ইবিতে ‘স্বাধীনতা বিরোধীর’ নামে হল, শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ
Published: 5th, March 2025 GMT
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) শেখ পরিবারের নামে থাকা বিভিন্ন আবাসিক হল ও স্থাপনার নাম পরিবর্তন করে নোটিস জারি করা হয়েছে। সেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের নাম পরিবর্তন করে শাহ আজিজুর রহমান রাখার সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শিক্ষার্থীরা।
এদিকে, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনয়নের ইবি সংসদ শাহ আজিজুর রহমানের নামে হলের নামকরণ করায় এক বিবৃতিতে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। অতিদ্রুত সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে মাওলানা ভাসানীর নামে হলের নামকরণের আহ্বান জানিয়েছে সংগঠনটি।
বুধবার (৫ মার্চ) দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার স্বাক্ষরিত এক নোটিসে নাম পরিবর্তনের এ তথ্য জানানো হয়।
আরো পড়ুন:
বুদ্ধিজীবীর সেকাল-একাল
‘আমরা এই দৃশ্য সহ্য করতে পারছিলাম না!’
নোটিস সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের নামে থাকা স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠানের নাম মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো পত্র অনুযায়ি পরিবর্তন করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা হলের নাম পরিবর্তন করে ‘জুলাই-৩৬, শেখ রাসেল হলের নাম পরিবর্তন করে ‘শহীদ আনাছ হল’, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে নাম পরিবর্তন করে ‘শাহ আজিজুর রহমান হল’ রাখা হয়েছে।
এছাড়া বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা হলের নাম পরিবর্তন করে ‘উম্মুল মু'মিনীন আয়েশা সিদ্দিকা হল’ এবং ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান ভবন নাম পরিবর্তন করে ‘ইবনে সিনা বিজ্ঞান ভবন’ নাম রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এ নোটিস জারি করার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
ইশতিয়াক ফেরদৌস ইমন নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, “ঠিক কি কারণে তার নাম আসলো আমার জানা নেই। আরো অনেক মানুষের নাম আসতে পারতো, যারা মুক্তিযুদ্ধ ও তার পরবর্তীকাল নিয়ে যথেষ্ট ট্রান্সপারেন্ট।”
আরেক শিক্ষার্থী আশহাদুল ইসলাম বলেন, “ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়াতে স্থাপনের পিছনে শাহ আজিজুর রহমানের ভূমিকা ছিলো ব্যাপক।”
শিক্ষার্থী রনি আহমেদ বলেন, “হলের নাম শাহ আজিজুর রহমানের মতো বিতর্কিত মানুষের নামে কেন পরিবর্তন করতে হবে, বুঝলাম না। কাঙাল হরিনাথ আছেন, বাঘা যতিন আছেন, তাদের নামেও তো নামকরণ করা যেত। এর বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ইসলামিক স্কলার প্রয়াত আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যারের নামটিও বিবেচনায় রাখা যেত। কুষ্টিয়া ও বাঙালির ঐতিহ্য বিবেচনায় এই নামগুলোর গুরুত্ব রাখে, তা বলার অবকাশ রাখে না।’
এদিকে, এ নামকরণের প্রতিবাদ জানিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের ইবি সংসদ বিবৃতি দিয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, শাহ আজিজুর রহমান একজন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন। তার মতো একজন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর নামে আবাসিক হলের নামকরণ জাতির জন্য এক কলঙ্কজন সিদ্ধান্ত।
একইসঙ্গে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনা পরিপন্থীও। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের হাতে লুট হয়ে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচারের বৈষম্যহীন দেশ গড়ার শপথই ছিল জুলাই অভ্যুত্থানের স্পিরিট। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী শাহ আজিজুর রহমানের নামে আবাসিক হলের নামকরণের মধ্য দিয়ে ইবি প্রশাসন মুক্তিযুদ্ধ ও জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। অবিলম্বে এই সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে।
প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্তের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে সংগঠনটির নেতৃবৃন্দ বলেন, মুক্তিযুদ্ধ, ভারতীয় আধিপত্যবাদবিরোধী ও এ দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের অগ্র নায়ক মাওলানা ভাসানী। আমরা ইবি প্রশাসনের কাছে রাজাকারের নাম পরিবর্তন ও মাওলানা ভাসানীর নামে আবাসিক হলের নামকরণের আহ্বান জানাচ্ছি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ বলেন, “ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনালগ্নে শাহ আজিজুর রহমান ছিলেন। মানুষ নিন্দা জানাতে পারে। কিন্তু এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় উনার অবদান আছে। কে নিন্দা জানাল, না জানাল সেটা সিন্ডিকেটের বিষয় না। তিনি দেশের তথা বিএনপির রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।”
২০০০ সালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-শিক্ষার্থী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র (টিএসসিসি) নির্মাণ করা হয়। পরে ২০০১ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কুষ্টিয়া জেলার বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব শাহ আজিজুর রহমানের নামে শাহ আজিজুর রহমান মিলনায়তন নামকরণ করা হয়।
পরে ২০১২ সালে মুনতাসীর মামুন ও শাহরিয়ার কবির এ নাম পরিবর্তন চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন। এতে ২০১২ সালের ১৪ মে হাইকোর্ট এ স্থাপনার নাম পরিবর্তনের আদেশ দিলে একই বছর ১৪ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩২তম সিন্ডিকেটে নাম পরিবর্তন করে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান মিলনায়তন রাখা হয়।
ঢাকা/তানিম/মেহেদী
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর স ব ধ নত শ হ আজ জ র রহম ন র ন মকরণ র ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
আপনার লাটসাহেবি জুতা, হাকিমি লাঠি কার পিঠে ভাঙছে...
নব্বই কিংবা শূন্যের দশকে আমরা যাঁরা মফস্সলে বেড়ে উঠেছি, তাঁদের কাছে মজমা খুব পরিচিত বিষয়। স্কুল-কলেজে যাওয়ার পথে কিংবা হাটবাজারে, স্টেশন চত্বরে মজমা বসিয়ে নানা কিছু বিক্রির পথচলতি দৃশ্য মিলেনিয়াম প্রজন্মের স্মৃতির অতিপরিচিত দৃশ্য। হকাররা ক্রেতা আকৃষ্ট করতে বাক্চাতুর্যের পরিচয় দিতেন। ক্রেতা টানতে তাঁদের খুব পরিচিত একটি বাক্য ছিল, ‘যদি না হয়, তাহলে আপনার পায়ের জুতা আর আমার পিঠ...।’
একজন সমাজসেবা কর্মকর্তা যেভাবে একজন রিকশাচালককে জুতা পেটা করেছেন, সেই ভিডিও দেখার পর কয়েক দশক আগের সেই মজমার কথা মনে আসছিল। জুতা প্রসঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের ‘অয়োময়’ নাটকের একটি দৃশ্যের কথা মনে পড়ে গেল।
জমিদার বা মির্জাবাড়ির সামনে দিয়ে যেতে হলে পায়ের স্যান্ডেল খুলে বগলে নিয়ে বাড়ির রাস্তাটা পার হতে হতো। ভুল করলেই নেমে আসত শাস্তি।
ব্যাপারটা হলো, জমিদারেরা জুতা পরবে, চাষাভূষা ছোটলোকেরা কেন জুতা পরবে? ছোটলোকেরা জুতা পরলে মানি লোকের সম্মান আর থাকে কোথায়! জুতা তাই প্রজাশাসনের একটা বড় হাতিয়ার ছিল। এ থেকেই সম্ভবত ‘জুতাপেটা’ শব্দটির প্রচলন। একজন মানুষকে চূড়ান্ত অবমাননা করা হয় জুতা পেটা করে।
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটি গত শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫) দুপুরের। ঘটনাস্থল রাজশাহীর পবা। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, ব্যাটারিচালিত একটি রিকশায় চড়ে ওই সমাজসেবা কর্মকর্তা একটি বাসার সামনে নামছেন। এরপর রিকশাচালককে ভাড়া দিয়ে সামনে এগোতে থাকেন। একপর্যায়ে পেছনে ঘুরে পায়ের জুতা খুলে রিকশাচালককে পেটাতে থাকেন।
প্রথম আলোর খবর থেকে ঘটনার বিস্তারিত জানা যাচ্ছে, ভিডিওতে দেখা যায়, একটি রিকশায় চড়ে সমাজসেবা কর্মকর্তা তাঁর বাসার সামনে নামেন এবং ৩০ টাকা ভাড়া দেন। তখন ওই রিকশাচালক তাঁকে বলেন, ‘বলে উঠবেনু’ (ভাড়া ঠিক করে)। এ সময় সমাজসেবা কর্মকর্তা বলেন, ‘বলে উঠবোনি, কিন্তু ভাড়া ৩০ টাকার বেশি কেউ চায় না।’ এ সময় রিকশাচালক কিছু একটা বলেন। তখন পেছনে ঘুরে এসে জাহিদ হাসান বলেন, ‘...আরেকবার বলতেছ কেন? আরেকবার বল।’ এরপরই তিনি পায়ের জুতা খুলে রিকশাচালকের মাথায় ও গালে মারতে থাকেন। হতবিহ্বল রিকশাচালক রিকশার ওপরেই বসে থাকেন।
সমাজসেবা কর্মকর্তা এ সময় জুতা পরে নিয়ে পাশেই রাখা তাঁর প্রাইভেট কারের দিকে যান। গাড়ির পেছন থেকে লাঠি বের করে রিকশাচালককে মারতে থাকেন। কয়েকটি আঘাত রিকশায় লাগে। এ সময় তিনি বলতে থাকেন, ‘আগা, আগা (চলে যা)।’ তখন রিকশাচালক রিকশা নিয়ে দ্রুত চলে যান।
ভ্যানচালক নিজেই যেখানে খেতে পান না, সেখানে কুকুর পোষার বিলাসিতা তাঁর কোথায়? নিজের উপার্জন থেকে কিছু বাঁচিয়ে তিনি পথকুকুরগুলোকে খাবার দিতেন। জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর হাকিমি মেজাজ দেখিয়েছেন ভ্যানচালকের পশ্চাৎদেশে লাঠিপেটা করে।ওই ঘটনা নিয়ে সমাজসেবা কর্মকর্তার ভাষ্য হচ্ছে, নির্ধারিত ভাড়ার বাইরে রিকশাচালক তাঁর কাছ থেকে লুঙ্গি কেনার জন্য ১০০ টাকা চেয়েছিলেন। সেটা না দেওয়ায় রিকশাচালক তাঁকে ‘লাটসাহেব’ বলে গালি দিয়েছেন। অবশ্য তিনি যে জুতা পেটা করেছেন, সেটা যে অত্যন্ত অন্যায় কাজ, সেটা তিনি স্বীকার করেছেন।
ভাবছিলাম, লাটসাহেব কবে ‘গালি’ হয়ে গেল যে, সেটা বলার কারণে একজন সমাজসেবা কর্মকর্তা রিকশাচালককে জুতা পেটা করতে পারেন? ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশ শাসকদের (বড় লাট, ছোট লাট) লাটসাহেব বলে ডাকতেন সাধারণ মানুষ। আর এদেশীয়দের মধ্যে যাঁরা মেজাজমর্জি, চালচলনে ব্রিটিশ প্রভুদের অনুকরণ করতেন, ব্যঙ্গার্থে তাঁদেরও লাটসাহেব বলে ডাকা হতো। সমাজসেবা কর্মকর্তাকে লাটসাহেব বলায় জুতা পেটা করে তিনি ঠিকই তাঁর লাটসাহেবি মেজাজ দেখিয়েছেন।
লাটসাহেব আমাদের কাছে পরিচিত সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘পণ্ডিতমশাই’ গল্পের মাধ্যমেও। পণ্ডিতমশাইয়ের আটজনের পরিবার ও লাটসাহেবের তিনঠেঙে কুকুরের গল্প পড়েছিলাম স্কুলের পাঠ্যবইয়ে। দরিদ্র স্কুলশিক্ষক পণ্ডিতমশাই বেতন পেতেন ২৫ টাকা। আর লাটসাহেবের তিনঠেঙে কুকুরের জন্য ব্যয় হতো মাসে ৭৫ টাকা। তাহলে আট সদস্যের দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবার লাটসাহেবের কুকুরের কয় ঠ্যাঙের সমান, প্রশ্নটি রেখেছিলেন হতভাগ্য পণ্ডিতমশাই।
রিকশাচালককে জুতা পেটা করার পর তার রিকশায় লাঠি দিয়েও আঘাত করা হয়।