খালেদা জিয়ার ভাষণ যে পার্থক্য দেখাল
Published: 6th, March 2025 GMT
বিএনপির বর্ধিত সভায় দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বক্তব্য বড় চমক হিসেবে দেখা যায়। খালেদা জিয়া ভাষণ দেবেন, এটা তেমন প্রচার করা হয়নি। সাধারণ মানুষের মধ্যে এ নিয়ে আলোচনা খুব বেশি ছিল না। অনেকেই মনে করেছিলেন, বর্ধিত সভায় দলের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। নির্বাচন, দলের অভ্যন্তরীণ বিষয় ও সরকারের আলোচনা–সমালোচনা করার গতানুগতিক সভা হবে। যদিও এই বর্ধিত সভার দিকে আগ্রহী সবাই দৃষ্টি রেখেছিলেন।
খালেদা জিয়ার ভাষণ বর্ধিত সভাকে যেন বিএনপির নিজস্ব কর্মসূচির গণ্ডি থেকে বের করে একধরনের জনগণের অনুষ্ঠানে পরিণত করল। সারা দেশের মানুষ দিনভর খালেদা জিয়ার ভাষণ নিয়ে আলোচনা করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বিস্তর আলাপ হয়েছে খালেদা জিয়ার ভাষণ নিয়ে।
খালেদা জিয়া ছয় বছর পর দলীয় নেতা–কর্মীদের সামনে কথা বললেন। কিন্তু এমন না যে এর আগে দেশের মানুষ খালেদা জিয়ার ভাষণ শুনেননি। ১৯৮২ সালের ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করে প্রথম রাজনৈতিক বক্তব্য দেন খালেদা জিয়া। ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে দলের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হন। এপ্রিল মাসে দলের বর্ধিত সভায় বক্তব্য প্রদান করেন। এরপর তিনি মাঠে–ময়দানে অজস্র বক্তব্য দিয়েছেন।
কিন্তু খালেদা জিয়ার এবারের বক্তব্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে। খালেদা জিয়া তাঁর বক্তব্যে একবারের জন্যও পুরো রাজনৈতিক জীবনের প্রতিপক্ষ শেখ হাসিনার নাম উচ্চারণ করেননি। এমনকি আওয়ামী লীগের নামও বলেননি। প্রচণ্ড দমন, নির্যাতন, বাড়ি থেকে উচ্ছেদ, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা ও জেলে ঢোকানোর পরও খালেদা জিয়া শেখ হাসিনার নাম মুখেই আনলেন না। ভয়ংকর এক নির্যাতনের কাল অতিক্রম করার পর এ ধরনের বক্তব্য বা অত্যাচারীর নাম মুখে না আনা এককথায় বিস্ময়কর।
খালেদা জিয়া তাঁর রাজনৈতিক জীবনে দেশকে শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরে ছিলেন। বাংলাদেশের বিষয়ে তাঁকে কখনোই টলানো যায়নি। খালেদা জিয়া রাজনৈতিক চরিত্র ও নেতৃত্বের বিশ্লেষণ আমাদের রাজনীতির গুণাগুণের পাঠোদ্ধারে ঋদ্ধ করবে।খালেদা জিয়ার জায়গায় শেখ হাসিনা থাকলে ভাষণ কী রকম হতো বা শব্দচয়ন কোন পর্যায়ের হতো, তা সহজেই অনুমান করা যায়। গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনা অত্যন্ত অশোভন ভাষায় খালেদা জিয়াকে বারবার আক্রমণ করেছেন। শেখ হাসিনা এমনো বলেছেন, ‘এই মরে মরে, এই যায় যায়। বয়স তো আশির ওপরে। মৃত্যুর সময় হয়ে গেছে। এত কান্নাকাটি করে তো লাভ নাই।’ কোনো দায়িত্বশীল রাজনীতিবিদের ভাষা এমন হতে পারে না।
শেখ হাসিনার শাসনামলে জেল, জুলুম, লাঞ্ছনা ও অবমাননার স্বীকার হয়েও খালেদা জিয়া বিচারের দায়ভার দেশ ও জনগণের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন, বরং তিনি জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে খালেদা জিয়ার সীমাবদ্ধতা নিশ্চয়ই ছিল। তবে মানুষ হিসেবে তিনি শোভন রুচির প্রমাণ দিয়েছেন পুরো ভাষণে নিজের ওপর দিয়ে যাওয়া ভয়াবহ নির্যাতনের কথা উল্লেখ না করে। তিনি কাউকে দোষারোপ করেননি। কাউকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেননি।
ভাষণের সময় খালেদা জিয়ার অভিব্যক্তি দেখে মনে হয়েছে রোগ, শোক তাঁকে কাবু করতে পারেনি। তিনি আগের মতোই দৃঢ় ও অনঢ়। মূলত খালেদা জিয়ার অনঢ় অবস্থান, অনমনীয় মনোভাব, শেষ পর্যন্ত লড়াই করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও জনগণের পাশে থাকার কৌশলই তাঁকে অন্যদের থেকে এগিয়ে দিয়েছে।
খালেদা জিয়ার ক্যারিশমার কারণেই বিএনপি ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল। এরপর ২০০১ সালের নির্বাচনেও বিএনপি জোট গঠন করে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়ার দল বিএনপি হেরে যায়। এরপর দলের ওপর বিপর্যয় নেমে আসে। দমন–পীড়নের শিকার হয় দলটি। খালেদা জিয়াকে জেলে যেতে হয় অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায়। যে কারণে তিনি ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি।
নানা উত্থান–পতনের মধ্য দিয়ে ১৯৮১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪–এর আগস্ট বিপ্লব পর্যন্ত খালেদা জিয়া দীর্ঘ ও ঘটনাবহুল রাজনৈতিক পথ অতিক্রম করেছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। জেলে গিয়েছেন দুইবার। রাজনীতিতে উত্থান–পতনের মধ্য দিয়ে নিজস্ব নেতৃত্বের ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছেন।
খালেদা জিয়ার রাজনীতির নিজস্ব একটি ধারা আছে। তাঁর নেতৃত্বে আছে গাম্ভীর্য, প্রজ্ঞা ও কৌশলের মিশ্রণ। ৩৬ বছর বয়সে স্বামীকে হারিয়ে দুই কিশোর সন্তানকে নিয়ে রাজনীতির মাঠে নেমেছিলেন খালেদা জিয়া। নিজে নেতৃত্ব দিয়ে বাহুধারায় বিভক্ত বিএনপিকে দুইবার ব্যালটের রাজনীতিতে জয়ী করেছেন। একাধিকবার দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য চাপ এসেছিল। কিন্তু দেশের বাইরে যেতে রাজি হননি তিনি।
রাজনীতিবিদদের জীবনে দুই ধরনের পাঠই থাকে। সফলতা ও ব্যর্থতা। আলোচনা ও সমালোচনাও থাকে। তা খালেদা জিয়াকে নিয়েও আছে। তবে খালেদা জিয়াকে কোনোভাবেই সমালোচনার কাঠামোর মধ্যে আটকে রেখে দেওয়া যায় না। ক্ষমতার রাজনীতিতে এ দেশের মানুষ খালেদা জিয়াকে দুহাতে আগলে রেখেছে। রাজনীতি থেকে খালেদা জিয়ার অর্জন বিশাল। কেড়ে নিয়েছে অনেক কিছুই। কিন্তু তার গাম্ভীর্য কেড়ে নিতে পারেনি।
বিতর্কিত জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন করে খালেদা জিয়া আদালতে দেওয়া বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘বারবারই প্রমাণ হয়েছে যে বাংলাদেশ ও এ দেশের জনগণের ভাগ্যের সঙ্গে আমার নিজের ও আমার পরিবারের ভাগ্য একসূত্রে গাঁথা হয়ে গেছে।’
খালেদা জিয়া তাঁর রাজনৈতিক জীবনে দেশকে শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরে ছিলেন। বাংলাদেশের বিষয়ে তাঁকে কখনোই টলানো যায়নি। খালেদা জিয়া রাজনৈতিক চরিত্র ও নেতৃত্বের বিশ্লেষণ আমাদের রাজনীতির গুণাগুণের পাঠোদ্ধারে ঋদ্ধ করবে।
ড.
মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত র র র জন ত র জন ত ক জনগণ র কর ছ ন র ওপর ব এনপ
এছাড়াও পড়ুন:
জনআকাঙ্ক্ষার সংস্কার উদ্যোগ, বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ
ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষার দেশ বিনির্মাণে বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্রের সংস্কার অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী দেশের সিংহভাগ মানুষ সংস্কারের পক্ষে। দেশ পুনর্গঠনের লক্ষ্যে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে দেশের পুলিশ, প্রশাসন, আইন, বিচার, আর্থিক খাত, নির্বাচন, গণমাধ্যম প্রভৃতি ক্ষেত্র সংস্কারের উদ্দেশ্যে কমিশন গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বেশির ভাগ কমিশন তাদের প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে এগুলোর ওপর ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়েছে। সেই কমিশন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের উদ্দেশ্য হচ্ছে সব রাজনৈতিক দল ও সমাজের নানা পেশার মানুষের মতামত নিয়ে একটি জুলাই-আগস্ট চার্টার্ড তৈরি করা; পরবর্তীকালে রাজনৈতিক সরকার এর পূর্ণ বাস্তবায়ন করবে এবং মেনে চলবে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশীজনের কাছ থেকে কখনও প্রকাশ্যে আবার কখনও অপ্রকাশ্যে এবং নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে চলমান সংস্কার উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। যেমন সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া, এটি করার অধিকার শুধু রাজনৈতিক সরকারের। সুতরাং আগে নির্বাচন দিতে হবে। কোনো কোনো মহল বলছে, যারা সংস্কার কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত তারা দেশের নাগরিক নন। ফলে তাদের প্রস্তাবকৃত সংস্কার মানা হবে না। আবার কেউ কেউ বলছেন, সংস্কারের নামে নির্বাচন পেছানোর পাঁয়তারা করা হচ্ছে। দেশের জনগণ তা মানবে না, দ্রুত জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে। আজ এই লেখায় মূলত আলোচনা করতে চেষ্টা করব রাষ্ট্র সংস্কারের সুফলভোগী মূলত কে বা কারা। একই সঙ্গে দেখতে চেষ্টা করব চলমান সংস্কার কার্যক্রমের প্রধান প্রধান অংশীজন কারা এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় কী কী?
প্রথম কথা হলো, রাষ্ট্র সংস্কারের প্রথম এবং প্রধান সুবিধাভোগী এ দেশের সাধারণ জনগণ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কে এই সাধারণ জনগণ? সেই জন সাধারণ জনগণ, যারা ক্ষেত-খামারে, অফিসে, শিল্পকারখানায়, জলে ও স্থলে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কোনো রাজনৈতিক দলের লাঠিয়াল বাহিনীর কাজ করেন না। তারা রাষ্ট্রের কাছ থেকে অতিরিক্ত এবং ব্যক্তিগত কোনো সুযোগ-সুবিধা প্রত্যাশা করেন না। তারা যা প্রত্যাশা করেন তা হলো, তাদের উৎপাদিত ফসল ও শ্রমের ন্যায্য মূল্য, মানুষ হিসেবে যথাযথ সম্মান, নিজস্ব মতামত ও ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার, নিজ নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা, সন্তানের শিক্ষার সুযোগ, স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা।
অন্য যেসব অংশীজন রয়েছে, তার মধ্যে আছে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, বিভিন্ন ব্যবসায়ী সমিতি, পরিবহন সমিতি, সংঘ, ক্লাব, পেশাজীবী সংগঠন ইত্যাদি। এদের আবার নিজস্ব সুযোগ-সুবিধার আলোকে রাষ্ট্রকে দেখার এবং ব্যবহারের নজির রয়েছে। মূলত রাষ্ট্র সংস্কারের প্রথম বাধাগুলো এখান থেকেই আসছে। প্রথমেই আলোচনা করা যাক, রাজনৈতিক দলের দৃষ্টিতে তারা কতটুকু রাষ্ট্র সংস্কারের পক্ষে? প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব দর্শন ও কর্মপরিকল্পনা থাকে। দলগুলো রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার আগে মুখে মুখে জনগণের কথা বললেও ক্ষমতায় যাওয়ার পর রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী হয়ে ওঠেন একেকজন একেকটি এলাকার প্রধান। তাঁর কথাই আইন। তিনি যা বলবেন এলাকার লোক তা মানতে বাধ্য। না মানলে নানা মাত্রায় হামলা, মামলা ও জেল-জুলুম নেমে আসে। অন্তত স্বাধীনতা পরবর্তী বছরগুলো থেকে সর্বশেষ জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের আগের অভিজ্ঞতার আলোকে এটা নিশ্চিত করে বলাই যায়। মূলত ব্যক্তিগত এবং গোষ্ঠীস্বার্থের কারণে দলগুলো রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার পর তাদের আচরণ জনমতের বিরুদ্ধে যেতে থাকে। অন্যদিকে দলগুলোর ভেতরে আর গণতান্ত্রিক চর্চা না হওয়াও একটি কারণ।
অন্য যেসব অংশীজন রয়েছে যেমন– বিভিন্ন ব্যবসায়ী সমিতি বা সংঘ, তারাও সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিজের ব্যবসায়ী স্বার্থসিদ্ধির জন্য সরকারি দলের লেবাসে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। দলগুলোও তাদের সহযোগিতা করে। কারণ এরাই দলের ফান্ডে যত চাঁদা তার সিংহভাগ সরবরাহ করেন। ফলে ব্যবসায়ীরা সরকারের কাছ থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়ে জনগণের পকেট কেটে তা দেশে-বিদেশে পাচার করে আরাম-আয়েশে জীবন কাটান। রাষ্ট্র সংস্কারের ফলে যদি কেউ বর্তমানে যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন সেগুলো কমে যায় বা প্রশ্নের মুখে পড়ে তাহলে সেই সংস্কারের পক্ষে কেন তিনি দাঁড়াবেন! সুতরাং বাধা এখান থেকেও আসছে– হোক তা প্রকাশ্যে অথবা অপ্রকাশ্যে।
আরও একটি অংশীজন হলো প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তারা তো রাষ্ট্রের কর্মচারী। তারা কেন রাষ্ট্র সংস্কারের বিরোধী হবেন? হওয়ার নানা কারণ রয়েছে। প্রথমত, তারা রাষ্ট্রের কর্মচারী ও জনগণের করের টাকায় তাদের বেতন-ভাতা হয় এবং তাদের প্রধান কাজ জনগণকে সেবা দেওয়া– কথাটা তাদের মাথায় নেই। তারা জনগণের সেবক না হয়ে ইতোমধ্যে জনগণের কর্তারূপে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। তাই যেখানে রাষ্ট্রের একজন কর্মচারী হয়ে এ দেশের প্রত্যেক মানুষকে স্যার বলার কথা, কিন্তু ঘটনা ঘটেছে উল্টো; জনগণকেই তারই টাকায় যাঁর বেতন-ভাতা হয়, তাঁকে স্যার বলতে বাধ্য হতে হয়। রাজনীতিতে যেমন জবাবদিহির অভাব ঘটেছে, তেমনি সরকারি চাকরির ক্ষেত্রও অনেকটা জবাবদিহির বাইরে চলে গেছে। ফলে সমাজে দুর্নীতি বেড়েছে। ভন্ড রাজনীতিক, অসৎ ব্যবসায়ীদের মতো দেশের অর্থ পাচার করে সরকারি কর্মচারীদেরও বিদেশের বেগমপল্লিতে বাড়ি-গাড়ির তথ্য বেরিয়ে আসছে।
এখন রাষ্ট্র সংস্কারের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো দেশ থেকে দুর্নীতি কমানো ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। সত্যি সত্যিই যদি রাষ্ট্র সেদিকে অগ্রসর হয়, তাহলে যারা এতদিন অনৈতিক সুবিধা নিয়ে আসছেন, তাদের সেই সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে এবং জবাবদিহির মধ্যে পড়তে হবে। কে চায় তাঁর সোনার সংসারে এমন আগুনের তাপ এসে লাগুক! সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই তারা এসব সংস্কার উদ্যোগে সহযোগিতা করবেন না, এটা পরিষ্কার। ইতোমধ্যে কিছু ক্ষেত্রে সেই আলামত দেখাও গিয়েছে। পুলিশ কাজ করছে না ঠিকমতো, প্রশাসনে অস্থিরতা বিরাজ করছে, সরাকারি নির্দেশ যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে না। মোট প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের মধ্যে যে ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধার সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে, তা প্রশ্নের মুখে পড়বে চলমান সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়িত হলে। তাই এই সংস্কারে তাদের সহযোগিতা খুব যে পাওয়া যাবে তা আশা করা যায় না।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, বিভিন্ন সমিতি, সংঘ, পেশাজীবী সংগঠন সবাই সংগঠিত এবং অনৈতিক সুবিধা নিয়ে আরামের সাম্রাজ্যে বসবাস করছে। তারা কোনো কালে জনগণের সুযোগ-সুবিধার কথা বিবেচনা করে বিশেষ কিছু করেছেন এমন নজির খুব কম। এমন পরিস্থিতিতে দেশের চলমান সংস্কার উদ্যোগে তারা পরিপূর্ণ সহযোগিতা করবেন এমনটা আশা করা ভুল। সুতরাং এ জাতির সামনে কি কোনো মুক্তির পথ নেই? কেউ কি নেই, যে এ জাতির মুক্তির ত্রাতা হয়ে উঠতে পারেন। হয়তো আছেন অথবা নেই। এর জন্য একটি শক্তিশালী জনগণকেন্দ্রিক রাজনৈতিক শক্তিই পারে এ দেশের সাধারণ মানুষের মুক্তির পথ খুলে দিতে। কিন্তু সেই রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা দল কোথায়? আপাতত অপেক্ষা ছাড়া ভাগ্যহত এ জাতির সামনে দ্বিতীয় বিকল্প কি দেখা যাচ্ছে?
মো. সাইফুজ্জামান: শিক্ষাবিষয়ক উন্নয়নকর্মী
shakdip@gmail.com