ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা পৃথিবীর প্রাচীনতম বইমেলার মর্যাদা লাভ করেছে। শুধু বইমেলা নয়, বইয়ের উৎপত্তির সঙ্গেও জড়িয়ে আছে ফ্রাঙ্কফুর্টের নাম। জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টের অধিবাসী জোহানেস গুটেনবার্গ [১৪৪০-৫০] কালের মধ্যে ছাপাখানা উদ্ভাবন করেন। তখন থেকেই বইয়ের অস্তিত্বের সূচনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৯ সালে আধুনিক ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা শুরু হলেও এর গোড়াপত্তন হয়েছিল প্রায় ৫০০ বছর আগে ১৪৬২ সালে। তবে শুধু বইমেলা নয়, ব্যাংক ও বারবনিতার জন্যও ফ্রাঙ্কফুর্ট শহর বিখ্যাত। মহাকবি গ্যোটের জন্ম এই শহরে, তেমনি ধনকুবের রথসচাইল্ড পরিবারের আদি নিবাস এখানে।
মেলার জার্মান প্রতিশব্দ হলো মেসে, সারা বছরই কোনো কোনো মেলা চলে, অক্টোবরের গোড়ায় বুক মেসে। এটাই এখন বিশ্বের সর্ববৃহৎ বইমেলা। পাঁচ দিনের এই বইমেলাকে কেন্দ্র করে ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে প্রায় তিন লাখ অতিরিক্ত লোকের সমাগম ঘটে।
বিশ্বনন্দিত এই বইমেলায় আমার অংশগ্রহণের সুযোগ ঘটে ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে। সে বছর ছিল ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার ৭৫তম আসর। এবারের অতিথি দেশ স্লোভেনিয়া। মেলায় ১০২টি দেশের ৭ হাজার ৩০০ প্রকাশনী সংস্থা অংশগ্রহণ করে। এবারের বইমেলা ছিল শারদোৎসবের কালে। শরতের সৌন্দর্যের কোল থেকে হঠাৎ যেন নিজেকে আবিষ্কার করলাম ইউরোপীয় শীতের ধূসর প্রাঙ্গণে। কনকনে শীতকে সঙ্গী করে ফ্রাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি আমরা গেলাম নির্ধারিত বাসভবনে। আমরা মানে তিনজন। হাড়কাঁপানো শীত ও পাকস্থলী কাঁপানো ক্ষুধা দুয়েরই নিবৃত্তি ঘটল কিছুক্ষণের মধ্যে।
পরদিন বিকেলে নির্ধারিত সময়ে উদ্বোধন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বইমেলা প্রাঙ্গণে উপস্থিত হলাম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত সরকারপ্রধান, লেখক, প্রকাশক, পাঠক, বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকদের কোলাহলে মুখর ছিল মেলা প্রাঙ্গণ। বিশাল মিলনায়তনে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ উদ্বোধন অনুষ্ঠান শুরু হয়। বইমেলার আয়োজক কমিটির প্রেসিডেন্ট, জার্মানির সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী ও বিভিন্ন দেশের লেখক এ বইমেলার তাৎপর্য তুলে ধরে চমৎকার বক্তব্য দেন। জার্মানির একজন জনপ্রিয় টিভি উপস্থাপক অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ছিলেন। তাঁর অসাধারণ উপস্থাপনা অনুষ্ঠান প্রাণবন্ত করে তুলেছিল। অতিথিদের উদ্দেশে তিনি একটি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন, হোয়াট ইজ দ্য রোল অব বুক ইন দিস ডিফিকাল্ট টাইম? মাত্র কয়েকদিন আগে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গে হামাসের রক্তাক্ত সংঘাত শুরু হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছিল বইমেলার উদ্বোধনী আসরেও। নজিরবিহীনভাবে উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে জড়িয়ে পড়েন বক্তারা। এমনকি বক্তার বক্তব্যের মাঝখানে দর্শকসারি থেকে মঞ্চের দিকে এগিয়ে গিয়েও কেউ কেউ প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু কোনো বিশৃঙ্খলা হয়নি। আয়োজক কমিটির প্রতিনিধি প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেছেন, তারা বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাসী ও ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
উদ্বোধন অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। অতিথি দেশ স্লোভেনিয়ার শিল্পীরা দৃষ্টিনন্দন নৈপুণ্যে তাদের দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য উপস্থাপন করেন। উদ্বোধন অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর ছিল আকর্ষণীয় পানাহার পর্ব। এরপর অতিথি দেশ স্লোভেনিয়ার জন্য নির্ধারিত হলরুমে দর্শনার্থীদের প্রবেশ। মঞ্চে বাজছে স্লোভেনিয়ার নিজস্ব বাদ্যযন্ত্রে সুরের লহরি। বিভিন্ন দেশ থেকে আগত লেখক, পাঠক ও প্রকাশকদের আড্ডা চলছে। সেখানেই দেখা হয়ে গেল আয়োজক দেশ জার্মানির সম্প্রচার ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী এবং স্লোভেনিয়ার সংস্কৃতিমন্ত্রীর সঙ্গে। দু’জনই নারী এবং তাদের চোখেমুখে আত্মবিশ্বাসের ছাপ। স্লোভেনিয়ার সংস্কৃতিমন্ত্রী অপেক্ষাকৃত তরুণ ও প্রিয়দর্শিনী। তাদের দু’জনের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা হলো। বাংলাদেশ থেকে গিয়েছি শুনে তারা আগ্রহ নিয়ে বাংলাদেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে চাইলেন। তারাসহ আরও কয়েকটি দেশের প্রতিনিধির সঙ্গে সময় কাটিয়ে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা উদ্বোধনের দিন পার হলো। পরের দিন বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে বসে সিংহভাগ সময় পার হলো। প্যাভিলিয়নে ঘুরতে আসা বিভিন্ন দেশের লেখক, পাঠক, সাংবাদিক বাংলাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও বই সম্পর্কে কৌতূহল প্রকাশ করেন। তাদের সঙ্গে আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে অনেকটা সময় অতিবাহিত হলো।
আমাদের প্যাভিলিয়নের মুখোমুখি ছিল সিঙ্গাপুরের প্যাভিলিয়ন। কয়েকজন উজ্জ্বল তরুণ-তরুণী সেই প্যাভিলিয়নের দায়িত্বে ছিলেন। প্রায়ই তাদের সঙ্গে দৃষ্টিবিনিময় ও কথার আদান-প্রদান চলছিল। একই সারিতে ছিল ভারত, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানিসহ আরও কয়েকটি দেশের প্যাভিলিয়ন। বিশ্বসেরা বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা অসাধারণ বইয়ের সম্ভার নিয়ে নিজেদের গর্বিত উপস্থিতি তুলে ধরেছিল। আয়োজক দেশ জার্মানি, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের প্যাভিলিয়নে নানা বিষয়ে নিয়মিত সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন ভবনে, ভিন্ন ভিন্ন ফ্লোরে সুবিশাল পরিসরে স্থান পেয়েছিল বিশ্বের বৃহত্তম বইমেলা। প্রায় চার মিলিয়ন বর্গফুটের আবদ্ধ স্থানে এই আয়োজন। প্রতিটি দেশ ও প্রকাশনা সংস্থার প্যাভিলিয়নে গিয়েছি। সবখানে বসতে পারিনি, ভালোভাবে বই দেখতে পারিনি। যেখানে ভালো লেগেছে সেখানে বসেছি, কথা বলেছি। বলা বাহুল্য শুধু বইয়ের আকর্ষণে নয়, মানুষের আকর্ষণেও।
ফুটবল খেলায় বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের কোনো অবস্থান না থাকলেও ফুটবল উন্মাদনায় বাংলাদেশের নাম প্রথম সারিতে থাকবে। বিভিন্ন দেশের প্যাভিলিয়নে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ চোখ আটকে গেল শতকোটি মানুষের আবেগের নাম আর্জেন্টিনায়। বাংলাদেশেও সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা এই দেশের ফুটবলারদের। ম্যারাডোনা থেকে মেসি– যার যার সময় সবচেয়ে বড় ফুটবলারের নাম। আর্জেন্টিনার প্যাভিলিয়নে ঢুকে তাদের প্রকাশক ও বিক্রয়কর্মীর সঙ্গে পরিচিত হলাম। আর্জেন্টিনার প্রতি আমার পরিবার ও দেশের গভীর অনুরাগের কথা জেনে তারা আনন্দিত হলেন। কয়েকটি বই হাতে নিয়ে ঘ্রাণ অনুভব করলাম। বাংলা সাহিত্যের মহত্তম প্রতিভা রবীন্দ্রনাথের নামও জড়িয়ে আছে আর্জেন্টিনার সঙ্গে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সুবাদে। কখনও আর্জেন্টিনা যেতে পারব কিনা জানি না, কিন্তু আর্জেন্টিনার নাগরিকদের সান্নিধ্য পেয়েছি, এটিই-বা কম কী!
ব্রাজিল, মেক্সিকো, চিলিসহ আরও কয়েকটি দেশের প্রকাশক ও বিক্রয়কর্মীদের সঙ্গে আড্ডা হলো। ফুটবল খ্যাতিতে এই দেশগুলোও উজ্জ্বল। বিশ্বের বৃহত্তম এ বইমেলায় ঘুরতে ঘুরতে একটি আক্ষেপ খুব তীব্র হচ্ছিল। কত গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয় বই নজর কেড়েছে। কিন্তু সেই বই কেনার উপায় নেই। ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা মূলত প্রদর্শনী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রকাশক ও বিপণনকারীরা এখানে আসেন। অনুবাদ ও বইয়ের স্বত্বের জন্য তারা চুক্তিবদ্ধ হন।
ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলাকে এককথায় বলা যেতে পারে ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন বুক’। মাত্র একটি ক্ষেত্রে এত বিচিত্র ধরনের শস্য এক অনন্য বিস্ময়। বিভিন্ন জাতির ও ভাষার লেখক, বুদ্ধিজীবী, প্রকাশক এবং বইপ্রেমী পাঠকের অন্তহীন মিলনমেলা। জ্ঞানের কোনো ভৌগোলিক সীমা নেই। মানবজ্ঞানের সমৃদ্ধ ভান্ডার যেন খণ্ড খণ্ড করে সমগ্র মানবজাতির জন্য সাজানো। v
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: আর জ ন ট ন র বইম ল র মন ত র র জন য উপস থ ফ টবল বইয় র
এছাড়াও পড়ুন:
‘অর্ধেক দামে বিক্রি করব ওমানের মুদ্রা’, প্রতারণার নতুন ফাঁদ
‘আমার কাছে কিছু ওমানি মুদ্রা আছে, অর্ধেক দামে বিক্রি করব’, এভাবে প্রতারণার ফাঁদ পেতে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে টাকা। বিদেশি মুদ্রা দেখিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগের মামলায় চট্টগ্রাম নগরে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁরা হলেন জয়নাল আবেদীন, জাহান হোসেন, এয়ার হোসেন ও মিজানুর রহমান। গতকাল সোমবার রাতে নগরের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সোলাইমান প্রথম আলোকে বলেন, প্রতারণার মাধ্যমে দোকানের এক বিক্রয়কর্মীর কাছ থেকে ১ লাখ ৫৭ হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়ার মামলায় চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে নেওয়া ২৯ হাজার টাকা ও ঘটনায় ব্যবহৃত সিএনজিচালিত অটোরিকশা উদ্ধার করা হয়েছে।
ওসি আরও বলেন, গত ২৩ ফেব্রুয়ারি নগরের সানমার ওশান সিটির একটি দোকানের বিক্রয়কর্মী মেজবাউল আলম দোকানের ১ লাখ ৫৭ হাজার টাকা জমা করার জন্য দোকান থেকে জিইসি মোড় ব্যাংক এশিয়ার শাখায় যাচ্ছিলেন। জিইসি এলিট পেইন্টের সামনে এলে এক সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক তাঁকে বলেন, তাঁর কাছে বিদেশি মুদ্রা আছে, ওমানের। তখন দোকানের বিক্রয়কর্মী নগরের আগ্রাবাদে গিয়ে বিক্রির জন্য বলেন। ইতিমধ্যে সেখানে জড়ো হন অটোরিকশাচালকের কয়েকজন সহযোগী। তাঁরা যাত্রী সেজে দ্রুত চালককে নিয়ে যেতে চান।
তখন চালক বলেন, অর্ধেক দামে হলেও মুদ্রাগুলো বিক্রি করে দেব। তখন যাত্রীবেশে থাকা চালকের সহযোগীরা তাতে সায় দেন। একপর্যায়ে ওমানের ১৮১টি মুদ্রা (পয়সা) ১ লাখ ৫৭ হাজার টাকায় কেনেন। পরে জানতে পারেন, ওমানি এক বাইসা (পয়সা)–এর বিপরীতে বাংলাদেশি ১৫ টাকা। প্রতারণার বিষয়টি জানার পর পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেন বিক্রয়কর্মী।