা রমেশ জ্যাঠার কাছে জানা গেল ‘ফেল্টু’ নামের ইতিবৃত্ত। তাঁর সত্যিকারের আসল নাম আশীষ নন্দী। কিন্তু ঐ নামে তাঁকে কেউ চেনে না, কিন্তু ‘ফেল্টু বাবু’ বললেই সবাই তাঁর দোকানের দিকে আঙুল উঁচিয়ে দেয়। রমেশ জ্যাঠা জানালেন যে, আশীষ নন্দী কিছুদিন পরপরই নিয়ম করে পরীক্ষায় গাড্ডা মারতেন। এই যেমন পঞ্চম শ্রেণিতে তিনবার ফেল করলেন। তার পরের দু’বছর তাঁর স্থিতি হলো ষষ্ঠ শ্রেণিতে। সপ্তম শ্রেণিতে আটকে থাকলেন এক বছর। রেকর্ড করলেন নবম শ্রেণিতে চার বছর ফেল করে। তখন তাঁর নামই হয়ে গেল ‘ফেল্টু’। পাড়ার গেজেট রমেশ জ্যাঠাও ঠিক বলতে পারলেন না যে, ‘ফেল্টু কাকা’ কবে প্রথম ফেল করেছিলেন, তবে তাঁর শেষ ফেল সেকালের ‘ম্যাট্রিক’ পরীক্ষায়। কারণ, তিনি ম্যাট্রিক পাস করতে পারেননি।
জীবনে যে আমাদের কত রকমের ফেলের মুখোমুখি হতে হয়। সাধারণ ফেল, উচ্চাঙ্গের ফেল; একক ফেল, দলগত ফেল; অতীতের ফেল, বর্তমানের ফেল। ফেলের যে কত ব্যঞ্জনা! বড় ভাই খুব ভোরে আমাদের ছোট্ট রেলস্টেশন ‘কালীদহ’ থেকে ফেনী যাবেন। ঘুম চোখেই জিনিস গুছিয়ে ছুটেছেন স্টেশনের দিকে। আধা ঘণ্টা পরে সদর দরজায় কড়া নাড়া– ফিরে এসেছেন তিনি। বাবা ঘুমজড়ানো চোখে বললেন, ‘কী রে, ট্রেন ফেল করলি?’ মানে, তিনি ট্রেন ধরতে কৃতকার্য হননি। আমার এক কাকা ব্যবসা করবেন– মূলধন দরকার। বাবাকে বলার সাহস নেই, তিনি গিয়ে ধরলেন আমার মাকে। মা দেওরের হয়ে মামলা পেশ করলেন আদালতে, জজ সাহেব এক কথায় মামলা খারিজ করে দিলেন, ‘ও কী ব্যবসা করবে? ওর ব্যবসা দু’দিনেই ফেল মারবে।’ মানে, অল্পদিনেই ব্যবসা লাটে উঠবে। পাশের বাড়ির হাবিব ভাই ছিলেন সুবেশ, সুকেশ, চৌকশ এক মানুষ– আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। একদিন দেখা গেল তিনি বিষণ্ণ, পাঞ্জাবির ওপরে ময়লা চাদর পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন– কিছুটা উদ্ভ্রান্তও বটে। তাঁর বন্ধুরা বলাবলি করছিল, তিনি প্রেমে ফেল করেছেন। মানে, প্রেমে ব্যর্থ হয়েছেন।
আসলে সব মানুষই জীবনের কোনো না কোনো সময়ে, কোনো না কোনো বিষয়ে ফেল করে। সোজা কথায়, অকৃতকার্য হয়, অসফল হয়, ব্যর্থ হয়। সব সাফল্যেরই একটি তাৎক্ষণিক উচ্ছ্বাস থাকে, কিন্তু বহু ছোটখাটো সাফল্য আমরা ভুলে যাই, তার উচ্ছ্বাস আমাদের মনে থাকে না। তবে এটাও সত্যি যে, কিছু কিছু মাইলফলক সাফল্যের কথা আমাদের চিরকাল মনে থাকে। এই যেমন, কবে কোন পত্রিকায় আমার প্রথম লেখা ছাপা হয়েছিল। এর বিপরীতে ব্যর্থতার থাকে একটি গভীর ক্ষত, যা আমরা মনের মধ্যে বয়ে বেড়াই। কোন কোন মাইলফলক ব্যর্থতা হৃদয়ে চুইয়ে চুইয়ে ধীর রক্তধারার মতো বইতে থাকে।
তবুও ফেলের কথা মনে পড়ে যায়– প্রথম ফেল এবং সেই সঙ্গে বহুবিধ ফেলের যাপিত জীবনের নানান অঙ্গনে। সেইসব ফেল শুকিয়ে যাওয়া নদীর মতো শুকিয়ে হয়তো গেছে, কিন্তু স্মৃতির একটি রেখা এঁকে রেখে গেছে হৃদয়ে। খুব একটা মনে করতে চাই না সেসব ব্যর্থতা– ‘কে আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে?’ ‘তবু টের পাই, সব টের পাই’, ‘মনের জানালা দিয়ে তারা উঁকি দিয়ে যায়।’
প্রথম ফেল করেছিলাম ‘মানসাঙ্কে’– অঙ্কেরই একটা অংশে। পঁয়ষট্টি বছর আগের আমাদের অঙ্কের দুটো অংশ ছিল– ‘কষার অঙ্ক’ ৮০ নম্বরের আর ‘মানসাঙ্ক’ ২০ নম্বরের। দ্বিতীয় অংশের জন্য বরাদ্দ ছিল ১৫ মিনিট, আর প্রথম অংশের জন্য বাকি সময়। প্রথমেই দেওয়া হতো মানসাঙ্কের প্রশ্নপত্র– অনেকটা একটা চিরকুটের মতো। কারণ, ওখানে কিছু কষা যাবে না, না প্রশ্নপত্রে, না অন্য কোনো কাগজে। মনে মনে অঙ্ক কষে শুধু উত্তরটা প্রতিটি প্রশ্নের বিপরীতে লিখতে হবে। পাঁচটি প্রশ্ন থাকত– সুতরাং প্রতিটি প্রশ্নের জন্য গড়ে তিন মিনিট পাওয়া যেত। আসলে পরীক্ষাটি ছিল দ্বিমাত্রিক। এক, মনে মনে কী করে উত্তর বের করতে হবে এবং দুই, সময়ের সঙ্গে কী করে পাল্লা দিতে হবে।
কষা অঙ্কে আমি বেশ ভালো ছিলাম। বেশ ভেবেচিন্তে লিখে লিখে ধাপে-ধাপে উত্তর বের করে নিতাম। আর তাঁর জন্য সময়ও পাওয়া যেত ভালোভাবেই। কিন্তু মানসাঙ্ক এলেই আমি ভীত হয়ে পড়তাম। কারণ, আমি কষা অঙ্কের নিয়মে ধাপে ধাপে মানসাঙ্ক করতে চাইতাম। মানসাঙ্কের যে মানসিক নিয়মকানুন আছে, যার প্রয়োগে মানসাঙ্ক দ্রুত করা যায়, তা আমার জানা ছিল না। এসব নিয়মকানুনের মধ্যে ‘কড়াকিয়া’, ‘গন্ডাকিয়ার’ কথা এখনও মনে আছে। ফলে মানসাঙ্কে আমার সময় লাগত। সেই সঙ্গে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে আমি হিমশিম খেতাম।
তৃতীয় শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা। দ্বিতীয় দিনের পরীক্ষা– অঙ্ক। সুন্দর একটি শীতের সকাল। ঝকঝকে রোদ চারদিকে। শ্রেণিকক্ষের বড় জানালা দিয়ে শঙ্করমঠের সোনালি চূড়ো দেখা যাচ্ছে। দরজার বাইরে ঝাঁকড়া হরীতকী গাছের ছায়া। ঘণ্টা বাজল– শুরু হলো পরীক্ষা। প্রথমেই মানসাঙ্কের চিরকুট প্রশ্ন। প্রথম প্রশ্নটিও মনে আছে। ‘এক ডজন কলার দাম আঠারো টাকা হলে নয়টি কলার দাম কত?’ আমি আমার মতো অনেকটা ঐকিক নিয়মে একটি কলার দাম বের করে, তারপর সেই সংখ্যাটিকে ৯ দিয়ে গুণ করে প্রার্থিত ফলটি পেলাম। উত্তর সঠিক হলো বটে, কিন্তু ঐ এক অঙ্ক করতেই আমার ৪ মিনিট চলে গেল। আর আমার বন্ধুরা অঙ্কটা করল এভাবে– এক ডজন কলার দাম আঠারো টাকা হলে ছ’টির দাম ন’টাকা। আর যেহেতু তিন হচ্ছে ছয়ের অর্ধেক, তিনটে কলার দাম সাড়ে চার টাকা। ন’ আর সাড়ে চার, সাড়ে তেরো। সুতরাং ন’টি কলার দাম সাড়ে তেরো টাকা। মুখে মুখে দেড় মিনিটে তামাম শোধ।
ফলে যা হবার তাই হলো। আমি পাঁচটি অঙ্কের মধ্যে মাত্র তিনটে করতে পারলাম। তার মধ্যে একটি আবার ভুল হলো তাড়াহুড়ো করার জন্য। বারবার রাবার ঘষাতে অপরিচ্ছন্নতার জন্য এক নম্বর কাটা গেল। সুতরাং, তৃতীয় শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় মানসাঙ্কে পনেরোর মধ্যে আমি পেলাম পাঁচ, মাত্র ত্রিশ শতাংশ– ডাহা ফেল। মানসাঙ্কের চিরকুট পত্র যখন অঙ্ক শিক্ষক অমূল্যবাবু আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন, তখন আর কিছুই আমি দেখতে পেলাম না। শুধু দেখলাম, লাল পেন্সিলের মোটা রেখায় বড় হাতের ইংরেজি ‘এফ’ অক্ষরটি লেখা এবং সেটাকে আরও ভাস্বর করে দেওয়ার জন্য অক্ষরটির চারপাশে একটি বৃত্ত আঁকা হয়েছে। অন্য কথায়, ঐ ‘এফ’ অক্ষরটিকে একটি বৃত্তের মাঝে আবদ্ধ করা হয়েছে। ফলে অক্ষরটি আরও ফুটে উঠেছে। অক্ষরটির দিকে তাকিয়ে আমার মনে হচ্ছিল, ওটা কোনো অক্ষর নয়, ওটা একটি ছোরা, যা আমার বুকে বিঁধিয়ে আমাকে রক্তাক্ত করে দেওয়া হয়েছে। আমার চোখ ছাপিয়ে জল এলো। অমূল্যবাবু সেদিকে ভ্রুক্ষেপও করলেন না। খুব শান্ত গলায় আমাকে জানালেন যে, যেহেতু অঙ্ক প্রশ্নপত্রের অন্য অংশে আমি ভালো করেছি, সুতরাং সামগ্রিক অঙ্ক বিষয়ে আমি পাস করেছি। তবে সারা ক্লাসের মধ্যে একমাত্র আমিই মানসাঙ্কে ফেল করেছি। তাঁর শেষ জিজ্ঞাস্য ছিল ‘কী করে পারলে?’– মানে, ফেল করতে পারলে? আমি মুখ তুলে তাকাতে পারছিলাম না– লজ্জায়, অপমানে, ব্যর্থতায়। চোখের কোনা দিয়ে দেখতে পাচ্ছিলাম যে, সহপাঠীরা আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে, ভাবখানা এ রকম যে ‘দ্যাখো, দ্যাখো, আমাদের ক্লাসের ফার্স্টবয় মানসাঙ্কে ফেল করেছে।’
বাড়িতে যখন খবরটা গেল আমারই প্রতিবেশী এক সদয় সহপাঠীর কল্যাণে, তখন মা’র বকাবকিতে চারদিক তোলপাড়। তাঁর একই কথা, মানসাঙ্কে ফেল করেছে এমন কথা তিনি বাপের জন্মেও শোনেননি। আর এই অশ্রুতপূর্ব কাজটি কিনা করেছে তাঁরই পেটের ছেলে! এটাও বললেন তিনি যে, ফেলই যদি করলাম, তাহলে মানসাঙ্কে কেন? কষা অঙ্কে করলে তাও একটা মান-ইজ্জত থাকত। ভাবখানা এ রকম, ‘মারি তো গন্ডার, লুটি তো ভান্ডার’। আমার শিক্ষক বাবা কিন্তু ঐ পথেই গেলেন না। তিনি খুব শান্ত স্বরে বললেন যে, ‘এরপর মানসাঙ্কের নিয়মকানুন ভালো করে শিখে নিও। তাহলেই সব পারবে।’ অর্থাৎ যে কোনো ব্যর্থতা থেকেই জয়ী হওয়ার কৌশলগুলো শিখে নিও। আমার সারাজীবনে বাবার এই কথাটি আমি মনে রেখেছি এবং অন্যদেরও, বিশেষত আমার শিক্ষার্থীদের, আমি এই কথাটি বলেছি। জীবনে ব্যর্থতার ভাগ তো আমার জীবনে কম আসেনি এবং ঐ কথাগুলো অনুসরণ করেই আমি আমার ব্যর্থতাগুলো অতিক্রম করতে চেষ্টা করেছি।
কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও তো সত্য যে, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা আমি সামাল দিতে পারিনি। সফল হইনি সেখানে। দীর্ঘদিন আমার অতি প্রিয় মানুষটি কর্কট রোগের সঙ্গে লড়াই করেছে। চেষ্টা করেছি চিকিৎসা বিজ্ঞানের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বোত্তম চিকিৎসা এবং সেবাসুবিধা দিয়ে ওকে সুস্থ করে তুলতে। দীর্ঘ বিশ বছরের এ লড়াইয়ে সর্বক্ষণ ওর পাশে ছিলাম– বিশ বছরে আমি নিজেও মোটামুটি এক বছর কাটিয়েছি ওর সঙ্গে হাসপাতালে। লড়াই জিতেছি দু’জনে মিলে একটার পর একটা– কিন্তু শেষ যুদ্ধটি হেরে গেছি। হারিয়েছি ওকেও। ব্যর্থ হয়েছি ওকে সারিয়ে তুলতে, বাঁচিয়ে রাখতে। এ-ও তো একটা একটা অকৃতকার্যতা, একটা ফেল। না, প্রথম ফেল নয়, তবে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ফেল তো অবশ্যই।
জীবনের এ প্রান্তে এসে কখনও ভাবি না, জীবনের কোথায় আমি পাস করেছি, কোথায় আমি ফেল করেছি। এটা কোনো হিসাব নয়, অঙ্ক নয়, মানসাঙ্ক তো নয়ই। অন্যেরা এ হিসাব করুক গে। আমি করি না। আমি এ কথাও বলি না, ‘জীবন এত ছোট ক্যানে?’। আমি শুধু বলি, ‘জীবন এমন অসম্ভব রকমের সুন্দর ক্যানো?’ তাই আমার কাছে জীবনের ফেল বলে কিছু নেই। আসলে জীবনে ফেল্টুবাবুদের কোনো অস্তিত্ব নেই।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প রথম ফ ল কল র দ ম ফ ল কর ছ র জন য আম র জ র জ বন জ বন র আম দ র পর ক ষ ব যবস করল ন
এছাড়াও পড়ুন:
চবির ‘এ’ ইউনিটের ফল প্রকাশ, পাসের হার ৩২.০৬ শতাংশ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত 'এ' ইউনিটের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাত ১১টায় ফলাফল প্রকাশ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট অথবা ভেরিফাইড ফেইসবুক পেজ থেকে ফলাফল দেখা যাবে।
এবারের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন ২৯ হাজার ৪১১ জন; পাসের হাস শতকরা ৩২ দশমিক ০৬ শতাংশ। অকৃতকার্য হয়েছেন ৫৯ হাজার ৫১১ জন শিক্ষার্থী। মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অর্জন করা শিক্ষার্থী পেয়েছেন ৯৭ দশমিক পাঁচ নম্বর।
বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, প্রকৌশল ও মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ অনুষদ নিয়ে গঠিত হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের 'এ' ইউনিট।
ভর্তি পরীক্ষার কো-অর্ডিনেটর ও প্রকৌশল অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সানাউল্লাহ চৌধুরী বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং ভর্তি পরীক্ষা কমিটির সঙ্গে মিটিং করে সাবজেক্ট চয়েস ও ভর্তি কার্যক্রম শুরুর বিষয়ে আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব।'
ফলাফল দেখুন এখানে।