রাজনৈতিক পালাবদলের পর খুলনায় সরকারি কাজের দরপত্রের নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীরা। প্রায়ই তাদের হাতে নাজেহাল হচ্ছেন সরকারি কর্মকর্তারা। গত রোববার খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) দুই প্রকৌশলীকে হুমকির পরদিনই এক নির্বাহী প্রকৌশলীকে মারধর করেন খানজাহান আলী থানা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মোল্লা সোহাগ হোসেন।

আউটসোর্সিংয়ের দরপত্র নিয়ে গত রোববার লাঞ্ছিত করা হয় সুন্দরবন গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক মো.

শাহ আলমকে। গতকাল বুধবার সকালে সেখানে দরপত্র জমা দিতে বাধা দেন সোনাডাঙ্গা বিএনপির নেতারা। এ ছাড়া ১৮ গ্রুপের দরপত্র নিয়ে প্রায়ই খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মহড়া দিচ্ছেন বিএনপির স্থানীয় কয়েকজন নেতা। 

এর বাইরে খুলনা সিটি করপোরেশন, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, গণপূর্ত বিভাগ, সড়ক বিভাগসহ সরকারি দপ্তরগুলোর ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা চলছে। গত সাড়ে ১৫ বছর আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল এসব প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদারি। এর বাইরে ছাত্র প্রতিনিধি পরিচয় দিয়েও বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের দরপত্রে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। গতকাল বুধবার সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানিতে দরপত্র জমা দিতে বাধা দেন কয়েকজন ছাত্র। তারা নিজেদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি পরিচয় দেন। এ ছাড়া পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে প্রায়ই তারা তদবির করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অবশ্য এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে রাজি হননি প্রতিষ্ঠানপ্রধানরা। তদবিরবাজদের নামও প্রকাশ করেননি তারা।

প্রকৌশলীরা জানান, গত ১৫ বছর অধিকাংশ বিএনপি নেতা কাজ করার সুযোগ পাননি। তাদের নামে ঠিকাদারি লাইসেন্স নেই। লাইসেন্স থাকলেও কাজ পাওয়ার যোগ্যতা নেই। এ জন্য অধিকাংশ সময় আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষে তদবির এবং তাদের নিবন্ধনে কাজ নেওয়ার চেষ্টা করেন বিএনপি নেতারা। যোগ্যতায় বাদ পড়লে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেন। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের সময় কুয়েটের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করতেন খানজাহান আলী থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান। গণঅভুত্থ্যানের পর তিনি পালিয়ে গেলে ঠিকাদারি কবজায় নেন থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদ আব্বাস। গত ৭ মাসে কোটেশন দরপত্রের বেশির ভাগই পেয়েছেন তিনি। কাজের ক্ষেত্রে বঞ্চিত হয়ে আসছিলেন থানা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মোল্লা সোহাগ হোসেন। সেই ক্ষোভ এবং অতিরিক্ত বিল তৈরি করে একটি কাজ তাঁকে দেওয়ার জন্য প্রকৌশলীকে চাপ দিয়ে আসছিলেন সোহাগ। এতে অপারগতা জানালে গত রোববার কুয়েটের দুই প্রকৌশলীকে হুমকি দেওয়া হয়। হুমকির ঘটনায় লিখিত অভিযোগ করায় পরদিন নির্বাহী প্রকৌশলী আবু হায়াতকে বাড়ির সামনে মারধর করেন সোহাগ। এ ঘটনার বিচারের দাবিতে কুয়েট কর্মকর্তা ও স্থানীয়রা আন্দোলনে নেমেছেন।

অবশ্য মোল্লা সোহাগ হোসেন মারধরের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ‘কুয়েটে আমার কোনো কাজ নেই। আমি কাউকে হুমকি দিইনি। আবু হায়াতের সঙ্গে দেখা হলে কুয়েটের সহিংসতা নিয়ে কিছুটা বাগ্‌বিতণ্ডা হয়। তবে তাঁকে কোনো আঘাত করিনি।’

সোহাগ অস্বীকার করলেও দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও সংগঠনবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গতকাল বুধবার তাঁকে সব পদ থেকে সাময়িক অব্যাহতি দিয়েছে বিএনপি। মহানগর বিএনপির মিডিয়া সেলের আহবায়ক মিজানুর রহমান মিলটন জানান, অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় মোল্লা সোহাগকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। 

এদিকে সুন্দরবন গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিতে ১৪৮ জন আউটসোর্সিং কর্মচারী নিয়োগের জন্য দরপত্র আহবান করা হয়। পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে তৎপরতা চালাচ্ছিলেন বিএনপি নেতারা। গত রোববার কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক শাহ আলমকে লাঞ্ছিত করেন তারা।

বুধবার দরপত্র জমার দিন সকাল থেকেই বাক্সের সামনে পাহারা বসান বিএনপি নেতাকর্মীরা। এক পর্যায়ে ছাত্র পরিচয় দিয়ে আসা কয়েকজন যুবকও দরপত্র জমা দিতে বাধা দেন। পরে পুলিশ ও সাংবাদিকরা গেলে তারা সরে যান। নির্ধারিত সময়ে চারটি দরপত্র জমা পড়ে।

প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা বলেন, দরদাতা চার প্রতিষ্ঠানই আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীর। তারা জেরিন নামে একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ নিয়ে মাছরাঙ্গা নামের প্রতিষ্ঠানকে দরপত্র জমা দিতে বাধা দিচ্ছিলেন। দুটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষেই বিএনপি নেতারা তদবির করছেন। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে তারা ‘আওয়ামী লীগের দোসর’ উল্লেখ করে কাজ পেলে আমাদের দেখে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন।

শাহ আলম বলেন, ‘দরপত্র আহবান করার পর অনেকেই যোগাযোগ করেছেন। থানা বিএনপির এক নেতাও আমার কাছে কয়েকবার ফোন দেন। আমি তাকে বলি, আপনি চাহিদা অনুযায়ী সব কাগজপত্র জমা দিলে কাজ পাবেন। কিন্ত তিনি কাজের জন্য আমার ওপর চাপ দিচ্ছিলেন। গত রোববার অফিসে এসে খারাপ ব্যবহার করেছেন।’

গত ২৮ জানুয়ারি খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের খাবার, ওষুধ, এমএসআর, গজ ব্যান্ডেজ, লিনেন, পোশাক প্রিন্টিংসহ ১৮টি গ্রুপের দরপত্র আহ্বান করা হয়। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি অনলাইনে দরপত্র জমা হয়েছে। এর আগে থেকেই ১৭ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি, অন্য এলাকার বিএনপি নেতা, ছাত্র প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন গ্রুপ নিয়মিত হাসপাতালে মহড়া দিচ্ছেন। কাজ না পেলে দেখে নেওয়াসহ নানাভাবে হুমকি দিচ্ছেন কর্মকর্তাদের।

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মোহসীন আলী ফরাজি বলেন, ‘প্রচণ্ড চাপে আছি। নানাভাবে হুমকি দেওয়ার চেষ্টা করছে।’ 

খুলনা মহানগর বিএনপির সভাপতি শফিকুল আলম মনা বলেন, ‘দলের নাম ব্যবহার করে কোনো নেতা টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি করলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব এনপ র স কর মকর ত র দরপত র ন ব এনপ আওয় ম তদব র সরক র ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

এলএনজি আমদানি: ব্যয় হবে ১৬২০ কোটি ৫ লাখ ২৮ হাজার টাকা

দেশের জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে গত কয়েক বছর ধরে স্পট মার্কেট থেকে আন্তর্জাতিক কোটেশনের মাধ্যমে এলএনজি আমদানি করছে সরকার।

এরই অংশ হিসেবে পৃথক তিনটি কোটেশনের মাধ্যমে আগামী মে, জুন ও জুলাই মাসের জন্য এই তিন কার্গো এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। এতে মোট ব্যয় হবে এক হাজার ৬২০ কোটি ৫ লাখ ২৮ হাজার ৬৬৪ টাকা।

মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) বিকেলে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভায় প্রস্তাব তিনটিতে অনুমোদন দেওয়া হয়। সভায় কমিটির সদস্য ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

আরো পড়ুন:

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ল

নতুন বছরের আগ মুহূর্তে কেরোসিন-ডিজেলের দাম কমল

সভা সূত্রে জানা গেছে, ‘পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা, ২০০৮’ অনুসরণ করে আন্তর্জাতিক কোটেশন প্রক্রিয়ায় স্পট মার্কেট হতে ১ কার্গো (২২-২৩ মে ২০২৫ সময়ে ২০তম) এলএনজি আমদানির প্রত্যাশাগত অনুমোদনের জন্য সভায় উপস্থাপন করা হলে কমিটি তাতে অনুমোদন দিয়েছে।

সূত্র জানায়, পেট্রোবাংলার মে মাসের জন্য ১ কার্গো এলএনজি সরবরাহের জন্য মাস্টার সেল অ্যান্ড পারচেজ অ্যাগ্রিমেন্ট (এমএসপিএ) স্বাক্ষরকারী চুক্তিবদ্ধ ২৩টি প্রতিষ্ঠানের  কাছ থেকে দরপ্রস্তব আহ্বান করা হলে ৫টি প্রতিষ্ঠান দরপ্রস্তাব দাখিল করে। দাখিলকৃত ৫টি প্রস্তাবই কারিগরি ও আর্থিকভাবে রেসপনসিভ হয়। দরপত্রের সব প্রক্রিয়া শেষে প্রস্তাব মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সুপারিশে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠান সিঙ্গাপুর ভিত্তিক আরামকো ট্রেডিং সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেডের কাছ থেকে প্রতি এই এক কার্গো এলএনজি সংগ্রহ করবে। প্রতি এমএমবিটিইউ ১১.১৫ মার্কিন ডলার হিসেবে এক কার্গো সমান ৩৩ লাখ ৬০ হাজার এমএমবিটিইউ এলএনজি ক্রয়ে মোট ব্যয় হবে ৫৩৪ কোটি ৭৬ লাখ ১১ হাজার ৩৬০ টাকা।

সূত্র জানায়, একই প্রক্রিয়ায় জুন মাসের অন্য এক কার্গো এলএনজির জন্য দরপত্র আহ্বান করা হলে ৩টি প্রতিষ্ঠান দরপত্র দাখিল করে এবং প্রস্তাবই কারিগরি ও আর্থিকভাবে রেসপনসিভ হয়। দরপত্রের সব প্রক্রিয়া শেষে দরপ্রস্তাব মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সুপারিশে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠান মেসার্স গানভর সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেড এই ১ কার্গো এলএনজি সরবরাহ করবে। প্রতি এমএমবিটিইউ ১১.২৭ মার্কিন ডলার হিসেবে ৩৩ লাখ ৬০ হাজার এমএমবিটিইউ এলএনজি ক্রয়ে মোট ব্যয় হবে ৫৪০ কোটি ৫১ লাখ ৬৪ হাজার ১২৮ টাকা।

সভায় জুলাই মাসের জন্য ও এক কার্গো এলএনজি আমদানির একটি প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে কমিটি। পেট্রোবাংলা কর্তৃক ১ কার্গো এলএনজি সরবরাহের জন্য এমএসপিএ স্বাক্ষরকারী চুক্তিবদ্ধ ২৩টি প্রতিষ্ঠানের  কাছ থেকে দরপ্রস্তাব আহ্বান করা হলে ৬টি প্রতিষ্ঠান দরপ্রস্তাব দাখিল করে। দাখিলকৃত ৬টি প্রস্তাবই কারিগরি ও আর্থিকভাবে রেসপনসিভ হয়। দরপত্রের সব প্রক্রিয়া শেষে প্রস্তাব মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সুপারিশের প্রেক্ষিতে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠান মেসার্স ভিটল এশিয়া প্রাইভেট লিমিটেড নির্বাচিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি এমবিটিইউ প্রতি এমবিবিইটএইউ ১১.৩৫৮৮ মার্কিন ডলার হিসেবে ৩৩ লাখ ৬০ হাজার এমএমবিটিইউ এলএনজি ক্রয়ে মোট ব্যয় হবে  ৫৪৪ কোটি ৭৭ লাখ ৫৩ হাজার ১৭৬ টাকা।

ঢাকা/হাসনাত/সাইফ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • এলএনজি আমদানি: ব্যয় হবে ১৬২০ কোটি ৫ লাখ ২৮ হাজার টাকা
  • ‘নতুন শুরুর আশায়’ মাগুরা টেক্সটাইল মিলসের পুরোনা মেশিন বিক্রি
  • কড়া নজরদারি সুন্দরবন সীমান্তে
  • সৌন্দর্যের সন্ধানে সুন্দরবনের গহীনে : দ্বিতীয় পর্ব
  • সোনাগাজীতে ইজারা চুক্তি না মেনে চলছে পশুর হাট
  • সুন্দরবনে অস্ত্রসহ বনদস্যু আটক
  • উপকূল রক্ষা বাঁধে ভয়াবহ ধস, প্লাবনের আশঙ্কা সুন্দরবন তীরবর্তী জনপদে
  • লোডশেডিং সীমিত রাখার চেষ্টা করা হবে: জ্বালানি উপদেষ্টা