জুলাই–আগষ্টের ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের সময়ে আন্দোলনকারী ও এর সমর্থকদের ওপর গুরুতর অপরাধ করেছে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। আন্দোলন দমন করে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ সরকারকে টিকিয়ে রাখতে এসব অপরাধ করেন তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের সদস্য, সরকারের কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনী সদস্যরা। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক গুরুতর অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিচারিক প্রক্রিয়ায় সুবিচার নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন।

বুধবার সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় এক আলোচনায় বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট বিক্ষোভ–সংশ্লিষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতনের ওপর জাতিসংঘের মানবাধিকার তথ্য অনুসন্ধান প্রতিবেদন নিয়ে এক আলোচনায় ফলকার টুর্ক এই তাগিদ দেন। তিনি এদিন ওই প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। পরে তা নিয়ে আলোচনা হয়।

ওই আলোচনায় প্যানেল আলোচক স্বেচ্ছাসেবী ও স্থপতি ফারহানা শারমিন (ইনু) এবং গণ–অভ্যুত্থানে শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধর বড় ভাই মীর মাহমুদুর রহমান দীপ্ত ন্যায়বিচার নিশ্চিতের ওপর জোর দেন।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক বলেন, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক উত্তরণের চ্যালেঞ্জটা বেশ কঠিন। তবে সব রাজনৈতিক দল ও সম্প্রদায়সহ সবার প্রত্যয় জোরালো থাকলে জটিল পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বকে বিরাট আশাবাদের গল্প শোনানোর সুযোগ রয়েছে। তাই বাংলাদেশের সামনে যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, তা গ্রহণ করে সেটা কাজে লাগাতে সবার সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা উচিত।

প্রসঙ্গত গত ১২ জানুয়ারি বাংলাদেশে অভ্যুত্থানে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিষয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের প্রতিবেদন জেনেভা থেকে প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় আওয়ামী লীগের সহিংস কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি বিগত সরকার এবং নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো পদ্ধতিগতভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জড়িত ছিল। ক্ষমতায় থাকার জন্য শেখ হাসিনা সরকার ক্রমাগত নৃশংস পদক্ষেপ নিয়ে পদ্ধতিগতভাবে বিক্ষোভ দমনের চেষ্টা করেছিল। বিক্ষোভ চলাকালে প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন নিহত হয়েছেন, যাঁদের বেশির ভাগই গুলিতে নিহত হন।

জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে আলোচনার শুরুতে ফলকার টুর্ক প্রতিবেদন নিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করেন। এরপর বক্তব্য দেন বাংলাদেশের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। পরে আলোচনায় অংশ নেন ফারহানা শারমিন ও মীর মাহমুদুর রহমান (দীপ্ত)। নির্ধারিত আলোচকদের বক্তব্যের পর উপস্থিত ব্যক্তিরা তাঁদের প্রশ্ন করেন। আলোচনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম।

আলোচনায় ফলকার টুর্ক ছাত্র–জনতার আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগ সরকার ও দলটির সদস্যদের নির্যাতন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্য তুলে ধরার পাশাপাশি ৫ আগস্ট–পরবর্তী সময়ে বিগত ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদেরসহ পুলিশ ও সংখ্যালঘুদের ওপর গুরুতর প্রতিশোধমূলক সহিংসতার কথা উল্লেখ করেন।

পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে জবাবদিহি নিশ্চিতের বিষয়টি তুলে ধরেন ফলকার টুর্ক। তিনি বলেন, জবাবদিহি নিশ্চিতে প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। অভ্যন্তরীণ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালসহ (আইসিটি) বাংলাদেশের আদালতে অনেক মামলা করা হয়েছে। তবে এসব মামলায় সুবিচার নিশ্চিত করতে হবে। আর জাতিসংঘ একাধিকবার মৃতু৵দণ্ডের বিধানটি বাংলাদেশ সরকারের কাছে তুলে ধরেছে। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘ চাইছে মৃত্যুদণ্ড প্রথা যেন বাতিল হয়।

জবাবদিহি নিশ্চিতের বাইরেও ক্ষত নিরাময়, সত্য বলা, পুনর্মিলন, জুলাই–আগস্ট স্মরণ ও সংস্কারের মতো বিষয়গুলোতে জোর দেওয়ার জন্য বলেন হাইকমিশনার। এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বাংলাদেশের জন্য অতীতকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার একটি বড় সুযোগ এসেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। ফলকার টুর্ক বলেন, ‘ধর্মীয় বা জাতিগত নিজেদের মধ্যে যে মতানৈক্যই থাকুক না কেন, বাংলাদেশ একটি দেশ, সবারই নাগরিকত্ব বাংলাদেশি, আমার মনে হয়, সংস্কারচেষ্টার মাধ্যমে এখন এ চেষ্টাই চলছে। ফলে আমাদের সবাইকে সংস্কার কার্যক্রমকে সহযোগিতা করতে হবে।’

এ প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থায় মানবাধিকারকে সংযুক্ত করার সুযোগ তৈরি হয়েছে বলেও আশা প্রকাশ করেন ফলকার টুর্ক। তিনি বলেন, ‘এটি সব বাংলাদেশির জন্য একটি বিরল সুযোগ, তাঁরা যে গ্রুপ বা কমিউনিটিরই হোক না কেন। এটাই মানবাধিকার দৃষ্টিকোণে একটি বড় আশা। অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে আলোচনায় তিনিও বলেছিলেন, ট্রানজিশন ও সংস্কার মানবাধিকারকে সামনে রেখে করা হচ্ছে।’
এটা কঠিন কাজ উল্লেখ করে ফলকার টুর্ক বলেন, ‘এটা সহজ নয়। এটাই সঠিক প্রচেষ্টা। এ সংস্কার প্রচেষ্টাকে আমাদের সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে।’

সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় বুধবার বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট বিক্ষোভ–সংশ্লিষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতনের ওপর জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান দলের প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনায় আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ফলক র ট র ক জ ল ই আগস ট র জন য অপর ধ আওয় ম ক ষমত সরক র র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

দখলবাজরাই ভোলাগঞ্জ বন্দর প্রকল্পে বাধা

ধলাই নদীতীরে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জে বছরের পর বছর পাথর ডাম্পিং ও ক্রাশিং করে আসছিলেন ব্যবসায়ীরা। সরকারি জায়গা দখল করে তারা সেখানে গড়ে তোলেন ক্রাশিং মেশিন ও স্থাপনা। হঠাৎ ঘটে ছন্দপতন। ২০১৯ সালে ভোলাগঞ্জ শুল্ক স্টেশনকে দেশের ২৪তম স্থলবন্দর হিসেবে ঘোষণা করার পর উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। অধিগ্রহণ শেষে গত বছর কাজও শুরু করে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ। তবে গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন ভোলাগঞ্জ স্থলবন্দরের নির্মাণ সামগ্রী লুটপাট হয়। ভেঙে ফেলা হয় পাশের পর্যটনের জায়গার সীমানা প্রাচীর। 

সম্প্রতি ভোলাগঞ্জ স্থলবন্দরের কাজ শুরু হলেও পর্যটনের জায়গাটি থেকে গেছে উন্মুক্ত। বারবার বাধাগ্রস্ত হওয়ার পরও কাজ যখন এগিয়ে চলছে, তখন বন্দরের অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধে বিরোধিতা করে মাঠে নামেন ভোলাগঞ্জ চুনাপাথর আমদানিকারক গ্রুপের কয়েক সদস্য। গত ২২ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলনে তারা স্থলবন্দরের অবকাঠামো বন্ধসহ শ্রমিক-ব্যবসায়ীর ক্ষতিপূরণ দাবি করে জানান, বাংলাদেশ অংশে স্থলবন্দর হলেও ভারত অংশে স্থাপনা নেই। একপেশে বন্দর হতে পারে না। লুটপাটের জন্যই আওয়ামী লীগ সরকার ১৭৫ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়।

তথ্য বলছে, স্থলবন্দর ঘোষণার আগে শুল্ক স্টেশন ও পর্যটনের জায়গা উন্মুক্ত থাকা অবস্থায় যারা জায়গা দখল করে ব্যবসা করে আসছিলেন, উচ্ছেদ হওয়ার পর তারাই এখন বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। জায়গা থেকে উচ্ছেদ ও অধিগ্রহণের পর সেসব ব্যবসায়ী ও শ্রমিক-মালিকরা এখন চাচ্ছেন না স্থলবন্দর হোক। তারা শুল্ক স্টেশন হিসেবে দেখতে চাচ্ছেন ভোলাগঞ্জকে। যদিও বন্দর নির্মাণকাজে সরাসরি কোনো বাধা তারা দিচ্ছেন না। এর নেপথ্যে রয়েছেন ভোলাগঞ্জ চুনাপাথর আমদানিকারক গ্রুপ ও উপজেলা বিএনপি সভাপতি মো. শাহাব উদ্দিন। তিনি গত ২৯ জানুয়ারি স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত আবেদন ছাড়াও ২২ ফেব্রুয়ারি সিলেটে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম, কোষাধ্যক্ষ আব্দুস সালাম বাবুলসহ কয়েকজন।  

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ভোলাগঞ্জ স্থলবন্দরের জমিসহ ১১২ একর সরকারি জায়গা সেখানে ছিল। বন্দর নির্মাণের কাজ শুরুর আগে সেই জায়গা বিএনপি নেতা শাহাব উদ্দিনসহ কয়েকজন ব্যবসায়ীর দখলে ছিল। তারা পাথর ব্যবসায়ীর কাছে ভাড়া দিয়ে আসছিলেন। উচ্ছেদের পর সেখানকার ৫২ একর জায়গাজুড়ে স্থলবন্দর নির্মাণে কাজ শুরু হলে তারা সেই আয় থেকে বঞ্চিত হন। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন স্থলবন্দরের নির্মাণসামগ্রী লুটসহ রাস্তার অন্য পাশে পর্যটনের জায়গার সীমানা প্রাচীর ভেঙে ফেলা হয়। অভিযোগ ওঠে, লুটপাট-ভাঙচুরের সঙ্গে আগে সুবিধা পাওয়া পাথর ব্যবসায়ী ও আমদানিকারক নেতাদের হাত ছিল।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভোলাগঞ্জ-১০ নম্বর ঘাটের এক পর্যটন ব্যবসায়ী জানান, সরকার পতনের পর ভোলাগঞ্জ স্থলবন্দরের জায়গা দখল না করতে পারলেও পাশের পর্যটন কেন্দ্রের ৫০-৬০ একর জায়গা দখল করে পাথর ব্যবসা করা হচ্ছে, যাদের দখলে আগেও ওই জায়গা ছিল। তিনি জানান, অতীতে যারা সরকারি জায়গা দখল করে ব্যবসা ও ভাড়া খেয়েছেন, তারাই এখন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন।

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, গত ১৭ ডিসেম্বর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন ভোলাগঞ্জ স্থলবন্দরের উন্নয়ন কার্যক্রম পরিদর্শন করেন। তিনি অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ ও ৫ আগস্ট স্থলবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পসহ নানা স্থাপনার ক্ষতিসাধন ও লুটপাটকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিলেও তা কার্যকর হয়নি। 

অভিযোগ বিষয়ে বিএনপি সভাপতি শাহাব উদ্দিন বলেন, সেখানে আমার ব্যক্তিগত কোনো লাভ নেই। শুল্ক স্টেশন দিয়ে যে কাজ পরিচালনা করা যেত, সেখানে একপেশে স্থলবন্দর করে সরকারের কোটি কোটি টাকার ক্ষতি করা হচ্ছে। আমরা সে বিষয়টি তুলে ধরেছি। জায়গা দখল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শুধু আমার নয়; অনেকে জায়গা সেখানে ছিল। সরকারি জায়গাও ছিল। উচ্ছেদ করে স্থলবন্দর করা হচ্ছে। আমরা বাধা দিচ্ছি না; দাবি করেছি। মানা-না মানা সরকারের বিষয়। 

এ ব্যাপারে ভোলাগঞ্জ স্থলবন্দরের প্রকল্প পরিচালক সারোয়ার আলম বলেন, এখন চুনাপাথর আমদানি হলেও ভবিষ্যতে রপ্তানির পরিকল্পনা রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে কাজ চলছে; নির্মাণকাজ বন্ধের সুযোগ নেই। কাজ শেষ হলে শুধু রাজস্ব বাড়বে না; এলাকার পরিবেশও বদলে যাবে। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ