ছয় সংস্কার কমিশনের সুপারিশের বিষয়ে মতামত জানাতে রাজনৈতিক দলগুলোকে চিঠি দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। প্রতিটি সুপারিশের বিষয়ে ‘একমত’, ‘আংশিক একমত’ এবং ‘ভিন্নমত’– এই তিনটি প্রশ্ন রয়েছে। সংস্কার বাস্তবায়নে পাঁচ বিকল্প দিয়ে মতামত চাওয়া হয়েছে। বিকল্পগুলো হলো– নির্বাচনের আগে অধ্যাদেশের মাধ্যমে, নির্বাচনের আগে গণভোটের মাধ্যমে, নির্বাচনের সময়ে গণভোটের মাধ্যমে, গণপরিষদের মাধ্যমে এবং নির্বাচনের পর সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে। ঐকমত্য কমিশন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সূত্র সমকালকে এসব তথ্য জানিয়েছে। 

রাজনৈতিক দলগুলোকে গত কয়েক দিনে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুদক, জনপ্রশাসন এবং পুলিশ সংস্কারবিষয়ক কমিশনের প্রতিবেদন একীভূত করে দেওয়া হয়েছে। 

রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার কমিশনের যেসব সুপারিশে একমত হবে, সেগুলোর ভিত্তিতে হবে জুলাই চার্টার বা সনদ। দলগুলো একমত হলে পুলিশ, দুদক, জনপ্রশাসনসহ যেসব বিষয়ে সাংবিধানিক প্রশ্ন নেই, সেগুলো অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংস্কার করবে সরকার। সংবিধান, বিচার বিভাগ, নির্বাচন ব্যবস্থাসহ যেসব বিষয়ে সাংবিধানিক প্রশ্ন রয়েছে, সেগুলো গণভোটের মাধ্যমে সংস্কার করা যায় কিনা, তা জানতে চাওয়া হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে। আগামী সংসদ নির্বাচনের সঙ্গেই গণভোট করা যায় কিনা, এ বিকল্পও রাখা হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে। দলগুলো একমত হলে নির্বাচনের পর আগামী সংসদেও সংস্কার হতে পারে। 

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের নেতারা গণভোট ও গণপরিষদের কথা বললেও বিএনপি এর ঘোর বিরোধী। একে নির্বাচন বিলম্বিত করার ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। তারা দ্রুত সংসদ নির্বাচন চায়। তবে জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দলের নেতারা তাড়াহুড়া নয়, টেকসই সংস্কারে গুরুত্ব দিচ্ছেন।  

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার সমকালকে বলেন, বুধবার মতামত চেয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। পাঁচটি বিকল্প দিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে, কোন প্রক্রিয়ায় সংস্কার চায় তারা। আগামী ১৩ মার্চের মধ্যে মতামত জানাতে অনুরোধ করা হয়েছে। 

যদিও কয়েকটি দলের অভিযোগ, তারা ছয়টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পুরোটা পায়নি। কোনো কোনো দল আংশিক পেয়েছে। একাধিক রাজনৈতিক দলের নেতা সমকালকে জানিয়েছেন, ২৫৪টি প্রস্তাব রয়েছে প্রতিবেদনগুলোতে। প্রতি প্রস্তাবের সঙ্গে তিনটি করে প্রশ্ন করেছে। একমত এবং আংশিক একমত হলে ‘টিক’ দিতে বলা হয়েছে। ভিন্নমত থাকলে তা বিস্তারিত লিখে সরকারকে জানাতে অনুরোধ করা হয়েছে। 

প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে গত ১২ ফেব্রুয়ারি ছয় মাসমেয়াদি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠিত হয়। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ কমিশনের সহসভাপতি।  নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুদক, জনপ্রশাসন এবং পুলিশ সংস্কারবিষয়ক কমিশনের প্রধানরা ঐকমত্য  কমিশনের সদস্য।

গত ১৫ ফেব্রুয়ারি এ কমিশন ২৭টি রাজনৈতিক দল এবং জোটের ১০০ প্রতিনিধির সঙ্গে প্রথম বৈঠক করে। 

এতে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে মতামত চাওয়া হবে। এরপর  দলগুলোর সঙ্গে আলাদা বৈঠকে বসবে কমিশন। পরে আবার সব দলের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার উপস্থিতিতে বৈঠক হবে। ১৫ ফেব্রুয়ারির বৈঠকে সরকারপ্রধান বলেছিলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। কোনো দল যদি একটি সংস্কার প্রস্তাবেও একমত না হয়, তাতেও অসুবিধা নেই। কোন দল কতটি প্রস্তাবে একমত হয়েছে, তা জানিয়ে দেওয়া হবে। ভিন্নমত থাকলে তা জানাতে পারবে কমিশনকে। কমিশন তা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রকাশ করবে। 

১৫ ফেব্রুয়ারির বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন জাতীয় নাগরিক কমিটি (জানাক) এবং  বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। শেখ হাসিনার পতন ঘটানো অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া দুই সংগঠনের নেতারা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নামে দল গঠন করেছেন গত ২৮ ফেব্রুয়ারি। 

এ দলও সংস্কারের সুপারিশমালায় মতামত জানাতে চিঠি পেয়েছে। দলটি সংসদের আগে গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি তুলেছে। গণপরিষদে নতুন সংবিধান প্রণয়নের কথা বলছে। এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শামরিন সমকালকে বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের চেতনা বাস্তবায়নে গণপরিষদের মাধ্যমে নতুন সংবিধানের প্রস্তাব করা হবে। 

কোন দল কী মতামত জানাবে– এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল জানিয়েছে, নির্বাচন ব্যাহত বা  বিলম্বিত হতে পারে– এমন সংস্কার প্রস্তাবকে সমর্থন করা হবে না। আগামী ডিসেম্বরেই নির্বাচন হতে হবে। এ সময়ের মধ্যে নির্বাচনের জন্য অত্যাবশকীয় সংস্কারে গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা। যেসব সুপারিশ নির্বাচনের পরে বাস্তবায়ন সম্ভব, সেগুলো আলাদা করা হবে। রাজনৈতিক নেতারা জানিয়েছেন, সংস্কারের সুপারিশ পর্যালোচনা করে মতামত তৈরি করা হবে। দলীয় নেতার বাইরে বিশেষজ্ঞদেরও পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে। বিএনপি নেতারা জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের রাষ্ট্র সংস্কারে ছয় সংস্কার কমিশন গঠনের আদলে দলীয়ভাবে ছয়টি কমিটি গঠন করে। এই কমিটিগুলো অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার পর কমিশনের সুপারিশের বিষয়ে মতামত তৈরি করা হচ্ছে। বিএনপি রাষ্ট্র সংস্কারে ৩১ দফা প্রস্তাবকে গুরুত্ব দিচ্ছে। 

দলটির নেতারা জানান, বিএনপি আগেই সংস্কার কমিশনগুলোতে দলীয় মতামত এবং প্রস্তাব লিখিত আকারে দিয়েছে। ঐকমত্য  সুপারিশমালা যে সংকলন তৈরি করেছে, তা পর্যালোচনা চলছে। সেখানে বিএনপির প্রস্তাব কমিশনগুলো কতটা আমলে নিয়েছে, কোন কোন সুপারিশ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক তা জানার চেষ্টা চলছে। এ ছাড়া জাতীয় নির্বাচনের আগে যেসব সুপারিশ বাস্তবায়নযোগ্য, তা আমলে নেওয়া হচ্ছে বলে তারা জানান। 

বিএনপির দলীয় সংস্কার কমিটির এক নেতা সমকালকে জানান, ভিন্ন ভিন্ন সংস্কার কমিশন একই বিষয়ে আলাদা সুপারিশ করেছে। কমিশনগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে তা হয়েছে। আবার কিছু সুপারিশে অস্পষ্টতা, অসংগতি ও বাস্তবায়নে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন রয়েছে, যা বাস্তবায়নে জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। রাজনৈতিক দল বা শক্তিগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য সৃষ্টিতে বাধার সৃষ্টি পারে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও প্রশাসন সংস্কার কমিটির প্রধান সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সংস্কার কমিশনের সুপারিশ পর্যালোচনা করা হচ্ছে। খুব বেশি সময় লাগবে না। হয়তো দু-একদিনের মধ্যেই হয়ে যাবে। পরে তা লিখিত আকারে জানানো হবে।

৩১ দফার বিষয়ে তিনি বলেন, এটি বিএনপির নিজস্ব সংস্কার প্রস্তাব, যা দলীয় প্রতিশ্রুতি। এর সঙ্গে হয়তো সরকারের সংস্কার কমিশনের বেশি মিল থাকতে পারে, আবার বাইরে থেকেও কিছু অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। যেসব অমিল থাকবে, তা আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান সম্ভব বলে আশাবাদী সালাহউদ্দিন আহমেদ।

জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ সমকালকে জানিয়েছেন, তারা কমিশনের সুপারিশ পেয়েছেন। মতামত দিতে কাজ চলছে।

১৩ মার্চের মধ্যে মতামত জানানোর অনুরোধের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এত তাড়াহুড়োর তো প্রয়োজন নেই। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সংস্কারের অভূতপূর্ব সুযোগ এসেছে জাতির সামনে। তা কাজে লাগাতে হবে। সংস্কার হতে হবে টেকসই। আবার অন্ততকাল সময়ও নেওয়া হবে না। যৌক্তিক সময়ের মধ্যে বিচার-বিশ্লেষণ পর্যালোচনা করে মতামত চূড়ান্ত করা উচিত। দেশের জন্য দলীয় স্বার্থে ঊর্ধ্বে উঠে সংস্কারে রাজি হতে হবে।’

চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব ইউনূস আহমাদ সমকালকে বলেন, ছয়টি কমিশনের সুপারিশের প্রশ্ন আকারে পেয়েছি। দলীয়ভাবে এগুলো ভাগ করে দেওয়া হয়েছে ছয়টি বিশেষজ্ঞ দলকে।

সংস্কারের সুপারিশমালা পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু। তিনি সমকালকে বলেন, প্রস্তাবগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক দল একমত, নাকি আংশিক একমত– তা জানতে চাওয়া হয়েছে। ভিন্নমত থাকলে তা জানাতে বলা হয়েছে।

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না সমকালকে বলেন, সংবিধান সংস্কারের সুপারিশমালার পাঁচ খণ্ডের মাত্র একটি পেয়েছি। প্রতিটি সংস্কারে প্রস্তাব যদি ২৫০ পৃষ্ঠারও হয়, তাহলে পড়তে ও বুঝতেও সময় দিতে হবে। একই অভিযোগ করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সহসভাপতি তানিয়া রব বলেন, মাত্র একটি সংস্কারের সুপারিশমালার হার্ডকপি পেয়েছি। 

ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল আলম বাবলু বলেন, সব সুপারিশ পেয়েছি। দলীয় নেতা ও বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে কমিশনকে জানানো হবে।

বাংলাদেশ এলডিপির সভাপতি শাহাদাত হোসেন সেলিম জানান, সব সুপারিশ পেয়েছেন। মতামত জানাতে প্রস্তুতি শুরু করবেন।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব এনপ জ ম য় ত ইসল ম মত মত জ ন ত সব স প র শ মত মত চ ব এনপ র ব কল প গণভ ট সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

রাজনৈতিক মেরুকরণ পরিষ্কার হচ্ছে

জুলাই ’২৪ বিপ্লবের পর রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছিল বিপ্লবের ছাত্রনেতাদের কার্যক্রম ঘিরে। বিপ্লবী ছাত্রনেতারা দুইভাবে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। এক, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে; দুই, নাগরিক কমিটি করে পরীক্ষামূলকভাবে রাজনীতিতে প্রবেশের আকাঙ্ক্ষা জানিয়ে। দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলও এই দুই ভাগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল।  

এই তাল মেলানোটা একতরফা ছিল না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেও অন্যান্য দলের, বিশেষ করে বড় দল বিএনপির সমালোচনাকে আমল দিয়ে তাদের বিভিন্ন সময়সূচি পরিবর্তন করতে হয়েছে।

প্রথমে বিভিন্ন উপদেষ্টা ও বৈষম্যবিরোধী নেতাদের বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছিল, যত সব সংস্কার তাঁরা দরকার মনে করেন, সেগুলো সম্পন্ন হওয়ার আগে তাঁরা নির্বাচন সমর্থন করবেন না। এটা অনেক সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু বড় দলগুলোর অধৈর্য টের পেয়ে সরকার সম্ভবত সেই অবস্থান থেকে ফিরে এসেছে। এ বছরের ডিসেম্বর বা আগামী বছরের মার্চের মধ্যে নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুননতুন দল নতুন কী নিয়ে হাজির হবে১৫ ঘণ্টা আগে

বিএনপি কখনো অস্থায়ী সরকারকে সমালোচনা, কখনোবা সমর্থন জানিয়ে অস্থায়ী সরকারের সঙ্গে একটা স্থিতিশীল সম্পর্ক বজায় রেখেছে। কিন্তু শিগগিরই নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকারকে ক্রমাগত চাপ দিয়ে আসছে।

প্রথমে তারেক রহমান চাইছিলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের নিয়ে বা তাঁদের সঙ্গে সমঝোতা করে জাতীয় সরকার বা নতুন নির্বাচনের একটা পরিকল্পনা বা রোডম্যাপ করতে। বিএনপি এরই মধ্যে আ স ম আবদুর রব, নুরুল হক নুরু, জোনায়েদ সাকি ও মাহমুদুর রহমান মান্নার দলের কিছু নেতার জন্য নির্বাচনী সমঝোতামূলক আসন ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা করেছে।  কিন্তু বৈষম্যবিরোধীরা এ ধরনের সমঝোতায় আগ্রহী বলে মনে হয় না। তারা এরই মধ্যে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছে।

জামায়াতে ইসলামী প্রথম থেকেই নিজেদের শক্তিকে সংহত করার কাজে চেষ্টা শুরু করে। আওয়ামী লীগের শাসনামলে তাদেরকে কিছুটা বিএনপির ছায়ায় থেকে রাজনীতি করতে হয়েছে।

৫ আগস্টের পর জামায়েত গা ঝাড়া দিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে রাজনীতি করার ঘোষণা দেয়। বিএনপিও জামায়াতের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে দূরত্ব বজায় রাখতে চেয়েছে। জামায়াতের অনেক কথাবার্তা বিএনপির সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল।

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে, এই ঘোষণা দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ডিসেম্বরে কিসের নির্বাচন হবে? জাতীয় নির্বাচন না স্থানীয় নির্বাচন? আর জাতীয় নির্বাচন হলে সেটা কি  সংবিধান লেখার জন্য গণপরিষদ গঠন করার জন্য নির্বাচন? নাকি নতুন পার্লামেন্ট গঠন করার নির্বাচন? নতুন রাজনৈতিক দল নাগরিক পার্টি খোলাখুলি ‘দ্বিতীয় রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের কথা বলেছে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্রশিবিরের বেশ কিছু নেতা বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতাদের সঙ্গে একত্রে কাজ করেছিলেন। মাঝেমধ্যে কিছু মতান্তর হলেও সেই ঐক্য মোটামুটি অক্ষুণ্ন রয়েছে। এটাকে জামায়াত খুব ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। তাঁরা নির্বাচনের জন্য সরকারকে আরও সময় দিতে প্রস্তুত আছে। সবকিছু মিলিয়ে রাজনীতিতে বিএনপি ও জামায়াত ভিন্ন ও বলা যায় প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক অবস্থান নিয়েছে।

অন্য ছোট দলগুলোর মধ্যে নুরুল হক নুরুর গণ অধিকার পরিষদ ও জোনায়েদ সাকির গণশক্তি পরিষদের তরুণদের মধ্যে কিছু সমর্থক রয়েছেন। ডাকসুর ভিপি থাকাকালে নুরুল হক নুরুই প্রথম কোটাবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে শেখ হাসিনার শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করেন। ধারণা করা হচ্ছে, নুরুল হক সম্ভবত এখন বিএনপি জোটে থেকেই পর্যবেক্ষণ করবেন। তাঁদের ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত অন্য রকম হতে পারে।

২৮ ফেব্রুয়ারি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে নতুন রাজনৈতিক দল—জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি)। নতুন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব নিয়েছেন নাহিদ ইসলাম। তিনি অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের প্রতিনিধি হিসেবে সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্বে ছিলেন। নতুন দল ঘোষণার সময় নাহিদ বলেন, এই দল ভারত ও পাকিস্তানকে তোষণের রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করবে। এর আগে ছাত্রনেতারা পরিবারভিত্তিক রাজনীতির সমালোচনা করেন। এসব থেকে আঁচ করা যায়, পরবর্তী রাজনৈতিক বিতর্ক কী নিয়ে শুরু হবে।

জাতীয় নাগরিক পার্টি আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হওয়ার আগে থেকেই বিএনপি এই প্রক্রিয়াকে ‘কিংস পার্টি’ আখ্যায়িত করেছে; কিন্তু তকমা তাদের গায়েও মেখে আছে।
ছাত্রদের প্রতিনিধি হিসেবে সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্বে আসা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও মাহফুজ আলম এখনো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে রয়ে গেছেন। অন্য রাজনৈতিক দলগুলো তাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে জাতীয় নাগরিক পার্টির লিয়াজোঁ হিসেবে গণ্য করলে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।  

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে, এই ঘোষণা দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ডিসেম্বরে কিসের নির্বাচন হবে? জাতীয় নির্বাচন না স্থানীয় নির্বাচন? আর জাতীয় নির্বাচন হলে সেটা কি  সংবিধান লেখার জন্য গণপরিষদ গঠন করার জন্য নির্বাচন? নাকি নতুন পার্লামেন্ট গঠন করার নির্বাচন? নতুন রাজনৈতিক দল নাগরিক পার্টি খোলাখুলি ‘দ্বিতীয় রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের কথা বলেছে।

আরও পড়ুনবিএনপি–জামায়াতের বাইরে অভ্যুত্থানের পক্ষের দলগুলোর নির্বাচনী জোট করা ছাড়া পথ কী০৩ মার্চ ২০২৫

অন্যদিকে বিএনপি চাচ্ছে, যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচিত সরকার গঠনের জন্য জাতীয় নির্বাচন। ডিসেম্বরে যদি গণপরিষদ নির্বাচন হয়, তাহলে ধরে নেওয়া যায়, যত দিন নতুন সংবিধান রচনা ও গৃহীত না হয়, তত দিন অধ্যাপক ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় থাকবে। বিএনপি কি তা মেনে নেবে? আবার খুব শিগগিরই যদি জাতীয় নির্বাচন হয়, ছাত্রদের নতুন দল মাত্র এই কয় মাসে তাদের নতুন দলে কোনো শক্তিই সঞ্চার করতে পারবে না। এসব নিয়ে সমঝোতা না হলে বিরোধ অনিবার্য।

সব রাজনৈতিক দল এখন মোটামুটি তাদের অবস্থান জানান দিয়ে মাঠে নেমেছে। এর মধ্যে আশা করা যায় আলাপ-আলোচনা হবে। একটা রোড ম্যাপ তৈরি হবে, যা সবাই মেনে নেবে। তবে জাতীয় নির্বাচন ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হবে রাজনৈতিক দলগুলোর নতুন মেরুকরণ। জাতীয় গ্র্যান্ড কোয়ালিশন না হলে বিএনপি ও নাগরিক পার্টি নির্বাচনী আঁতাত হবে না, তা ধরে নেওয়া যায়। কারণ, ছাত্ররা নতুন রাজনীতি নিয়ে কথা বলছেন। জামায়াত ও নাগরিক পার্টির কোয়ালিশনে না হওয়ার সম্ভাবনা আছে, যদিও নাগরিক পার্টিতে জামায়াতের বেশ কিছু অনুসারী রয়েছেন। নুরু ও জোনায়েদ সাকি কি নাগরিক পার্টির সঙ্গে আসবেন? এসব দেখার জন্য আমাদের কিছুদিন ধৈর্য ধরতে হবে।

রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। এত দিন সব রাজনৈতিক দল যে সংযম দেখিয়েছে, তা কত দিন টিকে থাকবে? ১ মার্চ নুরুল হক নুরু দুই ছাত্র উপদেষ্টাসহ সরকারে প্রতিনিধিত্বকারী সব ছাত্রকে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি আন্দোলনকেন্দ্রিক পরিচিত ছাত্রদের তদবির, নিয়োগ, টেন্ডার-বাণিজ্যসহ নানাবিধ বিষয়ে সমালোচনা করেছেন।

ধরে নেওয়া যায়, ক্রমে বিএনপিসহ অন্য দলগুলোও এগিয়ে আসবে ছাত্রদের নতুন দলের সমালোচনায়। তাদের দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করে অন্য দলগুলোকে মোকাবিলা করতে হবে। জাতীয় নাগরিক কমিটির জন্য আরেকটা সতর্কতা—তাদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন আদর্শের লোক রয়েছেন। রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বনাম প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক রেষারেষি। বিএনপির মতো বড় দলকে মোকাবিলা করতে হলে তাদের অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।

সালেহ উদ্দিন আহমদ লেখক, শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গাজা পুনর্গঠন পরিকল্পনায় আরব নেতাদের ঐকমত্য
  • পাঁচ বছরে ২৫ বার সভা নিরসন হয়নি যানজটের
  • শেখ হাসিনার বিচারপ্রক্রিয়ার সঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই: আমীর খসরু
  • সামনে আসছে জামায়াতসহ ইসলামী দলগুলোর মতভিন্নতা
  • ‘গণপরিষদ’ ও ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ নিয়ে যে কারণে বিএনপিতে সন্দেহ
  • নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে ধোঁয়াশা কাটুক
  • রাজনৈতিক মেরুকরণ পরিষ্কার হচ্ছে
  • জাতীয় ঐকমত্য কমিশন: সংস্কার নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে শিগগির আলোচনা
  • রোহিতের দলে থাকাই উচিত না, একমত তৃণমূল ও কংগ্রেস