ছাত্রী নেকাব না খোলায় ঢাবি শিক্ষক বললেন ‘নরক হয়ে গেছে দেশটা’
Published: 6th, March 2025 GMT
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বাংলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের তৃতীয় সেমিস্টারের পরীক্ষা চলাকালে এক ছাত্রীর পরিচয় যাচাইয়ে নেকাব খুলতে জোরাজুরি করার অভিযোগ উঠেছে। তিনি নেকাব খুলতে না চাইলে বিভাগের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম ‘দেশটা যে কী হচ্ছে, নরক হয়ে গেছে দেশটা’ বলে মন্তব্য করেন বলে জানা গেছে।
এদিকে, এ ঘটনার প্রতিবাদ এবং নিপীড়কদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ তিন দফা দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছেন ভুক্তভোগী ছাত্রী।
বৃহস্পতিবার (৬ ফেব্রুয়ারি) রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি জানান তিনি। তবে বিভাগের কোন শিক্ষকের বিরুদ্ধে তিনি অভিযোগ না করে সিস্টেমে পরিবর্তন চান।
ভুক্তভোগী নারী শিক্ষার্থীর নাম তাহমিনা তামান্না। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ২০২২-২৩ সেশনের রোকেয়া হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
ঘটনার বর্ননা দিয়ে তামান্না বলেন, “আজ থেকে আমার সেমিস্টার ফাইনাল শুরু হয়েছে। পরীক্ষা শুরুর পর স্যার খাতা সাইন করতে এসে আমাকে এটেন্ডেন্স শিটে সাইন করতে দিয়ে মুখ খুলতে বলেন। আমি আসলে কীভাবে না করব, এটা বুঝছিলাম না। তাই দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে ছিলাম। স্যার বললেন, ‘বসো, বসে মুখ খোল, চেক করতে হবে তো আমার।’ আমি মাথা নিচু করেই ছিলাম, হাত কাঁপছিল। স্যার পরে বললেন, ‘কোনো সমস্যা?’ বললাম, জি স্যার। পরে স্যার বললেন, ‘মুখ খুলবে না?’ আমি না বললে তিনি আমার থেকে অ্যাটেন্ডেন্স শিটটা নিয়ে খাতাটা সাইন না করে দিয়ে দেন এবং বলেন ‘ঠিক আছে রাখ, তোমারটা একটু পর সাইন করছি।’ বুঝলাম, কিছু একটা ঝামেলা হবে।”
তিনি বলেন, “দেখলাম, স্যাররা সামনে বসে আলোচনা করছেন। একটু পর চেয়ারম্যান স্যার ওঠে আসেন। আমার পিছন থেকে ম্যাম দাঁড়ান এসে। তারপর ম্যাম বলেন, ‘কি ব্যাপার কোন সমস্যা? স্যারকে সাইন করাতে দাওনি কেন? কোন সমস্যা? মুখ দেখাবে না?’ ম্যাম ভালো করেই জিজ্ঞেস করেছিলেন। এ সময় চেয়ারম্যান স্যার ‘দেশটা যে কী হচ্ছে, নরক হয়ে গেছে দেশটা’ বলে মন্তব্য করেন।”
তিনি আরো বলেন, “আমি ভয়ে কাঁপছিলাম, কারণ আমি ওতো সাহসী মানুষ না। মাথা নিচু করে ছিলাম। তখন ম্যাম তাকে দেখাতে। আমি একপাশ ফিরে ম্যামকে দেখালে তিনি সাইন করেন। পাশাপাশি তিনি বললেন, ‘সবসময় তো মহিলা টিচার থাকবেন না।’ তখন চেয়ারম্যান স্যার বলেন, ‘ওকে জিজ্ঞেস করেন তো, ও ভাইভাতে কী করবে?’ তখন ম্যাম আমাকে বলেন, ‘ভাইভাতে কী করবে? মুখ খুলবে না?’ আমি না বললে তিনি বলেন, ‘ভাইভা বোর্ডে তো মহিলা টিচার নাও থাকতে পারেন, তখন?’ পরে চেয়ারম্যান স্যার বলেন, ‘ওর জন্য কি অন্য টিচাররা সব ভাইভা বোর্ড থেকে বের হয়ে যাবে? ও মুখ খুলবেনা তাই চলে যাবে বের হয়ে? দেশটা যে কী হচ্ছে, নরক হয়ে গেছে দেশটা।’ আরও কিছু হয়তো বলেছেন, কিন্তু আমার তা খেয়ালে নেই।”
বিভাগের নারী শিক্ষক শান্তনা দেন উল্লেখ করে তামান্না বলেন, “আমার অলরেডি তখন চোখ দিয়ে পানি পড়া শুরু হয়েছে। তখন ম্যাম বুঝতে পেরে আমাকে অনেক শান্তনা দিয়ে বলেন, ‘আরে এ তো কান্নাকাটি শুরু করছে। নার্ভাস হইয়ো না। এ ঘটনার প্রভাব যেন পরীক্ষায় না পড়ে। এখন পরীক্ষা দাও, আমরা এ বিষয়ে পরীক্ষার পর কথা বলব।’ উনারা চলে যাওয়ার পরও লিখতে পারতেছিলাম না, ভয় পেয়ে গেছিলাম। পরীক্ষা কেমন হইছে সেটা আর না বলি।”
এ অভিযোগ কোন শিক্ষকের বিরুদ্ধে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমার আসলে শিক্ষকদের নিয়ে কিছু বলার নেই। তারা বরাবারই নিয়মের কথা বলেন। আর এটা সত্যি যে, নিয়মের মধ্যেই আসল ঝামেলাটা। আমি চাই নিয়মটা পরিবর্তন হোক। আমার শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। আমি চাই সিস্টেমটা পরিবর্তন হোক। কোন টিচারের কিছু হোক, সেটা চাই না। না হয় পরবর্তী পরীক্ষায়ও এটা ফেইস করা লাগবে, ভাইভাতেও।”
তিনি দাবি করে বলেন, “আমি চাই, সব বিভাগের ক্লাস, পরীক্ষা, ভাইভা, টিউটোরিয়ালে যারা হিজাব-নিকাব পরে, তাদের কোন সমস্যা যেন আর না হয়। চেক করার জন্য যেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই অন্য কোন ব্যবস্থা রাখা হয়। পরীক্ষার নিয়মটাই পরিবর্তন হোক। হিজাব-নিকাব পরা আমারসহ প্রত্যেকটা মেয়ের স্বাধীনতা হোক।”
তিনি বলেন, “আমরা আগে বলতে পারতাম না। ৫ আগস্টের পরে আমরা বাক-স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছি। তাই আমি এটা নিয়ে কথা বলার সিদ্ধান্ত নেই। পরে আমি ফেসবুক আইডি ও শিক্ষার্থী সংসদে পোস্ট দেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে আমরা বিভিন্ন সময়ে দেখেছি হিজাব-নিকাব পড়লে তাদের হেনস্তা করা হয়। আমি চেয়েছি এটার যেন সুষ্ঠু সমাধান হয়।”
সংবাদ সম্মেলনে তামান্নার ভাই আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী আমির ফয়সাল বলেন, “আমরা কোন আল্টিমেটাম দেব না। বিশ্ববিদ্যালয় এমনিতেই অনেক সহনশীল। তাই আশা করব, তারা এ বিষয়ে সমাধান বের করবেন। আমরা উপাচার্য স্যারের কাছে আবেদন জানাব, এ বিষয়ে যেন স্ট্রংলি দেখেন এবং ব্যক্তি শনাক্তকরণের আইন সিনেটে উত্থাপন করেন।”
তিনি বলেন, “রাস্তায় ওড়না পরতে বলা যেমন ক্রাইম, তেমনই নিকাব খুলতে বলাও ক্রাইম। ওড়না পড়তে বলায় একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু অসংখ্যবার হিজাব নিকাব খুলতে বলার পরও কারো বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।”
সংবাদ সম্মেলনে উত্থাপিত তার দাবিগুলো হলো- অনতিবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের চেহারা দেখে সনাক্তকরণ প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে এবং বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে শনাক্ত করতে হবে; বায়োমেট্রিক পদ্ধতি চালু করার পূর্ব পর্যন্ত পরীক্ষায় শিক্ষিকার মাধ্যমে শনাক্ত করার কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে; ইতোপূর্বে নারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘটিত প্রতিটি নিপীড়ন ও হেনস্তার যথাযথ তদন্ত সাপেক্ষে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
অভিযোগের বিষয়ে বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম বলেন, “পরীক্ষা চলাকালে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে আমি নিজেই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ছি। দেশটা নরক হয়ে যাচ্ছে, আমি এটা তাকে উদ্দেশ্য করে বলিনি। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিচারে এটা বলেছি। সে হয়তো বুঝতে ভুল করেছে।”
তিনি বলেন, “আমরা চাই এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার স্থায়ী সমাধান হোক। এটা নিয়ে ডিন মহাদয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে। বিষয়টি স্থায়ী সমাধান করা হবে, যাতে কাউকে এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে না হয়।”
ঢাকা/সৌরভ/মেহেদী
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর পর ক ষ য় স য র বল ব যবস থ বলল ন ঘটন র সমস য
এছাড়াও পড়ুন:
যশোরে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের কেন্দ্রীয় নেতাদের সভায় হট্টগোল
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে যশোরে মতবিনিময় সভায় হট্টগোলের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল রোববার সন্ধ্যায় জেলা পরিষদ মিলনায়তনে এ ঘটনা ঘটে।
নেতা-কর্মীরা জানান, সাংগঠনিক কমিটি গঠন ও কার্যক্রম গতিশীল করতে কেন্দ্রীয় নেতারা যশোরের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভার আয়োজন করেন। উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক জুবায়ের হোসেন ও আবদুস শহীদ নাসিম, সংগঠক সুলতানা খাতুন জান্নাত এবং সদস্য শাহরিয়ার কবির। সভা চলাকালে কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে উপস্থিত হন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জেলা কমিটির সাময়িকভাবে স্থগিত হওয়া সদস্যসচিব জেসিনা মুর্শিদ। তাঁকে উদ্দেশ করে স্লোগান দেন শিক্ষার্থীরা। জেসিনা মুর্শিদ অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ না করলে বিক্ষুব্ধ অংশগ্রহণকারীরা সভা বর্জনের হুমকি দেন। পরে কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশে জেসিনা অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
বিষয়টি জানতে চাইলে জেসিনা মুর্শিদ বলেন, ‘অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হওয়ার জন্য কেন্দ্র থেকেও বলা হয়েছিল। কিন্তু অনুষ্ঠানস্থলে গেলে কয়েকজন নেতা-কর্মী আমাকে চলে যাওয়ার শর্ত দেন। তখন আমি আমার সহযোগীদের নিয়ে বেরিয়ে আসি। পরে রাতে কেন্দ্রীয় নেতারা আমার সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেছেন।’
জেসিনা মুর্শিদ চলে যাওয়ার পর সভায় ছাত্রসংসদের কমিটি গঠন ও কার্যক্রম নিয়ে নানা পরামর্শ দেন কেন্দ্রীয় নেতারা। বক্তারা বলেন, সংগঠন দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স থাকবে। কোনো অপকর্মের স্থান এখানে হবে না। দেশে অস্থিরতা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজকে সজাগ থাকার আহ্বান জানান তাঁরা।
বক্তারা আরও বলেন, দেশে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের আর কোনো জায়গা হবে না এবং কোনো রাজনৈতিক দলকে স্বৈরাচার হওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে না। আওয়ামী লীগের বিচারের দাবিতে ছাত্রসমাজকে রাজপথে আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত থাকারও আহ্বান জানান তাঁরা।
প্রসঙ্গত, উপজেলা কমিটি গঠনসংক্রান্ত সাংগঠনিক নীতিবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের অভিযোগে ৪ ফেব্রুয়ারি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ও সদস্যসচিব আরিফ সোহেল স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জেসিনা মুর্শিদের পদ সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়।