ঐকমত্য কমিশন: সংস্কারের বিষয়ে মতামত চেয়ে দলগুলোকে চিঠি
Published: 6th, March 2025 GMT
ছয়টি সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোর বিষয়ে মতামত চেয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ‘স্প্রেড শিট’ পাঠিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। আগামী ১৩ মার্চের মধ্যে দলগুলোকে মতামত জানানোর অনুরোধ করা হয়েছে। মতামত পাওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাদাভাবে আলোচনা শুরু করবে কমিশন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের সই করা চিঠি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছে। চিঠির সঙ্গে ছয়টি সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোর সারসংক্ষেপ স্প্রেডশিটে ছক আকারে দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি সুপারিশের ক্ষেত্রে দুটি বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়েছে। প্রথমটি হলো—সংশ্লিষ্ট সুপারিশের বিষয়ে একমত কি না। এতে তিনটি বিকল্প রাখা হয়েছে। সেগুলো হলো—‘একমত’, ‘একমত নই’ এবং ‘আংশিকভাবে একমত’। এ তিনটি বিকল্পের যেকোনো একটিতে টিক চিহ্ন দিয়ে মতামত জানাতে বলা হয়েছে।
দ্বিতীয়তটি হলো, প্রতিটি সুপারিশের বিষয়ে সংস্কারের সময়কাল ও বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে মতামত চাওয়া হয়েছে। এই ক্ষেত্রে ছয়টি ঘর রয়েছে। সেগুলো হলো: সংস্কারের সময়কাল ও বাস্তবায়ন—‘নির্বাচনের আগে অধ্যাদেশের মাধ্যমে’, ‘নির্বাচনের আগে গণভোটের মাধ্যমে’, ‘নির্বাচনের সময় গণভোটের মাধ্যমে’, ‘গণপরিষদের মাধ্যমে’ ‘নির্বাচনের পরে সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে’ এবং ‘গণপরিষদ ও আইনসভা হিসেবে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে’। এসব ঘরের যেকোনো একটিতে টিক চিহ্ন দিয়ে মতামত দিতে বলা হয়েছে। এর বাইরে প্রতিটি সুপারিশের পাশে দলগুলোর ‘মন্তব্য’ দেওয়ার একটি জায়গা রাখা হয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সমন্বয়ের কাজটি করছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য) মনির হায়দার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মতামত চেয়ে বার্তাবাহক মারফত ৩২টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে ‘স্প্রেডশিট’ পাঠানো হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার সকালের মধ্যে সবার কাছে স্প্রেডশিট পৌঁছেছে বলে তাঁরা জেনেছেন। আগামী ১৩ মার্চের মধ্যে দলগুলোকে মতামত দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
বিএনপি সূত্র জানায়, তারা ঐকমত্য কমিশনের দেওয়া চিঠি পেয়েছে। দলীয় বৈঠকে আলোচনা করে সংস্কার-সংক্রান্ত মতামত জানাবে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও আজ বৃহস্পতিবার এই সংক্রান্ত চিঠি পেয়েছে বলে দলটির কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ প্রথম আলোকে জানিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যেসব সুপারিশের বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক ঐকমত্য ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ, দায়িত্ব ও ক্ষমতা এবং স্বার্থের দ্বন্দ্ব স্পষ্টীকরণ ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি আইন প্রণয়ন করা; একটি স্থায়ী জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনসহ সব সাংবিধানেক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেওয়া; প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সর্বোচ্চ দুই মেয়াদে সীমিত করা; দুইবার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের অযোগ্য করা; একই ব্যক্তি একই সঙ্গে যাতে দলীয় প্রধান, প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ নেতা হতে না পারেন তার বিধান করা; ১০০টি আসন নিয়ে সংসদের উচ্চকক্ষ সৃষ্টি করা; উচ্চকক্ষে আনুপাতিক পদ্ধতিতে আসন বণ্টন; বিরোধী দলকে সংসদের ডেপুটি স্পিকারের পদ দেওয়া; সরাসরি ভোটে ৪০০ প্রতিনিধির সমন্বয়ে সংসদের নিম্নকক্ষ গঠন; যার মধ্যে নিম্নকক্ষের ১০০ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত রাখা এবং সেগুলোতে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে সরাসরি ভোট করা; দলনিরপেক্ষ, সৎ, যোগ্য ও সুনামসম্পন্ন ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিধান করা; জাতীয় সংসদের উভয় কক্ষের সদস্য এবং স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে বৃহত্তর নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন; জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করা; নির্বাচন কমিশনকে দায়বদ্ধ করা; মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখতে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধন করা ইত্যাদি।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকারের অন্যতম লক্ষ্য দেশের বিভিন্ন খাতে সংস্কার আনা। এ লক্ষ্যে সংস্কার প্রস্তাব তৈরির জন্য গত বছরের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ, দুর্নীতি দমন কমিশন ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গঠন করে সরকার। গত ফেব্রুয়ারি মাসে এই ছয়টি কমিশন তাদের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এসব কমিশনের প্রধানদের নিয়ে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করে সরকার। ঐকমত্য কমিশন বলেছে, রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার কমিশনের যেসব সুপারিশে একমত হবে, সেগুলোর ভিত্তিতে তৈরি হবে ‘জুলাই চার্টার’ বা জুলাই সনদ।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
নির্বাচন ডিসেম্বরের পরে নিলে সেটার কারণ ব্যাখ্যা করতে হবে: জোনায়েদ সাকি
জাতীয় নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যে সময়সীমার কথা বলেছেন, তা আরও নির্দিষ্ট হওয়া দরকার বলে মনে করছেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি। তিনি বলেন, ডিসেম্বরের পরে যদি নির্বাচন নিতে হয়, তাহলে কী কারণে, সেটি ব্যাখ্যা করতে হবে।
আজ রোববার সকালে জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে গণসংহতি আন্দোলনের বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে দুপুরে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন জোনায়েদ সাকি।
জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘অন্য উপদেষ্টারাও বলেছেন এই টাইমলাইনের বাইরে তাঁরা যাচ্ছেন না। আমরা যেটা বলেছি, এই টাইমলাইন আরও নির্দিষ্ট হওয়া দরকার এবং আলোচনার মধ্য দিয়ে হওয়া দরকার। ফলে অংশীদারিদের সঙ্গে তাঁরা বসবেন আশা করি এবং বসে ঠিক করবেন কবে নির্বাচন হবে। ডিসেম্বরের পরে যদি নির্বাচন নিতে হয়, তাহলে কী কারণে নিচ্ছে, সেটি ব্যাখ্যা করতে হবে।’
জোনায়েদ সাকি বলেন, সংস্কার পরিষদ কিংবা সংস্কার সভা করতে হবে জনগণের ম্যান্ডেট (মতামত) নেওয়ার জন্য। এখন অনেকে বলছেন সংবিধান এবং সংবিধান সংক্রান্ত সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নির্বাচনের আগে না পরে হবে; আগে করার সুযোগ নেই। এটা জনগণের ম্যান্ডেড এবং একটা সংসদ ছাড়া আপনি সংবিধান বদলাতে পারবেন না। সংবিধান এবং সংবিধান সংশ্লিষ্টের বাইরে অন্যান্য প্রশাসনিক যে বিষয়গুলো আছে, সেগুলো অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাহী আদেশে করতে পারে। পরবর্তী সংসদ এবং সরকার সেগুলোকে জাস্টিফাই (ন্যায্যতা) করবে।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের বিষয়ে জোনায়েদ সাকি বলেন, আস্থা ভোট ও বাজেট—এ দুই বিষয় বাদে সব বিষয়ে যাতে সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারেন, সেই সুযোগ রেখে ৭০ অনুচ্ছেদ সংস্কারের কথা আমরা বলেছি। আমরা মনে করি, এটি ক্ষমতাকাঠামোর ভারসাম্য এবং সংসদকে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বিভিন্ন বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে গণসংহতি আন্দোলনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের এবং বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলাপ–আলোচনা করা হবে।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনের কথা বলা হয়েছে উল্লেখ করে গণসংহতি আন্দোলনের নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল বলেন, এখন কোনো কাজই রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি ছাড়া করতে পারেন না। আমরা চাই, এই জায়গা থেকে সরে গিয়ে রাষ্ট্রপতিকে নির্দিষ্ট করে বেশ কিছু নিয়োগের ক্ষমতা প্রদান করা হোক, তাঁকে অনেকগুলো কাজের ক্ষমতা প্রদান করা হোক। এ বিষয়গুলো এখনো আলাপ–আলোচনার ভেতরে আছে। সামগ্রিকভাবে আইন, নির্বাহী ও বিচার বিভাগে একটা ভারসাম্য তৈরির ব্যবস্থা যাতে সংবিধানে থাকে সে দাবি জানানো হয়েছে।
গণসংহতি আন্দোলন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ১৩৮টি প্রস্তাবে একমত, ১১টি প্রস্তাবে দ্বিমত, ১৩টি প্রস্তাবে আংশিক একমত এবং ৪টি বিষয়ে কোনো মতামত দেয়নি।
অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বে আলোচনায় অংশ নেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ইফতেখারুজ্জামান, সাবেক বিচারপতি এমদাদুল হক ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য) মনির হায়দার।
বৈঠকে গণসংহতি আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল, রাজনৈতিক পরিষদ সদস্য দেওয়ান আবদুর রশিদ, তাসলিমা আখতার, হাসান মারুফ রুমি, মনির উদ্দিন পাপ্পু, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য বাচ্চু ভূঁইয়া, জুলহাসনাইন বাবু, শ্যামলী সরকার, ইমরাদ জুলকারনাইন, তরিকুল সুজন, মুরাদ মোর্শেদসহ কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিরা।সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য বাচ্চু ভূঁইয়া, জুলহাসনাইন বাবু প্রমুখ।