অপারেশন ডেভিল হান্ট: সরকার নিজের কথা শুনুক
Published: 6th, March 2025 GMT
নব্বই দশকের শেষ দিকের ঘটনা। আমি তখন একটি বাম ছাত্র সংগঠনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক। তখন সক্রিয় প্রায় সব ছাত্র সংগঠনের প্রচারের অন্যতম উপায় ছিল দেয়াল লিখন। আমরাও এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলাম না।
দেয়াল লিখনকে বলা হতো ‘চিকামারা’। শব্দবন্ধটির উদ্ভব ষাটের দশকের আইয়ুববিরোধী আন্দোলনকালে। তৎকালীন ছাত্রনেতাদের কাছে শুনেছি, কাজটি গভীর রাতে হতো বলে পুলিশের ঝামেলা এড়াতে শব্দবন্ধটি ব্যবহৃত হতো। কিন্তু আমাদের চিকামারার একটা টিম এক দিন ওই ঝামেলা এড়াতে ব্যর্থ হয়।
দেশে নির্বাচিত সরকার ছিল; দেয়াল লিখন নিয়ে কারও তেমন আপত্তি ছিল না। তবুও এক গভীর রাতে কাঁটাবন এলাকায় চিকামারার সময় রমনা থানার টহল পুলিশ আমাদের টিমকে তুলে নিয়ে যায়। পুলিশ ভ্যানটি আমাদের টিমকে নিয়ে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ভোরবেলায় রমনা থানায় যায়। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা রমনা থানার অধীনে ছিল। থানার ফোন থেকেই ওই টিমের একজন সংগঠনের অফিসে ফোন করে বিষয়টি জানান। আমি রাতে সংগঠনের অফিসেই ছিলাম; আরেকজন সহকর্মীসহ রমনা থানায় ছুটে যাই। কর্তব্যরত কর্মকর্তা জানান, উদ্বেগের কিছু নেই। নিয়ম অনুযায়ী, প্রতি রাতে তাদেরকে একটা নির্দিষ্টসংখ্যক আটক বা গ্রেপ্তার দেখাতে হয়। সেই রাতে অন্যভাবে কোটা পূরণ না হওয়ায় টহল পুলিশ আমাদের টিমকে তুলে নেয়। সবাইকে ছেড়ে দেন তিনি।
আটকের কারণটি শোনার পর আমাদের মধ্যে হাস্যরস তৈরি হলেও, মানবাধিকার প্রশ্নে এটা গুরুতর ঘটনা। ঘটনাটি মনে পড়ল গত ৮ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া অপারেশন ডেভিল হান্ট দেখে। ৪ মার্চ প্রকাশিত সমকাল লিখেছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ‘ডেভিল হান্ট’ অভিযানে গ্রেপ্তার হয়েছেন ১২ হাজার ৫০০ জন। প্রশ্ন উঠেছে, এর মধ্যে কতজন প্রকৃত অর্থে অপরাধে যুক্ত? অন্তত সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে এ সংক্রান্ত ভিডিও ও ছবি দেখে নিশ্চিত হওয়া যায়, সিংহভাগই খেটে খাওয়া মানুষ। আমার সন্দেহ, পুলিশ ওই প্রতিদিনের নির্ধারিত কোটা পূরণে এই সিটিং ডাক বা সহজ শিকারদের তুলে আনছে না তো? গ্রেপ্তারদের চেহারা দেখেই বোঝা যায়, এরা হয় ভাসমান শ্রমিক কিংবা ফেরিওয়ালা; ফুটপাতে বসে বা রাস্তায় ঘুরে ঘুরে নানা জিনিস বিক্রি করে পেট চালায়। এ শ্রেণির মানুষের মানবাধিকার যতটা কাগজে আছে, ততটা বাস্তবে নেই। এলিট মানবাধিকারকর্মীদের কাছেও এর আবেদন নেই বললেই চলে। যে কোনো উছিলায় তাদেরকেই তুলে নেওয়া যায়।
বিগত সরকারের আমলেও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের কথা বলে মাঝে মাঝেই এ ধরনের অভিযান দেখা যেত, যা প্রধানত চালাত পুলিশ। সেই সময় গণগ্রেপ্তারের সঙ্গে পুলিশের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার বাণিজ্যের অভিযোগ উঠত। বলা হতে পারে, এখন চলছে যৌথ অভিযান, যেখানে পুলিশের সঙ্গে সেনাবাহিনী, র্যাব, বিজিবি, আনসার ও কোস্টগার্ড সদস্যরাও আছেন। তাই এখানে আগের মতো অন্তত গ্রেপ্তার বাণিজ্যের সুযোগ নেই। কিন্তু এতে কি গ্রেপ্তার কোটা পূরণের পুলিশি ঐতিহ্যকে অস্বীকার করা যায়?
‘ডেভিল হান্ট’ নামটিই বা কী ইঙ্গিত করে? ডেভিল মানে শয়তান। অর্থাৎ অপরাধ প্রমাণের আগেই গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে শয়তান ডাকা হচ্ছে! মানবাধিকারের কোনো সংজ্ঞাই তা অনুমোদন করে না। এ কারণে অভিযানটির শুরু থেকেই বিভিন্ন মহল বিশেষত নামটি নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছে। এমনকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদরদপ্তর সূত্র উল্লেখ করে ৪ মার্চ সমকাল লিখেছে, খোদ প্রধান উপদেষ্টাও নামটির বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছেন। সম্ভবত সে কারণেই সম্প্রতি এ নামে অভিযান না চালানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
নাম বদলালেও ‘বিশেষ অভিযান’ এখনও চালানো হচ্ছে। মনে আছে নিশ্চয়, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছিলেন, যতদিন ডেভিলের অস্তিত্ব থাকবে ততদিনই এই অপারেশন চলবে। উপরন্তু, যদিও ইদানীং রহস্যময় কোনো কারণে পুলিশ আর গ্রেপ্তার সম্পর্কিত তথ্য জানাচ্ছে না; ৪ মার্চ সমকাল লিখেছে, ডেভিল হান্টসহ চলমান বিশেষ অভিযানের ২১ দিনে সারাদেশে ৩২ হাজার ৩১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এতে স্পষ্ট, ডেভিল হান্ট বা বিশেষ অভিযান– যে নামেই ডাকা হোক, চলমান অভিযানে গণগ্রেপ্তার ভিন্ন কিছু নয়।
যদি সত্যিই ‘ডেভিল’ ধরা পড়ত, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে এর ছাপ থাকার কথা। উপরন্তু, আইনশৃঙ্খলার তোয়াক্কা না করে ‘মব’ চলছেই। মঙ্গলবারও গুলশানের মতো জায়গায় তল্লাশির নামে একটা বাড়িতে জোর করে ঢুকে এক দল তরুণ সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিল। পুলিশ ও সেনাসদস্যরা খবর পেয়ে অকুস্থলে এলেও তরুণরা নিরাপদে সরে যেতে পারল, তার ব্যাখ্যা কী? এ তো চলমান মবের মুল্লুকেরই প্রতিচ্ছবি।
বিগত সরকারের সময় যেসব মানবাধিকারকর্মী সোচ্চার ছিলেন, তারা এখন চুপ কেন? যেহেতু ‘ডেভিল হান্ট’ শুরু হয়েছিল মুখ্যত আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের লক্ষ্য করে এবং গণঅভ্যুত্থানে উৎখাত হওয়া দলটির প্রতি সামান্য সহানুভূতি দেখালেও কাউকে ফ্যাসিবাদের দোসর আখ্যা পেতে হচ্ছে, সম্ভবত সে কারণে কেউই অভিযানটি নিয়ে গলা উঁচু করার সাহস করছেন না।
প্রসঙ্গত, অভিযানের প্রথম কয়েক দিন প্রায় সব সংবাদমাধ্যমই পুলিশের তথ্য উদ্ধৃত করে বলেছিল, গ্রেপ্তারদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের সদস্য বা সমর্থক। উপরন্তু, গত ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবন ভাঙচুরের পর গোটা বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতার বাড়িতে হামলা, আগুন লাগানোর পাশাপাশি ভাঙচুর করা হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ঢাকার কাছে আওয়ামী লীগ নেতা মোজাম্মেল হকের বাড়িতেও হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। তবে সে ঘটনায় প্রথমবারের মতো হামলাকারীরা স্থানীয় মানুষদের প্রতিরোধের মুখোমুখি হলে অনেক ছাত্রনেতা-কর্মী আহতও হয়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষ নেতাদের চাপের মুখে সরকার অপারেশন ডেভিল হান্ট শুরু করে।
আওয়ামী লীগকে সমর্থন করলেই কি একজনকে ‘অপরাধী’ সাব্যস্ত করা যায়? শীর্ষ নেতাসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতা হত্যা ও বিভিন্ন ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত, সন্দেহ নেই। তাদের অনেকেরই মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বিচার চলছে। কিন্তু তাদের অপরাধে তো দলটির সাধারণ কর্মী বা সমর্থকের মানবাধিকার কেড়ে নেওয়া যায় না!
বিবিসি বাংলার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধকরণ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘আমার বরাবরই পজিশন হলো যে, আমরা সবাই এই দেশের নাগরিক। আমাদের এই দেশের ওপরে সমান অধিকার। আমরা সব ভাই ভাই। আমাদেরকে এই দেশেই বাঁচতে হবে। এ দেশকেই বড় করতে হবে। কাজেই যে মত-দল করবে, তার মতো করে সবকিছু করবে। এই দেশ থেকে কারও অধিকার কেড়ে নেওয়ার কোনো উপায় নেই। কিন্তু যে অন্যায় করেছে, যার বিচার হওয়া উচিত, তার বিচার হতে হবে। এটুকুই শুধু (৩ মার্চ ২০২৫)।’
বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টার ওপরে এখানে কেউ নেই। আমার প্রত্যাশা, সংশ্লিষ্ট সবাই রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর এ বক্তব্য মেনে চলবে।
সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: উপদ ষ ট স গঠন র এই দ শ আম দ র আওয় ম অপর ধ সমক ল সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটতেই থাকবে?
সমকালসহ গতকালের সংবাদপত্রে প্রকাশিত দুটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। এক. মাসখানেক আগে ধর্ষণের শিকার এক তরুণী আত্মহত্যা করেছে। তার পিতা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একজন শহীদ। পটুয়াখালীর দুমকীতে পিতার কবর জিয়ারত করে ফেরার পথে সে আক্রান্ত হয়। এতে গ্রেপ্তার হয় অভিযুক্ত দু’জন। এর মধ্যে তারা জামিনও পায়। তারপর ঢাকায় আত্মহত্যা করে তরুণী। পরিবার বলছে, আসামিরা জামিন পেয়ে যাওয়ায় মর্মাহত হয়ে সে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। দুই. টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীতে একটি পাঠাগারের বইপত্র লুট করে ইউএনওর কাছে জমা দিয়েছে ‘তৌহিদি জনতা’। পাঠাগারে ধর্মবিরোধী বই রাখার অভিযোগে ওই ঘটনা তারা ঘটায়। মামলা হয়েছে। এদিকে ইউএনও বলেছেন, দু’পক্ষের সঙ্গে বসে বিষয়টির নিষ্পত্তি করা হবে।
প্রথম ঘটনাকে সামাজিক অপরাধ বলে বিবেচনা করাই সংগত। অনেকে হয়তো বলবেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদের কন্যা ধর্ষিত হওয়ার ঘটনায় রাজনৈতিক উপাদান আছে। তেমনটি হলে মনে হয় না বর্তমান শাসনামলে আসামিরা সহজে জামিন পেত। তবে এ ধরনের মামলায় জামিন লাভ কতখানি গ্রহণযোগ্য– সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তারা ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছিল বলেই জানা যায়। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর যেসব ক্ষেত্রে তেমন পরিবর্তন আসেনি, তার মধ্যে রয়েছে বিচার বিভাগ। তদন্তকারী পুলিশের বিষয়েও অভিযোগ কমেনি। যা হোক, আসামি জামিন পাওয়ায় বিপর্যস্ত হয়ে ধর্ষিতার আত্মহত্যার ঘটনা মানুষকে ব্যথিত করবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদের কন্যাও ন্যায়বিচার না পাওয়ার ঘটনাটি হবে বিশেষভাবে আলোচিত।
দ্বিতীয় ঘটনা ‘মব ট্রায়াল’ বলেই বিবেচিত হবে। হালে এগুলোকে ‘মব ভায়োলেন্স’ বলা হচ্ছে। এসব অনেক বেশি ঘটছে গণঅভ্যুত্থানের পর। এর শিকার কেবল ক্ষমতাচ্যুতরা নয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও আক্রান্ত। জনপ্রশাসনও বাদ যায়নি। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ওপরেও কিছু হামলা হয়েছে। একই ধর্মাবলম্বীর মধ্যে ভিন্নধারার প্রতিষ্ঠানও হয়েছে আক্রান্ত। এতে অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবমূর্তির সংকট কম উপস্থিত হয়নি। তা সত্ত্বেও সরকারকে কড়া ব্যবস্থা নিতে দেখা গেছে কমই। এর ধারাবাহিকতায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িসহ অনেক স্থাপনায় এক দল লোক বুলডোজার চালানোর মতো কাজও করেছে। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছিল– এসব আর ঘটতে দেওয়া হবে না। কিন্তু মব ভায়োলেন্স যে বন্ধ হয়নি– ধনবাড়ীর ঘটনাই তার প্রমাণ। ওই পাঠাগার থেকে রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের বইও বস্তায় ভরে নেওয়া হয়েছে বলে খবরে প্রকাশ। সালিশে এমন ঘটনার কী নিষ্পত্তি করা যাবে, কে জানে! কিছু লোকের একটা কিছু মনে হবে আর তারা দলবদ্ধ হয়ে যা খুশি করবে– এই বাংলাদেশ তো কেউ চায়নি। মব দ্বারা শতাধিক মাজার আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় বোঝা যায়, এদের হাতে স্বধর্মের ভিন্নধারাও নিরাপদ নয়। বিচারের দাবি উঠলেও এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি নেই। তৌহিদি জনতার নামে পাঠাগারে নৈরাজ্য চালানোর বিচারও কি হবে না? বিচার না হলে এমন ঘটনা আরও বড় পরিসরে ঘটার শঙ্কা অমূলক নয়। যেসব বইপত্র তারা বস্তায় ভরে নিয়ে গেছে, সেগুলো দেশের অন্যান্য পাঠাগার আর বইয়ের দোকানেও আছে নিশ্চয়।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর সমকালে দীর্ঘ প্রতিবেদন ও বিশেষজ্ঞ মন্তব্য ছাপা হয়েছে গত শনিবার। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে হওয়া মামলার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়– খুন, অপহরণ, ডাকাতি, ছিনতাইসহ ছয় ধরনের অপরাধ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে। এর মধ্যে নারী-শিশু নির্যাতন আছে বৈ কি। আছে আসামি ছিনতাই, থানায় হামলার ঘটনা। খোদ শাহবাগ থানায় এক নারী উত্ত্যক্তকারীকে ছাড়িয়ে নিতে এক দল লোক কী করেছিল, তা সবার জানা। ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ চলাকালেও এসব ঘটে চলেছে। এ পরিস্থিতিতে এক দিন মধ্যরাতে সংবাদ সম্মেলন করতে দেখা গেল স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কিছুদিন পরই মহলবিশেষের দাবির মুখে এ পদে পরিবর্তন এনে তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হলেও তিনি কতখানি সাফল্য দেখাতে পেরেছেন, তা পৃথকভাবে বলার কিছু নেই। চলমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিই সেটা বলছে।
গেল বছরের প্রথম তিন মাসের সঙ্গে চলতি বছরের সরাসরি তুলনা অবশ্য যুক্তিযুক্ত নয়। এর মধ্যে নজিরবিহীন গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ বাহিনীও ভেঙে পড়ে। এর কারণ সবার জানা। পুলিশকে সক্রিয় করতে এখনও লড়তে হচ্ছে সরকারকে। মাঠে বিশেষ ক্ষমতাসহ থাকতে হচ্ছে সেনাবাহিনীকে। তাদের ওপর আস্থা আছে জনসাধারণের। তবে পুলিশের কাজে তাদের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সেনাবাহিনী অপেক্ষা করছে– কবে পুলিশ পূর্বাবস্থায় ফিরবে। কিন্তু সরকারের ৯ মাস হতে চলার সময়ও পুলিশকে সক্রিয় দেখা যাচ্ছে না। তাদের কাছে এসে অভিযোগ দাখিলে লোকে উৎসাহী হলেও এর নিষ্পত্তির চিত্র উৎসাহব্যঞ্জক নয়। সেনাবাহিনীকেও অভিযুক্তদের থানায় এনে সোপর্দ করতে হচ্ছে। এর পর থানা ও আদালতপাড়ায় যা ঘটছে, তার চিত্র কি উৎসাহব্যঞ্জক?
গণঅভ্যুত্থানের পর কোথায় কোথায় আইনশৃঙ্খলার কতটা অবনতি ঘটেছিল, সে উদাহরণ টেনে অনেকে বাংলাদেশ পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছেন। এটা অযৌক্তিক নয়। অনেকে এমনও বলেন, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে গোটা পুলিশ বাহিনী নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ার ঘটনা বিরল। তবে আট-নয় মাস পরও অন্তর্বর্তী সরকার কেন পরিস্থিতিতে লক্ষণীয় উন্নতি ঘটাতে পারছে না, তার পক্ষে যুক্তি দেওয়া কঠিন। মাঝে রমজানে পণ্যবাজারের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সরকার এক ধরনের সাফল্য কিন্তু দেখিয়েছিল। ঈদের পর সেটা ধরে রাখা গেল না কেন?
সামাজিক অপরাধের পাশাপাশি রাজনৈতিক অপরাধ যেন আরও বেশি করে ঘটছে। গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থের চেষ্টা বাড়তে পারে। এসব দেখা যেত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার হাতবদলের সময়ও। এবার স্বভাবতই তা সীমা ছাড়িয়েছে। সঙ্গে নতুন উপাদান হিসেবে চলছে মব ভায়োলেন্স। মবের ভয়ে মিডিয়াও কাজ যথাযথ করতে পারছে না বলে অনেকের অভিমত। সরকার ঘোষণা দিলেও তা দমনে এখন পর্যন্ত ব্যর্থ। আর রাউজানের মতো কোনো কোনো অঞ্চলে খুনখারাবি মানুষকে রীতিমতো আতঙ্কিত করে তুলছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর হানাহানি চলছে আর্থিক অপরাধের ক্ষেত্র দখলকে কেন্দ্র করেও। দেশ পরিচালনার দায়িত্বে থাকলে যে কোনো সরকারকেই দমাতে হয় এসব অপরাধ। বিশেষ কোনো পক্ষ অতিউৎসাহী হয়ে মব ভায়োলেন্স চালালে সেটাও দমন করতে হবে। নতুন পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলার উন্নয়নে বিশেষ নীতিকৌশল জরুরি হলে সে পদক্ষেপও সরকারকে নিতে হবে। সমধর্মী পট পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষাও নেওয়া যায়। সেগুলো কেবল বর্ণনা করা হলে অনেকেরই মনে হবে, সরকার হয়তো পরিস্থিতির উন্নয়নে অনিচ্ছুক!
এমন ‘ষড়যন্ত্রতত্ত্ব’ও রয়েছে– অন্তর্বর্তী সরকার এসব হতে দিচ্ছে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার অজুহাত তৈরি করতে। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা তো স্পষ্টভাবেই জানিয়েছেন, আগামী বছরের জুনের মধ্যে হবে জাতীয় নির্বাচন। তার অনুকূল পরিবেশ তৈরিতেও আইনশৃঙ্খলার উন্নতি ঘটাতে তৎপর হতে হবে সরকারকে। এদিকে বিনিয়োগ বাড়াতে কম সচেষ্ট নয় সরকার। সে লক্ষ্য অর্জনেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে আনতে হবে। বর্ণাঢ্য বিনিয়োগ সম্মেলন চলাকালেও কিন্তু মব ভায়োলেন্সের শিকার হয়েছিল কয়েকটি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের দেশীয় প্রতিষ্ঠান!
হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলাম লেখক