দরপত্র কবজায় নিতে মারমুখী বিএনপি নেতারা
Published: 6th, March 2025 GMT
রাজনৈতিক পালাবদলের পর খুলনায় সরকারি কাজের দরপত্রের নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীরা। প্রায়ই তাদের হাতে নাজেহাল হচ্ছেন সরকারি কর্মকর্তারা। গত রোববার খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) দুই প্রকৌশলীকে হুমকির পরদিনই এক নির্বাহী প্রকৌশলীকে মারধর করেন খানজাহান আলী থানা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মোল্লা সোহাগ হোসেন।
আউটসোর্সিংয়ের দরপত্র নিয়ে গত রোববার লাঞ্ছিত করা হয় সুন্দরবন গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক মো.
এর বাইরে খুলনা সিটি করপোরেশন, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, গণপূর্ত বিভাগ, সড়ক বিভাগসহ সরকারি দপ্তরগুলোর ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা চলছে। গত সাড়ে ১৫ বছর আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল এসব প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদারি। এর বাইরে ছাত্র প্রতিনিধি পরিচয় দিয়েও বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের দরপত্রে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। গতকাল বুধবার সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানিতে দরপত্র জমা দিতে বাধা দেন কয়েকজন ছাত্র। তারা নিজেদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি পরিচয় দেন। এ ছাড়া পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে প্রায়ই তারা তদবির করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অবশ্য এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে রাজি হননি প্রতিষ্ঠানপ্রধানরা। তদবিরবাজদের নামও প্রকাশ করেননি তারা।
প্রকৌশলীরা জানান, গত ১৫ বছর অধিকাংশ বিএনপি নেতা কাজ করার সুযোগ পাননি। তাদের নামে ঠিকাদারি লাইসেন্স নেই। লাইসেন্স থাকলেও কাজ পাওয়ার যোগ্যতা নেই। এ জন্য অধিকাংশ সময় আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষে তদবির এবং তাদের নিবন্ধনে কাজ নেওয়ার চেষ্টা করেন বিএনপি নেতারা। যোগ্যতায় বাদ পড়লে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের সময় কুয়েটের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করতেন খানজাহান আলী থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান। গণঅভুত্থ্যানের পর তিনি পালিয়ে গেলে ঠিকাদারি কবজায় নেন থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদ আব্বাস। গত ৭ মাসে কোটেশন দরপত্রের বেশির ভাগই পেয়েছেন তিনি। কাজের ক্ষেত্রে বঞ্চিত হয়ে আসছিলেন থানা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মোল্লা সোহাগ হোসেন। সেই ক্ষোভ এবং অতিরিক্ত বিল তৈরি করে একটি কাজ তাঁকে দেওয়ার জন্য প্রকৌশলীকে চাপ দিয়ে আসছিলেন সোহাগ। এতে অপারগতা জানালে গত রোববার কুয়েটের দুই প্রকৌশলীকে হুমকি দেওয়া হয়। হুমকির ঘটনায় লিখিত অভিযোগ করায় পরদিন নির্বাহী প্রকৌশলী আবু হায়াতকে বাড়ির সামনে মারধর করেন সোহাগ। এ ঘটনার বিচারের দাবিতে কুয়েট কর্মকর্তা ও স্থানীয়রা আন্দোলনে নেমেছেন।
অবশ্য মোল্লা সোহাগ হোসেন মারধরের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ‘কুয়েটে আমার কোনো কাজ নেই। আমি কাউকে হুমকি দিইনি। আবু হায়াতের সঙ্গে দেখা হলে কুয়েটের সহিংসতা নিয়ে কিছুটা বাগ্বিতণ্ডা হয়। তবে তাঁকে কোনো আঘাত করিনি।’
সোহাগ অস্বীকার করলেও দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও সংগঠনবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গতকাল বুধবার তাঁকে সব পদ থেকে সাময়িক অব্যাহতি দিয়েছে বিএনপি। মহানগর বিএনপির মিডিয়া সেলের আহবায়ক মিজানুর রহমান মিলটন জানান, অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় মোল্লা সোহাগকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
এদিকে সুন্দরবন গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিতে ১৪৮ জন আউটসোর্সিং কর্মচারী নিয়োগের জন্য দরপত্র আহবান করা হয়। পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে তৎপরতা চালাচ্ছিলেন বিএনপি নেতারা। গত রোববার কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক শাহ আলমকে লাঞ্ছিত করেন তারা।
বুধবার দরপত্র জমার দিন সকাল থেকেই বাক্সের সামনে পাহারা বসান বিএনপি নেতাকর্মীরা। এক পর্যায়ে ছাত্র পরিচয় দিয়ে আসা কয়েকজন যুবকও দরপত্র জমা দিতে বাধা দেন। পরে পুলিশ ও সাংবাদিকরা গেলে তারা সরে যান। নির্ধারিত সময়ে চারটি দরপত্র জমা পড়ে।
প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা বলেন, দরদাতা চার প্রতিষ্ঠানই আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীর। তারা জেরিন নামে একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ নিয়ে মাছরাঙ্গা নামের প্রতিষ্ঠানকে দরপত্র জমা দিতে বাধা দিচ্ছিলেন। দুটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষেই বিএনপি নেতারা তদবির করছেন। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে তারা ‘আওয়ামী লীগের দোসর’ উল্লেখ করে কাজ পেলে আমাদের দেখে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন।
শাহ আলম বলেন, ‘দরপত্র আহবান করার পর অনেকেই যোগাযোগ করেছেন। থানা বিএনপির এক নেতাও আমার কাছে কয়েকবার ফোন দেন। আমি তাকে বলি, আপনি চাহিদা অনুযায়ী সব কাগজপত্র জমা দিলে কাজ পাবেন। কিন্ত তিনি কাজের জন্য আমার ওপর চাপ দিচ্ছিলেন। গত রোববার অফিসে এসে খারাপ ব্যবহার করেছেন।’
গত ২৮ জানুয়ারি খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের খাবার, ওষুধ, এমএসআর, গজ ব্যান্ডেজ, লিনেন, পোশাক প্রিন্টিংসহ ১৮টি গ্রুপের দরপত্র আহ্বান করা হয়। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি অনলাইনে দরপত্র জমা হয়েছে। এর আগে থেকেই ১৭ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি, অন্য এলাকার বিএনপি নেতা, ছাত্র প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন গ্রুপ নিয়মিত হাসপাতালে মহড়া দিচ্ছেন। কাজ না পেলে দেখে নেওয়াসহ নানাভাবে হুমকি দিচ্ছেন কর্মকর্তাদের।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মোহসীন আলী ফরাজি বলেন, ‘প্রচণ্ড চাপে আছি। নানাভাবে হুমকি দেওয়ার চেষ্টা করছে।’
খুলনা মহানগর বিএনপির সভাপতি শফিকুল আলম মনা বলেন, ‘দলের নাম ব্যবহার করে কোনো নেতা টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি করলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব এনপ র স কর মকর ত র দরপত র ন ব এনপ আওয় ম তদব র সরক র ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
শেখ অ্যাগ্রো ফুড থেকে কেনা হচ্ছে ১০ হাজার মে.টন মসুর ডাল
ভর্তুকি মূল্যে বিক্রির জন্য ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এর জন্য উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে ১০ হাজার মে.টন মসুর ডাল ক্রয়ের উদ্যোগ নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। প্রতি কেজি মসুর ডালের দাম ৯৪.৫০ টাকা হিসেবে ১০ হাজার মে.টন মসুর ডাল ক্রয়ে মোট ব্যয় হবে ৯৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা। শেখ অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাষ্ট্রিজ এই মসুর ডাল সরবরাহ করবে।
সূত্র জানায়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা টিসিবি'র ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনায় ২ লাখ ৮৮ হাজার মে.টন মসুর ডাল ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এরমধ্যে এ পর্যন্ত ক্রয় চুক্তি সম্পাদন হয়েছে ১ লাখ ৪২ হাজার ৯৫০ মে.টন। ইস্যুকৃত এনওএ-এর পরিমাণ (চলমান) ১০ হাজার মে.টন। স্থানীয়ভাবে প্রস্তাবিত ক্রয়ের পরিমাণ ১০ হাজার মে.টন মসুর ডাল।
সূত্র জানায়, মোট চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে সমগ্র বাংলাদেশে (সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাসহ) টিসিবি'র ফ্যামিলি কার্ডধারী প্রায় ১ কোটি নিম্নআয়ের পরিবারের মাঝে প্রতি মাসে ভর্তুকি মূল্যে পণ্য বিক্রির লক্ষ্যে টিসিবি কর্তৃক স্থানীয়ভাবে ১০ হাজার মে.টন মসুর ডাল কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতির অধীন স্থানীয় ক্রয়ের ক্ষেত্রে পণ্য সরবরাহ, কার্যসম্পাদন বা ভৌত সেবার জন্য বিজ্ঞাপন পত্রিকায় প্রকাশের তারিখ থেকে দরপত্র প্রণয়ন ও দাখিলের জন্য ন্যূনতম ২৮ দিন সময় ধার্য থাকলেও পিপিআর-২০০৮ এর বিধি ৬১ (৫) অনুযায়ী অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির ২০২৪ সালের ৪ জুন তারিখের সভায় টিসিবি'র জন্য স্থানীয় দরপত্র আহ্বানের ক্ষেত্রে দরপত্র প্রণয়ন ও দাখিলের সময়সীমা ১৪ দিন করার সিদ্ধান্ত হয়।
স্থানীয়ভাবে ১০ হাজার মে.টন মসুর ডাল ক্রয়ের জন্য পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা, ২০০৮ অনুসরণ করে গত ১৩ জানুয়ারি তারিখে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্র জমা দেওয়ার নিদ্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ৪টি দরপত্র জমা পড়ে। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা, ২০০৮ এর বিধি-১৬ (৫ক) অনুযায়ী প্রতি কেজি মসুর ডালের দাপ্তরিক প্রাক্কলিত মূল্য ১১০.৫৪ টাকা।
দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সভা গত ৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। মূল্যায়ন কমিটি প্রাপ্ত ৪টি দরপত্র, তুলনামূলক বিবরণী এবং সংযুক্ত দাখিলকৃত কাগজাদি পর্যালোচনা করেন। পর্যালোচনা শেষে দাখিলকৃত ৪টি দরপত্রই রেসপনসিভ হিসেবে বিবেচিত হয়। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি কর্তৃক রেসপনসিভ সর্বনিম্ন দরদাতা শেখ অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাষ্ট্রিজ। এ প্রতিষ্ঠানটি ৫০ কেজির বস্তায় অগ্রিম আয়কর এবং টিসিবি'র গুদামসমূহে পরিবহন খরচসহ ১০ হাজার০ মে. টন মসুর ডালের প্রতি কেজির দাম ৯৫.৪০ টাকা উল্লেখ করে সর্ব নিম্নদরদাতা নির্বাচিত হয়। দরপত্রে অংশ নেওয়া অন্য ৩ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মেসার্স পায়েল ট্রেডার্স প্রতি কেজির দাম ৯৫.৯৬ টাকা, শবনম ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ৯৬.৭৩ টাকা এবং নাবিল নবা ফুড লিমিটেড প্রতি কেজি মসুর ডালের দাম ৯৭.২৫ টাকা উল্লেখ করে।
দরপত্রে অংশ নেয়া ৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি ১০ হাজার মে.টন মসুর ডাল সরবরাহ করার জন্য শেখ অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাষ্ট্রিজ-এর নাম সুপারিশ করে। প্রতি কেজি মসুর ডালের দাম ৯৫.৪০ টাকা হিসেবে ১০ হাজার মে.টন মসুর ক্রয়ে মোট ব্যয় হবে ৯৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
মূল্যায়ন কমিটির সপারিশে বলা হয়-(ক) রেসপনসিভ সর্বনিম্ন দরদাতা কর্তৃক প্রস্তাবিত প্রতি কেজি মসুর ডালের দাম প্রাক্কলিত দামের চেয়ে (১১০.৫৩৫-৯৫.৪০)=১৫.১২৫ টাকা কম।
(খ) রেসপনসিভ সর্বনিম্ন দর প্রতি কেজিতে অগ্রিম আয়কর ও টিসিবি'র গুদামসমূহে পরিবহন খরচসহ ৯৫.৪০ টাকা থেকে ১শতাংশ অগ্রীম আয়কর বাবদ ০.৯৫৪ টাকা ও পরিবহন খরচ ২ টাকা বাদ দিয়ে প্রকৃত মূল্য দাঁড়ায় (৯৫.৪০-০.৯৫৪-২)= ৯২.৪৪৬ টাকা। উল্লেখ্য, টিসিবি'র বাজার তথ্য অনুযায়ী গত ৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে স্থানীয় বাজারে মাঝারি দানার মসুর ডালের প্রতি কেজির গড় খুচরা মূল্য ১১৫.০০ টাকা। আলোচ্য দর বর্তমান স্থানীয় খুচরা বাজার মূল্য থেকে প্রতি কেজিতে (১১৫.০০-৯৫.৪০)= ১৯.৬০ টাকা কম।
(গ) গত ১৩ জানুয়ারি তারিখে স্থানীয়ভাবে উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে ৫০ কেজির বস্তায় প্রতি কেজি মসুর ডাল ৯৭.৯২ টাকা দরে ক্রয় করা হয়েছে। যা থেকে আলোচ্য দর প্রতি কেজিতে (৯৭.৯২-৯৫.৪০)=২.৫২ টাকা কম দরে ১০ হাজার মে.টন মসুর ডাল কেনার উদ্যোগ নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
ঢাকা/টিপু