ধলাই নদীতীরে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জে বছরের পর বছর পাথর ডাম্পিং ও ক্রাশিং করে আসছিলেন ব্যবসায়ীরা। সরকারি জায়গা দখল করে তারা সেখানে গড়ে তোলেন ক্রাশিং মেশিন ও স্থাপনা। হঠাৎ ঘটে ছন্দপতন। ২০১৯ সালে ভোলাগঞ্জ শুল্ক স্টেশনকে দেশের ২৪তম স্থলবন্দর হিসেবে ঘোষণা করার পর উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। অধিগ্রহণ শেষে গত বছর কাজও শুরু করে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ। তবে গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন ভোলাগঞ্জ স্থলবন্দরের নির্মাণ সামগ্রী লুটপাট হয়। ভেঙে ফেলা হয় পাশের পর্যটনের জায়গার সীমানা প্রাচীর। 

সম্প্রতি ভোলাগঞ্জ স্থলবন্দরের কাজ শুরু হলেও পর্যটনের জায়গাটি থেকে গেছে উন্মুক্ত। বারবার বাধাগ্রস্ত হওয়ার পরও কাজ যখন এগিয়ে চলছে, তখন বন্দরের অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধে বিরোধিতা করে মাঠে নামেন ভোলাগঞ্জ চুনাপাথর আমদানিকারক গ্রুপের কয়েক সদস্য। গত ২২ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলনে তারা স্থলবন্দরের অবকাঠামো বন্ধসহ শ্রমিক-ব্যবসায়ীর ক্ষতিপূরণ দাবি করে জানান, বাংলাদেশ অংশে স্থলবন্দর হলেও ভারত অংশে স্থাপনা নেই। একপেশে বন্দর হতে পারে না। লুটপাটের জন্যই আওয়ামী লীগ সরকার ১৭৫ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়।

তথ্য বলছে, স্থলবন্দর ঘোষণার আগে শুল্ক স্টেশন ও পর্যটনের জায়গা উন্মুক্ত থাকা অবস্থায় যারা জায়গা দখল করে ব্যবসা করে আসছিলেন, উচ্ছেদ হওয়ার পর তারাই এখন বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। জায়গা থেকে উচ্ছেদ ও অধিগ্রহণের পর সেসব ব্যবসায়ী ও শ্রমিক-মালিকরা এখন চাচ্ছেন না স্থলবন্দর হোক। তারা শুল্ক স্টেশন হিসেবে দেখতে চাচ্ছেন ভোলাগঞ্জকে। যদিও বন্দর নির্মাণকাজে সরাসরি কোনো বাধা তারা দিচ্ছেন না। এর নেপথ্যে রয়েছেন ভোলাগঞ্জ চুনাপাথর আমদানিকারক গ্রুপ ও উপজেলা বিএনপি সভাপতি মো.

শাহাব উদ্দিন। তিনি গত ২৯ জানুয়ারি স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত আবেদন ছাড়াও ২২ ফেব্রুয়ারি সিলেটে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম, কোষাধ্যক্ষ আব্দুস সালাম বাবুলসহ কয়েকজন।  

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ভোলাগঞ্জ স্থলবন্দরের জমিসহ ১১২ একর সরকারি জায়গা সেখানে ছিল। বন্দর নির্মাণের কাজ শুরুর আগে সেই জায়গা বিএনপি নেতা শাহাব উদ্দিনসহ কয়েকজন ব্যবসায়ীর দখলে ছিল। তারা পাথর ব্যবসায়ীর কাছে ভাড়া দিয়ে আসছিলেন। উচ্ছেদের পর সেখানকার ৫২ একর জায়গাজুড়ে স্থলবন্দর নির্মাণে কাজ শুরু হলে তারা সেই আয় থেকে বঞ্চিত হন। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন স্থলবন্দরের নির্মাণসামগ্রী লুটসহ রাস্তার অন্য পাশে পর্যটনের জায়গার সীমানা প্রাচীর ভেঙে ফেলা হয়। অভিযোগ ওঠে, লুটপাট-ভাঙচুরের সঙ্গে আগে সুবিধা পাওয়া পাথর ব্যবসায়ী ও আমদানিকারক নেতাদের হাত ছিল।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভোলাগঞ্জ-১০ নম্বর ঘাটের এক পর্যটন ব্যবসায়ী জানান, সরকার পতনের পর ভোলাগঞ্জ স্থলবন্দরের জায়গা দখল না করতে পারলেও পাশের পর্যটন কেন্দ্রের ৫০-৬০ একর জায়গা দখল করে পাথর ব্যবসা করা হচ্ছে, যাদের দখলে আগেও ওই জায়গা ছিল। তিনি জানান, অতীতে যারা সরকারি জায়গা দখল করে ব্যবসা ও ভাড়া খেয়েছেন, তারাই এখন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন।

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, গত ১৭ ডিসেম্বর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন ভোলাগঞ্জ স্থলবন্দরের উন্নয়ন কার্যক্রম পরিদর্শন করেন। তিনি অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ ও ৫ আগস্ট স্থলবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পসহ নানা স্থাপনার ক্ষতিসাধন ও লুটপাটকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিলেও তা কার্যকর হয়নি। 

অভিযোগ বিষয়ে বিএনপি সভাপতি শাহাব উদ্দিন বলেন, সেখানে আমার ব্যক্তিগত কোনো লাভ নেই। শুল্ক স্টেশন দিয়ে যে কাজ পরিচালনা করা যেত, সেখানে একপেশে স্থলবন্দর করে সরকারের কোটি কোটি টাকার ক্ষতি করা হচ্ছে। আমরা সে বিষয়টি তুলে ধরেছি। জায়গা দখল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শুধু আমার নয়; অনেকে জায়গা সেখানে ছিল। সরকারি জায়গাও ছিল। উচ্ছেদ করে স্থলবন্দর করা হচ্ছে। আমরা বাধা দিচ্ছি না; দাবি করেছি। মানা-না মানা সরকারের বিষয়। 

এ ব্যাপারে ভোলাগঞ্জ স্থলবন্দরের প্রকল্প পরিচালক সারোয়ার আলম বলেন, এখন চুনাপাথর আমদানি হলেও ভবিষ্যতে রপ্তানির পরিকল্পনা রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে কাজ চলছে; নির্মাণকাজ বন্ধের সুযোগ নেই। কাজ শেষ হলে শুধু রাজস্ব বাড়বে না; এলাকার পরিবেশও বদলে যাবে। 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব যবস য় র প রকল প সরক র আমদ ন

এছাড়াও পড়ুন:

অর্থের অপচয়, ফল পেল না রাষ্ট্র

চুনারুঘাট উপজেলার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নতুন সম্ভাবনা হয়ে সামনে এসেছিল কেদারাকোর্টে অবস্থিত বাল্লা স্থলবন্দর। স্থানীয় ব্যবসায়ী ও বাসিন্দাদের আশা ছিল, বদলে যাবে এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি। অন্যান্য বন্দর এলাকার মতো কেদারাকোর্টেও বাড়বে কর্মসংস্থান। তবে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের অসহযোগিতায় সে স্বপ্ন ভাঙার দ্বারপ্রান্তে।
ব্যবসায়ী ও স্থানীয়দের হতাশায় ডুবাল বাল্লা স্থলবন্দর বন্ধের আশঙ্কা। সম্প্রতি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ অলাভজনক হওয়ায় একাধিক স্থলবন্দর প্রাথমিকভাবে বন্ধের সুপারিশ করেছে; যার একটি হচ্ছে চুনারুঘাটের এ স্থলবন্দরটি। কর্তৃপক্ষের একটি উচ্চপর্যায়ের যাচাই কমিটি এ প্রতিবেদন দিয়েছে।
কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, বাল্লা স্থলবন্দরের বাংলাদেশ অংশে অবকাঠামো নির্মাণ হলেও ভারতীর অংশে কোনো অবকাঠামো ও সড়ক সুবিধা না থাকায় স্থলবন্দরের কার্যক্রম চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ভারতীয় অংশে অবকাঠামো ও সড়ক সুবিধা না থাকায় বাল্লা স্থলবন্দরের কার্যক্রম স্থগিত রাখা যেতে পারে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন দায়িত্ব গ্রহণের পর দেশের বিভিন্ন স্থলবন্দর সরেজমিন পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনকালে তিনি অলাভজনক ও কার্যক্রমহীন স্থলবন্দরের কার্যকারিতা মূল্যায়নের জন্য একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করেন। উক্ত কমিটি চুনারুঘাটের বাল্লা স্থলবন্দরটি পর্যালোচনা করে বন্ধের সুপারিশ করেছে।
স্থানীয়রা জানান, ১৯৫১ সালে ৪.৩৭ একর জায়গায় বাল্লা স্থলবন্দর প্রতিষ্ঠিত হয়। ৭১ বছর পর ২০১২ সালে বাল্লা স্থলবন্দর আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেই লক্ষ্যে আগের স্থান থেকে ২ কিলোমিটার পশ্চিমে কেদারাকোট এলাকায় ১৩ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়। অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় করা হয় প্রায় ৪৯ কোটি টাকা। এরপর এখন এটি বন্ধ হয়ে যাওয়া হতাশার।
তারা বলছেন, অবকাঠামো নির্মাণকাজ সমাপ্ত হলেও ভারতীয় অংশে তৎপরতা না থাকায় একটি স্বপ্নের অপমৃত্যু হলো। স্বাভাবিকভাবেই কমিটি বাল্লা স্থলবন্দরটি বন্ধের সুপারিশ করেছে। এর আগে ফেব্রুয়ারিতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে নৌপরিবহন, শ্রম ও কর্মসংস্থান বিষয়ক উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন জানান, বিগত সরকারের আমলে বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে, যা রাষ্ট্রের জন্য কোনো সুফল বয়ে আনেনি। অর্থের অপচয় হয়েছে। দেশের জনগণের উন্নয়নের জন্য যেসব স্থলবন্দর উপকারী হবে, সেগুলো সচল রাখা হবে।
২০১৬ সালের ২৩ মার্চ বর্তমান বাল্লা স্থল শুল্কবন্দরটি পাশ কাটিয়ে বাল্লা থেকে ৩ কিলোমিটার দক্ষিণে গাজীপুর ইউনিয়নের ১৩ একর জমি অধিগ্রহণ করে কেদারাকোর্ট এলাকায় বাল্লা স্থলবন্দর নির্মাণ করা হয়। কাজ শেষ হয় ২০২৩ সালের জুনে। পরে বাল্লা স্থলবন্দরকে দেশের ২৩তম স্থলবন্দর ঘোষণা করেন তৎকালীন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী এবং হবিগঞ্জ জেলার শায়েস্তাগঞ্জের তৎকালীন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব অশোক মাধব রায়ের তদবিরে বাল্লা শুল্ক স্টেশনকে স্থলবন্দর ঘোষণা করা হয়।
আধুনিক স্থলবন্দরে যা যা দরকার, তার সবই আছে বাল্লা বন্দরে। যেমন– ওয়্যারহাউজ, ট্রান্সশিপমেন্ট ইয়ার্ড, ট্রাক পার্কিং ইয়ার্ড, ওপেন ইয়ার্ড, প্রশাসনিক ভবন ও ডরমিটরি। এসব স্থাপনা নির্মাণকাজে ব্যয় হয়েছে ৪৯ কোটি ৯০ লাখ  টাকা। বাল্লা স্থলবন্দর নির্মাণের আগে এ স্থানে শতাধিক পরিবার বসবাস করতেন। স্থলবন্দর নির্মাণ কাজ শুরু হলে তাদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়। তাদের অভিযোগ অনেকেই ক্ষতিপূরণের পুরো টাকা এখনও পাননি।
এদিকে বন্দর এলাকায় গিয়ে দেখা যায় সেখানে ১৬টি পরিবার স্থলবন্দরের সীমানার ভেতরে বসবাস করছেন। ভেতরে গরু-বাছুর চড়াচ্ছেন আর বন্দর পাহারা দিতে দেখা গেছে মাত্র একজন আনসার সদস্যকে।
অভিযোগ রয়েছে, স্থলবন্দরকে কেন্দ্র করে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা সিন্ডিকেট করে বন্দর এলাকায় কয়েক একর জমি কিনেছিলেন। এখন সেই জমিও তাদের গলার কাঁটা। বন্দর চালু না হওয়ায় এখন তারা চড়া দামে জমিও বিক্রি করতে পারছেন না। চড়া মূল্য দেখালেও জেলা প্রশাসন থেকে অধিগ্রহণ করা জমির তেমন মূল্য তারা পাননি।
চুনারুঘাট উপজেলার গাজীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী জানান, বাংলাদেশের অভ্যন্তরের যাবতীয় প্রস্তুতি শেষ। ভারতের অংশে কোনো কাজ হয়নি। ভারত যদি স্থলবন্দর নিয়ে কোনো আগ্রহ না দেখায় এবং সহযোগিতা না করে, তাহলে বাল্লা স্থলবন্দর কোনো কাজে আসবে না।
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কর্ণফুলী নদীতে দখলবাজি
  • অর্থের অপচয়, ফল পেল না রাষ্ট্র