রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বুধবার রাতে সারজিস আলমের উপস্থিতি ঘিরে একপক্ষের প্রতিবাদী স্লোগান ও পরবর্তী সময়ে মারামারির ঘটনায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। মো. মুশতাক তাহমিদ নামের এমবিএর ওই শিক্ষার্থীর পিঠে ধারালো অস্ত্রের আঘাত লেগেছে। সেখানে ১৩টি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।

আহত মুশতাক তাহমিদ আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ নম্বর ফটকে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে আরও চার শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন।

হামলার জন্য মুশতাক তাহমিদ নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র ও ছাত্রদল নেতা পরিচয়ধারী আহমেদ শাকিল ও তাঁর সহযোগী মাসরুরকে দায়ী করেছেন। আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে এ ঘটনায় থানায় মামলা গ্রহণ এবং দোষীদের গ্রেপ্তারের দাবি করেছেন তিনি।

গতকাল রাতের ঘটনার বিষয়ে মুশতাক তাহমিদ জানান, জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সমন্বয়ক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম গতকাল রাত আটটার দিকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ‘ঘাট পাড়ে’ যান। সেখানে অনেকের সঙ্গে তাঁর কথা হয়। তিনি কেন আগেই এখানে আসেননি, গণ–অভ্যুত্থানে হতাহত ব্যক্তিদের পরিবারকে দেখভালসহ নানা বিষয়ে তাঁর কাছে অনুযোগ করেন শিক্ষার্থীদের অনেকে। এই আলাপচারিতার এক পর্যায়ে রাত ১০টার পর সারজিস আলম নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ নম্বর ফটকের সামনে যান। কিছুক্ষণ পর সেখানে ছাত্রদলের পরিচয় দিয়ে ৩৫–৪০ জনের মতো ছেলে সারজিস আলমের উপস্থিতির প্রতিবাদ জানিয়ে নানা স্লোগান দেন। ‘ঢাবির দুই গালে, জুতা মারো তালে তালে’সহ বিভিন্ন উসকানিমূলক স্লোগান দেন তাঁরা।

একপর্যায়ে ওই প্রতিবাদকারীদের সঙ্গে সারজিস আলম ও তাঁর সঙ্গে থাকা শিক্ষার্থীদের বাগ্‌বিতণ্ডা হয় জানিয়ে মুশতাক তাহমিদ বলেন, তাঁরা সারজিস আলমের ওপর আক্রমণ করতে এলে তিনি থামানোর জন্য এগিয়ে যান। তখন তাঁর ওপর হামলা হয়। ‘এ সময় আহমেদ শাকিল আমাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করেন এবং মাসরুর মাথায় কামড় দেন,’ বলেন তাহমিদ।

হামলাকারীদের মধ্যে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের কেউ ছিলেন না জানিয়ে মুশতাক তাহমিদ বলেন, ‘আহমেদ শাকিল ও মাসরুর রাজনৈতিক দলের হলেও তাঁদের আমি কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা মনে করি না। আমি মনে করি, তারা সন্ত্রাসী। তাঁদের সন্ত্রাসী হামলায় আমার শরীরে ১৩টির মতো সেলাই লেগেছে। আমি নিজেও কোনো রাজনৈতিক দলের নই। আমি বিভিন্ন সময়ে কোটাবিরোধী আন্দোলনসহ ছাত্রদের বিভিন্ন দাবির পক্ষে আন্দোলনে সক্রিয় ছিলাম। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানেও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলাম।’

এই হামলার এক পর্যায়ে সারজিস আলমকে নিরাপদে সেখান থেকে চলে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয় বলে জানান মুশতাক তাহমিদ। তিনি বলেন, তাঁর জানামতে হামলায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও দুই শিক্ষার্থী হালকা আহত হয়েছেন।

এ ঘটনার পর গতকাল গভীর রাতে ভাটারা থানায় আহমেদ শাকিল ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেন কয়েকজন শিক্ষার্থী। ওই রাতেই থানাটিতে পাল্টা অভিযোগ দেয় অপর পক্ষ। তবে কোনো পক্ষের অভিযোগকে মামলা হিসেবে গ্রহণ করেনি পুলিশ।

ভাটারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল ইসলাম আজ সকালে প্রথম আলোকে বলেন, দুই পক্ষই পরস্পরের বিরুদ্ধে হামলা, মুঠোফোন ও টাকা ছিনতাইয়ের অভিযোগ করেছে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ বিষয়ে আহত মুশতাক তাহমিদ বলেন, তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষীরা রাতে মামলা করতে থানা থেকে বলা হয়, ওপর থেকে নির্দেশ আছে। সে কারণে মামলা নিতে পারবে না। অবিলম্বে মামলা নিয়ে এ বিষয়ে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করার দাবি জানিয়েছেন তিনি।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আহম দ শ ক ল গ রহণ

এছাড়াও পড়ুন:

স্থায়ী সমাধান ও অনিয়ম বন্ধে ব্যবস্থা কী

ব্রোকারেজ হাউস মালিক ও মার্চেন্ট ব্যাংকারদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে শেয়ারবাজারের নেগেটিভ ইকুইটি তথা ঋণাত্মক ঋণ হিসাবের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশনিংয়ের বাধ্যবাধকতার সময়সীমা আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) গত বৃহস্পতিবার এক জরুরি সভায় সময় বাড়ানোর এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

শেয়ারবাজারে ২০১০ সালের ধসের পর ঋণাত্মক ঋণ হিসাবের এই সমস্যা তৈরি হয়। এরপর প্রায় দেড় দশক ধরে শেয়ারবাজারে সমস্যাটি জেঁকে বসেছে। এই সময়ে বিএসইসির কোনো নেতৃত্ব সমস্যাটির স্থায়ী সমাধান করেননি বা করতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেননি। বরং সব কমিশনই সমস্যাটির তাৎক্ষণিক সমাধান হিসেবে শুধু সময় বাড়িয়ে নিরাপত্তা সঞ্চিতিতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ছাড় দেওয়া দিয়েছে। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠানও নিজে থেকে এই সমস্যা সমাধানে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা ক্রমাগতভাবে কমেছে। সেই সঙ্গে একশ্রেণির ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকের কাছে ঋণাত্মক ঋণ হিসাবগুলো অনিয়মের এক হাতিয়ারে পরিণত হয়। তাই শেয়ারবাজার–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এই সমস্যাকে বাজারের জন্য ‘ক্যানসার’ হিসেবে অভিহিত করেন। তাঁরা বলছেন, সাধারণ ওষুধে (সময় বৃদ্ধির মতো সিদ্ধান্ত) এখন আর এই ক্যানসারের নিরাময় সম্ভব নয়। এই রোগ সারাতে অস্ত্রোপচার করতে হবে। তার জন্য নিতে হবে কঠোর ও বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা।

ঋণাত্মক ঋণ হিসাব কী ও কেন তৈরি হয়

২০১০ সালের ধসের আগে দেশের শেয়ারবাজারে বড় ধরনের বুদ্‌বুদ বা উল্লম্ফন দেখা দেয়। ওই সময় শেয়ারবাজার সম্পর্কে না জেনে না বুঝে হাজার হাজার মানুষ লাভের আশায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাতে শেয়ারের দাম ও লেনদেন ক্রমাগত বাড়তে থাকে। ফলে শেয়ারসূচক লাগামহীনভাবে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠে। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ব্যাপক আগ্রহের সুযোগ নিয়ে গ্যাম্বলার তথা কারসাজিকারকেরা তৎপর হয়ে ওঠেন। তাঁরা কারসাজির মাধ্যমে অনেক শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়েছেন। যার অনিবার্য ফল হিসেবে ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে ধস নামে। এই ধসের আগে অস্বাভাবিক উত্থানপর্বে ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোও যথাযথ বাছবিচার ছাড়াই শেয়ারের বিপরীতে বিনিয়োগকারীদের ‘মার্জিন লোন’ বা প্রান্তিক ঋণসুবিধা দেয়। কখনো নিয়মের মধ্যে থেকে আবার কখনো নিয়ম ভেঙে কয়েক গুণ বেশি ঋণসুবিধা দেওয়া হয় বিনিয়োগকারীদের। একসময় বাজারে ধস নামতে শুরু করে। তাতে শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক হারে কমতে থাকে এবং ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর দেওয়া বিপুল পরিমাণ ঋণ আটকে যায়।

এত দিনেও কেন শেয়ারবাজারের ঋণাত্মক ঋণ হিসাবের স্থায়ী কোনো সমাধান হলো না, সেটি এক বড় প্রশ্ন। যত দ্রুত সম্ভব এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান দরকার। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহ করে প্রয়োজনে সময় বেঁধে দিয়ে এসব অনাদায়ি ঋণ অবলোপনের ব্যবস্থা নিতে হবেফারুক আহমেদ সিদ্দিকী, সাবেক চেয়ারম্যান, বিএসইসি

এই ধসে পুঁজি হারিয়ে ও নিঃস্ব হয়ে ঋণগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের বড় অংশই বাজার ছেড়ে চলে যান। ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো পরে আর এসব বিনিয়োগকারীকে খুঁজে পায়নি। আবার ২০১০ সালের ধসের পর বাজারে পতন ঠেকাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘ফোর্সড সেল’ বা ‘জোরপূর্বক বিক্রি’ বন্ধ ঘোষণা করে। ফলে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রি করে অনাদায়ি ঋণ আদায়ে সময়মতো উদ্যোগ নিতে পারেনি।

বিষয়টি একটি উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যেতে পারে। ধরা যাক, একজন বিনিয়োগকারী ঋণযোগ্য কোনো এক কোম্পানির শেয়ার কিনতে নিজের ১০০ টাকার (ঋণসীমা ১ অনুপাত ২ হারে) বিনিয়োগের বিপরীতে ২০০ টাকা ঋণ নিয়ে মোট ৩০০ টাকা বিনিয়োগ করেন। তখন ওই শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল ১০০ টাকা। ফলে ওই বিনিয়োগকারী যেখানে নিজের বিনিয়োগের টাকায় একটি শেয়ার কেনার সামর্থ্য ছিল, সেখানে ২০০ টাকা ঋণসুবিধা পাওয়ায় তিনি তিনটি শেয়ার কিনতে সক্ষম হন। এভাবে ব্যাপক হারে শেয়ারের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু পরে যখন বাজারে ধস নামে, তখন শেয়ারের দাম নেমে আসে ৫০ টাকা বা তারও নিচে। তাতে ৩০০ টাকার তিনটি শেয়ারের দাম কমে হয় ১৫০ টাকা বা এর চেয়ে কম। তখন ওই শেয়ার ১৫০ টাকায় বিক্রি করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পক্ষে পুরো ঋণ আদায়ের সুযোগ ছিল না। অন্যদিকে বিনিয়োগকারীর নিজের ১০০ টাকার পুঁজির পুরোটাই লোকসানের খাতায় চলে যায়। উল্টো ঋণের আসল ও সুদ মিলিয়ে বড় দেনা তৈরি হয়। এ অবস্থায় অনেক বিনিয়োগকারী নিজের পুঁজি হারিয়ে আর বাজারমুখী হননি। এরই মধ্যে শেয়ারের দাম আরও কমে। তাতে ঋণাদাতা প্রতিষ্ঠানের অনাদায়ি ঋণের পরিমাণও সুদে–আসলে কাগজে–কলমে বাড়তে থাকে। এভাবে শেয়ারবাজারে বড় অঙ্কের ঋণাত্মক ঋণ বা মন্দ ঋণ বা নেগেটিভ ইকুইটির বোঝা ভারী হয়ে ওঠে।

বিএসইসি সূত্রে জানা যায়, দেশের শেয়ারবাজারে ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর মোট অনাদায়ি ঋণাত্মক ঋণের পরিমাণ ৯ হাজার কোটি টাকার বেশি। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক হিসাবমান নিয়ম অনুযায়ী, ঋণদাতা যেকোনো প্রতিষ্ঠানকে প্রতিবছর তার অনাদায়ি ঋণের বিপরীতে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রভিশনিং বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি হিসেবে সংরক্ষণ করতে হয়। সাধারণত প্রতিষ্ঠানের মুনাফা থেকে এই নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়। তাতে প্রতিষ্ঠানের মুনাফা কমে যায়। ২০১০ সালের পর শেয়ারবাজারে দীর্ঘ সময় ধরে মন্দাবস্থা চলে। তাতে ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর বড় অংশই মুনাফার দেখা পায়নি। ফলে তাদের পক্ষে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণের আর্থিক সামর্থ্যও ছিল না। এই অবস্থায় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির পক্ষ থেকে দফায় দফায় নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণে সময় বাড়িয়ে ছাড় দেওয়া হয়।

এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান দরকার। বছর বছর সময় বাড়িয়ে এই সমস্যার সমাধান হবে না। এ ছাড়া ঋণাত্মক ঋণ হিসাবের অনিয়ম রোধে তদারকি ব্যবস্থা জোরালো করতে হবে। তদারকির দুর্বলতার কারণেই আমরা বাজারে ঋণাত্মক ঋণ হিসাব নিয়ে নানা ধরনের অনিয়মের কথা শুনতে পাইসাইফুল ইসলাম, সভাপতি, ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশন (ডিবিএ)

ব্রোকারেজ হাউস মালিকদের সংগঠন ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ঋণাত্মক ঋণ হিসাবগুলোকে অবলোপনের বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য বিএসইসির কাছে আবেদন করেছি। আমরা মনে করি, এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান দরকার। বছর বছর সময় বাড়িয়ে এই সমস্যার সমাধান হবে না। এ ছাড়া ঋণাত্মক ঋণ হিসাবের অনিয়ম রোধে তদারকি ব্যবস্থা জোরালো করতে হবে। তদারকির দুর্বলতার কারণেই আমরা বাজারে ঋণাত্মক ঋণ হিসাব নিয়ে নানা ধরনের অনিয়মের কথা শুনতে পাই।’

ঋণাত্মক ঋণ যেভাবে অনিয়মের হাতিয়ার

এদিকে ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর বিপুল অনাদায়ি ঋণ অনেকের কাছে অনিয়মের হাতিয়ারে পরিণত হয়। লাভের আশায় অনেক প্রতিষ্ঠান এই সমস্যার সমাধানে উদ্যোগ না নিয়ে সময় বাড়ানোর চাপ তৈরি করার মাধ্যমে দেড় দশক ধরে সমস্যাটি জিইয়ে রেখেছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাও তাতে সহায়তা দিয়ে গেছে। অনাদায়ি ঋণ মূলত ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের দায়। তাই যে প্রতিষ্ঠানের এই দায় বেশি, সেটি তত দুর্বল হয়েছে। আর প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই ঋণের দায় বাড়িয়ে দুর্বল করার পেছনে কিছু কিছু কর্মকর্তারও ব্যক্তিগত স্বার্থ ছিল। তাঁরা এসব ঋণাত্মক ঋণ হিসাবকে নিজেদের স্বার্থে অনিয়মের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। কীভাবে সেটি করলেন তার একটি ধারণাভিত্তিক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।

ধরা যাক, কোনো একজন বিনিয়োগকারী ৫০ টাকা দামে একটি কোম্পানির শেয়ার কিনেছেন। পরে বাজারে সেই শেয়ারের দাম নেমে এসেছে ২০ টাকায়। এ রকম পরিস্থিতিতে ওই বিনিয়োগকারী ঋণদাতা ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকের দুর্নীতিগ্রস্ত কিছু কর্মকর্তার শরণাপন্ন হলেন। দুজনের মধ্যে একধরনের সমঝোতা হলো। বাজারমূল্যের চেয়ে কিছুটা বেশি দামে (যেমন ২৫ বা ২৭ টাকা) ওই বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে সেই শেয়ার কিনে নেন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব হিসাবে। বিনিময়ে ওই কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে শেয়ারপ্রতি নগদে নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ গ্রহণ করেন। তাতে বিনিয়োগকারী বাজারমূল্যের চেয়ে কিছু টাকা বেশি পান। অন্যদিকে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি করে নিজে নগদ অর্থ কামিয়ে নেন। পরে ওই সব শেয়ার নেগেটিভ ইকুইটি বা ঋণাত্মক ঋণ হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। এতে প্রতিষ্ঠানের অনাদায়ি ঋণের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পায় এবং আর্থিক সক্ষমতা কমে যায়। বেসরকারি মালিকানাধীন ব্রোকারেজ হাউস, মার্চেন্ট ব্যাংক, ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশেও (আইসিবি) এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। ফলে ২০১০ সালের পর থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের নেগেটিভ ইকুইটির বোঝা কেবলই বেড়েছে।

সমস্যার স্থায়ী সমাধান কী

বাজার–সংশ্লিষ্ট একটি পক্ষ বলছে, এখন আর শুধু নিরাপত্তা সঞ্চিতির সময় বাড়িয়ে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যাটির সমাধান করতে হলে সব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণাত্মক ঋণ হিসাবের পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। তারপর সেসব হিসাবকে ব্লক হিসাবে স্থানান্তরের মাধ্যমে এসব হিসাবে অনুমোদন ছাড়া শেয়ার কেনাবেচা বন্ধ রাখতে হবে। এরপর প্রতিষ্ঠানভেদে সুনির্দিষ্ট তথ্য–উপাত্তের ভিত্তিতে এসব অনাদায়ি ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় সময়সীমা বেঁধে দিয়ে ধাপে ধাপে প্রভিশনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এ–ও বলছেন, ব্যাংকে যে পন্থায় খেলাপি ঋণ অবলোপন বা রাইট অফ করা হয়, শেয়ারবাজারেও সেই পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে কিছু কিছু অনাদায়ি ঋণের ক্ষেত্রে। কারণ, এসব ঋণ আদায়ের বাস্তব সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। অনেক বিনিয়োগকারীকে এখন আর খুঁজে পাওয়াও যাবে না। আবার শেয়ারবাজারে ঋণের ক্ষেত্রে শেয়ার ছাড়া আর কোনো জামানতও থাকে না। ফলে হয় শেয়ার বিক্রি করে এসব অনাদায়ি ঋণ সমন্বয় করতে হবে ধাপে ধাপে, অন্যথায় অবলোপনের পথে যেতে হবে। এটি করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো যেন নতুন করে আর ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে জন্য সরকারি কিছু নীতি সহায়তাও দিতে হবে।

সর্বশেষ বিএসইসি সময় বাড়ানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে ঋণাত্মক ঋণ হিসাবের প্রভিশনিংয়ের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে আলাদা কর্মপরিকল্পনা তৈরির শর্তারোপ করা হয়েছে। সেই শর্ত পরিপালনের মাধ্যমে শেয়ারবাজারের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান যেন হয়, সেটিই প্রত্যাশা বাজার অংশীজনদের। কারণ, এই সমস্যার স্থায়ী নিরাময় চায় বাজার–সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ। আর সেই নিরাময়ে বিএসইসিকে চিকিৎসকের ভূমিকায় থেকে সুচিন্তিত ও বাস্তবভিত্তিক কার্যকর সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে।

জানতে চাইলে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, এত দিনেও কেন শেয়ারবাজারের ঋণাত্মক ঋণ হিসাবের স্থায়ী কোনো সমাধান হলো না, সেটি এক বড় প্রশ্ন। যত দ্রুত সম্ভব এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান দরকার। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহ করে প্রয়োজনে সময় বেঁধে দিয়ে এসব অনাদায়ি ঋণ অবলোপনের ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রতিষ্ঠানভেদে ও ক্ষতির পরিমাণ বিবেচনায় নিয়ে সমাধান করতে হবে। আর এসব হিসাবে অনিয়ম রোধেও কার্যকর পদক্ষেপ দরকার।

সম্পর্কিত নিবন্ধ